সম্পর্কের টান । পর্ব-৫৭+৫৮


সম্পর্কের টান

 পর্ব-৫৭+৫৮

দশ দিনের মত হাসপাতালে রাখার পর বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তৌহিদকে। আগের চেয়ে এখন অনেকটাই সুস্থ সে। ডক্টরের রুটিনমাফিক মেডিসিন চলছে, ডেইলি ৩০ মিনিটের মত সাপোর্ট দিয়ে হাটানো হচ্ছে, সাথে থ্যারাপি টাও চলছে। কথার জড়তাও এখন অনেকটা কমে এসেছে। তৌহিদের এসব উন্নতিতে যার অবদানের কথা না বললেই নয়.... সে অর্থি। সবকিছু ছেড়েছুড়ে সে লেগে পড়েছে তৌহিদের সেবায়।

তৌহিদ বসে বসে পেপার পড়ছিল। আপাতত তার সারা রাতদিন কাটে এসব করেই। কখনো এই পেপার তো কখনো ওই পেপার। কিছু নিউজ বারবার পড়তে পড়তে তো এ টু জেড মুখস্থও হয়ে গেছে। ঠিক এমন সময় হাতে খাবার প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো অর্থি। ঘড়িতে বাজছে রাত্রি নয়টা। তৌহিদের মেডিসিনের সময় হয়ে এসেছে।
-"পেপার রেখে এদিকে তাকাও। খাবার রাখলাম... খেয়ে নাও জলদি।"
তৌহিদ পেপার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অর্থির দিকে দিয়ে বললো,
-"হাতটায় কেমন যেন কোনো শক্তি পাচ্ছি না।"
-"নতুন কিছু বলো। এটা তো তোমার রোজকার ডায়লগ।"
-"আপাতত নতুন কিছু মাথায় আসছে না। দাও না একটু খাইয়ে!"
তৌহিদের বলা কথায় হেসে ফেললো অর্থি। প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে তৌহিদের মুখে তুলে দিয়ে বললো,
-"তনয় হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াতে শিখে গেছে। এই ঘরেও তো একটু আগে এসেছিল। দেখেছো?"
-"উহু.. খেয়াল করি নি।"
-"তা করবে কিভাবে! সারাদিন তো চোখের সামনে একটুকরো কাগজ ধরে রাখো।"
মৃদু হেসে তৌহিদ বললো,
-"তনয়কে খেয়াল না করলেও সেদিন কিন্তু মাহসান কে খেয়াল করেছিলাম।"
তৌহিদের কথায় বিস্মিত হয়ে গেল অর্থি। তৌহিদ সেদিন মাহসানকে তাহলে দেখেছে? অর্থি নিজেও এই ভয়েই ছিল। তবে এই কয়দিন তৌহিদ এসব নিয়ে কথা না উঠানোর ফলে অর্থি ভেবেই নিয়েছিল তৌহিদ হয়তো মাহসান কে দেখেনি। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তৌহিদ দেখেছে... এখন কি নিজের মনে চলা সব কথাগুলো সে খুলে বলবে তৌহিদকে? কিন্তু তৌহিদের এই অবস্তায় তাকে এসব কিছু বলা টা কি ঠিক হবে? না.. এই সময়টি এসব নিয়ে আলোচনা করার জন্য উপযোগী নয়।
-"তুমি কি খবর দিয়েছিলে মাহসানকে?"
তৌহিদের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল অর্থির। বললো,
-"আমি কেন বলবো? তোমার বোনের সাথে এসেছিল।"
-"তৃষ্ণার সাথে?"
-"হ্যাঁ।"
তৃষ্ণা আর মাহসানকে নিয়ে নিজেদের মাঝে আর কোনো সমস্যা চায় না অর্থি। যা হবার হবে.. তবে তৌহিদের সাথে এই ব্যাপারে আজই সব ক্লিয়ার করে নেবে।
-"তুমি আমি তো মাহসান তৃষ্ণা কে নিয়ে গুঁতোগুঁতি করতে করতে অস্থির। ওইদিকে উনারা দুইজনে ঠিকই নিজেরা নিজেদের মত করে ঘুরছে ফিরছে। সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখছে।"
-"আমার কিন্তু তেমন কিছু মনে হয় না। হয়তো আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে মাহসান এসেছিল হসপিটালে।"
-"মাহসানকে খবর দিল কে? আর ওরা দুজনই বা একসাথে আসলো কিভাবে? ওদের মাঝে যোগাযোগ আছে বলেই ওরা যোগাযোগ করে একসাথে হয়ে আসতে পেরেছে। অথবা যখন তোমার বোনকে তোমার অসুস্থতার খবর দেয়া হয়েছিল, তখন হয়তো ওরা দুজন একসাথেই ছিল।"
অর্থির কথায় চিন্তিত স্বরে তৌহিদ বললো,
-"আমার কিন্তু তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। আমরা হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলছি। তেমন কিছু থাকলে তৃষ্ণা অবশ্যই ডিভোর্সে রাজি হতো না।"
-"এক্সাক্টলি। আমারো এটাই প্রশ্ন। যদি তোর মনে মাহসানের জন্য ফিলিংস থাকেই, মাহসানের সাথে সংসার যদি তুই করতেই চাস... তাহলে শুধুশুধু ডিভোর্সের নাটক টা কেনো করলি? ওরা দুজন তো ঠিকঠাকই আছে। যা ক্ষতি হচ্ছে... সবটাই আমার হচ্ছে। আমার ভাইকে নিয়ে আমার উঠতে বসতে কথা শুনতে হচ্ছে, তা নিয়ে আমি আমার হাজবেন্ডের সাথে রাগারাগি করছি, আমার হাজবেন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সব ক্ষতি তো আমারই হলো... না?"
তৌহিদের মাথা আপাতত কাজ করছে না। অর্থির যুক্তি ফেলে দেবার মত নয়। তবে নিজের বোন তৃষ্ণার উপরেও তার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। তৃষ্ণা নিজের জীবনের এত বড় একটা ডিসিশন নেবার আগে অবশ্যই তাকে জানাবে।
-"আমি নিজেও সন্দেহ করতাম না... কিন্তু তোমার বোনের কিছু কার্যকলাপ আমাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করছে। কিছুদিন আগে রাত ২ টোর দিকে পানি খেতে উঠে দেখি ঘরে পানি নেই। গেলাম জগ পুরো করতে। আর সেদিনই আমি প্রথম খেয়াল করেছি.. তোমার বোন কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। আর শুধু একরাত নয় আমি প্রায় রাতেই খেয়াল করেছি... তোমার খারাপ লাগতে পারে ব্যাপারটা। তবে বিষয়টা চোখে লাগার মত ছিল বলেই আমার নজরে এসেছে।"
অর্থির কথার পিঠে বলার মত কোনো কথা খুঁজে পেল না তৌহিদ। চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল সে। অর্থি নিজেও আর কথা বাড়ালো না। তার মনে তৃষ্ণাকে নিয়ে যেসব অভিযোগ চলছিল, তা আজ একজনকে তো বলতে পেরেছে... এতেই অনেকটা শান্তি পাচ্ছে অর্থি। এইকদিনে সবার প্রতি এত অভিযোগ তার মনের ভেতরটায় এসে জমা হয়েছে যে, নিজেকে কেমন যেন মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল না.. অভিযোগের পাহাড় নিয়ে বুকটা প্রায় সবসময়ই ভারী হয়ে থাকতো। আজ তৌহিদকে বলতে পারায় মন অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে অর্থির।
খাবার শেষে প্লেট হাতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অর্থি। তৌহিদের হাত পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-"আমি প্লেট রেখে হাত টা ধুয়ে এসে তারপর মেডিসিন বের করে দেব। তুমি ওস্তাদি না করে চুপচাপ বসে থাকো। একটার জায়গায় দুটো খেয়ে ফেলো।"
-"আচ্ছা.. তৃষ্ণাকে একটু ডেকে দিতে পারবে?"
-"এখন?"
-"হ্যাঁ।"
-"এখন এসব নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। সময় আছে.. পরে একসময় না হয়.."
-"তোমাকে যেটা বললাম সেটা করো।"
হঠাৎ তৌহিদকে ধমকের সুরে কথা বলতে দেখে তাকে আর ঘাটলো না অর্থি। চুপচাপ বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে।

-"ভাইয়া,, ডেকেছিলে? কিছু বলবে?"
-"হ্যাঁ.. বয়।"
বিছানায় একপাশে বসতে বসতে তৃষ্ণা বললো,
-"আংগুল গুলো তো দেখছি ভালোই নাড়াতে পারছো।"
তৌহিদ সে কথায় তাল না দিয়ে বললো,
-"মাহসানের সাথে ডিভোর্সে তোর নিজের কি সম্মতি ছিল? নাকি আমার জোড়াজুড়িতে তুই মত দিয়েছিস?"
হঠাৎ মাহসানের কথা উঠতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তৃষ্ণার। কিছুটা নড়েচড়ে বসে বললো,
-"নিজের সম্মতিতেই।"
-"তাহলে তুই মাহসানকে নিয়ে দ্বিতীয়বার সংসার শুরু করতে চাস না... এই তো?"
ঢোক গিলে তৃষ্ণা বললো,
-"হ্যাঁ।"
-"তাহলে রোজ রাতে ফোনে ওর সাথে কথা বলছিস কেনো? যোগাযোগ রাখছিস কেনো ওর সাথে?"
তৌহিদের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। রোজ রাতে ফোনে কথা বলার ব্যাপারে তৌহিদ কিভাবে জানলো? আর কথা তো সে মাহসানের সাথে নয়.. মুহিবের সাথে বলে। কিন্তু একথা কিভাবে বলবে তৃষ্ণা তার ভাই কে? এটা কি আদৌ বলা সম্ভব? রোজ রাত জেগে সে তারই বন্ধুর সাথে কথা বলে... অসম্ভব! রাতের পর রাত জেগে ছেলেকে পাশে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চালিয়ে যায় এমন এক পুরুষের সাথে.. যার কিনা তার জীবনে কোনো অস্তিত্বই নেই। সে কি করছে এসব? এত নীচে সে কিভাবে নামছে? মাহসান কে ভুলতে, সে কেন আশ্রয় নিচ্ছে মুহিবের? মুহিবকে কি নিজের অজান্তেই মনে জায়গা দিয়ে দিচ্ছে না সে? হয়তোবা দিয়ে দিয়েছেও। প্রত্যেকটা মুহূর্তে সে যেভাবে মিস করে মুহিবকে, তার একটি কলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে, শাড়ি পড়ে নিজের সৌন্দর্য্য দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠে.... তাতে এইসব পাগলামোর কি নাম দেবে সে? সে যা করছে তা মোটেও ঠিক করছে না। তার যে একটা ছেলে রয়েছে সেটা কেন বারেবার ভুলে যাচ্ছে সে? মুহিবের সাথে নিজেকে এভাবে জড়িয়ে সে কি প্রমাণ করতে চাইছে? আর তার ভাইয়ের প্রশ্নেরই বা কি উত্তর দেবে সে? রাত জেগে সে মাহসানের সাথে নয়.. মুহিবের সাথে ফোনে কথা বলে। ছিঃ! শুনতেই কি বিশ্রী লাগছে! আর সে এই কাজটাই করেছে রাতের পর রাত। তার কি বুদ্ধিশক্তি দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে? এসব শুনলে তৌহিদ কি ভাববে তাকে? এতটা সাপোর্ট দিয়ে আজ এত দূরে নিয়ে আসার পর তার বোনের এসব কীর্তিকলাপ শুনে নোংরা মানসিকতা একটা মেয়ে ছাড়া আর কিইবা ভাববে তাকে? ভাইয়ের মনে এখন যে ভালোবাসা, স্নেহ নিয়ে সে রয়েছে... তখন কি এসব থাকবে?
অপরদিকে তৃষ্ণাকে চুপচাপ থাকতে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল তৌহিদ। গভীর কিছু নিশ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-"যা এখন।"

ঘরে এসেই ফোন হাতে নিয়ে আগে মুহিবের নাম্বার ব্লক লিস্টে দিল তৃষ্ণা। আর কোনো ধরনের যোগাযোগ করবে না সে মুহিবের সাথে... যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে নিয়েছে সে। মুহিবের প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। মাহসানের দেয়া কষ্ট গুলো চরম পর্যায়ে এসে পৌছেছিল, তখনই এসে মুহিব তার যত্নের দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। একটি ছেলের কাছে এতটা অবহেলা, কষ্ট পাবার পর হঠাৎ আবার ওই ছেলে জাতেরই অপর একজনের কাছ থেকে যত্ন, ভালোবাসা পেয়ে সে নিজের মন কে স্থির রাখতে পারে নি। অজান্তেই সে ধীরেধীরে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, আবেগে জড়িয়ে পড়েছে। তবে এখন আর সে কোনো ছেলে, তার ভালোবাসা যত্নে জড়িয়ে পড়বে না। নিজের পরিবার যেখানে সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তাকে সাপোর্ট দিচ্ছিল,, সেখানে সে আবারো আগের মতই দুই পয়সার আবেগে জড়িয়ে পড়েছিল। কিভাবে পারলো সে এসব করতে? একবারো কি মনে পড়লো না তার ছেলে, তার পরিবারের কথা?

রাত ২ টোর বেশি বাজে। অথচ এখনো ঘুমের কোনো নাম গন্ধ নেই মাহসানের। একাএকা এই বাড়িতে আর কতোদিন? এখন তো কিছু একটা করতেই হবে। ওদিকে ডিভোর্সের নোটিশ নিয়েও তৃষ্ণার সাথে কিছু কথা বলতে হবে। তার দিক থেকে অবজেকশন পেপার জমা দিয়েছে সে কোর্টে। তবে তা তেমন একটা কাজে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। তৃষ্ণাকে বুঝাতে হবে ডিভোর্স টি উইথড্র করবার জন্য। আপাতত এটা ছাড়া উত্তম কোনো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। খানিকটা সময় এসব নিয়ে নানান চিন্তাভাবনার পর কল দিল সে তৃষ্ণার নাম্বারে। ওপাশ থেকে প্রায় সাথেসাথেই ফোন রিসিভ করলো তৃষ্ণা। ঘুমন্ত গলায় বললো,
-"হ্যালো.."
-"ঘুমাচ্ছো?"
মাহসানের কন্ঠ শুনে ঘুম কেটে গেল তৃষ্ণার। চোখজোড়া পুরোদমে খুলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"বেআক্কেলের মত কথা কেন বলছো? আর এত রাতে কল করেছো কেনো?"
-"তৌহিদের কি অবস্থা?"
হাই তুলতে তুলতে তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"ভালো।"
-"অহ... কাল একবার দেখা করতে পারবে?"
বিরক্তি নিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"না।"
-"প্লিজ তৃষ্ণা। না হলে অফিসে চলে আসবো কিন্তু!"
-"আজব তো! আচ্ছা যাও করবো দেখা।"
তৃষ্ণার উত্তরে ঠোঁটে হাসি ফুটলো মাহসানের। বললো,
-"থ্যাংকইউ। আর একটা রিকোয়েস্ট করবো।"
-"কি?"
-"কাল একটু প্লিজ তনয়কে নিয়ে আসবে.. প্লিজ প্লিজ প্লিজ.... তৃষ্ণা। না করো না। তুমি আমার কাছে রেখে না হয় অফিস করলে।"
-"অসম্ভব! তনয় তোমাকে কখনো দেখেই নি। ও থাকবে না তোমার কাছে।"
কথাটি বলেই বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। সে কি তার নিজের স্বার্থের জন্য তার ছেলের কাছ থেকে বাবার আদর, ভালোবাসা কেড়ে নিচ্ছে না?
-"থাকবে তৃষ্ণা। তুমি একবার আনো। প্লিজ.. আমি কিছু সময় তনয়ের সাথে কাটাতে চাই, তৃষ্ণা।"
মাহসানের অসহায়মাখা গলার স্বর শুনে তৃষ্ণা বললো,
-"দেখি।"
-"দেখাদেখি না... তুমি আনবেই। আর হ্যাঁ, তোমাকে অনেকদিন হলো একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।"
-"আবার কি?"
গলার স্বর নামিয়ে আনলো মাহসান। ভারী গলায় বলতে লাগলো,
-"আমি অতৈন্দ্রিলাকে জব থেকে বের করে দিয়েছি, তৃষ্ণা। আর শুধু জব থেকে না... নিজের জীবন থেকেও।"

ফোন রাখতেই তৃষ্ণার চোখের কোণা বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অঝোর ধারায় পানি। কি হচ্ছে তার জীবনে? এ কোন খেলা শুরু করেছে বিধাতা তার জীবন নিয়ে? আর এর শেষই বা কোথায়?

     (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৫৮

সকাল সকাল উঠে আগে গোছলটা সেরে ফেললো তৃষ্ণা। আজ তনয়কে নিয়ে মাহসানের সাথে দেখা করতে যাবে সে। এই প্রথম তনয় তার বাবার সাথে কিছু সময় কাটাবে... ভাবতেই মনের ভেতর অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করছে। তনয়ও হয়তো খুবই খুশি হবে! বাবার কোলে উঠে ওর প্রথম  রিয়াকশন টা কেমন হবে? কাঁদবে? নাকি মুহিব ভাইয়ের মত খুব সহজেই আপন করে নেবে মাহসানকে? যেমনটা মুহিব ভাইয়ের কোলে উঠেই তনয় তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে আঁকড়ে ধরতো তার নাক ? মুহিব ভাইয়ের দৃষ্টি নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য  শার্ট টেনেটুনে একাকার করে ফেলতো! এমনটাই কি আজ তনয় করবে মাহসানকে কাছে পেয়ে? এসব ভাবতেই হঠাৎ মনটা হতাশায় ভরে গেল তৃষ্ণার। সব কথায় মুহিবকে বারবার কেনো টেনে আনছে সে তনয় এবং মাহসানের মাঝে? মুহিব কেউ নয়। তার জীবনে মুহিবের কোনো অস্তিত্বও নেই। সে কেনো বারবার মুহিবের কথা ভাবছে? নিজের সিদ্ধান্তে কেনো অটল থাকতে পারছে না? জোরে জোরে কিছু নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করলো তৃষ্ণা। আলমারি খুলে তনয়ের কিছু জামাকাপড় বের করে ব্যাগে ভরলো সে, যেহেতু সারাদিনের জন্য বের হচ্ছে তনয়কে নিয়ে। ব্যাগের চেইন লাগিয়ে বিছানায় রেখে আবারো এগিয়ে এল সে আলমারির দিকে। নিজের পরণের জন্য একটি কামিজ বের করে ওয়াশরুমের দিকে এগুতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো তৃষ্ণার।

-"কি ব্যাপার? এতদিন পর মনে পড়লো যে! ভুলেই তো গিয়েছিলে!"
-"তো তুমিও তো ভুলেই গিয়েছো, ভাবি। ডেইলি ঢাকায় আসো.. অথচ একটাবার আমাকে দেখতে বাসায় আসো না।"
বিছানায় আরাম করে বসতে বসতে তৃষ্ণা বললো,
-"যেতাম। আসলে অফিস থেকে বেরই হই ৫ টার দিকে। তার মাঝে আবার ভাইয়ার একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেল। সব মিলিয়ে যাই যাই করেও আর যাওয়া হয়ে উঠছিল না। তা কেমন আছো? শরীর ভালো?"
-"আছি ভালোই। একটা প্রশ্ন ছিল... করবো?"
-"অবশ্যই।"
আগে থেকেই সব কথা ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেছিল ঐতিহ্য। তৃষ্ণার অনুমতি পেতেই সে বললো,
-"তুমি ভাইয়ার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করছো? তুমি কি সব জেনে শুনেই ডিসিশন নিয়েছো?"
-"তুমি কোথাও ভুল করছো। আমি তেমন কোনো ডিসিশন নেই নি। আর.."
তৃষ্ণাকে থামিয়ে ঐতিহ্য বলতে লাগলো,
-"এক মিনিট... আমাকে আগে কথা গুলো বলে শেষ করতে দাও। তো যেটা বলছিলাম,, অতৈন্দ্রিলা.. হ্যাঁ অতৈন্দ্রিলার ভাইয়া কে চিট করা, ভাইয়ার দিশেহারা হয়ে পড়া... সব জেনে শুনেই ডিসিশন নিয়েছো তো? এখন অতৈন্দ্রিলা চিট করেছে বলে সে তোমার পিছে দৌড়াচ্ছে। দুই দিন পর আরেক অতৈন্দ্রিলা এলে সে যে আবার তার পিছনে দৌড়াবে না... সেটার গ্যারান্টি নিয়েছো তো?"
ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা বললো,
-"বুঝলাম না। পুরো ঘটনা টা খুলে বলো।"
দেরি করলো না ঐতিহ্য। ভাইয়ের প্রতি তার সামান্য শ্রদ্ধা, মর্যাদা আর না ভালোবাসা.. কোনোটাই বেঁচে নেই। নিজের এই পাথরের মত শক্ত মনের ভেতরটায় ভাইয়ের হাহাকার কোনোভাবেই তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। আর কখনো পারবেও না। যদি এসব মূল্যহীন আবেগ তার মনে স্পর্শ করে তার মনের ভেতরটায় ঢুকতে পারতো, তাহলে যেদিন তার ভাই মাহসান মেন্টালি সাপোর্ট চাইতে এসেছিল.. সেদিন তাকে অপমানিত হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে হত না। এই আবেগ জিনিসটির কারণেই সে বেড়িয়ে এসেছিল হাসিখুশিতে ভরে থাকা তার বাড়ি ছেড়ে, এই আবেগের বসেই সে তার বাবার কথার মর্যাদা না রেখে বিয়ে করেছিল নিহালকে, আর এই আবেগের ফলেই শেষমেশ সে হারিয়েছে তার বাবাকে। তাহলে এখন সে কোন আশায় আবেগের মূল্য দেবে? আবেগ জিনিসটি তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তার বাবাকে। তাহলে আবারো কেন সেই একই পথ ধরে চলবে সে? কেনো ভাইয়ের অস্থিতিশীল আবেগের মূল্য দিতে গিয়ে, একজন মেয়ের পুরো জীবনকে বাজি রাখবে? একটি মেয়ের জীবন কি এতটাই সস্তা?
ঐতিহ্যর মুখ থেকে সব শুনে স্তব্ধ হয়ে মেঝের দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তৃষ্ণা। মাহসানের অনুতপ্ত হবার কারণটা এখন বুঝতে পারছে সে। সে কতো বোকা.. না? মাহসান একবার শুধু বলেছিল, সে অতৈন্দ্রিলা কে ছেড়ে দিয়েছে। আর সে নিজে সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। মনে কোথাও মাহসানের প্রতি একটা টান অনুভব করছিল। এমন কি তনয়ের জন্য তাদের সম্পর্ককে আরেকটি চান্স দেবার কথাও ভাবছিল। কি.. ভাবছিল না? ভাবছিল..
-"ভাবি, তোমার যদি ভাইয়ার বলা অতীতের কথাগুলো মনে না থাকে... তাহলে কি আমি মনে করিয়ে দেব?"
ভারী গলায় তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"না।"
-"দ্যাটস গুড। নিহাল আমাকে যেভাবে টেককেয়ার করে, মাথায় তুলে রাখে... সেখানেই ও একদুইটা ছোট ছোট ভুল করলেই আমি চিল্লাফাল্লা করি, ডিভোর্স ডিভোর্স করে পাগল হয়ে যাই। সেখানে ভাইয়া ছোটখাটো ভুল নয়.. অনেক বড় অন্যায় করেছে। আল্লাহ না করুক,, এমন কোনো কাজ যদি নিহাল করে, আমি ওর কপালে দশ লাত্থি মেরে এই বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাব। আর যাই হোক এখন আর এসব বস্তাপচা সস্তা আবেগের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।"

ঐতিহ্য ফোন রাখতেই কলি এসে ঢুকলো তাদের শোবার ঘরে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
-"ওই বেটি আসছে। ড্রইংরুমে বসতে বলছি। আপনি নাকি উনারে আসতে বলছেন?"
-"হ্যাঁ। তোর খালু কই?"
-"একটু আগেই তো বের হইলো।"
-"আচ্ছা... তুই যা। আর শরমির কিছু লাগবে নাকি জিজ্ঞেস কর। আমি একটু পর আসবো।"

তৃষ্ণার রেজিগনেশান লেটার হাতে নিয়ে শরিফ আহমেদ ঠান্ডা গলায় বললেন,
-"হঠাৎ?"
-"পারসোনাল কিছু প্রব্লেম।"
-"আমাকে খুলে বলতে পারেন।"
হালকা নড়েচড়ে বসে তৃষ্ণা বললো,
-"আসলে আমার ভাই বলতে গেলে একদম বেডে। এতদিন আমার ছেলেকে ভাইয়ের ওয়াইফের কাছেই রেখে এসেছি, নিশ্চিন্তে কাজকর্ম করেছি। তবে এখন আর তার ভরসায় রেখে আসতে পারছি না। কারণ এখন প্রায় সবসময়ই আমার ভাইয়ের ওয়াইফের ভাইয়ের পাশেই থাকতে হয়। আর ওর বয়সও খুব বেশি নয়। একাহাতে সব দিকে সামলানো ওর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। যার কারণে আমি জব টা আপাতত করতে পারছি না।"
তৃষ্ণার কথায় অট্টহাসি হেসে শরিফ আহমেদ বললেন,
-"হাহা.. কিছুদিন আগে ফাতেমা গেল। আজ আবার তুমি!"
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শরিফ আহমেদের দিকে ছুড়ে তৃষ্ণা বললো,
-"ফাতেমার যাবার কারণ আলাদা। আমার আলাদা। দুটোকে এক করে অহেতুক হাসছেন কেনো!"
-"আচ্ছা? তা ফাতেমার যাবার কারণ কি ছিল শুনি?
-"সেটা আমার বা আপনার কারোরই অজানা নয়।"
অবাক ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো শরীফ আহমেদ। তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-"আমার জানা নেই। আমি ওর কাছে জব ছেড়ে দেবার কোনো এক্সপ্লেনেশন চাই নি। কেন জব টা ছেড়ে দিল ফাতেমা? এভাবেই ওর বুকে হাত দিয়েছিলাম বলে?"
আচমকা শরীফ আহমেদের কাজে হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। এই লোক এখন কাছে এসে এমন কোনো কাজ করবে, তা স্বপ্নেও ভাবে নি সে। সজোরে একটি ধাক্কা মেরে শরিফ আহমেদ কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিল তৃষ্ণা। শরীরে বাজে উদ্দেশ্যে অচেনা কারো স্পর্শে রাগে, ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে তার। নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো না সে। এগিয়ে গেল শরিফ আহমেদের দিকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গালে জোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে চিৎকার করে বললো,
-"তুই আমার বুকে হাত দিলি কেন? বল.. দিলি কেন? তোর বোনের বুকে গিয়ে এভাবে হাত দিতে পারবি তুই? বল? ঘরে সুন্দরী বউ রেখে এসে এভাবে বাইরের মেয়েদের দিকে বাজে নজরে তাকিয়ে কি আনন্দ পাস তোরা? কাছে পেলে তো কুকুরের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবি। তোরা ভাবিস কি মেয়েদের? কোনো পণ্য?"
ঢোক গিলে শরিফ আহমেদ বললেন,
-"ধীরে কথা বলো।"
-"কিসের ধীরে কথা বলবো! তোর লুচ্চামির খবর শুধু এই অফিস কেন তোর বাড়িতেও যাবে।"
বলতে বলতেই শরীফ আহমেদের রুম ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো তৃষ্ণা। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। যা শোনার তারা শুনে নিয়েছে। আপাতত আর এক সেকেন্ডও এই অফিসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না সে। দ্রুত পায়ে সে বের হয়ে এল অফিস ছেড়ে। একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়তেই পিছন থেকে একটি মেয়েলী কন্ঠস্বরে 'তৃষ্ণা' ডাকটি শুনতে পেল সে। পিছন ফিরে তাকাতেই চোখমুখ কুঁচকে গেল তার।
-"এই তৃষ্ণা? কোথায় যাচ্ছো? কিছু কথা ছিল তোমার সাথে। আমাকে হয়তো চিনবেনা তুমি, আমি অতৈন্দ্রিলা।"

তৃষ্ণার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেনো? এতটা দেরি তো হবার কথা নয়। তনয়কে নিয়ে বেড়িয়েছে বলে কি একটু আস্তে ধীরে বেড়িয়েছে? হতে পারে... তবে তার তো আর তর সইছে না। কখন আসবে তনয়? কখন তার নিজের এই খালি বুকটা ভরে যাবে? কখন তনয়ের পুরো মুখে সে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেবে? এসব ভেবেই রেস্টুরেন্টের সামনের রাস্তায় পায়চারী করছিল মাহসান। ঠিক তখনি আগমন ঘটলো তৃষ্ণার। মাহসানকে ইশারায় ভেতরে আসতে বলে নিজেও রেস্টুরেন্টের ভেতরে এসে ঢুকলো।

-"তনয় কোথায়?"
-"বাসায়।"
দাঁতে দাঁত চেপে মাহসান বললো,
-"তোমার ওকে সাথে নিয়ে আসবার কথা ছিল।"
-"ও আসতে চাইছিল না।"
-"সত্যিটা বলো। তুমি ইচ্ছে করেই ওকে নিয়ে আসোনি।"
-"হ্যাঁ। আনিনি।"
-"কেনো তৃষ্ণা? আর কতভাবে আমাকে শাস্তি দেবে তুমি? আমার ছেলেকে কেন আমার কাছ থেকে দুরে রাখছো তুমি?"
মাহসানের অসহায়ত্বের দিকে নজর না দিয়ে তৃষ্ণা নির্বিকারভাবে বললো,
-"অন্যায় করেছো.. শাস্তি পাচ্ছো। তোমাকে আমি শাস্তি দেবার কে?"
-"তুমি আমাকে শাস্তি দিচ্ছো না?"
-"না।"
চোখজোড়া বুঁজে জোরে কিছু নিশ্বাস ফেললো মাহসান। হাতে মুঠ পাকিয়ে তৃষ্ণার উপর রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিছুটা সময় নিল সে। তারপর বললো,
-"ক্ষমা করা যায় না আমাকে? সবকিছু ভুলে আমাদের সম্পর্ককে আরেকটি সুযোগ দেয়া যায় না?"
-"অবশ্যই যায়। ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। তুমি যদি অতৈন্দ্রিলার করা সব কাজ ভুলে তাকে ক্ষমা করে তোমাদের সম্পর্ককে আরেকটি সুযোগ দিতে পারো... তাহলে আমি কেনো পারবো না? অতৈন্দ্রিলা ও তোমাকে ছেড়ে অন্যের সাথে বেডে গিয়েছে, তুমিও আমায় ফেলে অতৈন্দ্রিলার সাথে বেডে গিয়েছো। তবে এখানে সামান্য কিছু কারেকশন আছে... অতৈন্দ্রিলা তোমার সাথে কোনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল না, কিন্তু তুমি আমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলে। সেক্ষেত্রে অতৈন্দ্রিলার দোষ কিন্তু তোমার চেয়ে অনেকটা কম। তো যে কথা বলছিলাম.. তুমি যদি সব ভুলে অতৈন্দ্রিলাকে ক্ষমা করে দাও, ওকে আরেকটিবার চান্স দাও, বিয়ে করে ফেলো ওকে,,,, তাহলে আমিও সব ভুলে তোমাকে ক্ষমা করে দেব, ফিরে যাবো তোমার কাছে। বলো, সব ভুলে দেবে অতৈন্দ্রিলাকে আরেকটি চান্স?"
তৃষ্ণার কথায় বিস্মিত চোখে মাহসান তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তৃষ্ণার মাথা কি ঠিকঠাক আছে? পাগলের মত এগুলো কিসব প্রলাপ বকছে সে?

  (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ