সম্পর্কের টান
পর্ব-৫১+৫২
-"তুই তাহলে কাল সকালেই যাচ্ছিস?"
-"হ্যাঁ।"
-"আর দু এক দিন থাকলেই পারতি।"
তৌহিদের কথার পিঠে হালকা হাসলো মুহিব। টেবিলে থাকা পেপার হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলো সে। তৌহিদ কিছুক্ষণ মুহিবের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নজর সরিয়ে নিল। মুহিবকে নিয়ে তার সন্দেহ টা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তবে তার মনে চলা কথাগুলো খুলে বলতেও পারছে না সে মুহিবকে। যদি এসব কিছু মুহিবের মনে না চলে? তার ভাবনাই যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়,,, তখন তো মুহিবের সামনে ছোট হতে হবে তাকে। সেই সাথে সম্পর্কের একটা ব্যাপারও আছে.... ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থিকে ডেকে চা দিতে বললো তৌহিদ। তারপর ঘুরেফিরে তৃষ্ণার প্রসঙ্গ এনে বললো,
-"তৃষ্ণা বলছিল তুই নাকি ওকে রাজশাহী থেকে মাস্টার্স করতে বলেছিস?"
পেপারের পাতা থেকে মুখ না উঠিয়েই মুহিব মাথা নেড়ে জবাব দিল,
-"হু।"
-"রাজশাহী ভার্সিটি থেকে?"
-"হ্যাঁ।"
-"ফর্ম ছেড়েছে কি?"
-"না,, ছাড়লে আমি তোকে জানাবো।"
-"আচ্ছা। তোর কি ধারণা? তৃষ্ণা টিকতে পারবে? ইদানিং পড়াশোনা তো তেমন একটা করছে না বললেই চলে।"
এ পর্যায়ে পেপারের দিক থেকে নজর উঠিয়ে তৌহিদের দিকে দিল মুহিব। ঠান্ডা গলায় জবাব দিল,
-"বলতে পারছি না। তবে আমি চেষ্টা করবো। আজকাল চেনাজানা লোকজন থাকলে কি না হয়!"
-"তা অবশ্য ঠিক... তা যদি তৃষ্ণা চান্সটা পেয়েই যায়,, তখন ওখানে কিভাবে থাকবে? তনয়ও অনেক ছোট।"
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মুহিব। আবারো নজর দিল পেপারে। অপরপাশে তৌহিদ ও আড়চোখে তাকিয়ে আছে মুহিবের দিকে। অপেক্ষা করছে তার জবাবের.... খানিক্ষণ দুইজনই নিরব থাকার পর মুহিব বললো,
-"পরের টা পরেই ভাবা যাবে। আগে তৃষ্ণা এক্সাম দিক। আর তৃষ্ণার ডিভোর্স নিয়ে কি কিছু ভাবছিস?"
-"ভাবার উপরেই আছি।"
-"তৃষ্ণার সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে কিছু?"
-"হ্যাঁ,, হয়েছিল। তাও ২ মাস আগে।"
-"ওর মতামত কি?"
-"কিছুদিন সময় চেয়েছিল।"
তৌহিদের উত্তরে মুহিবের চোখেমুখে নেমে এল কষ্টের এক আভাস। কিছুটা নড়েচড়ে বসে সে বললো,
-"হু... সময় নিক। তৃষ্ণার অনুমতি ছাড়া তো আর এগুনো যাবে না।"
-"সেটা আগানো না গেলেও অনেক সময়ই পেরিয়ে গেছে। এবার এগুতে হবে। আজকালের ভেতরই তৃষ্ণার সাথে এ নিয়ে কথা বলবো।"
-"আচ্ছা।"
-"হ্যাঁ,, আর আমার দিক থেকে সব রেডি। তৃষ্ণা অনুমতি দিলেই ডিভোর্স পেপার কোর্টে জমা দিয়ে দেব। মাহসানের কাছেও একটা নোটিশ চলে যাবে। ও ওর উকিলকে দিয়ে নো অবজেশন জানাবে। এরপর শুধু তিনমাস অপেক্ষা। তিনমাস পর দুজনের কাছেই কোর্ট থেকে ডিভোর্স লেটার যাবে 'দে আর নাও করফার্মড দেয়ার ডিভোর্স।'"
তৌহিদের কথা শুনে চিন্তিত ভঙ্গিতে মুহিব বললো,
-"যদি এর মাঝে দুজনের মন ঘুরে যায়...!"
-"বললেই হলো নাকি! সম্পর্ক মগের মুল্লুক নয়। আর যে সম্পর্কে কোনো টান নেই সেই সম্পর্ক শুধু বয়ে বেড়ানোর দরকার টা কি! আর মাহসানের মত কোনো ছেলের কাছে তৃষ্ণা যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না। জীবনের একটা মূল্য আছে... আমার বোনের জীবন এতোটাও সস্থা হয় নি যে, মাহসানের কাছেই ফিরতে হবে তাকে। মোট কথা এই সম্পর্ক কখনোই ঠিক হবার না আর মন ঘুরে যাবারও কোনো রাস্তা নেই। তৃষ্ণা যেহেতু ডিভোর্স টা দিচ্ছে,, সেহেতু ডিভোর্স উইথড্র করতে চাইলে তৃষ্ণাই করতে পারবে। আর যেটা আমি কখনোই তৃষ্ণাকে করতে দেব না।"
-"সেটা কি ঠিক হবে? তৃষ্ণা নিজে যদি মাহসানের কাছে ফিরতে চায় তখন ওর মনের উপর দিয়ে জোর খাটানো উচিৎ হবে বলে আমার মনে হয় না।"
মুহিবের কথায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
-"তৃষ্ণাকে ভুল পথ থেকে ফিরে আনাও ভাই হিসেবে আমার কর্তব্য। বাকি দশটা মেয়ের মত সুস্থ স্বাভাবিকভাবে একটি সুন্দর জীবন কাটানোর অধিকার তৃষ্ণারও আছে। আর আমি ভাই হিসেবে সেটাই করবো যেটাতে আমার বোনের ভবিষ্যৎ টা সুন্দর হবে। আগের বার যা করেছি এবার আর তার পুনরাবৃত্তি করবো না.... যাই হোক তুই বয়। আমি দেখে আসি অর্থি চা আনছে না কেনো! সেই কখন ডেকে চা দিয়ে যেতে বলেছি।"
রান্নাঘরে অর্থিকে দেখতে না পেয়ে তৌহিদ পা বাড়ালো তাদের শোবার ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকেই অর্থিকে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তৌহিদ তার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"কি করো এখানে? একটু আগে না চা দিতে বললাম!"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-"তোমার সাথে কথা আছে।"
অর্থির পাশে বসতে বসতে তৌহিদ বললো,
-"হু... বলো।"
সকালের ঘটা কথাগুলো একে একে সব খুলে বললো অর্থি তৌহিদকে। তৌহিদ সব শুনে কপাল কুঁচকে ধীর গলায় বললো,
-"একাক দিন একেক ঝামেলা! পরশু রাতে সময় দেই না বলে ক্যাচক্যাচ করলো... আজ আবার এই সমস্যা।"
তৌহিদের কথা কানে পৌছালো না অর্থির। ভ্রু কুঁচকে তৌহিদের দিকে তাকিয়ে সে বললো,
-"কি বলছো?"
-"কিছু না... মার এভাবে মুহিবের সামনে বলাটা ঠিক হয় নি। আর তোমারো উচিৎ হয় নি তৃষ্ণাকে ভাবি বলে ডাকা। যেহেতু পরশু রাতেই মা তোমাকে নিষেধ করেছিল।"
-"আজব! আমি কি ইচ্ছে করে ডেকেছি নাকি! ভুলে ডেকে ফেলেছি। এতোদিনের অভ্যাস এত জলদি তো পরিবর্তন হবে না।"
-"তা হবে না... তবে চেষ্টা করো।"
তৌহিদের ছন্নছাড়া কথাবার্তা শুনে ফুসে উঠলো অর্থি। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
-"আমি চেষ্টা করি না? কি বলতে চাচ্ছো তুমি? ইচ্ছে করে আমি ভাবি বলে ডাকছি? এই তোমাকেই যদি এখন আমাকে অর্থি বলে না ডেকে ভাবি বলে ডাকতে দেয়া হয়,, তাহলে তুমি পারবে? সময় লাগবেনা কিছুদিন তোমার?"
-"কিসব আবলতাবল কথা বলছো এগুলো অর্থি? তোমাকে আর ভাবি! উদাহরন দেবে ঠিকাছে... তাই বলে সম্পর্ক দেখবে না?"
-"না... না... না। দেখবো না। বলো তুমি.. ডাকতে পারবে? সময় লাগবে না তোমার?"
-"চুপ করো অর্থি। কিসব বলো আর না বলো! চলো শুয়ে পড়ি।"
-"তুমি নিজেই ঘুমাও। শুয়ে পড়বার সময় আমি, বাড়ির সব কাজ করবার সময় আমি... অথচ কথা শোনানোর সময় কেউ কম শোনাও না। আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে ভাই কে সাপোর্ট না করে ভাবিকে সাপোর্ট করা। যার ফলাফল হিসেবে আজ শুনতে হলো, উপরে উপরে ভালোবাসা দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে সব উজাড় করার নাকি তাল করছি আমি! তোমাদের দিয়েই এসব সম্ভব। তোমাদের ফ্যামিলি ছাড়া অন্য কোনো ফ্যামিলি হলে, এসব কথা শোনানোর পরিবর্তে আমাকে তারা মাথায় উঠিয়ে রাখতো।"
কথাটি বলেই হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল অর্থি। তৌহিদ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর নিজেও ঘর ছেড়ে পা বাড়ালো ড্রইংরুমে বসে থাকা মুহিবের দিকে
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তনয়ের পাশে অর্থিকে শুয়ে থাকতে দেখে তৃষ্ণা বললো,
-"ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে?"
-"না... আজ তনয়ের সাথে ঘুমুতে ইচ্ছা করলো৷ থাকি এখানে?"
-"অবশ্যই। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হবে নাকি! তবে একটা কথা জানো কি? স্বামী স্ত্রীর মাঝে..."
তৃষ্ণার কথার মাঝেই অর্থি বলে উঠলো,
-"ঘুম পেয়েছে.. ঘুমাবো। গুড নাইট।"
অর্থির কথায় থেমে গেল তৃষ্ণা। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-"আচ্ছা.. ঘুমাও।"
৪ দিন ছুটি কাটাবার পর আজ প্রথম অফিসে এসেছে তৃষ্ণা। তবুও কাজের তেমন একটা চাপ নেই বললেই চলে ৷ দু একটা কাজ যা জমে ছিল সেগুলোও তার পাশের সহকর্মীরা মিলে সেরে দিয়েছে। তাই চার দিন ছুটির পর আজ অফিসে এসেই ফুরফুরে মেজাজেই আছে তৃষ্ণা।
-"বিয়েতে কেমন এঞ্জয় করলেন, আপা?"
পাশের ডেস্ক থেকে তুষার হোসেন নামের একজন সহকর্মী কথাটি জিজ্ঞেস করলো তৃষ্ণাকে। তৃষ্ণাও হাসিমুখে তার দিকে ফিরে বললো,
-"ভালোই মজা করেছি। হিন্দুধর্মের বিয়ে টিয়ে খাওয়া হয়েছিল না এর আগে।"
-"আমি তো নিজেই থাকি হিন্দুদের এলাকার মাঝে। উঠতে বসতে সারাদিন তাদের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে আমার এখন সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।"
বলেই হেসে উঠলো তুষার হোসেন। তৃষ্ণা নিজেও হালকা হেসে বললো,
-"আপনার বাসা কোথায়?"
ঠিক সেই মুহুর্তেই তাদের রুমে আগমন ঘটলো ফাতেমার। একটি ফাইল হাতে ঢুকতে ঢুকতে সে তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বললো,
-"বস তোমাকে তার রুমে যেতে বললো।"
-"যাচ্ছি। তোমার মন খারাপ?"
কিছু বলতে গিয়েও তুষারকে দেখে কিছু বললো না ফাতেমা। চোখের ইশারায় বললো, পুরো ঘটনা পরে সে বলবে তৃষ্ণাকে। তৃষ্ণাও আর কিছু না বলে উঠে পড়লো তার চেয়ার ছেড়ে। পরণের কামিজ, ওড়না ঠিকঠাক করে দরজার দিকে ফিরতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠলো সে। আতংকিত চোখে সে তাকিয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাহসানের দিকে।
-"চলো। পাশের রেস্টুরেন্টে বসবো। কথা আছে কিছু।"
ওপাশে তৃষ্ণাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মাহসান তৃষ্ণার কাঁধে হাত রেখে ঝাকুনি দিয়ে আবারো বললো,
-"কি হলো? চলো।"
মাহসানের স্পর্শে পুরো শরীর কেপে উঠলো তৃষ্ণার। বুকের মাঝের ধরফরানি ক্রমেই বেড়ে গেল। নিজের চোখ কে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষ্ণা। মাহসান এসেছে? তবে এই রেশকে বেশিক্ষণ প্রশ্রয় দিল না তৃষ্ণা। খুব দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে দাঁতেদাঁত চেপে ধীর গলায় বললো,
-"তুমি এখানে কেনো এসেছো?"
-"তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।"
-"তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ভদ্র ভাবে বলছি, কোনো সিনক্রিয়েট না করে এখান থেকে চলে যাও। এটা আমার অফিস।"
-"অফিস জন্যই তোমাকে বলছি চলো পাশের রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলতে।"
-"আমি কোথাও যাবো না। তুমি চলে যাও। আমি পরে তোমাকে কল করবো।"
-"তোমাকে তো বলেছি যা বলার সামনাসামনি বলবো।"
মাহসানের কথায় মুখের বিরক্তির আভা ফুটিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"ইশ! যাও তো তুমি এখান থেকে। কেন ঝামেলা করছো শুধু শুধু!"
-"তুমি যাবে না আমার সাথে?"
-"না.. যাবো না।"
-"ভেবে বলো।"
-"বললাম তো যাবো না। আর তুমি..."
তৃষ্ণার কথা শেষ হবার আগেই আচমকা এসে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো মাহসান... ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। কাঁপাকাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
-"কি হচ্ছে এসব? ছাড়ো।"
-"এখন বলো... যাবে? নাকি যাবে না?"
এখন মাহসানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানো তেমন কঠিন ব্যাপার না। চিল্লাপাল্লা করলে বা জোড়াজুড়ি করলেই মাহসান বাধ্য হবে তাকে ছেড়ে দিতে। তবে তাতে অফিসে বিশ্রী কিছু কান্ড ঘটে যাবে। অপরদিকে কোনো সিনক্রিয়েট না করে চুপচাপ মাহসানের সাথে বেড়িয়ে গেলে হয়তো নানান কথাবার্তা রটে যাবে তাকে নিয়ে। তবে মারামারির মত খারাপ পর্যায়ের কিছু ঘটবে না। তাই সব ভেবে মাহসানের সাথে চুপচাপ বেড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল তৃষ্ণা।
-"যাবো আমি। ছাড়ো এখন।"
মাহসান তার বাহুডোর থেকে তৃষ্ণাকে ছেড়ে দিতেই তৃষ্ণা চোখ বোলাতে শুরু করলো রুমের চারপাশটায়। বড়সড় এই রুমে ডেস্ক আছে দশটি। যার মাঝের দুটি ডেস্ক ফাঁকা। বাকি আটটিতেই নিয়োগ রয়েছে কর্মীরা। যাদের সবাই ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণা এবং মাহসানের দিকে।
-"যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমার হাতে সময় নেই।"
কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মাহসান বললো,
-"বেশি সময় সময় করো না। তোমার চেয়ে আমার ব্যস্ততা কম?"
-"তো তুমি এত ব্যস্ত হলে এখানে এসে এসব নাটক করছো কেনো?"
জবাব দিল না মাহসান। কিভাবে তৃষ্ণার কাছে মাফ চাইবে, তাকে আরেকটি বার চান্স দিতে বলবে সেসব নিয়ে ভাবতে লাগলো সে। কথাগুলো মনের মাঝে গুছিয়ে নিলেও এখন তা তৃষ্ণার সামনে প্রকাশ করতে পারছে না। কোথাও কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে,, যা বারবার তাকে বাঁধা দিচ্ছে মনের সেই জমানো কথাগুলো তৃষ্ণাকে বলতে। কিন্তু না.. বলতে তাকে হবেই। তাই তনয়কে দিয়েই ধীরেসুস্থে এগুলো মাহসান।
-"তনয় কেমন আছে?"
-"ভালো।"
-"ওর রিসেন্ট তোলা কোনো ছবি হবে?"
কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা৷ ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সঞ্চির বিয়েতে উঠা কিছু ছবির মাঝে একটি ছবি স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলে তা মেলে ধরলো মাহসানের সামনে।
মাহসান হাত এগিয়ে তৃষ্ণার ফোন নিজের হাতে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা তনয়ের দিকে।
-"তুমি আমার ছোটবেলার ছবি দেখেছো? একদম আমার কপি। উফ!! এতোটা মিল কেমনে সম্ভব!"
মাহসানের এই কথাটিই হয়তো কিছুদিন আগে শুনলে মধুর মত লাগতো। তবে এখন লাগছে না। বিষের মত কথাগুলো কানে এসে লাগছে তৃষ্ণার। আসলে প্রত্যেক জিনিসেরই নির্দিষ্ট কিছু সময় থাকে। যার সময়কাল ফুরিয়ে গেলে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে,, তা অব্যবহৃত হয়ে যায়। যা থেকেও না থাকার সমতুল্য।
-"ছেলেটা কে?"
হঠাৎ মাহসানের কথায় চিন্তার জগৎ ছেড়ে বাস্তব জগতে ফিরে এল তৃষ্ণা। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"কোনটা?
মাহসান ফোন তৃষ্ণার দিকে মেলে ধরতেই তৃষ্ণা বললো,
-"অহ,, এটা মুহিব ভাই।"
-"মুহিব টা আবার কে?"
-"যেই হোক.. তা জেনে তোমার কি কাজ!"
-"অবশ্যই আমার কাজ আছে। প্রত্যেকটা ছবিতেই ওর কোলে আমার ছেলে। হোয়াই? আমার ছেলে ওর কোলে কেনো? আর তোমার নিজের ছবি গুলো দেখেছো? এই ছেলের দিকে ওভাবে তাকিয়ে দেখছো টা কি!"
-"যা ইচ্ছে দেখছি। দেখি আমার ফোন দাও। তোমাকে তনয়ের একটা ছবি দেখার জন্য দিয়েছি। পুরো ফোন ঘাটাঘাটি করার পারমিশন তোমাকে কে দিল?"
-"কথা ঘোরাবে না একদম। এই ছেলে কে? আর আমার ছেলে ওর কোলে করছে টা কি!"
মাহসানের প্রশ্ন শুনে তৃষ্ণা চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-"বারবার আমার ছেলে আমার ছেলে করবে না।"
-"তো কি মুহিবের ছেলে মুহিবের ছেলে করবো? তুমি কি মুহিবের সাথে শুয়ে জন্ম দিয়েছিলে ওকে?"
-"মুখ সামলে কথা বলো। আমারই ভুল হয়েছে এখানে আসা। আমার বোঝা উচিৎ ছিল এর চেয়ে ভালো ভাষা অন্তত তোমার মুখ দিয়ে বেরুবে না।"
হঠাৎ পরিস্থিতি পালটে যেতে দেখে হুশ ফিরলো মাহসানের। কি বলতে এসেছিল আর কি বলছে সে! সে কি তৃষ্ণাকে চেনে না? তাহলে কেন বলছে সে এসব কথা? হয়তো ছেলেটি তৃষ্ণার পরিচিত কেউ।
-"সরি, তৃষ্ণা। আমি ওভাবে বলতে চাই নি।"
সে কথার উত্তর দিল না তৃষ্ণা। মাহসানের হাত থেকে ফোনটি হাতে নিয়েই উঠে পড়লো সে। কঠিন গলায় বললো,
-"আর একদিন যদি আমার অফিসে তুমি পা দাও, আল্লাহর কসম সেদিন খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে।"
কথাটি বলেই তৃষ্ণা দ্রুতপায়ে বেড়িয়ে এল রেস্টুরেন্ট ছেড়ে।
-"হায় আল্লাহ! তুই কি বলছিস এসব? পাগল টাগল হলি নাকি?"
-"আম্মা.. প্লিজ। এসব বলো না তো। তুমি তো জানো আমি কতোটা পছন্দ করি তৃষ্ণাকে।"
মুহিবের কথা শুনে তার মা শাহানা বেগম বললেন,
-"পছন্দ যখন করতি তখন ও অবিবাহিত ছিল। কিন্তু এখন তো আর অবিহিত না। একটা ছেলেও আছে।"
-"থাকুক,, আম্মা। আমার এতে কোনো সমস্যা নেই।"
-"বাবু শোন,, আমার কাছে এসে বস। আমাকে খুলে বল সব।"
-"কিছুই খুলে বলার নেই আম্মা। তোমার সাথে আমি সব ব্যাপার শেয়ার করি। তাই এখন এই ব্যাপারেও জানালাম।"
বলেই মুহিব বেড়িয়ে গেল মায়ের ঘর ছেড়ে। শাহানা বেগম বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলের গমন পথের দিকে। ছেলেটা কি পাগল টাগল হলো? কি বলছে সে এগুলো? তৃষ্ণা বিবাহিত একটা মেয়ে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুন্দর সংসার করছে। এর মাঝে তার ছেলে কি এমন ঘটিয়ে রেখে এল? একবার তৌহিদ কে কল করে দেখবে কি?
(চলবে)।
সম্পর্কের_টান
পর্ব-৫২
মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়িতে ঢুকেই অর্থিকে এক কাপ চা দিতে বলে সোফায় নিজের গা মেলে দিল তৌহিদ। আজকাল হাটা চলাফেরা করাটাও কঠিন হয়ে গিয়েছে। অল্পতেই বেশ হাপিয়ে উঠে। মাঝেমাঝে হাটুর নিচের অংশে চিরচিরে ব্যথা অনুভব হয়। যার চেয়ে হয়তো মরণ যন্ত্রণা হাজার গুণে সহজ হবে। আগে এসব উপসর্গ গুলো সামান্য আকারে দেখা দিলেও এখন তা ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে যাবে যাবে করে যাওয়াও হচ্ছে না। তবে এর ভেতর থেকেই একদিন সময় বের করে যেতে হবে এবং তা খুব অতিদ্রুত।
-"তোমার চা।"
তৃষ্ণাকে চা এনে টেবিলে রাখতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেল তৌহিদের। তীক্ষ্ণ গলায় সে জানতে চাইলো,
-"অর্থি কোথায়?"
-"তনয় কে নিয়ে নিচের ফ্লাটে গেছে। ডাকবো?"
-"না.. থাক। তুই বয়। কিছু কথা আছে।"
ভাইয়ের কথামত বসে পড়লো তৃষ্ণা। হাসি মুখে বললো,
-"কি কথা?"
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তৌহিদ বললো,
-"ডিভোর্স নিয়ে কিছু ভেবেছিস? অনেক দিনই তো হয়ে এল।"
ডিভোর্স এর কথা উঠতেই মাহসানের আজকের করা কার্যকলাপ গুলোর কথা মনে পড়ে গেল তৃষ্ণার। মাহসানের জড়িয়ে ধরার মুহূর্ত টা কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না সে। বারবার মনে পড়তেই পুরো শরীর কেঁপেকেঁপে উঠছে। মাহসানের প্রথম স্পর্শেও কি এই অনুভূতি গুলোই কাজ করেছিল?
-"কি রে?"
তৌহিদের ডাকে হুশ ফিরলো তৃষ্ণার। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হালকা হাসলো সে। মাহসানের এসব কাজকর্ম গুলো যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়ে যায় তৌহিদ তাহলে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে। যার ফলাফল যে খুন ভয়াবহ হবে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। তাই আপাতত ব্যাপারটা চেপে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো।
-"আমি এখনো ভাবি না। আর কিছুদিন সময় আমাকে দাও।"
তৃষ্ণার কথায় বিরক্ত ভঙ্গিতে তৌহিদ বললো,
-"এত ভেবে করবি টা কি! তোর কি আবার মাহসানের কাছে ফিরে যাওয়ায় কোনো মতলব আছে?"
সময় নিল না তৃষ্ণা। ছোট্ট একটা নিশ্বাস জবাব দিল,
-"না।"
-"তাহলে সময় চাচ্ছিস কেনো? এসব আইনি ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলবি, ততই তোর আর তনয়ের জন্য ভালো হবে।"
-"হু।"
-"তাহলে কি করবো... বল? কাগজপত্র কাল কোর্টে জমা দিয়ে দেই?"
-"দাও।"
আজ দাও কথা টি বলতে কোনো কষ্টবোধ হচ্ছে না তৃষ্ণার। না কোনো দ্বিধায় ভুগছে... এই কি সেই তৃষ্ণা? যে একসময় মাহসানের সাথে সংসার করবার জন্য তার সকল অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে গেছে? ভেতরে ভেতরে কষ্ট গুলো জমিয়ে রেখে রাতের পর রাত তীব্র এক যন্ত্রনা সহ্য করে গেছে? এমন কি সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য মাহসানের পা পর্যন্ত ধরতে চেয়েছে? এই কি সেই তৃষ্ণা? না... অদ্ভুত এক পরিবর্তন আজকের এই তৃষ্ণার মাঝে। সময় কত কিছুই না পালটে দেয় মানুষের জীবনে। সাথে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার জন্য তার মাঝে ধৈর্যও দান করে।
অর্থির চুল আঁচড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে তৌহিদ বললো,
-"কোথায় যাচ্ছো?"
-"ঘুমুতে।"
অর্থির কথায় অবাক হয়ে তৌহিদ জানতে চাইলো,
-"কোথায় ঘুমাবে?"
-"গেস্ট রুমে।"
-"কেনো?"
-"৩ টি কারণে। শুনতে চাও কারণ তিনটি?"
-"অবশ্যই চাই।"
-"প্রথম কারণ,, তোমাকে এত করে বলার পরও তুমি আমাকে সময় দিচ্ছ না। আগের মতই ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে চলছো। দ্বিতীয় কারণ, তোমার মা এত বড় একটা কথা আমাকে শোনানোর পরও তুমি সেখানেও আমাকেই দোষারোপ করছো। আমি এটাই বুঝছি না... আমার দোষ টা সেখানে কি ছিল? ভুলে যে ভাবি উচ্চারণ করে ফেলেছি সেটা তুমি আর না তোমার মা কেউই মানছোই না। আর তৃতীয় কারণ..."
কথার মাঝে এসেই থেমে গেল অর্থি। অপরদিকে অর্থিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাতের আংগুল কচলাতে দেখে তৌহিদ বললো,
-"আর তৃতীয় এবং প্রধান কারণ তৃষ্ণাদের ডিভোর্স। ঠিক বললাম কি?"
সে কথার জবাব না দিয়ে তৌহিদের দিকে এগিয়ে এল অর্থি। বিছানায় এক কোণে বসে গলার স্বর নামিয়ে এনে বললো,
-"তুমি প্লিজ,, ডিভোর্স এর ব্যাপারটা ভাইয়া আর ভাবির মাঝে এনো না। ডিভোর্স একটি সম্পর্কের সঠিক সমাধান নয়। একটা সম্পর্ক ভাঙ্গা কি এতোটাই সহজ?"
তৌহিদ নিজেও ঠান্ডা গলায় জবাব দিল,
-"যে সম্পর্কে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা নেই, রেসপেক্ট নেই সেসব সম্পর্কের ডিভোর্স টাই সঠিক সমাধান।"
-"তুমি কিভাবে জানলে ভাইয়া আর ভাবির মাঝে ভালোবাসা নেই?"
-"ভালোবাসা থাকলে কখনোই একজন ছেলে তার বউ কে ফেলে, ঘর সংসার ফেলে দ্বিতীয় কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াবে না।"
তৌহিদের কথায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থি থেমে থেমে বলতে লাগলো,
-"আমার ভাইয়া এমন ছিল না। একটা খারাপ মেয়ের চক্কোরে পড়ে ভাইয়া একটা ভুল করে ফেলেছে। শুধু ভুল না। অনেক বড় ভুল। যাতে আমি নিজেও কিন্তু আমার ভাইয়াকে সাপোর্ট করি নি। বাবা মা কে হারানো, দুনিয়ায় বোন থেকেও না থাকা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা, নিজেরে রক্ত নিজের ছেলেকে একটা বারও স্পর্শ করতে না পারা.... এসবের চেয়ে কঠিন শাস্তি আর দুনিয়াতে কি থাকতে পারে?"
-"নিঃসঙ্গ জীনন কাটাবে কেনো? যার জন্য তৃষ্ণাকে ছাড়লো... সেই উনি কি ছেড়ে চলে গেছে?"
তৌহিদের তাচ্ছিল্যের বাণী শুনেও জবাব দিল না অর্থি। ঐতিহ্য তাকে ফোনে সবই জানিয়েছে। মাহসানের ঐতিহ্যর বাড়িতে আসা, সব কিছু খুলে বলা, অতৈন্দ্রিলার চিট করা, শেষে মানুসিক শান্তির জন্য বোনের কাছে সাহায্য চাওয়া... কোনোটাই এখন আর অজানা নয় অর্থির। কিন্তু এখন এসব কিছুই খুলে বলা যাবে না তৌহিদ কে। সে নিজেও জানে তার ভাই খুব খারাপ কাজ করেছে... আর যার শাস্তিও পাচ্ছে, আরো পাবে। দরকার হলে তারা নিজেরাও না হয় নানান ভাবে শাস্তি দেবে। তাই বলে ডিভোর্স কেনো!
-"দেখো,, আমার মনে হয় একটাবার ভাইয়াকে সুযোগ দেয়া উচিৎ। বাবা মারা যাবার পর ভাইয়াকে গাইড করার কেউ ছিল না। যার ফলাফল কিছুদিনের মাঝেই খারাপ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা। এখন যদি আমরা একজন ভাইয়ার পাশে দাঁড়াই,, ভাইয়া কে গাইড করি, মেন্টালি সাপোর্ট দেই আমার মনে হয় ভাইয়া আবারো তার আগের লাইফে ব্যাক করতে পারবে। আর সব চেয়ে বড় কথা তনয়। তনয়ের চলার পথে বাবা মা দুজনকেই ওর দরকার। আর শুধুশুধু ভাবি একাই কেনো তনয়ের দায় দায়িত্ব পালন করবে? বাবা হিসেবে ভাইয়ারো তনয়ের উপর কিছু দায়িত্ব রয়েছে।"
সব শুনে তৌহিদ এগিয়ে এল অর্থির কাছে। আগের মতই ঠান্ডা গলায় বললো,
-"সব কথাই শুনলাম,, বুঝলাম। এখন তুমি আমাকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও। এক. একজন চরিত্রহীন বাবা সংস্পর্শে ছেলের চরিত্র কতোটা ভালো হবে? কেমন শিক্ষা একজন চরিত্রহীন বাবা তার ছেলেকে দিতে পারবে? দুই. তৃষ্ণা আবারো মাহসানের কাছে ফিরে গেলে তাদের দাম্পত্য জীবন কতটা সুখের হবে? সব ভুলে আগের মত সংসার করাটা কি আদৌ একজন মেয়ের পক্ষে সম্ভব? তুমিও তো একজন মেয়ে... তো তুমিই বলো? তিন. মাহসান তৃষ্ণার সঙ্গ পেলেই যে তার ফুর্তিবাজ ব্যাভিচার জীবন থেকে সরে আসবেই... তার গ্যারান্টি কি? আমি কোন গ্যারান্টি তে সব জেনেবুঝে চরিত্রহীন একজন ছেলের হাতে আবারো আমার বোনকে তুলে দেব?"
অর্থির উদ্দেশ্যে তৌহিদের ছোড়া প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব আছে কি অর্থির কাছে? নেই... সব গুলোর উত্তরের শেষেই একটি 'হতে পারে' এসে যুক্ত হবে। যার সবই ভবিষ্যৎ নির্ভর। জোর দিয়ে বলার মত উত্তর আপাতত নেই অর্থির কাছে। তাই আর কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। তাই চুপচাপ অর্থি বেড়িয়ে এল তাদের শোবার ঘর ছেড়ে। খানিকটা সময় এদিক সেদিক পায়চারী করার পর গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো অর্থি।
নিজের ডেস্কে হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ রেখেই তৃষ্ণা এগুলো ফাতেমার ডেস্কের দিকে। কাল মাহসানের করা কান্ডের পর মন মেজাজ খারাপ থাকায় ফাতেমার সাথে কথাই হয় নি। বসের রুম থেকে ওভাবে ফিরে কেন এলো মেয়েটা সেটা জানা খুবই জরুরী।
-"কি ব্যাপার? কি খবর তোমার?"
জবাবে হালকা হেসে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এল ফাতেমা। তৃষ্ণাকে টেনে রুমের এক কোণায় এনে বললো,
-"তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,, তৃষ্ণা। কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে না পেরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।"
ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা বললো,
-"হয়েছিল কি তখন?"
-"কিন্তু কাল স্যার রুমে ডেকে আমাকে বললো, আমার হিসেবে নাকি গড়মিল হয়েছে। তবে সামান্য,, আমাকে বুঝিয়ে দিলেই নাকি আমি ঠিক করতে পারবো। ব্যস! উনি আমার পাশে এসে বসার পর কিছুক্ষন ধরে এটাসেটা নিয়ে কথা বলার পর আচমকা আমার বুকে হাত দিয়ে বসলো। আর কিছু বুঝে উঠার আগেই..."
এটুকু বলেই থেমে গেল ফাতেমা। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ জোড়া বন্ধ করে আবারো বললো,
-"আমার বাবা নেই। তিন বোনের মাঝে পরিবারের বড় মেয়ে আমি। বাবাও বেশি একটা জমিজমা রেখে যায় নি যা দিয়ে অনায়াসে আমরা চলতে পারবো। মাও তেমন পড়াশোনা জানে না, যা দিয়ে কোনো চাকরীবাকরী করে আমাদের চালাতে পারবে। তাই তো বাবা মারা যাবার পরপরই পড়াশোনা ছেড়ে চাকরীর খোঁজে নেমে পড়ি। অনার্স শেষ না হওয়ায় কোনো চাকরী পাচ্ছিলামও না। অবশেষে এই কোম্পানির জয়েনিং লেটার পেলাম। সব ছেড়েছুড়ে উপার্জনের লক্ষে রাজশাহী ছেড়ে এলাম ঢাকায়... এই পশুদের মাঝে। কাল অফিসে লোকজন থাকার ফলে বেশি কিছু করতে না পারলেও যতোটুকুই করেছে, তাতে একজন মেয়ে হয়ে আমার কিন্তু আজ এই অফিসে আসা উচিৎ হয় নি। তাই না? কিন্তু কি করবো... তুমিই বলো? পরিবারে উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি আমিই। এখন এই জব টা ছাড়লে আমি আমার মা বোনকে কি বলবো? আর নতুন জবই বা আমাকে কে দেবে?"
সব শুনে তৃষ্ণা বললো,
-"তাহলে কি তুমি চুপচাপ এসব সহ্য করতে চাচ্ছো? কাল যা করেছে তাতে আজ যদি তুমি চুপ করে থাকো... পরশু কিন্তু তোমার সাথে এর চেয়ে বেশি খারাপও হতে পারে।"
অসহায় গলায় ফাতেমা বললো,
-"তাহলে কি করবো এখন আমি? এই পরিস্থিতিতে স্যারের বিরুদ্ধে কথা বলে আমার চাকরী ছাড়া সম্ভব না।"
কিছু সময় নিয়ে চিন্তা করার পর তৃষ্ণা বললো,
-"তোমার বাসা তো রাজশাহী... না?"
-"হ্যাঁ।"
-"রাজশাহী তে এর চেয়ে কম স্যালারীর কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তির আন্ডারে তোমার কাজের ব্যবস্থা করতে পারি... করবে?"
তৃষ্ণার কথায় চোখেমুখ উজ্জ্বল হয়ে এল ফাতেমার। বললো,
-"আমার জন্য সেটাই ভালো হয়। নিজের শহরে, নিজের বাড়িতে থেকে জব করা। তবে কোনোভাবেই পাচ্ছিলাম না। আর আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করার মতো কেউ নেই।"
-"এক মিনিট। আমি দেখছি।"
নিজের ডেস্কে এসে মুহিবের নাম্বারে কল দিল তৃষ্ণা।
-"কি ব্যাপার? কেমন আছো?"
-"ভালো.. আপনি?"
-"আছি ভালোই। দিনকাল কেমন কাটছে? তনয় ভালো আছে?"
-"সবাই ভালো আছে। আচ্ছা মুহিব ভাই.. একটা হেল্প করতে পারবেন?"
-"অবশ্যই.. একবার বলেই দেখো।"
-"আমার এক ফ্রেন্ড.. রাজশাহীতেই থাকে। কিছুদিন হলো ওর বাবাও মারা গেছে। ওই সবার বড়,, ভাইও নেই। তিন বোন ওরা। এখন এই অবস্থায় ওর একটা কাজ দরকার।"
-"পড়াশোনা কতদুর?"
-"অনার্স টা শেষ করে নি এখনো।"
-"আচ্ছা.. সমস্যা নেই। আমি দেখছি।"
-"দেখছি না.. মুহিব ভাই। করতেই হবে।"
তৃষ্ণার কথায় সামান্য হেসে মুহিব বললো,
-"আচ্ছা.. রাতে জানাচ্ছি।"
মুহিবের সাথে কথা শেষ হতেই তৃষ্ণা আবারো এল ফাতেমার কাছে। চোখেমুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-"টেনশন করো না। হয়ে যাবে। মুহিব ভাই কিছু একটার ব্যবস্থা অবশ্যই করবে।"
তৃষ্ণার কথায় আস্থা ফিরে পেয়ে ফাতেমাও তার ঠোঁটে ফুটিয়ে তুললো হাসির রেখা। বললো,
-"থ্যাংকইউ সো মাচ, তৃষ্ণা। অহো! একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। কালকের ঘটা ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু অফিসের সবাই নানান ধরনের কথা বলে বেড়াচ্ছে। এবং সেগুলো খুবই বাজে। কানে নেয়ার মত না।"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তৃষ্ণা বললো,
-"আল্লাহ মানুষকে মুখ দিয়েছে বলার জন্যই... সেখানে তারা তো বলবেই। আর বাদবাকি রইলো আমার রিয়াকশনের কথা! আমি আপাতত সেগুলো কানে নিচ্ছি না। আসলে এতটা সহ্য করে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি যে, আজ অন্যের বলা কথাগুলোও আর গায়ে লাগে না। আমি ভালো আছি... আর আপাতত এটাই আমার কাছে সব।"
রাতের খাবার শেষে ঘরে এসে বিছানা করছিল তৃষ্ণা। ঠিক সেই মুহুর্তেই মুহিবের কল এক তার ফোনে। মুহিব কি তার আস্থার মান রাখতে পারবে? একটা কাজের ব্যবস্থা কি সে করতে পেরেছে ফাতেমার জন্য? খুব বড় মুখ করে সে ফাতেমাকে বলেছে, মুহিব ভাই কিছু একটা করবে। আর বেচারি নিজেও সেই ভরসাতেও বসে আছে... কি আছে তার কপালে কে জানে! চিন্তায় জগৎ ছেড়ে না বেড়িয়েই ফোন রিসিভ করলো তৃষ্ণা।
-"পেলেন কিছু?"
-"ওরে বাবা! ফোন রিসিভ করেই এই কথা! কেমন আছি না আছি সব বাদ!"
-"অহ.. হ্যাঁ। ভালো আছেন?"
তৃষ্ণার কথায় জোর গলায় হেসে উঠলো মুহিব। বললো,
-"তোমার এই বোকাসোকা মুখটাই আমার হৃদয় ঘায়েল করে বসেছিল।"
-"কচু! বলুন না? কিছু হলো কি?"
-"হ্যাঁ.. হয়েছে। ফাতেমার সিভি সহ আদার ডকুমেন্টস গুলো আমাকে কাল পাঠিয়ে দেবে। আর সবচেয়ে ভালো হয় ফাতেমার সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিলে। তাহলে আমি ডিটেইলসে সব বলতে পারবো ওকে।"
মুহিবের কথায় আনন্দের রেখা ফুটলো তৃষ্ণার চোখেমুখে।
-"থ্যাংকইউ থ্যাংকইউ থ্যাংকইউ সো মাচ। আপনি কি জানেন.. আপনি কত্তগুলো ভালো?"
-"জানতাম না... তবে এখন জানলাম। তো এই ভালো মানুষটা যদি তোমার কাছে কিছু চায়... তাহলে পাবে?"
মুহিবের হঠাৎ এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল তৃষ্ণা। আমতা আমতা করে বললো,
-" ক.. কি চাইবেন? না মানে.. সাধ্যের মাঝে থাকলে দেয়ার চেষ্টা করবো।"
-"প্রতি রাতে খানিকটা সময় আমাকে দেয়া... আমার সাথে ফোনে খুব বেশি না,, অল্প কিছু সময় কথা বলা। এটা কি আপনার সাধ্যের মাঝে পড়ে?"
মুহিবের কথায় আতংকে জমে থাকা মুখ হাস্যজ্বল হয়ে উঠলো। হাসি মুখেই তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"আমি কিন্তু বেশি রাত জাগি না। তো ফোন দিতে চাইলে বেশি রাত করবেন না। কেমন?"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।