সম্পর্কের টান
পর্ব-৫৯+৬০
তৃষ্ণার কথায় বিস্মিত দৃষ্টিতে মাহসান তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তৃষ্ণার মাথা কি ঠিকঠাক আছে? পাগলের মত এগুলো কিসব প্রলাপ বকছে সে?
-"কি ব্যাপার? উত্তর দিচ্ছো না কেনো? অতৈন্দ্রিলাকে আরেকটিবার সুযোগ দেবে না?"
-"অতৈন্দ্রিলা এখানে আসছে কিভাবে, তৃষ্ণা? আমি তোমার হাজবেন্ড.. আমি ইচ্ছে করেই হোক বা নিজের অজান্তেই হোক, একটা অন্যায় করে ফেলেছি। আর সেটা আমি এখন মানছিও। সব মেনে অনুতপ্ত হয়ে, তোমার কাছে আমি এখন ক্ষমাও চাচ্ছি। আরেকটিবার আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে বলছি। আর এসব কিছুর মাঝে তুমি অতৈন্দ্রিলা কে টেনে আনছো কেনো?"
গলা কিছুটা উঁচু করে তৃষ্ণা বললো,
-"টেনে আনবোই বা না কেনো? আর কি বললে তুমি? তুমি অনুতপ্ত? কোথায় অনুতপ্ত? কোন দিকে দিয়ে অনুতপ্ত?"
-"এভাবে কথা বলছো কেনো? তোমার মতে কি আমি অনুতপ্ত নই? আচ্ছা.. আমি যদি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নাই হই,, তাহলে কেন তোমার কাছে আবারো ফিরে এলাম? তোমাকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনবার জন্য কেন এত কষ্ট করছি?"
-"তামাশা গুলো করছো কারণ অতৈন্দ্রিলা তোমাকে ঠকিয়েছে। তোমার অজান্তেই ও অন্য লোকের সাথে নষ্টামিতে জড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে তুমি তোমার পুরো পরিবার ছাড়লে তার এই ঠকানো টা তুমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলে না। অনেকটা ভেঙে পড়েছিলে, হতাশায় ভুগছিলে, নিজেকে প্রচন্ড একাকী অনুভব করছিলে.. তোমার জীবন কাটছিল নিঃসঙ্গতায়। তোমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে পাশে দাঁড়ানোর মত একজনকে খুব বেশিই প্রয়োজন ছিল তোমার। যে তোমাকে মেন্টালি সাপোর্ট দেবে। ঐতিহ্যর কাছে গিয়েছিলে, কিন্তু পাও নি। অর্থির কাছে গিয়েও কাজ হতো না, ও কখনোই ভাইয়ার উপরে কথা বলে তোমাকে মেন্টালি সাপোর্ট দিতে স্বামী সংসার ফেলে তোমার কাছে আসবে না। তো? এখন শেষমেশ কে বাঁচে? এই তৃষ্ণা... না? তো এসে পড়লে তার কাছে। নাটক শুরু করলে ছেলেকে ভালোবাসার, অনুতপ্তের।"
-"আমি নাটক করতে জানি না, তৃষ্ণা। আমি স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড একজন মানুষ। যা মনে থাকে, তা মুখে স্বীকার করি। আর যার কারণেই আজ আমি পরিবার বিহীন জীবন কাটাচ্ছি। এটা মানো তো?"
-"না,, মানি না। তোমার কোনো কথাই আর আমি মানি না। তুমি অনুতপ্ত নও... তুমি অনুতপ্ত নও। যা করছো তার সবটাই নাটক।"
একপর্যায়ে ব্যাকুল স্বরে মাহসান বলতে লাগলো,
-"বিশ্বাস করো, তৃষ্ণা। তুমি চলে যাবার পর থেকেই আমি প্রত্যেকটি মুহূর্তে তোমাকে মিস করিছি। চাই নি তোমার স্মৃতি মনে করতে। এটাসেটা নিয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি... পারি নি। দিনশেষে সেই তোমাকে আর তনয়কে ভেবেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আবার জেগেও তোমাকে আমার পাশে, আমার বুকে খুঁজেছি।"
-"আচ্ছা!! তাইলে তখনই আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসো নি কেনো? আমি তো তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। সারাদিন ভর আমি শুধু এটাই ভেবেছি.. আর যাই হোক না কেনো তুমি আমাকে আর তনয়কে নিতে আসবে। আমরা নতুন ভাবে আবার সংসার শুরু করবো। এসব নানান জিনিস ভেবে আমি সময় চেয়েছি ভাইয়ার কাছ থেকে। কেউ ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বললেও পাত্তা দেই নি... সময় চেয়েছি। কই? তখন তো আসো নি! এসেছো কখন? তোমার অতৈন্দ্রিলা তোমাকে ঠকানোর পর... তোমার বাবার কসম খেয়ে একটি সত্যি কথা বলো তো তুমি। অতৈন্দ্রিলা তোমাকে না ঠকালে, তুমি কি কখনো আমার কাছে আসতে? আমার পিছুপিছু ঘুরতে? নিজের এই কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে? তোমার এই সো কলড অনুতপ্তর কথা কি কখনো মুখ দিয়ে বেরুতো তোমার? না... কক্ষনোই না।"
চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো মাহসান। অনেক্ষণ যাবৎ আটকে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে লম্বা দম নিল সে। কি করে বুঝাবে সে তৃষ্ণাকে? সে কোনো নাটক করছে না। সে অনুতপ্ত। মনের অন্তঃস্থল থেকে থেকে অনুতপ্ত সে। তাহলে এসব কেন বুঝতে চাইছে না তৃষ্ণা? আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেঝেতে দুই হাটু গেড়ে বসে পড়লো মাহসান। নিজের দুই হাতজোড়া দিয়ে চেপে ধরলো তৃষ্ণার পা। ভারী গলায় বলতে লাগলো,
-"আমি অন্যায় করে ফেলেছি.. খুব বড় অন্যায়। আমাকে ক্ষমা করে দাও। একবার ডিভোর্স টা উইথড্র করে নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো। নিজেকে প্রুভ করবার একটা সুযোগ আমাকে দাও। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে হতাশ করবো না। তোমাকে কখনোই দুঃখ কষ্ট কি জিনিস বুঝতে দেব না। আমাকে ভালো হবার, প্রায়শ্চিত্ত করবার একটা সুযোগ দাও।"
মাহসানের করা কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। তবে মাহসানের বলা কথা গুলোয় সেই বিস্ময় নিমেষেই কেটে গিয়ে রূপ নিল পীড়ায়। কষ্ট হচ্ছে তার। খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে। মাহসানের চোখের কোণায় জমে থাকা পানি মুছে দিয়ে তাকে বুকের মাঝটায় আঁকড়ে নিতে ইচ্ছে করছে। একসময় তো স্বামী বলে মেনে ভালোবেসেছিল তাকে। কিন্তু আদৌ কি মাহসান স্বামী হবার কর্তব্য গুলো পালন করেছে কখনো? আর এখন কি এই স্বামী নামটার কোনো মর্যাদা আছে তার জীবনে? না.. তাহলে সে আবার মাহসানের সাথে নিজের জীবন পেঁচিয়ে একই ভুল করবে কেনো! মাহসান তার সাথে যা করেছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। ভুলতে পারবে না সে ওই দিনগুলো,, যখন নিঃসঙ্গতার কালো ছায়ায় রাতের পর রাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে সে... নিজেকে শক্ত করলো তৃষ্ণা। মনেমনে আওড়াতে লাগলো, 'আবেগে গা ভাসিয়ে দেবার মত কিছু হয় নি, তৃষ্ণা। বি স্ট্রং।' আশেপাশে তাকাতেই একরাশ অস্বস্তি এসে চেপে ধরলো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় তৃষ্ণা বললো,
-"পা ছেড়ে উঠে বসো।"
-"তুমি আগে বলো,, আমাকে একটা সুযোগ দেবে?"
-"পা ছাড়ো বলছি।"
-"প্লিজ, তৃষ্ণা।"
আর কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা। মাহসানের হাতের মাঝ থেকে পা ছাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো সে। কঠিন দৃষ্টি মাহসানের দিকে ছুড়ে বললো,
-"তোমাকে আমি ক্ষমা করবো না। আর না কোনো সুযোগ দেব। আমার সাথে আর কখনোই কোনোভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। যদি তেমন কোনো চেষ্টা করো তাহলে প্রথমে মারবো তোমার বাচ্চাটাকে, তারপর মারবো নিজেকে। কি বললাম.. শুনেছো? প্রথমে মারবো তনয়কে তারপর নিজেও মরবো।"
কথাটি বলেই তৃষ্ণা দ্রুত পদে বেড়িয়ে এল রেস্টুরেন্ট নামক এই জাহান্নাম ছেড়ে।
নিহালকে কল করে জরুরী তলবে বাসায় ফিরতে বলে ঐতিহ্য নিজেও বের হয়ে এল শোবার ঘর ছেড়ে। হাসি মুখে ঢুকলো ড্রইংরুমে। শরমির পাশে বসতে বসতে বললো,
-"আমার একটা কলেই যে চলে আসবে.. এটা মোটেও ভাবি নি!"
ঐতিহ্যর দিকে ফিরে শরমি বললো,
-"অনেকদিন হলো দেখা সাক্ষাৎ নেই। তাই ভাবলাম চলে আসি। কাজের কাজও হবে, দেখা সাক্ষাৎও হবে। তা কেমন আছো?"
-"খারাপ... খুবই খারাপ।"
ভ্রু কুঁচকে শরমি বললো,
-"ওমা! কেনো?"
নিজের পেটের দিকে ইশারা করে বললো,
-"এই অবস্থায় ভালো থাকি কি করে? তার উপর তুমি ইদানীং যা শুরু করেছো!"
-"আমি? আমি কি করলাম?"
-"কি করো নি.. সেটা জিজ্ঞেস করো।"
ঢোক গিলে শরমি বললো,
-"মানে?"
-"নিহালের পিছনে ঘুরঘুর করছো কেনো?"
আকাশ থেকে পড়ার ভান করে শরমি বললো,
-"আরে! কিসব বলছো এগুলো? আমি স্যারের পিছনে ঘুরঘুর করবো কেনো?"
এপর্যায়ে গলার স্বর উঁচু করে ঐতিহ্য বললো,
-"কেনো করছো সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।"
-"আমি এসব কিছু করছি না।"
-"তুমি এসব কিছুই করছো।"
-"না আমি এসব কিছু করছি না।"
-"তুই করছিস।"
-"না।"
-"হ্যাঁ। তুই করছিস.. তুই করছিস।"
-"হ্যাঁ আমি করছি। তো? তাতে তোর কি?"
কথাটি বলেই হকচকিয়ে গেল শরমি। হায়! হায়! এটা কি বলে ফেললো সে?
শরমির প্রত্যেকটি কথা ঐতিহ্যর পুরো শরীরে বিধছে কাঁটার মত। মেয়েটি এতটা নির্লজ্জ কেনো? চুলের ঝুটি টেনে ছিড়তে পারলে শান্ত হতো মন টা। নিজের মনের ইচ্ছাকে দমন করে ঠান্ডা গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"ওকে.. তা কেন পিছে ঘুরঘুর করছিলে নিহালের?"
খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকার পর মেঝের দিকে তাকিয়ে শরমি জবাব দিল,
-"ভালো লাগে তাই।"
-"ভালো লাগলেই তার পিছুপিছু ঘুরতে হবে? তাকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে? তার সাথে প্রেম করতে হবে? আর স্যারের সাথে কিসের প্রেম রে? ভার্সিটি তে যাস কি স্যারদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বানানোর কাজে? নষ্টামির জায়গা পাস না?"
-"মুখ সামলে কথা বলো, ঐতিহ্য। তুমি কি করেছো সেটা কি ভুলে গেছো? তুমি নিজে করলে সেটা প্রেম, ভালোবাসা... আর আমি করলেই নষ্টামি?"
-"আরে বেহায়া মেয়ে! তখন নিহাল আনম্যারিড ছিল। কিন্তু এখন নিহাল ম্যারিড। আমি ওর বউ.. এমনকি কিছুদিন পর ও বাচ্চার বাবাও হয়ে যাবে। কিসের সাথে কি তুলনা করছিস তুই?"
ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে উঠলো কলিংবেল। ঐতিহ্য তার কথা থামিয়ে কলিকে ডেকে দরজা খুলতে বলে অপেক্ষা করতে লাগলো নিহালের। নিহাল তাড়াহুড়ো করে বাসায় ঢুকতেই ঐতিহ্য বলে উঠলো,
-"আরে বর মহাশয়! আপনি এত লেট যে! জলদি আসুন। সেই কখন থেকে আপনার জন্য আমরা দুইজন অপেক্ষা করছি!"
ঐতিহ্যর কথায় যতটা না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি অবাক হলো নিহাল শরমি কে দেখে। সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নিহাল বললো,
-"কি ব্যাপার? শরমি এখানে কিভাবে!"
-"কেনো? শরমি এখানে থাকতে পারে না?"
-"না.. সেভাবে বলি নি।"
-"ফোন কোথায় তোমার? কোনো কাজীর নাম্বার আছে? কল দিয়ে আসতে বলো তো।"
ঐতিহ্যর কথা বিস্ময় নিয়ে নিহাল বললো,
-"কেনো? কাজী দিয়ে কি হবে?"
-"কাজী এসে বিয়ে পড়াবে। তোমার আর শরমির বিয়ে।"
ঐতিহ্যর কথা শোনামাত্র বাঁজ পড়লো পুরো ঘরজুড়ে। নিহাল এবং শরমি দুইজনই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ঐতিহ্যর মুখের দিকে।
-"কি বলছো এসব তুমি? আমি ওকে বিয়ে করতে যাবো কেনো?"
-"যাবে... কারণ তোমার তখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে শরমি কে দেখতে হবে না। একদম বাসায় আনার ব্যবস্থা করছি। সারাদিন তোমার চোখের সামনে থাকবে। যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা দেখতে পারবে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কষ্ট করে দেখতে হবে না।"
-"আমি ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে কখন দেখলাম! তুমি কি পাগল হয়েছো? কি রেখে কি বলছো এসব!"
নিহালের কথার জবাবে উঁচু স্বরে দাপুটে গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"চুপ.. একদম চুপ। তুই ওকে পাত্তা না দিলে ও কিভাবে সাহস পায়? আমাকে কোলের শিশু মনে হয় তোর? আমি কিছু বুঝি না?"
বিরক্ত হয়ে নিহাল বললো,
-"হ্যাঁ,, তুমি বোঝো না। এই শরমি, তুমি যাও এখন।"
সুযোগ খুঁজছিল শরমি বাড়ি থেকে বেরুনোর। তাই নিহালের বলামাত্রই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। দরজার দিকে এগুতেই ঐতিহ্য তার হাত টেনে ধরে বললো,
-"এই, তুই কোথাও যাবি না। বস এখানে চুপচাপ। তোর মাবাবা কে খবর দিব। তারা আসবে, তার মেয়ের কীর্তি কলাপ সম্পর্কে জানবে। তারপর তুই নড়বি। বিবাহিত ছেলেদের উপর প্রেম উৎলে উঠার সাধ আগে মেটাবো তারপর নড়বি তুই।"
ঐতিহ্যর কান্ডকারখানা দেখে পুরো থ খেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শরমি। ক্লাসমেট হবার সুবাদে ঐতিহ্যকে যতটুকু জানে সে, তাতে ঐতিহ্য অনেক শান্তশিষ্ট, ধীরস্থির স্বভাবের একজন মেয়ে। কিন্তু আজ এ বাড়িতে এসে ঐতিহ্যকে নিয়ে পুরো মনোভাব পালটে গেছে তার। পুরো ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি টাইপ অবস্থা হয়ে গেছে। আপাতত এই পাগল মেয়ের হাত থেকে বেঁচে গেলে আর জীবনে নিহালের ছায়াও মারাবে না সে, বলে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
-"ঐতি, ওকে যেতে দাও। আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তেমন কিছুই হয় নি। আমি তো ঠিকঠাক আছি... না? আমি তো তোমারই আছি।"
নিহালের কথায় ঐতিহ্য হাতের বাঁধন হালকা করতেই শরমি তার হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। কোনোদিন না চেয়েই সে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ফ্লার্ট ছেড়ে। অপরদিকে নিহাল ঐতিহ্য কে শান্ত করতে শক্ত করে তাকে চেপে ধরলো বুকে। ধীর গলায় বলতে লাগলো,
-"আমি আমার আগের ঐতিহ্য কে ফিরে পেতে চাই। আরেকটি বার আগের মত হয়ে যাও না, ঐতি! তারপর আর কক্ষনোই তোমার সেই রূপ থেকে তোমাকে পাল্টে যেতে দিব না.. প্রমিজ।"
পুরো পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে মাহসান। কোনোভাবেই কোনো কাজের দ্বারা শান্তি পাচ্ছে না। কি করলে একটু শান্তি পাবে সে? কার কাছে গেলে একটু শান্তি পাবে? আপন বলতে কেউ কি আছে তার? নেই... তার জীবন কি ছিল! আর এখন কি রেখে কি হয়ে গেছে! একটা অন্যায় যে এভাবে মানুষের জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নেয়,, এটা কি জানা ছিল না তার? জানা ছিল না.. জানা থাকলে কখনোই এমন একটি অন্যায় করতো না সে। মাথার যন্ত্রণায় পুরো মাথা ছিড়ে যাচ্ছে তার। দুইদিন আগের তৃষ্ণার বলা কথাগুলো ঘড়ির কাটার মত একনাগাড়ে বেঁজে যাচ্ছে তার মাথায়। 'প্রথমে মারবো তনয়কে, তারপর নিজেও মরবো।' এই পরিস্থিতিতে কি করবে সে? কি করার আছে তার? সিগারেট ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মাহসান। তৈরি হয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। আপন বলতে আপাতত তার মনিরা খালার নামটাই মনে পড়ছে। তার মা শান্তি বেগমের ছোটবেলার খেলার সাথি। বড় হবার পরও যাদের সম্পর্ক ছিল সেই ছোট্টকালের মতই মধুর।
তিন রাত, দুই দিন যাবৎ কথা হচ্ছে না তৃষ্ণার সঙ্গে মুহিবের। সব তো ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল, তৃষ্ণা নিজেও অনেকটা ঝুঁকে পড়েছিল তার দিকে, অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল দুজনের রাত জেগে কথা বলা। তাহলে.. এর মাঝে কি এমন হলো যে তৃষ্ণা আর এখন কথাই বলছে না তার সাথে? নিজের নাম্বার দিয়ে কল ঢুকছিল না বলে অন্য নাম্বার দিয়েও বারবার চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো নাম্বার থেকে কল দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ফোনটাই বন্ধ করে রেখেছে তৃষ্ণা। তৌহিদের নাম্বারে কল করে নানান বাহানায় তৃষ্ণার কথা জানতে চেয়েও কাজ হচ্ছে না। তেমন কোনো খবর জানা যাচ্ছে না তৃষ্ণার ব্যাপারে। এমন করছে কেনো তৃষ্ণা তার সঙ্গে? কি করেছে সে? নিজের অজান্তেই কি কোনো ভুল করে ফেলেছে? নিজের কোনো কথা বা কাজের দ্বারা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে কি সে তৃষ্ণাকে? আর কিছুই ভাবতে পারছে না মুহিব। পুরো মাথা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। তৃষ্ণার এমন হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ করাটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে।
রাত আটটার পর মাহসান গিয়ে উপস্থিত হলো মনিরা বেগমের বাড়িতে। তাকে দেখামাত্রই মনিরা বেগম তার ছোটকালের বান্ধবী শান্তি বেগমের স্মৃতিচারণ করতে শুরু করে দিলেন। খানিকটা সময় নিয়ে সেসব শোনার পর ছাড়া পেল সে। গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগলো নিলয়ের জন্য। মনিরা বেগমের ছোট ছেলে নিলয়। শান্তি বেগম বেঁচে থাকতে মাসে প্রায় একবার হলেও এখানে আসতো মাহসান তার মায়ের সঙ্গে। দুই বান্ধবী মিলে গল্পের আসর খুলে বসতো। ছোট থেকেই এই যাওয়া আসার কারণেই নিলয়ের সাথে খুব ভালো একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মাহসানের। যা বড় হবার পরও তারা টিকিয়ে রেখেছিল। দেখা সাক্ষাৎ খুব একটা বেশি না থাকলেও নিলয় প্রায়ই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিতো তাদের। বন্ধুমহলে বড্ড রসিক শ্রেণীর একজন হিসেবে নিলয়ের পরিচিতি থাকলেও তার রসিকতা শুধু বন্ধুমহলেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি সবার কাছেও এক নামে পরিচিত সে।
মাহসানের মুখ থেকে সব টা শুনে নিলয় হতাশ হয়ে বললো,
-"তুই কি রে? তুই এটা করলি কি করে? এইসব মেয়ে দেখলে আমি দশ হাত দুরে থাকি.. আর তুই নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বাঁশ চেয়ে চেয়ে নিলি। তুই এমন একটা কাজ করেছিস! বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি। তোকে তো আমি সেই ছোট থেকেই দেখে আসছি। তুই জাস্ট...."
-"একটা অন্যায় করে ফেলেছি। আর যা এখন আমি স্বীকার করছি। নিজে সেই অন্যায় শুধরাতেও চাচ্ছি। আমি মানছি আমার অন্যায় টা খুবই বড়.. তাই বলে নিজেকে শুধরানোর একটা চান্স কি পাবো না আমি?"
খানিকটা সময় চিন্তাভাবনা করার পর নিলয় বললো,
-"ভুল, অন্যায় কাজ এগুলো মানুষই করে। আর তুই যেহেতু এখন অনুতপ্ত তাতে একটা বার তোকে নিজেকে প্রমাণ করবার সুযোগ দেয়া উচিৎ। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। আমরা যেহেতু পুরুষ.. সেক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাধারা মিলে যাচ্ছে। আমরা ভাবছি, একটা সুযোগ দিলে কি এমন ক্ষতি হয়! অপরদিকে ভাবি মানে মেয়েজাতি.. তাদের চিন্তার জগৎ আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর বাড়িতে পা দেয়। আল্লাহ কর্তৃক তাদের মনে স্বামীর জন্য একটি আলাদা জায়গা সৃষ্টি হয়। যেখানে থাকে ভালোবাসা, বিশ্বাস, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, মর্যাদা। স্বামী কে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আশা থাকে তাদের মনে। কোন মেয়ে চায় তার স্বামীর ভাগ অন্যকে দিতে... বল?"
নিলয়ের কথায় কোনো জবাব দিল না মাহসান। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে।
-"তোর ভুলের হিসেব নেই। আমার বন্ধু না হয়ে তুই অন্যকেউ হলে কখনোই আমি তোকে সাপোর্ট করতাম না এই কাজ গুলোর জন্য। এখন যা হবার তা তো হয়েই গেছে। যেহেতু ভাবি তোকে কোনোভাবেই তার লাইফে চাচ্ছে না, সেহেতু তোর আপাতত সব ভুলে মুভ অন করা উচিৎ। তুই তো মাশাল্লাহ! চেহারা, বডি, টাকাপয়সা... কোনোভাবেই কোনোদিক থেকে কম না। মুভ অন কর। মেয়ের অভাব হবে না তোর জন্য। তুই যদি বলিস, আমি নিজে তোর জন্য মেয়ে দেখবো। ভদ্র সভ্য, শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেল। এভাবে একাএকা আর কিছুদিন থাকলে তুই পাগল হয়ে যাবি। বুঝতে পারছিস আমার কথা?"
ঘাড় নেড়ে মাহসান জবাব দিল,
-"হু।"
-"তাহলে এই কথাই রইলো। মুভ অন... তৃষ্ণা, তনয় নামের কেউ কখনোই তোর লাইফে আসে নি.."
নিলয়ের কথা শেষ হবার আগেই মাহসান বললো,
-"সম্ভব না। আমি পারবো না। আমার তৃষ্ণাকেই চাই, আমার আমার ছেলে তনয়কেই চাই। ওদের নিয়েই আমি নতুন করে আবার জীবন সাঁজাতে চাই। কিছুদিনের মোহতে জড়িয়ে যে ভুল করে ফেলেছি আমি তা শুধরাতে চাই।"
মাহসানের কথায় বিরক্ত হয়ে নিলয় বললো,
-"এতই যখন তৃষ্ণা তৃষ্ণা করছিস! তখন এত বড় ভুল করলি কেনো? করেছিস তো করেছিস! সব কিছু চেপে রাখতে পারিস নি? নিজের সত্যতা দেখাতে গিয়ে তো বাঁশ টা খেলি! আমাদের সমাজে এমন অনেক লোকই আছে, যারা এসব কাজ প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছে। কই? তারা তো তোর মত সত্যতা দেখাতে যায় না। তারা তো তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে এসব নষ্টামির জীবন এক করে ফেলে না। দুই দিক সামলিয়ে তো তারা দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে, আমাদের সমাজে ঘাড় উঁচিয়ে চলাফেরাও করে যাচ্ছে। অথচ তুই তোর অনেস্টি দেখাতে গিয়ে পরিবার, সমাজে মান মর্যাদা সব হারালি। না রইলো এখন তোর একুল না ওকুল। এখন কাটা এভাবেই তোর তৃষ্ণা তনয় বিহীন নিঃসঙ্গ জীবন।"
(চলবে)
সম্পর্কের_টান
পর্ব-৬০
-"পাগল হয়েছিস? কি রেখে কি বলছিস এসব?"
-"কেনো? ভুল কিছু বলেছি কি? এতই যখন বউ বাচ্চার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস, তখন এত বড় একটা ভুল করলি কিভাবে! আর করলি তো করলো, চেপে যেতে পারলি না?"
নিলয়ের কথায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মাহসান থেমে থেমে বলতে লাগলো,
-"তুই আমাকে জানিস। আমি এতটা খারাপ নই। হ্যাঁ, আমার ভুল ছিল তখন। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি, জড়িয়ে পড়িছি অবৈধ এক সম্পর্কে। আমি সেসময়টায় এমন এক মোহতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, যা থেকে চাইলেও উঠে আসতে পারি নি। একটা ঘোর কাজ করছিল আমার মাঝে। এই ঘোরের কারণে কখনো আমি তৃষ্ণাকে বুঝতে চেষ্টা করি নি, প্রেগন্যান্সিতে হাজবেন্ড হিসেবে কখনো সাপোর্ট দেই নি। আমার মা.. যিনি বাবার শোকে ধীরেধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল, তাকেও পর্যন্ত আমি সময় দেই নি। শুধু ডক্টর দেখিয়েই নিজের কর্তব্য শেষ করে ফেলেছি। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তৃষ্ণা আমার মার দেখাশোনা, তাকে সময় দেয়া, ঔষধপত্র থেকে শুরু করে সবই করেছে। আর আমি তার ছেলে হয়ে এক নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে থেকেছি। মা, বউ, সংসার কোনোদিকেই নজর দেই নি। আমি আমার মার মৃত্যুর রাতেও... বলতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, আমি সে রাতে অতৈন্দ্রিলার সাথে ছিলাম। আমার একটাবার এটা মাথায় আসে নি.. আমার মা, আমার ছোট বোন বাসায় একা। আমি তখন অতৈন্দ্রিলা নামক একটি নেশায় আসক্ত ছিলাম, অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার মাথায় অতৈন্দ্রিলা ছাড়া কিছুই ছিল না। আমার রাত, আমার দিন সবটা মিলে ছিল অতৈন্দ্রিলা। নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম ওকে। হ্যাঁ, আমি পারতাম সব কিছু লুকিয়ে অতৈন্দ্রিলার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে। তবে আমি সেটা করি নি। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। ভেবেছিলাম তৃষ্ণার মত সাধাসিধে মেয়ে আমার জন্য নয়। তাহলে শুধুশুধু আমি ওকে কেন রাখবো আমার লাইফে! আমি.. আমার মাঝে তখন মানুষের ছিটেফোঁটাও ছিল না। যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করেছিলাম, দুর্ব্যবহার করেছিলাম। বিশ্বাস কর, তৃষ্ণা তখনো আমাকে ঘুরে এসবের উত্তর দেয় নি। আমি তখন তৃষ্ণার সাথে এতটাই বাজে কিছু কাজ করেছিলাম, যার ফলস্বরূপ কিন্তু আজ তনয় আমাদের মাঝে না ও থাকতে পারতো। আমার ছেলে হবার পর অর্থি, ঐতিহ্য বারবার আমাকে কল করেছিল। কিন্তু আমি পাত্তা দেই নি। কি বলেছিলাম আমি... জানিস? হয়েছে হয়েছে। তাতে আমার কি? তারপর যখন তৃষ্ণা নিজে কল করলো, আমাকে একটিবার তনয়কে দেখতে যেতে অনুনয় করতে লাগলো.. তখন আমি বললাম, কার না কার সাথে শুয়ে পেট বাধিয়েছো! কতটা অমানুষ হলে, মানুষ এই কথাটি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারে? তুই বল?"
কথাগুলো বলতে বলতে মাহসানের চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনা পানি। এই চোখের পানি কোনোভাবেই মিথ্যে হতে পারে না। একজন ছেলের, স্ট্রং পারসোনালিটির একজন ছেলের সহজে চোখর পানি ঝড়ে না। কয়টা ছেলে পারে নিজের করা ভুল গুলো খেটেখুটে সবার কাছে বলতে? অনুতপ্ত এবং মন থেকেই অনুতপ্ত বলে আজ সে নিজের দোষ গুলো স্বীকার করছে। নিজের করা কৃতকর্মের জন্য চোখের জল ফেলছে। যা কি আদৌ সহজ? মাহসান যে আজ সত্যিই অনুতপ্ত, তৃষ্ণা তনয়ের উপর যে তার মারাত্মক ভাবে সফটকর্নার কাজ করে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই নিলয়ের। সফটকর্নার বললেও হয়তো ভুল হবে,, নিঃসংকোচে এটি ভালোবাসা। শয়তানের প্ররোচনায় পরে যেখানে আমাদের প্রথম নবী হযরত আদম আঃ ভুল করে ফেলেছিল, সেখানে তো আমরা তো কেবল সাধারণ মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে... মাহসানের কাঁধে হাত রেখে নিলয় বললো,
-"আরে ব্যাটা! ছেলেরা কখনো কাঁদে না। ছেলেরা হেসে নিজেরটা নিজেরা আদায় করে নেই। এতক্ষণ যা বলছিলাম, সব তোকে পরীক্ষা করবার জন্য বলছিলাম। তুই এসে বলবি আমি অনুতপ্ত... আর তাতেই সবাই মেনে নেবে? কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে হবে তোকে... তুই আসলেই অনুতপ্ত, প্লাস অতীতের করা ভুল তুই পুনরায় দৌড়াবি না। তবেই না যে বিশ্বাস যে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছিলি তুই, তা ফিরে পাবি। শুধুশুধু তোকে আবারো বিশ্বাস করবে কেনো ভাবি? গ্যারান্টি ছাড়া যেখানে একটি সুতোও নড়ে না,, সেখানে তোকে ভাবি তার মন আবারো দিয়ে দেবে?"
আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল নিলয় মাহসানকে। তবে তা আর হয়ে উঠলো না আঁখির উপস্থিতির কারণে।
-"ভাইয়া, চলুন। খাবার দিয়েছি।"
-"শুধু ভাইয়াকেই খাওয়াবে? আর আমি? কেউ বাড়িতে এলেই তুমি আমাকে ভুলে যাও। দিস ইস নট ফেয়ার, আঁখি।"
নিলয়ের কথায় হেসে উঠলো মাহসান। কত সুন্দর একটা সম্পর্ক নিলয়ের সঙ্গে আঁখির। সারাদিন হাসিঠাট্টা, মান অভিমান, ভালোবাসা লেগেই রয়েছে। তার এবং তৃষ্ণার সম্পর্কটাও কি এরূপ হতে পারতো না? পারতো, সে নিজেই হতে দেয় নি.. ভাবতেই মাহসানের বুকচিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।
-"আমার মনে হচ্ছে, আমার জোরাজুরিতেই তৃষ্ণা মাহসানকে ডিভোর্স দিতে রাজি হয়েছে।"
-"হতে পারে।"
-"তুমি কি একটাবার কথা বলে দেখবে?"
তৌহিদের কথা শোনামাত্রই ভ্রু কুঁচকে ফেললো অর্থি। বললো,
-"না। আমি আর এসবের মাঝে নেই।"
-"তাহলে এখন কি করবো আমি?"
-"তোমার আপাতত কিছুই করতে হবে না। সুস্থ হও, তারপর ভাইয়াকে ডেকে কথা বলো।"
-"এর মাঝেই যদি তৃষ্ণা, মাহসান মিলে কোনো ডিসেশন নিয়ে নেয়?"
-"নিলে নেবে। তুমি এত টেনশন কেনো নিচ্ছো?"
অর্থির এমন ভাবলেশহীন কথায় কিছুটা বিরক্ত হলো তৌহিদ। সে চিন্তা করবে না? তার বোনের জীবন নিয়ে খেলা চলবে, আর সে বসেবসে দেখবে? সে বললো,
-"সব ভাই কি আর তোমার ভাইয়ের মত!"
তৌহিদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অর্থির বুকটা কেঁপে উঠলো। তার ভাই কি ভাই হিসেবে, একজন ব্যক্তি হিসেবে এতটাই খারাপ? একরাশ কষ্ট এসে জমা হলো দুচোখের পাতায়। নিজেকে কোনোমতে সামলিয়ে ভারী গলায় বললো,
-"আমি খাবার নিয়ে আসছি।"
রান্নাঘরে এসে কিছুক্ষণ নিরবে কাঁদলো অর্থি। ভাই যখন ভুল করেছিল তখন তাকে বকেছে, ছোট হয়েও শাষণ করেছে। আর আজ যখন তার ভাই কষ্টে আছে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেই অপরাধ বোধ টা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে তাকে তখন ভাইয়ের হয়ে কিছু বলতে গিয়েও দোষ হয়ে যাচ্ছে তার। কি করবে সে? এসবের মাঝে কি করা উচিৎ তার? ন্যায় অন্যায় কিছুই কি বলতে পারবে না? বোন হিসেবে ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগাটা কি অপরাধ?
-"কি করছো এখানে এভবে দাঁড়িয়ে? রাত কত হয়েছে দেখেছো? তৌহিদকে খেতে দেবে কখন?"
তৌহিদা বেগমের কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্লেটে খাবার বাড়তে লাগলো অর্থি। খাবার বেড়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরুতেই অর্থির সামনে পড়লো তনয়। হামাগুড়ি দিয়ে তার সামনে এসে, তাকে ধরে সোজা দাঁড়িয়ে পড়েছে। যা কোলে উঠার পূর্ব লক্ষণ। এদিকে এমন ভাবে অর্থিকে সাপোর্ট দিয়ে দাঁড়িয়েছে তনয় তাতে সামান্য নড়লেই ছেলেটা সরাসরি পড়বে ফ্লোরে। হাত দুটোও খালি নেই অর্থির। কোনো উপায় না দেখে অর্থি বলতে লাগলো,
-"বাবা, ছাড়ো। দেখো ফুপুর একটি হাতও খালি নেই। এটা রেখে এসেই তোমাকে কোলে নেব, প্রমিজ। ছাড়ো বাবা।"
অর্থির কথায় খিলখিল করে হেসে উঠছে তনয় বোঝা তো দূরস্থান! অবশ্য ও বুঝবেই বা কি করে! বয়স হয়েছে কি বুঝবার? নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো অর্থি। তনয়কে হালকা সরানোর চেষ্টা করতেই প্লেটে থেকে ডাল এসে গড়িয়ে পড়লো তার উপর। গরম ডাল পিঠে লাগার সাথেসাথেই চেচিয়ে উঠলো তনয়। অপরদিকে তনয়ের কাঁদার চিৎকার কানে আসতেই রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল তৌহিদা বেগম। কঠিন দৃষ্টি অর্থির দিকে ছুড়ে বললো,
-"ওর উপর ডাল পড়লো কি করে? চোখ কি আসমানে রেখে হাটা চলাফেরা করো?"
-"আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি। হঠাৎ করেই পড়ে গেছে। এদিকে এসে একটু ওকে ধরুন।"
-"হঠাৎ করে পড়বে কেনো? আমার কাছ থেকে তো পড়ে না। এত দিশেহারা ভাবে হেলেদুলে না চললে চলে না?"
কথোপকথনের এ পর্যায়ে তার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল তৃষ্ণা। দৌড়ে গিয়ে তনয়কে কোলে নিতে নিতে বললো,
-"মা, তুমি তনয়কে উঠানোর পরিবর্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অর্থিকে এভাবে অর্থিকে বকছো কেনো?"
তৃষ্ণা তনয়কে উঠিয়ে কোলে নিতেই দৌড়ে গিয়ে হাতে থাকা খাবারের প্লেট টেবিলে গিয়ে রাখলো অর্থি। তারপর এগুলো তৃষ্ণার ঘরের দিকে।
ডাল বেশি একটা গরম না থাকার কারণে তেমন একটা ক্ষতি হয় নি তনয়ের। শুধু পিঠের যে অংশে ডাল পড়ে গিয়েছিল, সে অংশ লাল হয়ে পড়েছে। মলম লাগিয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়ায় চুপচাপ সে ঘুমিয়ে পরেছে মায়ের বুকে। খানিকটা সময় তনয়কে বুকে নিয়ে বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। কোমরটা লেগে এসেছে। তনয়কে নিয়ে হাটতে লাগলো সে ঘরের মাঝে। কয়েকদিন যাবৎ তার অতীত টা খুব বেশিই জ্বালাতন করছে তাকে। অফিস, তনয়, মুহিবকে নিয়েই বলতে গেলে লাস্ট কিছুদিন ছিল সে। অতীত মনে পড়বার মত সময় বা সু্যোগ কোনোটাই ছিল না। তবে এখন না আছে অফিস না মুহিব... সারাদিন বাসার এই চার দেয়ালের মাঝে থেকে আবারো আগের সেই অতীত গুলো আঁকড়ে ধরছে তাকে। মাহসানের দেয়া ভালোবাসা, আদর, কষ্ট, যন্ত্রণা সারাটা দিন উঠতে বসতে মনে পড়ে যায় তার। অসহ্য লাগে এখন তার এসব। মুক্তি পেতে চায় এখন এগুলো থেকে সে। কিন্তু কিভাবে? এসবের থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে কি?
রাত ২ টো পর্যন্ত নিলয়ের সঙ্গে আড্ডা দেবার পর ঘুমোতে এল মাহসান। নিলয়ের প্রেরণাদায়ী কথাবার্তা আজ তার মানিসিক শান্তির কারণ। আজ বহুদিন পর আজ একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারবে সে। বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে চোখেজোড়া বন্ধ করতেই তনয়ের মুখ ভেসে উঠলো তার সামনে। আচ্ছা.. তনয়কে কোলে নিয়ে তৃষ্ণাকে দেখতে কেমন লাগে? একদম মা মা ভাব এসে যায় হয়তো তখন তার মাঝে... আফসোস এই অপরূপ এই দৃশ্য টি এখনো দেখার সুযোগ হয়ে উঠে নি তার। তবে খুব শিঘ্রই হবে হয়তো। তনয় এবং তৃষ্ণাকে নিয়ে এসব নানা ধরনের চিন্তাভাবনা করতে করতেই ঘুমের দেশে পারি জমিয়ে ছিল মাহসান। তবে বেশি একটা সময় টিকতে পারলো না সে ঘুমের সেই রাজ্যে। নিহালের আসা ফোন কলে ঘুম ভেঙে গেল তার।
-"ভাইয়া, আপনি কি স্কয়ার হসপিটালে একটু আসতে পারবেন?"
নিহালের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল মাহসানের। ঘুমে আচ্ছন্ন চোখজোড়া খুলে বললো,
-"এর রাতে হসপিটালে কেনো?"
-"ভাইয়া, ঐতিহ্যর পেইন শুরু হয়েছে। আমি মাত্রই ওকে নিয়ে এসেছি হসপিটালে। আপনি আসলে একটু ভালো হতো। এখানে আমি একা কি করবো না করবো বুঝছি না। এর রাতে আর কাকে কল করবো বুঝছিলামও না।"
শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো মাহসান। ঘরের আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
-"তুমি একদম টেনশন করবে না। আমি আসছি। আমি তো বাসায় নেই, ময়মনসিংহ এসেছি। তবে টেনশন করো না, আমি রওনা হচ্ছি। বেশি সময় লাগবে না। আর যোগাযোগের উপরেই থেকো।"
-"আচ্ছা।"
এই শীতের রাতে গাড়ি নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যাওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। কুয়াশায় ভরে আছে চারিদিকটা। তবুও সে যাবে। তাকে তো তার ভুল গুলো শুধরাতে হবে.. এই সময়টাকে সে কাছে থেকে দেখতে চায়। নিহালের প্রত্যেকটি অনুভূতি সে তার নিজের চোখ দিয়ে দেখতে চায়। সে যা অনুভব করতে পারে নি, তা না হয় অন্যেরটা দেখেই আপাতত পুষিয়ে নেবে।
মেয়ে হয়েছে ঐতিহ্যর। শ্যামলা গায়ের রঙের মাঝে বড়বড় টানা দুটি চোখ, তরতরা নাক। দ্বিতীয় তার মা... নিজের কোলে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তার দিকে মাহসান। তার বুকের মাঝে চলা উথালপাতাল কি কমেছে কিছুটা? নিজের সন্তানকে কাছে না পাবার, বুকে না নেবার যে কষ্ট ছিল.. তাতে একটু হলেও শান্তির ছোয়া পাচ্ছে সে। অপরদিকে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে যে কষ্টটি তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল.. তাও কিছুটা কমেছে। আত্মায় পানি ফিরে এসেছে তার। এক অসম্ভব ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছে তার মন।
হসপিটালের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে তৃষ্ণা কল দিল নিহালকে। তার কাছ থেকে সব ডিটেইলস জেনে উঠে পড়লো লিফটে। পাশে দাঁড়িতে থাকা অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"তনয় কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?"
-"না। জাগাই।"
-"এত চুপচাপ যে!"
-"টায়ার্ড হয়তো। জার্নি করে তো ওর তেমন একটা অভ্যাস নেই।"
কেবিনে ঢুকতেই বুকটা ধক করে উঠলো তৃষ্ণার। এটাই ভাবছিল সে আসার পথে। নিহালকে একবার জিজ্ঞেসও করেছিল। তবে নিহাল বলেছিল, মাহসান আসে নি.... মিথ্যে কেন বললো নিহাল?
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।