সম্পর্কের টান । পর্ব-৬১+৬২


সম্পর্কের টান

 পর্ব-৬১+৬২

বেডে ঐতিহ্যর পায়ের দিকটায় চুপচাপ বসে রয়েছে মাহসান। শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে মেঝের দিকে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আজ তার সামনে এসে ধরা দিয়েছে। অথচ মুখ তুলে তাকানোর মত সাহাস পাচ্ছে না মাহসান। একটাবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে তৃষ্ণার মাতৃত্বর রূপ। দেখতে ইচ্ছে করছে তার ছেলে, তার কলিজার টুকরো তনয়কে। নিজের বুকের হাহাকার মেটাতে বুকের মাঝটায় আঁকড়ে নিতে ইচ্ছে করছে তনয়কে। তবে আপাতত এসবের মাঝে একটি কাজ করবার মত সাহস হচ্ছে না তার। তৃষ্ণার বলা কথাগুলো একনাগাড়ে কানে বেঁজে যাচ্ছে তার। 'প্রথমে তনয়কে মারবো, তারপর নিজে মরবো।'

ঐতিহ্যর মেয়েকে কোলে নিয়ে খানিকটা সময় আদর করবার পর, তাকে আবারো মায়ের পাশে বেডে শুয়িয়ে দিল অর্থি। এগুলো তৃষ্ণার কোলে থাকা তনয়ের দিকে। তনয়ের দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিতেই সে ঝেপে পড়লো ফুপুর কোলে। ঠোঁটে সেই ভুবন ভুলানো হাসি।
-"কি খবর আপনার?"
অর্থির হাতের স্পর্শে চিন্তার বেড়াজাল ছিড়ে বাস্তব জগতে ফিরে এল মাহসান। মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললো,
-"ভালো। তোর কি খবর? তৌহিদকে একা ফেলে না আসলেও পারতি।"
-"বিকেলেই চলে যাবো। তাছাড়া বাবা আর মা তো আছেই।"
-"অহ।"
-"এভাবে মুখ নিচু করে রেখেছো কেনো? এদিকে তাকাও।"
অর্থির কথা শুনেও না শোনার ভান করে আগের মতই চুপচাপ বসে রইলো মাহসান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর অর্থি নিজেই মাহসানের মুখ ফেরালো নিজের দিকে। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-"তনয়, দেখ তোর বাবা। হাই দে বাবাকে একটা। ভাইয়া, দেখো.. কিভাবে হাই দেবে তোমাকে। এত ট্যাটন হয়েছে তোমার ছেলে!"
একনজর তনয়ের দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল মাহসান। অজানা এক কষ্ট এসে ঘিরে ধরেছে তাকে। বুকের মাঝটায় চলছে ঘূর্ণিঝড়। পুরো পাগল পাগল লাগছে তার নিজেকে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সুযোগ পেয়েও মন ভরে দেখবে না সে তার ছেলেকে? ছেলেকে বুকে নিয়ে তার মনের মাঝে চলা ঝড় কে দমাতে পারবে না? প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানতে সে অসহায় চোখে তাকালো তৃষ্ণার দিকে। তবে তৃষ্ণার কোনোরকম ভাবান্তর না দেখতে পেয়ে নিজের মন কে শক্ত করলো মাহসান। যা হবার হবে.. তবে এখন আর এই সুযোগকে হাত ছাড়া করবে না সে। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে সে তাকালো তার কলিজার টুকরো, তার ছেলে তনয়ের দিকে। দুই হাত বাড়িয়ে দিতেই তনয় ঝাপিয়ে পড়লো মাহসানের দিকে।

বুকের মাঝে তনয়কে চেপে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর তনয়ের পুরো মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিল মাহসান। তার চোখের কোনায় জমে রয়েছে নোনা পানি... যে কোনো মুহূর্তেই তা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। তনয়ও কম যাচ্ছে না। অচেনা লোকের কোলে কখনোই সহজে যেতে চায় না সে। অথচ আজ কত সহজেই মাহসানের বুকে গিয়ে তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে বাবার শার্ট। অন্যকেউ গালে চুমু দিতে গেলেই যেখানে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়ে, সেখানে আজ মুখের ফাঁক দিয়েও একটি শব্দ করছে না সে। ঠোঁটে তার ভুবনজয়ী হাসি ফুটিয়ে বাবার আদর উপভোগ করে যাচ্ছে সে। মাঝেমাঝে পিচ্চি হাতের আংগুল গুলো দিয়ে মাহসানের ঠোঁট, নাক, চোখ, চুল সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এমনকি মাহসান যখন তাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল শক্ত করে তখনো চুপচাপ বাবার বুকে মাথা রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে রেখেছিল তনয়। যেনো সবচেয়ে ভরসার জায়গায় আজ নিজের মাথা গুঁজে শান্তির ছোঁয়া পেয়েছে সে। এটাই কি সম্পর্কের টান? জন্মর পর থেকে যাকে একটিবারো দেখে নি, অচেনা একজনই বলতে গেলে মাহসান তনয়ের কাছে.. হঠাৎ সেই মানুষটির সঙ্গ পেয়ে তাকে এতটা আপন করে নিয়েছে তনয়। গভীর ভাবে অনুভব করছে সে এই অচেনা আজানা মানুষটিকে...
বাবা ছেলের এই মধুর মিলনের দৃশ্য কেবিনে থাকা সকলের চোখেই পানি এনে দিল। সবাই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো বাবা ছেলের কার্যক্রম গুলো।

মাহসান, তৃষ্ণা এবং তনয়কে কিছুটা সময় দিতে কেবিন ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এল নিহাল এবং অর্থি। করিডোরে দাঁড়িয়ে অর্থি বললো,
-"আপুকে রাত কয়টার দিকে হসপিটালে এনেছেন?"
-"২ টোর দিকে।"
-"আর আমাদের খবর দিয়েছিলেন সকালে! এত দেরিতে দিলেন কেনো!"
-"এত রাতে কল করে বিরক্ত করতে চাই নি।"
অর্থি ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"আপনি এমন পরপর বিহাব করেন কেনো!"
অর্থির কথায় হেসে ফেললো নিহাল। বললো,
-"এখন তাহলে একটু আপন আপন ব্যবহার করি.. কেমন?"
-"অবশ্যই। আমি আমার একমাত্র শালিকা। আপনি আমার একমাত্র দুলাভাই। এতে পরপর ভাবার কোনো জায়গা নেই।"
-"হ্যাঁ,, সেটাই। আচ্ছা শোনো.. আমার আম্মা বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে আজ দশ দিনের মত হলো। এই অবস্থায় আম্মাকে ফেলে আমার বোনও এখানে আসতে পারছে না। তবে এখানে মানে ঐতিহ্যর পাশে আপাতত একজন মেয়ের খুবই দরকার। বেশি ভালো হয় বয়স্ক জানাশোনা কেউ থাকলে। বাসায় একটা পিচ্চি আছে, তবে ওকে দিয়ে হবে না। ঐতিহ্যর দেখাশোনা আমি করতে পারলেও, আমার মেয়েরটা আপাতত আমি পারবো না। তুমি কি বুঝতে পারছো?"
ঘাড় নাড়িয়ে অর্থি বললো,
-"হ্যাঁ,, দরকার। কিন্তু আমি তৌহিদকে ফেলে রেখে কি করে আসবো! আজ কিছু সময়ের জন্য এসেছি.. তাতেই আমার মন মানছে না। ইশ! যখন বিপদ আসে সব দিক থেকে আসে।"
-"না.. না। তোমার থাকতে হবে না। তৌহিদ ভাইয়ের যা অবস্থা তাতে, তাকে ওভাবে ফেলে রেখে আসার কোনো প্রশ্নই উঠে না।"
চিন্তিত গলায় অর্থি বললো,
-"তাহলে?"
-"তৃষ্ণা ভাবিকে রাখতে চাইছি। উনাকে বললে কি উনি থাকবেন? তনয়কে নিয়ে ঝামেলা হবে না। বাসায় আমি আছি, কলি আছে। আমরা দেখে রাখতে পারবো। আর বেশি দিনও না.. বরিশালে আমার খালা থাকে। উনি আসলেই ভাবি না হয় চলে যাবে। ততদিন কি একটু কষ্ট করে থাকতে পারবে?"
অর্থি খানিকটা সময় ভেবে বললো,
-"না পারার কি আছে? বিপদে পড়েছেন বলেই তো সাহায্য চাইছেন। ভাবি থাকবে.. সমস্যা নেই। আমি ভাবির সাথে কথা বলবো।"
অর্থির কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নিহাল। বিষয় টি প্রচন্ড ভাবাচ্ছিল তাকে। যাক! অবশেষে তো একটা গতি হলো!

      (চলবে)

সম্পর্কের টান

 #পর্ব-৬২

বাবা ছেলের মধুর মুহূর্ত খানিকটা সময় নিয়ে উপভোগ করলো তৃষ্ণা। আজ এই প্রথম তার মনে হচ্ছে, সে তনয়ের সাথে অন্যায় করছে। অতীত ভুলতে দিনে দিনে সে এতটাই স্বার্থপর হয়ে পড়েছিল যে.. নিজের ছেলের দিকটাও একবার ভেবে দেখে নি, একবার তনয়ের দিকে তাকানোর কথা মনে পরে নি তার। কখনো ভাবে নি, পিচ্চি এই নিষ্পাপ বাচ্চাটির দোষ কোথায়? মা হয়ে কেন সে বাবার আদর থেকে এতদিন বঞ্চিত করে রেখেছিল তনয়কে? অতীত ভুলতে গিয়ে কি এটাই সে ভুলে যাচ্ছিল না... সে একজন মা? দুই হাত চোখে চেপে চোখজোড়া মুছল তৃষ্ণা। পা বাড়ালো তাদের আনা খাবারের দিকে। ব্যাগ থেকে একেএকে খাবারের বাটি গুলো বের করতে করতে মাহসানের উদ্দেশ্যে বললো,
-"এত জোরে চেপে ধরছো কেন? ব্যথা পাবে তনয়।"
ছেলেকে বুকে পেয়ে আশেপাশের সব কিছু ভুলতে বসেছিল মাহসান। হঠাৎ তৃষ্ণার কথায় সম্বিত ফিরে এল তার। ঠোঁটে বিশ্বজয়ী হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"পাবে না। তৃষ্ণা?"
-"হু।"
-"আমি তনয়কে কোলে নিয়েছি বলে কি তুমি রাগ করেছো?"
মাহসানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"সকালে কিছু খেয়েছিলে তোমরা?"
-"হ্যাঁ। হালকা নাস্তা করে নিয়ে ছিলাম।"
-"অহ.. নিহাল ভাই কে ডেকে আনো। দুপুরের খাবারটা খেয়ে নাও।"
-"কোথায় ও? আর অর্থি কোথায়?"
-"জানি না। বাইরেই কোথায় আছে হয়তো। খুঁজে আনো। আবার বাড়িতে ফিরতে হবে। বেলা থাকতেই বের হবো।"
তৃষ্ণার কথায় মাহসানের হাসিমাখা মুখে নেমে এল কষ্টের কালো ছায়া। তনয়কে কোলে নিয়েই সে পা বাড়ালো কেবিনের বাইরে। আর কিছু সময় পরই আবারো তার বুক থেকে হারিয়ে যাবে তার ছেলে। ভাবতেই এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছেয়ে যাচ্ছে তার বুক।

অর্থির মুখ থেকে সব শুনে খানিকটা সময় নিয়ে ভাবলো তৃষ্ণা। তারপর কেবিনে থাকা সবার উদ্দেশ্যে বললো,
-"অবশ্যই থাকবো। আমার বিপদের সময় ঐতিহ্য এবং নিহাল ভাই যা করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাদের অবদান সত্যিই কখনো ভোলার নয়। আর আজ তাদের বিপদে যদি আমি কাজে আসি তাহলে সেটা হবে আমার ভাগ্য।"
নিহাল স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
-"ধন্যবাদ ভাবি। অনেক বড় একটা উপকার করলেন। খুব টেনশনে ছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। তাহলে আমি এক কাজ করি.. অর্থিকে গিয়ে রেখে আসার সাথেসাথে আপনার জামাকাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসি। আপনি অর্থিকে বলে দিলেই ও গুছিয়ে দিতে পারবে না?"
-"হ্যাঁ... সমস্যা নেই। অর্থি পারবে। আপনারা বরং তাহলে আলো থাকতেই বেরিয়ে পড়ুন। আবার ব্যাক করতে হবে তো!"

প্রতিদিন নিয়ম করে দুই বেলা তৃষ্ণার নাম্বারে কল দেয় মুহিব। সন্ধ্যার পর ফ্রি হয়ে আজও তৃষ্ণার নাম্বারে ডায়েল করলো সে। প্রথম সিম থাকে কল না ঢুকলেও দ্বিতীয় সিম থেকে তৃষ্ণার নাম্বারে ডায়েল করতেই রিং বেজে উঠলো ওপাশ থেকে।
-"হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম।"
-"তৃষ্ণা? তোমার ফোন অফ ছিল কেনো?"
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মুহিবের গলার স্বর শুনতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। তাড়াহুড়ো করে কল কেটে আবারো ফোন সুইচড অফ করে রাখলো তৃষ্ণা।

রাতে তৌহিদকে খাওয়াতে বসে ঐতিহ্যর মেয়েকে নিয়ে কথা বলছিল অর্থি। তৌহিদের মন তেমন একটা ভালো না থাকলেও অর্থিকে সঙ্গ দিতে চুপচাপ অর্থির কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল সে। মাঝেমাঝে হ্যাঁ হু করেও যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তাদের ঘরে আগমন ঘটলো তৌহিদা বেগমের। কঠিন গলায় সে অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"তোমার আক্কেল দেখে আমি মরে যাচ্ছি! তুমি তৃষ্ণাকে ওইখানে একা ছেড়ে আসলে কিভাবে?"
শাশুড়ির কথায় অর্থি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-"একা নেই তো। ওখানে নিহাল ভাই, আপু আছে তো।"
-"থাকুক! তুমি ওকে ফেলে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসলে কিভাবে? আবার এসেও সুন্দর করে তৃষ্ণার কাপড় চোপড় গুছিয়ে ওই ছোকরার হাতে তুলে দিলে।"
-"আপনার মেয়েই দিতে বলেছিল বলে দিয়েছি।"
অর্থির কথা ভ্রু কুঁচকে তৌহিদা বেগম বললেন,
-"আপনার মেয়ে আবার কি? এটা কি ধরনের কথা?"
এ পর্যায়ে তৌহিদ বলে উঠলো,
-"মা, তুমি অযথা চিৎকার করো না তো। তুমি অর্থিকে ভাবি বলে ডাকতে নিষেধ করেছো। অর্থি তোমার নিষেধ পালন করে যাচ্ছে। এখান ওর যা ইচ্ছে ডাকুক। সময় দাও ওকে। ধীরেসুস্থে ঠিক করে নেবে। এটা নিয়ে আর কথা বাড়িয়ো না।"
ছেলের কথায় চুপ হয়ে গেলেন তৌহিদা বেগম। খানিকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর অর্থির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন,
-"তৃষ্ণার নিজেরই যেখানে ছোট বাচ্চা রয়েছে,, সেখানে ও কিভাবে আরেকটা ছোট বাচ্চাকে সামলাবে? আর ওখানে মাহসানও আছে।"
এই একটি কথাই ভাবাচ্ছে তৌহিদকে। নানান জিনিস ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়েও নিজের মন কে শান্ত করতে পারছে না সে। কিন্তু আপাতত তার কিছু করারও নেই। নিহাল এবং ঐতিহ্য কম করেনি তৃষ্ণার জন্য। তাহলে আজ সে কিভাবে তাদের বিপদে বোনকে সেখানে গিয়ে থাকতে নিষেধ করবে? ওদিকে তার মায়ের কথাও থামছে না। সারাদিন শুয়েশুয়ে এসব দেখতে দেখতে একদম বিরক্ত হয়ে গেছে সে এই কদিনেই। বিধাতাই জানে এর শেষ কোথায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৌহিদ তৌহিদা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,
-"তুমি এ ব্যাপার নিয়ে শুধুশুধু অর্থিকে বকছো কেনো? কথায় কথায় অর্থিকে বকা বন্ধ করো তো, মা। এসব দেখতে আর ভালো লাগে না।"
আরো কিছু কথা অর্থিকে শোনানোর ইচ্ছে ছিল তৌহিদা বেগমের। তবে ছেলের বিরক্তের কারণ বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালেন না তিনি। চুপচাপ বেড়িয়ে এলেন ছেলের ঘর ছেড়ে।

রাতে কেবিনে একজন সদস্য থাকবার অনুমতি রয়েছে। তাই সব ভেবে তৃষ্ণাকে কেবিনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাহসান এবং নিহাল বসে রইলো ওয়েটিং রুমে। তৃষ্ণার একার পক্ষে দুটো বাচ্চা সামলানো কঠিন, তার উপর ঐতিহ্যর দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। একা কিভাবে কি করছে তৃষ্ণা কে জানে!! এসবই বসে বসে ভাবছিল মাহসান। তখনি তার ফোনে এল তৃষ্ণার কল।
-"কোথায় তুমি? হসপিটালেই আছো?"
-"হ্যাঁ। কেনো কিছু হয়েছে?"
-"তনয় উঠে পড়ার পর থেকেই একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। নতুন জায়গা তো,, বিরক্ত করছে খুব। ঐতিহ্যরও সমস্যা হচ্ছে বোধহয়। নিয়ে যাবে ওকে একটু?"
-"আমাকে তো ওই দিকটায় এখন এলাও করবে না। তুমি বরং ওকে আমার কাছে দিয়ে যাও। নিচেই আছি আমি।"
-"আচ্ছা... আসছি।"

তনয়ের দিকে মাহসান দুই হাত বাড়াতেই নিমেষেই কান্নাকাটি থেমে গেল তার। ঠোঁটে ফুটলো তার সেই ভুবন ভুলানো হাসি... তৃষ্ণা তনয়কে মাহসানের কাছে দিয়ে বললো,
-"কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলেই ঘুমিয়ে যাবে। আর ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে একটা কল দিও। এসে নিয়ে যাবো।"
মাহসান কিছুটা ইতস্তত করে বললো,
-"চলো.. একটু রাস্তা দিয়ে হেটে আসি।"
মাহসানের কথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো তৃষ্ণা। বললো,
-"কেনো?"
-"এমনিতেই বলছিলাম। আচ্ছা যেতে ইচ্ছে না করলে দরকার নেই।"
-"নিহাল ভাই কোথায়?"
-"এখানেই তো ছিল। কেনো?"
-"এমনিতেই... চলো, হেটে আসি।"

দুজনেই নিশ্চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই আপন মনে হেটে চলছে নির্জন রাস্তা ধরে। মাহসানের কাঁধে মাথা রেখে মুখ দিয়ে নানান রকমের অস্পষ্ট আওয়াজ করে যাচ্ছে তনয়। পাশেই মাহসানের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে হেটে যাচ্ছে তৃষ্ণা। জীবনে এর চেয়ে বেশি কি চাওয়ার ছিল মাহসানের? আজ জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে সে, বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছে। এভাবেই তৃষ্ণাকে পাশে নিয়ে, তনয়কে বুকে নিয়ে সারাজীবন হাটতে পারলে জীবনটা কিন্তু মন্দ হয় না! খানিকটা সময় এভাবে চলার পর নিরবতা ভেঙে মাহসান বললো,
-"এই পথ যদি না শেষ হয়.. তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?"
ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা বললো,
-"কি?"
তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো মাহসান। বললো,
-"কিছু না... তৃষ্ণা?"
-"হু।"
-"ভালোবাসি।"
মাহসানের মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটি শুনেই বুকটা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। নিজেকে কোনোমতে সামলিয়ে বললো,
-"চলো.. এবার ফেরা যাক।"
হসপিটালের দিকে এগুতে এগুতে আবারো মাহসান বললো,
-"একটা সুযোগ কি দেয়া যায় না? একটা বার কি মাফ করা যায় না?"
-"না।"
-"এতটা কঠিন হয়ে সিদ্ধান্ত নিও না, তৃষ্ণা।"
-"সহজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তো জীবনে কিছু করতে পারি নি। শুধু মানুষের কাছে থেকে অবহেলা, কষ্টই পেয়ে গেছি।"
-"আর পাবে না। লাইফটাইম গ্যারান্টি দিচ্ছি। দেবে না শেষ সুযোগ?"
তৃষ্ণা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
-"তনয় ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখি দাও। নিয়েই যাই ওকে।"

তনয়কে নিয়ে তৃষ্ণার হেটে চলার দিকে স্থবির দৃস্টিতে তাকিয়ে রইলো মাহসান। তৃষ্ণার বলা কথা গুলোয় প্রচুর কষ্ট পেলেও কোথাও একটা আশার আলো খুঁজে পাচ্ছে সে...

     (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ