সম্পর্কের টান
পর্ব-৫৩+৫৪
ভালোই কাটছে তৃষ্ণার দিনকাল। দিনভর অফিস, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে তনয়ের সাথে সময় কাটানো, সবশেষে রাতে মুহিবের সাথে জমিয়ে আড্ডা। একমাসের বেশি হলো এই ধরাবাঁধা নিয়মের মাঝেই চলছে তার দিনকাল। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে মুহিবের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যেন তৃষ্ণার নতুন উদ্যমে আরেকটি সুন্দর দিন শুরু করার হাতিয়ার। মাহসানের কাছ থেকে এতোটা অবহেলা, অবজ্ঞা, অনাদর পাবার পর আজ যখন মুহিবের কাছ থেকে এতোটা যত্ন, ভালোবাসা পাচ্ছে.. তখন কি নিজের অজান্তেই মুহিবের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে তৃষ্ণা? এর উত্তর আপাতত নেই তার কাছে। তবে ভালো লাগে মুহিবের বলা একএকটি ধ্বনি, ভালো লাগে তার সাথে ফোনে কথা বলা প্রত্যেকটি মুহূর্ত। সারাদিন নানান কাজের ফাকে হঠাৎই মনে পড়ে বসে, রাত হতে আর কত বাকি?
অপরদিকে অর্থির দিনকাল কাটছে বেশ খারাপভাবে। দিনভর মাহসানকে নিয়ে শাশুড়ির কথা শুনে শুনে যখন তিক্ত বিরক্ত তখনি এসে উপস্থিত হচ্ছে তৌহিদ। অর্থিও নিজের রাগগুলো ঝেড়ে দিচ্ছে তৌহিদের উপর। তৌহিদ কিছু না বললেও তাদের সম্পর্কের মাঝে ধীরেধীরে দুরত্ব ঢুকে পড়ছে...
টেবিলে খাবার সাজিয়ে তৌহিদকে ডাকলো অর্থি। তৌহিদ কোট গায়ে চাপিয়ে ডাইনীং এর দিকে আসতে আসতে বললো,
-"আজ এর দেরি হলো যে! ৮.৩০ টার উপরে বেজে গেছে।"
অর্থি সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
-"আপু কল করেছিল কাল?"
-"অহ.. হ্যাঁ। ঐতিহ্য কল করেছিল।"
-"রিসিভ করো নি কেনো?"
-"তখন বিজি ছিলাম। পরে মাথা থেকেই কথা টা বেড়িয়ে গিয়েছিল। তাই আর কল ব্যাক করতে পারি নি।"
-"তো তুমি আমাকে সেটা জানালে না কেনো?"
খাবার মুখে দিতে দিতে তৌহিদ বললো,
-"বললাম তো। খেয়াল ছিল না।"
-"খেয়াল ছিল না এইটা বিশ্বাস করতে বলো আমায়?"
-"আমার বলার কথা আমি বললাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার ব্যাপার।"
তৌহিদের এমন কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে অর্থি বললো,
-"সত্যি বলতে তোমার লাগে? এইটা কেন বলছো না? তুমি আর তোমার মা দুইজন মিলেই চাচ্ছো আমার ভাইবোনের সাথে আমি যেন কোনো রকম যোগাযোগ না রাখি। বলো... চাচ্ছো না?"
-"না.. তেমন কিছু চাচ্ছি না।"
উত্তরে অর্থি চিৎকার করে বললো,
-"তেমন কিছুই চাচ্ছো। কিভাবে ভুলে যাও তোমরা সব? তোমার বোনকে ঢাকায় যে একটা মাস রাখতে হয়েছিলে... কোথায় রেখেছিলে? আমার বোনের বাসায়ই তো.. না? তোমার বোনের পক্ষে গিয়ে আমরা দুই বোন ভাইকে একা এক ঘরে ফেলে এসেছিলাম। এসব কিভাবে ভুলে যাও তোমরা? তোমরা কি অন্ধ? না হলে ভাইয়ার করা একটা অন্যায় কেন বারবার টেনে আনো তোমরা? আমি আমার বোন যে এত টা করলাম, এত কিছু ছাড়লাম সেসব কিছু তোমাদের চোখে পড়ে না? আচ্ছা.. আপাতত তোমার বোনের টপিক বাদ। তুমি এখন বলো... আমি যেই ফ্যামিলি বিলং করি... তাতে কি তোমার মনে হয় আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে আসতো তোমাদের বাড়িতে? আর ধরলাম আসতো,, কিন্ত আমাকে দিয়ে যে ঝিগিরী করাচ্ছো... সেটা করতো?"
-"ধীরে কথা বলো অর্থি। আর তোমার আজ থেকে বাসার কোনো কাজ করতে হবে না। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করছি।"
-"খবরদার কোনো কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করবে না। আর কিসের ধীরে কথা বলতে বলো? আমাকে তুমি চেনো না? এই অর্থি কাওকেই ভয় পায় না। এতদিন যদি চুপচাপ থেকে থাকে তাহলে সেটা বড়দের সম্মান দিয়েই থেকেছে। কিন্তু বড়রাই যদি তাদের সম্মানের মান না রেখে তার ফালুদা বানায়, তাহলে আমি শুধু শুধু কেন সম্মান দিতে যাব?"
খাবার ছেড়ে উঠে পড়লো তৌহিদ। কোনোরকম কথা না বাড়িয়ে এগুলো দরজার দিকে। এখানে বেশিক্ষণ না থাকাটাই ভালো। অর্থি ঠান্ডা হোক,, কোর্ট থেকে ফিরে এসে বিকেলে না হয় এ নিয়ে কথা বলবে।
অপরদিকে তৌহিদ কে তার কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যেতে দেখে অর্থির রাগ পৌছে গেল চরম পর্যায়ে। টেবিলে থাকা তৌহিদের আধ খাওয়া প্লেট নিচে ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-"তোকে যেন আর আমার চোখের সামনে না দেখি। এখন এভাবে বেরিয়ে যাচ্ছিস... এই যাওয়াই তোর শেষ যাওয়া। আবার বাড়িতে পা দিয়ে দেখ কি রেখে কি হয়ে যায়। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। ভালো হয়ে থাকতে চাইলে জ্বলাজ্বলি শুরু হয়ে যায় তোদের। এবার দেখ কি করি আমি।"
কোর্ট থেকে আসা ডিভোর্স নোটিশ পেয়ে আর এক মিনিটও দেরি করলো না মাহসান। বেরিয়ে পড়লো তৃষ্ণার অফিসের উদ্দেশ্যে। তৃষ্ণা নিজে নিষেধ করার পর ওই অফিসে আর দ্বিতীয় বার পা দেয় নি মাহসান। সময় দিয়েছে তৃষ্ণাকে... আসলে সে তৃষ্ণার সাথে যা কিছু করেছে তাতে সব কিছু মেনে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যও কিছু সময়ের দরকার। আর সবচেয়ে বেশি দরকার একটি উপযুক্ত সময়। যেটার অপেক্ষাতেই এতদিন ছিল মাহসান। কিন্তু না... আবারো ভুল করে ফেলেছে সে। উপযুক্ত সময়ের জন্য বসে থাকার মত বোকামি না করে তার উচিৎ ছিল সময়কে উপযুক্ত করে তোলা। উপযুক্ত সময় নিজে থেকে এসে ধরা দেবে না কারো হাতে। নিজেরই সময়কে তার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে।
-"কি এটা? আর তুমি আবার কেনো এসেছো এখানে?"
-"আমি একটা চান্স চাই, তৃষ্ণা... লাস্ট চান্স। না করো না। তুমি আমি তনয় মিলে আমরা আবারো নতুন একটা সংসার সাজাবো।"
তৃষ্ণা সে কথার তাল না দিয়ে পেপারগুলো দেখতে লাগলো। ডিভোর্স নোটিশ... ভাইয়া জমা দিয়েছে?
-"তৃষ্ণা?"
-"তুমি পেপারগুলো নিয়ে এখনি বের হও। আর তুমি সরাসরি অফিসের মাঝে কিভাবে ঢুকে পড়ো! স্ট্রেঞ্জ! বের হও এখনি।"
-"তুমি আগে আমার কথার উত্তর দাও তৃষ্ণা।"
-"না.. উত্তর না। দিয়ে দিলাম তো। এখন বের হও।"
তৃষ্ণা এত সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে না করছে কিভাবে? তার তৃষ্ণা এমন না.. আর এটাও তৃষ্ণার মনের কথা না। তৃষ্ণার দু হাতে চেপে ধরে মাহসান বললো,
-"এত সহজেই না বলে দিলে? একবার বুক কাঁপলো না তোমার?"
-"তুমিও তো খুব সহজেই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে, নানান কথা শুনিয়েছিলে... তখন যদি তোমার বুক না কাঁপে তাহলে আজ একটি না বলতে আমার বুক কাঁপবে কেনো?"
-"তৃষ্ণা... তৃষ্ণা। আমি অনুতপ্ত,, আমি আমার দোষ মেনে নিয়েছি। আমি জানি আমি কতবড় অন্যায় করেছি। তুমি প্লিজ আমাদের সম্পর্ককে আর একটা সুযোগ দাও। প্লিজ তুমি ডিভোর্স টা উইথড্র করে নাও। আমার কথা বাদ দিলাম। অন্তত তনয়ের কথা ভাবো। আমি ওর বাবা।"
-"চুপ... কিসের বাবা তুমি ওর? শুধু একফোঁটা স্পার্ম দিলাম আর বাবা হয়ে গেলাম!! বাবা হওয়া এতই সহজ মনে করেছো?"
কথাটি বলেই হুশ ফিরলো তৃষ্ণার। চারপাশের সব লোকজন তাকিয়ে তামাশা দেখছে তাদের। মুখে তাদের একরাশ বিস্ময়, আবার কিছু লোকের মুখে শয়তানি হাসি... ঠিক সেই মুহূর্তেই ফোন বেজে উঠলো তৃষ্ণার। আশপাশ থেকে নজর সরিয়ে নিল তৃষ্ণা। মুখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে সে এগুলো তার ডেস্কের দিকে।
তৃষ্ণা ফোন নামিয়ে রাখতেই আবারো তার দিকে এগুলো মাহসান। আজ সে যাবে না.. তৃষ্ণা নিষেধ করলেও না। আজ এসবের একটা গতি করেই এই অফিস থেকে নড়বে সে। তাতে যা হবার হবে...
-"তৃষ্ণা.. আমার কথা একবার মন দিয়ে শোনো। দেখো আমাদের একসাথে থাকাটা খুব জরুরী..."
মাহসানের কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিল তৃষ্ণা। কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
-"ভাইয়া হসপিটালে।"
অবাক হয়ে মাহসান বললো,
-"তৌহিদ?"
-"হ্যাঁ।"
-"কি হয়েছে?"
তৃষ্ণা ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বললো,
-"জানি না। আমি যাচ্ছি।"
-"দাঁড়াও.. আমিও যাবো।"
মাহসানের কথায় থেমে গেল তৃষ্ণা। পিছন ফিরে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। মাত্র আসা ফোন কল অনুযায়ী তৌহিদের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। তাই কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে গেল তৃষ্ণা। খানিকটা সময় চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মাহসানও পিছু নিল তৃষ্ণার।
দোতালায় করিডোরের মেঝেতে বসে একনাগাড়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে অর্থি। পাশে চেয়ারে হতভম্ব হয়ে বসে রয়েছে লিয়াকত সরকার। তৃষ্ণা খুব ধীর গতিতে এগুলো তাদের দিকে। তার বুকের মাঝে অনবরত হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছে কেউ। দম বন্ধ হয়ে আসছে হসপিটালে ঢোকার পর থেকে। আর অর্থিই বা এভাবে কাঁদছে কেন? সে যা ভাবছে,, তা যেন না হয়। তার ভাই যেন সুস্থ থাকে।
অর্থির পাশে চুপচাপ বসে পড়লো তৃষ্ণা। তার বাবার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই লিয়াকত সরকার ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলেন,
-"আমার ছেলেটা আর নেই... আমার ছেলেটা আর নেই রে মা। আমার ছেলে নেই।"
লিয়াকত সরকারের কথাগুলো কানে পৌছতেই তৃষ্ণার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অঝোর ধারায় নোনা পানির ঢেউ। কি শুনছে এগুলো সে? তার ভাই আর বেঁচে নেই?
অপরদিকে অর্থির পাগলপ্রায় অবস্থা। যেভাবে চিৎকার করে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে, হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে তাতে এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে সে। তাকে কোনোভাবে শান্ত করতে হবে... অর্থিকে টেনে নিজের বুকে আনার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে তৃষ্ণা বলতে লাগলো,
-"এমন করিস না, অর্থি। শান্ত হ একটু।"
বলেই পিছন ফিরে মাহসান কে খুঁজতে লাগলো সে। মাহসান ও তো তার সাথে এসেছিল। কোথায় গেল? মেঝে থেকে উঠে পড়ে করিডর বেয়ে সামনে এগুতে লাগলো তৃষ্ণা মাহসানের খোঁজে।
-"উপরে চলো।"
-"আমাকে দেখলে তৌহিদ রিয়াক্ট করতে পারে। থাক,, আমি এখানেই ঠিক আছি।"
কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা। মাহসানের হাত ধরে টেনে নিয়ে এল দোতালায়। অর্থির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-"বসো অর্থির পাশে। ওকে শান্ত করো।"
অর্থিকে এভাবে দেখে মাহসান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তৃষ্ণার দিকে। যে দৃষ্টিতে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন।
-"ভাইয়া, আমার তৌহিদ আর নেই। আমি কি করলাম? আমি কি করলাম, ভাইয়া? ওর সাথে রাগারাগি কেন করলাম আমি? আল্লাহ কেন আমার সাথেই এমন করে বারবার! আমার তৌহিদের সাথে কেন এটা করলো সে! বাবা মা কে নিয়ে গিয়ে কি শান্তি পায় নি সে? আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন, আমার হাসি, আমার জীবন টাই কেড়ে নিল কেন সে? কেন.. কেন! তাহলে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে? আমাকেও নিয়ে যাক সে। আমি কিচ্ছু জানি না... আমি কিচ্ছু বুঝি না। আমার আত্মা,, আমার তৌহিদ কে আমার কাছে ফেরত দাও। আর কিচ্ছু চাই না আমার। আমি সারাজীবনে আর কিচ্ছু চাইবো না। শুধু আমার তৌহিদ কে চাই।"
ক্রন্দনরত গলায় কথাগুলো বলতে বলতেই একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়লো অর্থি মাহসানের কোলে।
(চলবে)
সম্পর্কের_টান
পর্ব-৫৪
ঐতিহ্যকে দেখাশোনার জন্য রাজশাহী থেকে বছর দশেকের মত কলি নামের একটি মেয়ে নিয়ে এসেছে নিহাল। দেখাশোনা বলতে যতটুকু সময় নিহাল ভার্সিটি তে থাকবে ততটুকু সময়ে ঐতিহ্যর আশেপাশে থাকা। বাদবাকি সময় নিজেই সে ঐতিহ্যর দেখাশোনার কাজে লেগে থাকে। এত ছোট একটা বাচ্চার উপর আর কিইবা দায়িত্ব দেবে নিহাল? কলিকে ঢাকায় নিয়ে আসার একদম ইচ্ছে ছিল না নেহালের। তবে সবশেষে তেমন সুবিধার কাওকে না পেয়ে কলিকেই নিয়ে আসতে একরকম বাধ্য হয়েছে সে। এই পিচ্চি একটা বাচ্চাকে শুধু শুধু নিয়ে গিয়ে হবে টা কি? এর চেয়ে খালি হাতে ফেরাই ভালো ছিল। তবে কলিকে এখানে নিয়ে আসার পর কলির সম্পর্কে নিহালের মনোভাব সম্পূর্ণ পালটে গেছে। মানতেই হবে,, মেয়ের মাঝে মুগ্ধ করার মত কিছু রয়েছে। তার কাজকর্ম, কথাবার্তা, চালচলন নিহাল কে অবাক করে দিয়েছে। এত ছোট মেয়ে অথচ এই কয়দিনের যেভাবে এসে তাদের সংসারের হাল ধরেছে তাতে কলি সত্যিই প্রসংশার দাবিদার।
ঐতিহ্য শাওয়ার সেরে চুল মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। ব্যালকনির একপাশটায় কিছু কড়া রোদ এসে পড়েছে। শীতের দুপুরে এই কড়া রোদ শরীরে এসে লাগতেই তরতাজা হয়ে উঠে শরীর। সাথে শীত নিবারণ তো আছেই। ঠিক তখনি হাতে এক গ্লাস নিয়ে ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হলো কলি। ঐতিহ্যর দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বেশ টানতে টানতে বললো,
-"দেখি.. এটা নিন। খালু খেতে বলেছে আপিনারে।"
-"কি এখানে?"
-"ফ্রুট জুস.."
ঐতিহ্য হাতে গ্লাস নিয়ে বললো,
-"কি করছিলি রে?"
-"খালু বলেছে সবজি কেটে রাখতে। তাই সেগুলোই কাটছিলাম।"
-"আচ্ছা.. পরে কাটিস। আয় গল্প করি কিছুক্ষণ।"
-"কিসের গল্প শুনাবেন?"
-"তুই বল... কিসের গল্প শুনবি?"
-"আপনার আর খালুর গল্পই তাইলে শুনান। খালু আপনারে যত লাইক করে! সারাদিন শুধু তাকাই তাকাই দেখতেই মন চায়।"
কলির কথায় ফিক করে হেসে দিল ঐতিহ্য। বললো,
-"তুই আবার লাইক করাও বুঝিস?"
-"তো বুঝবো না? আমার পাশের বাড়িতে সুলতান নামের একটা ব্যাটা ছিল। আমারে খুবই লাইক করতো।"
-"তুই লাইক করতি না?"
-"আমি তেমন একটা করতাম না। ব্যাটা মানুষ হবে ব্যাটা মানুষের মত। কিন্তু সুলতান ব্যাটার চালচলন পুরাই বেটিদের মত।"
আবারো কলির কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ঐতিহ্য বললো,
-"কে বলবে তোর বয়স ১০ বছর? এত পাঁকাপাঁকা কথা! আচ্ছা,, একটা কাজ কর তো। আমার ফোন টা নিয়ে আয়। ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখেছি হয়তো।"
আদেশ পেয়েই কলি দৌড়ে গেল ফোনের খোঁজে। সমানতালে দৌড়ে আবার ফিরেও এল সে। ফোন ঐতিহ্যর হাতে দিতেই ঐতিহ্য গ্যালারিতে গিয়ে শরমির একটি ছবি বের করে তা মেলে ধরলো কলির সামনে। বললো,
-"দেখ তো এই মেয়েকে। ভালোভাবে দেখ। দেখেছিস?"
-"হ্যাঁ.. দেখলাম।"
-"সুন্দর না?"
-"হ্যাঁ.. সুন্দর।"
-"ওকে আর আমাকে তোর সামনে দাঁড় করিয়ে যদি মার্কস দিতে বলা হয়... তাহলে তুই কাকে কত দিবি?"
-"সুন্দরের জন্য?"
-"হ্যাঁ।"
ঐতিহ্যর কথায় গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করলো কলি। এক পর্যায়ে বললো,
-"আপনারে দিব ১০ এ ৭। আর উনারে দিব ১০ এ ৪। আমার চোখে উনার চেয়ে আপনিই সুন্দর। আচ্ছা.. এই বেটি কি খালুরে লাইক করে?"
ঐতিহ্য অসহায় গলায় জবাব দিল,
-"হু। তোর খালুও করে রে।"
ঐতিহ্যর কথায় অবাক হয়ে কলি বললো,
-"ও আল্লাহ! একসাথে দুইজনরেও লাইক করা যায় নাকি!"
রহমত সাহবকে এগিয়ে আসতে দেখে থেকে উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। চোখ জোড়া মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো তৃষ্ণা। তার এখন এইভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকেই সামলাতে হবে সবদিক। এত বড় দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে ভাইয়া কিভাবে পারলো দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিতে? সে পারবে না এসব। সকালে যাকে সুস্থসবল দেখে বের হলো অফিসের উদ্দেশ্যে,, সেই কিনা এখন আর নেই এই দুনিয়ায়? ভাবতেই বুক টা ভারী হয়ে আসছে। কষ্টগুলো বারবার এসে কেন শুধু তাদেরই আঁকড়ে ধরে?
-"তোমরা এখানে কি করছো?"
রহমত সাহেবের কথায় কষ্টের সেই জগৎ ছেড়ে বেড়িয়ে এল তৃষ্ণা। কিন্তু বেড়িয়ে এসে হবেটাই বা কি? এই জগতে কি কষ্টের পরিমাণ কম?
অপরদিকে তৃষ্ণার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রহমত সাহেব চারপাশটায় নজর দিয়ে বললো,
-"উনি তৌহিদ ভাইয়ের ওয়াইফ না? মেঝেতে এভাবে পড়ে রয়েছে কেন? উনি কি অসুস্থ? উনাকে উঠান। কেবিনে নিয়ে চলুন। আমি এক ঘন্টা আগে আপনার বাবা কে কল করেছিলাম। অথচ উনাদের আসতে এত দেরি! আর এসেও কিনা এখানে বসে রয়েছে! কেবিনে চলুন। তৌহিদ ভাই ওখানেই আছে। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।"
রহমত সাহেবের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল তৃষ্ণার। রহমত সাহেব পেশায় একজন উকিল। পেশাগত কারণে তৌহিদের সাথে ভালোই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। সেক্ষেত্রে তৌহিদের যাই হোক, হসপিটালে আনতে হয়তো উনিই সাথে এসেছিল। অপরদিকে রহমত সাহেব বলেই যাচ্ছে,
-"এময়ারঅাই করা হয়েছে। মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। বাম পা টা হয়তো প্যারালাইসিস...."
বলতে বলতেই থেমে গেল রহমত সাহেব। তৃষ্ণাও ধীরেধীরে নিজের স্তব্ধতা কাটিয়ে বললো,
-"ভাইয়া বেঁচে আছে?"
-"মানে?"
রহমাত সাহেবের কথায় উত্তর দিল না তৃষ্ণা। দৌড়ে লিয়াকত সরকারের কাছে গিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো,
-"বাবা, ভাইয়া তো কেবিনে। বেঁচে আছে ভাইয়া। তোমরা এখানে কেনো? কে বলেছে এসব উলটাপালটা? এই মাহসান, ভাইয়া কেবিনে। অর্থি, উঠ।"
অর্থিকে তৌহিদের কেবিনে রেখে বেড়িয়ে এল মাহসান। জ্ঞান ফিরছে না কোনোভাবেই অর্থির। ডক্টরকে ডাকতে হবে। তবে ডক্টর ডাকার আগে যে কাজটি করতে হবে তা হলো হসপিটাল অথোরিটির ব্যবস্থা করা। কোনো রকম যাচাই বাছাই না করে এরা কিভাবে রোগীর পরিবারদের ভুল তথ্য দেয়?
-"আমার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে স্যার বলেছিল অটির বাইরে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনাদের খবর টা জানিয়ে দিতে।"
নার্সের কথা শুনে মাহসান দাপুটে গলায় বলে উঠলো,
-"আপনি এখনো বলছেন, আপনার কোনো দোষ নেই। অথচ আপনার করা ভুলের জন্যই একটা পরিবার কি সাফার করেছে.. ধারনা আছে আপনার? এখন যদি আমি এসে আপনার জীবত স্বামী কে মৃত বানিয়ে দেই,, তারপরও কি আপনি বলবেন আমার কোনো দোষ নেই এতে!"
-"আমি তো জেনেশুনে করি নি। উনারা অটির সামনে হাটাহাটি করছিল। তাতে আমার মনে হয়েছে হয়তো উনারা অটিতে নিয়ে যাওয়া লোকেরই পরিবারের সদস্য।"
-"আপনি যাচাই বাছাই না করে বলবেন কেনো? অর্থিদের খবর দেয়া হয়েছিল তৌহিদ দোতালায় আছে। তো ওরা এসে দোতালায় তৌহিদকেই খুঁজছিল। আর একজন অটির সামনে থাকলেই সে অটিতে নেয়া লোকের রিলেটিভ হয়ে যাবে?"
এ পর্যায়ে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের প্রধান জনাম হানিফ সাহেব বলে উঠলেন,
-"শান্ত হোন, মাহসান সাহেব। ভুল টা আমাদেরই ছিল। আসলে এমন ঘটনার মুখোমুখি আমরা এর আগে কখনো হই নি। এই প্রথম... তবে কথা দিচ্ছি আমরা বিষয় টির প্রতি খেয়াল রাখবো। ভুল থেকেই তো মানুষ শেখেন। আমরাও আজ শিখলাম।"
কথাগুলো মাহসানের উদ্দেশ্যে বলে এবার জনাব হানিফ তাকালেন নার্সের দিকে। কড়া গলায় বললেন,
-"তর্ক করছো কেনো? ভুল করেছো স্মীকার করো। সরি বলো এখনি উনাকে। আর উনার বোনের জন্য ডক্টর সেলিম কে নিয়ে ২৩২ নম্বর রুমে চলে যাও।"
হানিফ সাহেবের কথামত সরি বলে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল নার্স। মাহসানের দিকে সামান্য ঝুকে এসে হানিফ সাহেব বললেন,
-"ঠান্ডা দিতে বলি? নাকি চা কফি?"
-"না,, কিছু লাগবে না।"
-"আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত। আপনাদের পরিবারের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে তা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝছি। তবে আসলে আমরা ইচ্ছে করে কিছু করি নি। আসলে কিছু কনফিউশন হয়েছিল। আপনার ফ্যামিলি তৌহিদ সাহেবকে খুঁজছিল। নার্স ভেবেছিল হয়তো উনারাই অটিতে নিয়ে যাওয়া প্রেশেন্টের রিলেটিভ। আই হোপ, আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি আপনি বুঝতে পারছেন। প্লিজ, একটু কনসিডার করুন।"
ঝাপসা দৃষ্টিতে তৃষ্ণার হাসিমাখা মুখ ভেসে উঠছে অর্থির চোখে। চোখজোড়া পুরোপুরি ভাবে খুলতে গিয়েও খুলতে পারছে না। পুরো মাথা ভার হয়ে আছে। কিছু একটা বলছে তাকে তৃষ্ণা। কিন্তু কি বলছে? আর সেই বা বুঝতে পারছে না কেন? খানিকটা সময় চেষ্টার পর চোখজোড়া পুরোদমে খুলে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো তৃষ্ণার দিকে।
অপরদিকে তৃষ্ণা বলেই যাচ্ছে,
-"অর্থি, পাশে ফিরে তাকা। দেখ ভাইয়া। ভাইয়ার কিছু হয় নি। আল্লাহ ভাইয়াকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। নার্সটা তোদের ভুল ইনফরমেশন দিয়েছিল। তাকা একবার।"
অর্থির কোনোরকম পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে তাকে কিছুটা সময় দিল তৃষ্ণা। কি রেখে এখন কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছে না তার। কোনো জায়গায় স্থিরভাবে একদন্ড বসতেও পারছে না, ছটফটানি লেগেই আছে। খুশিতে কি পাগল হয়ে গেছে সে? গেলেও সমস্যা নেই। তাই ভাই তার চোখের সামনে জীবতবস্থায় শুয়ে রয়েছে এর চেয়ে বেশি খুশির আর কি থাকতে পারে তার কাছে? আজ চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছে তার এই খুশির কারণ।
-"তোর ফোন বাজছে রে।"
লিয়াকত সরকারের কথায় ফোনের দিকে নজর দিল তৃষ্ণা। মুহিব কল করেছে। ঢাকা থেকে এখানে আসার পথে তৌহিদের হসপিটালে ভর্তি নিয়ে মুহিবকে ম্যাসেজ করেছিল তৃষ্ণা। তারপর তো আর কোনো কথাই হয় নি। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ফোন নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে এল তৃষ্ণা।
চারপাশটা ভালোভাবে খেয়াল করলো মাহসান। তারপর খুব ধীরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তৃষ্ণাকে।
আচমকা শরীরে কারো স্পর্শ পেয়েই চমকে উঠলো তৃষ্ণা। মুহিবের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই একদম করিডোরের শেষ মাথায় এসে পড়েছিল সে। এদিকটা খানিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, লোকজনের উপস্থিতিও তেমন একটা নেই বললেই চলে। এই সুযোগেই কি কেউ এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে? তবে তার ভুল ধারণা ঘুঁচে গেল ঘাঁড়ে পড়া সেই চিরচেনা নিশ্বাসে। মাহসানের নিশ্বাসগুলো ঘাঁড়ে পড়তেই পুরো শরীর কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার।
লিয়াকত সরকারের মুখে সব শুনে স্তব্ধতা কাটিয়ে বেড ছেড়ে উঠে পড়লো অর্থি। পাশের বেডে শুয়ে থাকা তৌহিদের কাছে দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাপিয়া পড়লো অর্থি৷ চোখেমুখে, বুকে হাজার চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলো। সে স্বপ্ন দেখছে না তো? তার তৌহিদ তার বুকেই আছে? খুশিতে আত্মহারা হয়ে কান্নামাখা গলায় সে বলতে লাগলো,
-"আর কখনোই তোমার সাথে রাগারাগি করবো না। তুমি যেমনভাবে যেটা বলবে সেটাই করবো। তবুও তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না। তুমি জানো না... এই অর্থির জীবনে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই? তোমাকে ছাড়া থাকবে কি করে তোমার অর্থি? মরে যাবে অর্থি। আমি আর কখনোই রাগারাগি করবো না। কখনোই না।"
লিয়াকত সরকার নিজের চোখের পানি মুছে চুপচাপ বেড়িয়ে এল কেবিন ছেড়ে। কাঁদুক অর্থি.. যত ইচ্ছে কাঁদুক। এই কান্না তো সুখের কান্না। তাহলে সে শুধুশুধু থামাবেই বা কেনো!!
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।