সম্পর্কের টান । পর্ব-৬৩+৬৪


সম্পর্কের টান
পর্ব-৬৩+৬৪

ভালোই কাটছে মাহসানের দিনগুলো। ঐতিহ্য কে তিনদিন হসপিটালে রেখে বাসায় নিয়ে আসার পর থেকে ঐতিহ্যদের বাসাতেই ঘাটি গেড়ে বসেছে মাহসান। সারাদিনভর তনয়ের সাথে সময় কাটিয়ে রাতে নিজের বাড়িতে ফিরে যায় সে। রাত টুকু কোনো রকম পাড় করেই আবারো ভোর না হতেই এসে হাজির হয় ঐতিহ্যদের বাড়িতে। তনয়ের দুষ্টুমি, হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়িতে ঘুরে ফেরা.. এর কোনো একটাও মিস করতে চায় না মাহসান। সাথে তৃষ্ণার মন গলানোর চেষ্টা তো রয়েছেই। মোটকথা আটঘাট বেঁধে এবার সে নেমে পড়েছে তার সংসার নতুন ভাবে জোড়া লাগানোর। নিলয়ের কথামতো মন প্রাণ দিয়ে যতটুকু তার সাধ্য, ততটুকুই চেষ্টা করে যাবে সে। বাকিটুকু উপরওয়ালার হাতে। উনি চাইলে কি না হয়!

মাহসানকে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে তার পাশে গিয়ে বসলো ঐতিহ্য। কাঁধে হাত রেখে হালকা ঝাকুনি দিয়ে বললো,
-"ভাইয়া.. কখন এসেছো?"
ঐতিহ্যর ঝাকুনি খেয়ে চিন্তার জগৎ ছেড়ে বাস্তব জগতে পা দিল মাহসান। ম্লান হেসে বললো,
-"অনেক্ষণ হলো। তুই আবার হেটে এইদিকে এলি কেনো! আমাকে ডাকলেই পারতি।"
-"সমস্যা হবে না। খেয়েছো কিছু?"
-"হ্যাঁ।"
-"অহ.. আচ্ছা।"
ঐতিহ্যর এক হাত নিজের দু হাতের মাঝে নিয়ে হালকা চেঁপে মাহসান বললো,
-"কিছু বলবি?"
-"হু।"
-"তো বলে ফেল।"
খানিকটা সময় নিল ঐতিহ্য। ছোট্ট কিছু নিশ্বাস ছেড়ে ভারী গলায় বললো,
-"আমি সব কিছুর জন্য সরি, ভাইয়া। তোমাকে আমি খুব হার্ট করে ফেলেছি..."
-"কাঁদছিস কেন, বোকা মেয়ে? আর হার্ট প্রথমে আমি তোদের করেছি.. আমাকে নিয়ে তোদের মনে যে সম্মান ছিল, ভালোবাসা ছিল সেগুলো নষ্ট করে দিয়েছি। পরে তোরা যাই বা করেছিস সেটা আমার প্রাপ্য ছিল।"
-"না, ভাইয়া.. আমার যেন কি হয়ে গিয়েছিল! আমি কেমন যেন আবেগহীন একটা পুতুলে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার মৃত্যু টা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। শুধু তুমি না.. আমি আমার জীবনে প্রতিটি মুল্যবান মানুষকেই হার্ট করেছি।"
এগিয়ে বসলো মাহসান। ঐতিহ্যকে নিজের বুকে নিয়ে বললো,
-"বললাম না কাঁদিস না! তোদের কারো চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। তারপরও তোরা দুই বোন আমার সামনে যখনি আসিস, একদম পানির ফোয়ারা খুলে বসিস।"
মাহসানের কথায় হেসে ফেললো ঐতিহ্য। চোখজোড়া মুছতে মুছতে বললো,
-"নিহনের পুরো নাম রেখে ফেলেছি। নিলৈতি আহমেদ নিহন। সুন্দর না?"
-"সুন্দর.. "
দুই ভাই বোনের খুনসুঁটির দৃশ্য রান্নাঘর থেকে দেখছিল তৃষ্ণা। তার কারণে ভাই বোনদের মাঝে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল,, তা অনেকটাই কমে এসেছে। হয়তো ধীরেধীরে আরো কমে যাবে। ভাবতেই মন টা আনন্দে ভরে যাচ্ছে তৃষ্ণার। তবে এই ভালোলাগার পাশাপাশি এক ধরনের ভয়ও কাজ করছে তার মনে। মাহসানের দিকে আবারো ঝুঁকে পড়তে চায় না তৃষ্ণা। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ মাহসানের সকল কাজকর্মে নিজের অনিচ্ছায় তার দিকে ঝুঁকে আবারো একই ভুল করছে সে। অবশ্য একজন মানুষ সর্বক্ষণ পিছুপিছু ঘুরলে আর কতভাবেই বা তাকে ইগনোর করবে তৃষ্ণা! তারপরও সে যতটুকু পারে, মাহসানকে ইগনোর করার উপরেই আছে। এখন এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারলেই মাহসানের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু এই যাওয়াটাই হয়ে উঠছে না। কে জানে কবে আসবে নিহালের বরিশালের খালা!

মুহিবের মুখ থেকে সব শুনে শাহানা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-"তৃষ্ণার সাথে এত কিছু হয়ে গেছে! অথচ আমি কিছুই জানি না। তুইও আমাকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নি। আমি আরো ভাবছি তৃষ্ণা স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করে যাচ্ছে। তুই মাঝখান থেকে ওদের মাঝে গিয়ে অশান্তি না বাজাস সে নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছি!"
-"তোমার ছেলে এত নীচু মানের কাজ কখনো করবে বলে তোমার মনে হয়?"
-"দেখ বাবু, আমি ওসব কিছু ভাবি নি। আচ্ছা.. এবার আমার কথা শোন।"
মুহিব মায়ের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,
-"আম্মা, আমি শুধু এটুকুই জানতে চাই তৃষ্ণার হঠাৎ কি হলো! ও আমার সাথে এমনটা কেনো করছে..."
-"হয়তো তৃষ্ণার মনে হয়েছে তোর সাথে মেলামেশা করাটা ওর ঠিক হচ্ছে না। যেহেতু ওর ডিভোর্স টা এখনো হয় নি। অথবা অন্য কিছুও মনে চলতে পারে... তনয়ও কারণ হতে পারে। আমি বা তুই দুর থেকে তো ওর মনে কি চলছে সেগুলো বুঝতে পারবো না।"
-"কারণ যেটাই হোক, ও একবার আমার সাথে শেয়ার করতে পারতো! ও আমার সাথে মেলামেশা করতে না চাইলে কখনোই আমি জোড় করতাম না। আর আমার কাছে তনয়ও কোনো ফ্যাক্ট না।"
ছেলেকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে শাহানা বেগম বললেন,
-"তোর প্রথমেই আমাকে সব জানানোর দরকার ছিল। আমি সময় দেখে তৌহিদ বা ওর বাবার সাথে কথা বলতাম। তা না করে তুই নিজে ব্যাপার টা হ্যান্ডেল করতে চেয়েছিস। যেটাতে.."
মায়ের কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিল মুহিব। বললো,
-"আমি তৃষ্ণা কে সময় দিতে চেয়েছিলাম। ও যে পরিস্থিতিতে ছিল, সেই পরিস্থিতির মাঝে আমি চাই নি ওর উপর কেউ কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিক। ওকে স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলাম, ওর নিজের মত নিয়েই আমি ব্যাপার টা এগুতে চেয়েছিলাম।"
-"তুই আবারো আগের ভুলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটালি।"
-"আম্মা, প্লিজ এভাবে বলো না। এখনো কিছু হয় নি। তুমি শুধু আমাকে এটুকু বলো, তুমি আমার পাশে আছো তো? তনয়সহ তৃষ্ণাকে এক্সেপ্ট করতে তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?"
ছেলের মাথায় হাত রেখে ম্লান হেসে শাহানা বেগম বললেন,
-"তোর বাবা মারা যাবার পর থেকে তোকে কখনো একা ছেড়েছি আমি? তোর চলা প্রতিটি পদে সবসময় আমাকে পাশে পাবি তুই, বাবু।"

রাতের খাবারগুলো গরম করছিল তৃষ্ণা। এবার ঠান্ডাটা হয়তো আগের বারের তুলনায় একটু বেশিই পড়েছে। গা কাঁপানো ঠান্ডা না হলেও খুব একটা কম ঠান্ডাও পড়ে নি। ব্লানকেটের ভেতর থেকে বের হওয়া মাত্রই হাত পা ঠান্ডায় বরফ হয়ে পড়ে। ঠান্ডায় জমে থাকা হাত দিয়ে কোনো একটা কাজও করতে ইচ্ছে করে না। এই ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য যেমন একটি উপায় ব্লানকেটের মাঝে ঢুকে থাকা, তেমনই আরেকটি উপায় হলো আগুনের পাশাপাশি থাকা। রান্নাঘরে চুলোর উপর দুই হাত মেলে এসব হাবিজাবি চিন্তাভাবনা করে যাচ্ছিল তৃষ্ণা। হঠাৎ পেটে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই পিছনে থাকা মানুষটির গরম নিশ্বাস এগুতে এগুতে তার গাল স্পর্শ করলো। তারপর আবারো ধীরেধীরে পিছিয়ে কানের পাশে আসতেই বলে উঠলো,
-"ভালোবাসি।"
মাহসানের স্পর্শের নেশায় নিজেকে ডোবাতে গিয়েও সামলে নিল তৃষ্ণা। লম্বা দম ছেড়ে বললো,
-"ছাড়ো।"
-"ভালোবাসি, তৃষ্ণা।"
পেট থেকে মাহসানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে তৃষ্ণা বললো,
-"আচ্ছা.. খুবই ভালো কথা। এবার হাত সরাও।"
-"উহু।"
-"প্লিজ.. সরাও। ঠান্ডা হাত তো।"
-"থাকুক.. সমস্যা কি!"
চেষ্টার উপরে চেষ্টা চালিয়েও মাহসানের হাত সামান্য একটুও সরাতে পারলো না তৃষ্ণা। ক্লান্তস্বরে বললো,
-"নিহাল ভাই যেকোনো সময় চলে আসবে।"
-"আসুক।"
একপর্যায়ে কঠিন স্বরে তৃষ্ণা বললো,
-"তুমি এভাবে আমার সাথে জোড় জবরদস্তি করতে পারো না। হাত সরাতে বলেছি... তো সরাও।"
হাত সরিয়ে নিল মাহসান। কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
-"সরি।"
তৃষ্ণা সেদিকে নজর না দিয়ে খাবার গুলো সব বাটিতে বাড়তে লাগলো। এভাবে আর চলতে পারছে না সে। নিহাল কে বলে খুব তাড়াতাড়ি এ বাড়ি ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
-"খাবার গুলো নিয়ে টেবিলে রাখবো?"
মাহসানের কথায় তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? কত রাত হয়েছে দেখেছো? তাড়াতাড়ি খেয়ে বিদায় হও।"
-"আজ যাচ্ছি না।"
মাহসানের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল তৃষ্ণার। বললো,
-"কেনো?"
মাহসান বাটি হাতে ডাইনিং এর দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"নিহাল নিষেধ করেছে তাই।"
মাহসানের যাবার পথের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"নিহাল নিষেধ করলেই থাকতে হবে কেনো? আর তুমি এখানে থাকবেই বা কোথায়?"
মাহসান তৃষ্ণার দিকে ফিরে সে কথার জবাব না দিয়ে রহস্যময় একটা হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বললো,
-"তেরে সামনে আজানে সেয়.. এ দিল মেরা ধারকা হেয়। এ গালতি নেহি হেয় তেরি.. কুসুর নাজার কা হেয়!! জিস বাত কা তুঝকো ডার হেয়.. ও কারকে দিখা দুংগা।"
মাহসান থামতেই আরো প্রখর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো তৃষ্ণা। চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-"কি?"
উত্তরে মাহসান চোখ টিপে বললো,
-"এয়সে না মুঝে তুম দেখো,, সিনে সে লাগা লুংগা। তুমকো মেয় চুরা লুংগা তুমসে দিল মেয় চুপা লুংগা.... গানের লিরিক্স টা সুন্দর না?"

     (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৬৪

নিহাল ঘরে ঢুকতেই ঐতিহ্যর উদ্দেশ্যে বললো,
-"কিছু লাগবে? ওয়াশরুমে কি যাবা?"
-"না।"
-"তাহলে আলো নিভিয়ে দেব?"
-"তোমার কাজ শেষ?"
-"হ্যাঁ। আপাতত আর কাজ নেই।"
-"তাহলে বন্ধ করে দাও।"
নিহাল ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে ঘুমন্ত নিহনের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-"শরীর খানিকটা গরম মনে হচ্ছে। জ্বর ট্বর এল নাকি!"
-"কই! দেখি?"
নিহনের কপালে হাত রাখতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেললো ঐতিহ্য। বললো,
-"কই? ঠিকই তো আছে।"
-"আমার মনে হচ্ছে গরম।"
-"এটা স্বাভাবিক তাপমাত্রাই।"
নিহাল আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো নিহনের একপাশে। ঐতিহ্য খানিকটা সময় চুপচাপ শুয়ে থাকার পর বললো,
-"ঘুমিয়েছো?"
অপরপাশ থেকে নিহাল জবাব দিল,
-"উহু।"
-"কিছু কথা ছিল।"
-"হু বলো।"
-"আমাকে বিয়ে করার পর তোমার কি মনে হয়নি, এ কেমন মেয়েকে বিয়ে করলাম... বিয়ের আগে মেয়েটাকে যেমন দেখেছিলাম, বিয়ের পর ঠিক তার উলটো। অতিরিক্ত আবেগী থেকে হঠাৎ আবেগহীন হয়ে পড়া একটা মেয়েকে মেনে নিতে তোমার কষ্ট হয় নি?"
-"সত্যি বলবো?"
-"অবশ্যই।"
-"হতো... মাঝেমাঝেই মনে হতো। তবে পরমুহূর্তে যখন তোমার নিষ্পাপ মুখটি দেখতাম, তখনি সেসব এক নিমেষেই ভুলে যেতাম।"
নিহালের কথা শুনতেই বুকটা কেঁপে উঠলো ঐতিহ্যর। নিহাল কে প্রচুর কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। এক বছরের বেশি হয়েছে তাদের বিবাহিত জীবনের। অথচ এই এক বছরে নিহাল কে এক সেকেন্ডের জন্য শান্তিতে থাকতে দেয় নি ঐতিহ্য। সবসময় এটা সেটা নিয়ে ঝগড়াঝাটি করার উপরেই থেকেছে। ভালোবাসি কথাটা তো কখনো মুখের কোণা দিয়েও উচ্চারণ করে নি। আজ যে তাদের এই সংসার টিকে আছে, তাদের দুইজনের মাঝে ছোট্ট একটি জান এসেছে... এসবের কৃতিত্ব শুধুমাত্র যায় একজনকেই। সে নিহাল.. নিহালের হার না মানা মোনোভাব, ঐতিহ্যর মুখ থেকে হাজার বার ডিভোর্স এর কথা শুনেও কোনোরকম সাড়া না দিয়ে চুপচাপ ধৈর্য নিয়ে চলার ফলই নিহন। আজ যে তারা এক বিছানায় তিনজন সুখী দম্পতির বেশে শুয়ে রয়েছে তাও শুধুমাত্র এই নিহালের ধৈর্যর ফলেই।
-"মন খারাপ?"
নিহালের প্রশ্নে ম্লান হাসলো ঐতিহ্য। বললো,
-"না। আমি যেমন পাগলী ছিলাম.. তাতে সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ আমার পাশে দিনের পর দিন থেকেছে কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক লাগছে!"
নিহাল উঠে বসতে বসতে বললো,
-"এখন একটা ডাইলোগ ছাড়ি?"
-"হু।"
-"আমিও তো পাগল ছিলাম! তোমার প্রেমে পাগল... তাই এই পাগলীটার পাশে দিনের পর দিন অনায়াসে থাকতে পেরেছি।"
নিহালের কথায় ফিক করে হেসে দিল ঐতিহ্য। ঠোঁটে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়েই বললো,
-"আপনার পাগলী তো ধীরেধীরে সুস্থ হচ্ছে.. তা আপনি কবে হবেন?"
-"তাই নাকি? তা আমার পাগলী সুস্থ হচ্ছে কিভাবে? না মানে সেই টেকনিক টা আমিও অবলম্বন করতাম।"
নিহনের দিকে তাকিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"আমার ডক্টর। আপনিও তার সাথে আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলে দেখতে পারেন। আমিও দোয়া করে দিচ্ছি.. আল্লাহ খুব জলদি আপনার সুস্থতা দান করুক। বলুন.. আমিন।"
-"আমিন। তা আমাদের ডক্টরকে এক কোণায় রেখে আপনি একটু মাঝে আসবেন?"
নিহালের কথায় লাজুক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"ইশ! শখ কতো! যাও ঘুমাও।"

তৌহিদ ফোন রাখতেই অর্থি বললো,
-"কে কল করেছিল এত রাতে?"
-"মুহিব।"
-"কি বললো?"
-"কাল আসবে এখানে।"
-"অহ... কোনো কাজে নাকি তোমাকে দেখতে?"
-"জানি না। দেখি পানি খাবো। উঠে এক গ্লাস পানি দাও।"
তৌহিদের আদেশে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অর্থি। গ্লাসে পানি ঢেলে তৌহিদের হাতে দিয়ে বললো,
-"কাল কিন্তু তোমার ডক্টর দেখানোর ডেট। পায়ের অবস্থা দেখে মেডিসিন চেইঞ্জ করে দেবে।"
পুরো এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করলো তৌহিদ। তারপর গ্লাস অর্থির হাতে দিয়ে বললো,
-"হুম.. মনে আছে।"
এখন তেমন কোনো সাপোর্ট ছাড়াই অনেকখানি হাটতে পারে তৌহিদ। তবে সমস্যা একটাই,, মাঝেমধ্যেই হাটুর নিচের যন্ত্রনায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। চিনচিনে ব্যাথায় পুরো পাগল পাগল মনে হয় নিজেকে। তখন মৃত্যু নামক জিনিসটি ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না তার। অর্থিকে বিয়ে করে ওর জীবন টা নষ্ট করার কি কোনো মানে ছিল? কেন তার এই প্রতিবন্ধকতার জীবনে জড়ালো সে অর্থিকে? এখন যদি তার কিছু হয়ে যায়.. কোথায় যাবে এই মেয়েটা? ভাইয়ের সাথে পর্যন্ত সম্পর্ক নষ্ট করেছে সে তৌহিদের নিজের জন্য। কাজটা কি ঠিক করছে সে? ক্রোধের বসে ভাইবোনকে এভাবে আলাদা করে রাখছে কেন সে? মাহসান স্বামী হিসেবে যত খারাপই হোক, ভাই হিসেবে সে মোটেও খারাপ নয়। নিজের চোখেই এটা দেখা তার। অপরদিকে তার নিজের বোন তৃষ্ণা.. আজ তার কিছু হয়ে গেলে তৃষ্ণারই বা কি হবে? সমাজে ডিভোর্সি মেয়ের জায়গাটা যে কতটা নীচুতে তা উকিল হবার সুবাদে খুব ভালো করেই জানা আছে তার। আজ তৃষ্ণার মাথার উপর ভাই হিসেবে ছায়া দিয়ে রেখেছে সে.. কাল যখন সে থাকবে না, তখন এই ছায়াটাই বা কে দেবে? মধুর উপর যেমন মৌমাছি ঝাক বেঁধে বসে পড়ে মধু আহরণের জন্য, সমাজে ছায়াবিহীন ডিভোর্সি মেয়ের উপরেও তেমন মৌমাছির অভাব হয় না। এসব মৌমাছিরা আর কিছু না পারলেও খুব ভালোই পারে মেয়েদের জীবন তিক্ত করে তুলতে। কথাগুলো ভাবতেই তৌহিদের মনের অন্তঃস্থল থেকে বেড়িয়ে এল একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস... আবারো বিছানায় গা মেলে ব্লানকেট গায়ে জড়াতেই বিড়াল ছানার মত তার বুকের মাঝটায় মুখ গুঁজে দিল অর্থি। তৌহিদও দু হাতে অর্থিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-"পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হলেই আগে গিয়ে দেখে আসবো নিহনকে।"
-"আর আমাদের নিহন কবে আসবে?"
অর্থির কথায় দীর্ঘশ্বাস গোপন করে তৌহিদ বললো,
-"তোমার সামনে টেস্ট এক্সাম... সেদিকে খেয়াল আছে তো?"
-"হু।"
-"পড়াশোনা কতদুর?"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে তৌহিদের বুক থেকে মুখ উঠিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আসছে একজন! সারাদিন পড়া আর পড়া! কখনো তো বলো না, এই অর্থি একটা চুমু দিয়ে যাও।"
অর্থির কথায় হাসি ফুটলো তৌহিদের মুখে। বললো,
-"এই অর্থি, একটা চুমু দিয়ে যাও তো।"
সময় নিল না অর্থি। তৌহিদের কথা শেষ না হতেই সে আলতো করে ছুঁয়ে দিল তৌহিদের ঠোঁট।

রাতের খাবারের পর সব কাজ সেরে তৃষ্ণা কলির উদ্দেশ্যে বললো,
-"তুই এখন যা। ঘুমিয়ে পর।"
কলিও আর কথা বাড়ালো না। বেড়িয়ে এল রান্নাঘর ছেড়ে। সারাদিন তনয়ের পিছুপিছু দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠেছে সে। এত বিচ্ছু বাচ্চা তার জীবনে সে দেখেনি। একদন্ড চুপচাপ কখনো কোথাও বসে না। সারাদিন টৈটৈ করার উপরেই থাকে। কে জানে কি মাটি দিয়ে বানিয়েছে এই ব্যাটারে!

তৃষ্ণা ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলো মাহসান নিজের শরীর মেলে আরামসে ঘুমিয়ে রয়েছে বিছানায়৷ কিছু বলতে গিয়েও বললো না। তনয়ের একপাশে একটি বালিশ রেখে নিজের শোবার জন্য আরেকটি বালিশ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে বাঁধা অনুভব করলো তৃষ্ণা।
-"কোথায় যাচ্ছো?"
-"ঘুমুতে।"
-"কোথায়?"
-"যেখানে ইচ্ছা সেখানে। দেখি হাত ছাড়ো।"
-"তনয় উঠে যদি মাঝরাতে কাঁদে.. তখন?"
মাহসানের কথায় তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"আমি তো লন্ডন যাচ্ছি না। পাশের রুমেই আছি।"
-"এই রুমে থাকতে কি সমস্যা?"
-"অনেক সমস্যা.. দেখি হাত ছাড়ো।"
মাহসান হাত ছাড়ার বদলে টেনে বিছানার এক কোণায় বসিয়ে দিল তৃষ্ণাকে। বললো,
-"তনয় বাবা মার সাথে এক বিছানায় ঘুমুতে চায়। আমরা কি ওর বাবা মা হিসেবে ইচ্ছে টা পুরণ করতে পারি না?"
মুখ বাঁকিয়ে তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"না।"
তৃষ্ণার হাত ছেড়ে দিল মাহসান। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
-"ওকে.. ফাইন।"
মাহসানকে দরজার দিকে এগুতে দেখে হাপ ছেড়ে বেঁচে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। তবে মাহসানকে ঘর ছেড়ে বেরুনোর পরিবর্তে দরজা লাগাতে দেখেই চোখ মুখে নেমে এল বিরক্তের ছাপ। বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুতেই মাহসান থামালো তাকে। পাঁজকোলে নিয়ে বিছানার এক কোণায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজের শরীরের ভর টুকোও ছেড়ে দিল মাহসান তৃষ্ণার উপর।
-"ক্ষমা করো.. একটা বার ক্ষমা করো। আর কখনোই তোমাকে কষ্ট পেতে দিব না।"
চোখজোড়া বুঁজে জোরে কিছু নিশ্বাস ফেলে তৃষ্ণা বললো,
-"আমি ভুলতে পারবো না তোমার বলা কথা গুলো, তোমার করা কাজ গুলো। এই যে তুমি এখন আমার এত কাছে রয়েছো.. কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে পারছি না। তোমার এই গা থেকে এখন আর আমি সেই নেশায় আসক্ত হবার মত, নিজেকে মাতাল করবার মত ঘ্রাণ পাই না। কিসের ঘ্রাণ পাই.. জানো?"
-"আমি জানি, তৃষ্ণা। সব জানি। তবুও একটাবার চেষ্টা করো.. হ্যাঁ, আমি অন্যায় করে ফেলেছি। তবে আমি এখন বুঝেছি আমার জীবনে তোমার মূল্য, আমার ছেলের মূল্য।"
তৃষ্ণা চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তের ছাপ মুখে ফুটিয়ে বললো,
-"সম্ভব না। আমি পারবো না... প্লিজ, তুমি আমাকে আমার মত করে বাঁচতে দাও। আমার জীবনে তোমার কোনো মূল্য নেই। আমার জীবনে লাগবে না তোমাকে।"
-"কিন্তু আমার জীবনে লাগবে তোমাকে, তৃষ্ণা।"
মাহসানকে সরাতে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে তৃষ্ণা বললো,
-"ইশ! সরো। অসহ্য লাগছে.. এসব ন্যাকামি তোমার সাথে যায় না। ভালোই ভালোই বলছি, উঠো। না হলে কিন্তু চিৎকার শুরু করবো। যেটা মোটেও কিন্তু..."
তৃষ্ণাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না মাহসান। নিজের ঠোঁটজোড়া পুড়ে দিল সে তৃষ্ণার ঠোঁটের মাঝে। ধীরেধীরে শুষে নিতে শুরু করলো সে তৃষ্ণার ঠোঁট.. সাথে তৃষ্ণার মনে তাকে নিয়ে জমে থাকা রাগ, অভিমান, কষ্ট।

   (চলবে)

বি দ্রঃ মাহসান এবং তৃষ্ণার মাঝের ঘটনা এখনো শেষ হয় নি। পরবর্তী পর্বে বাকিটা থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ