সম্পর্কের টান । পর্ব-২৫+২৬


সম্পর্কের টান

পর্ব-২৫+২৬

মাহসান নিজেকে কিছুতেই ধাতস্থ করতে পারছে না। তার ছোট বোন, যে কিনা ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও আগে দশবার ভাবতো,, সে আজ নিঃসংকোচে অপমানজনক কথা তাকে শুনিয়ে যাচ্ছে....
-"তোমার চেহারা দেখে কে বলবে তুমি এসব কুকর্ম বাইরে করে বেড়াও? কেউ বলবে না। নিতান্তই এক ভদ্রসুলভ লোক হিসেবে সবাই জানে তোমাকে। এই যে আমরা,, তোমার ছোট দুই বোন। আমরাও প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তুমি আর খারাপ কাজ! অসম্ভব! কিন্তু আম্মা.... সে কেন নিজের পেটের ছেলেকে নিয়ে মিথ্যে বলবে! বাবা মারা যাবার পর থেকে তুমি যা শুরু করেছো!! ছি,, ভাইয়া... তুমি কিভাবে পারলে এসব করতে! একবার মৃত বাবার কথা তোমার মনে পড়লো না? আল্লাহ খুব ভালো করেছে বাবাকে নিয়ে গিয়ে। কারণ বাবা বেঁচে থাকলে নিজ চোখে কখনওই এসব দেখতে পারতো না। এই আমি,, আজ পর্যন্ত নিজেকে দোষী হিসেবে মানি। হু,, আমার জন্যই বাবা মারা গেছে। আমাকে দেখে তোমার শিক্ষা হয় নি? তাহলে এমন কাজ তুমি আবার কেন করলে! আম্মার কথাটা কি একবার মনে পড়লো না তোমার! এসব জানলে আম্মার উপর দিয়ে কি যাবে এটা মনে হলো না তোমার! আমি নিজে এখনো স্বাভাবিক একটা লাইফ লিড করতে পারি না। সব ভুলে মন দিয়ে সংসার করতে পারি না। বারবার আমার ভেতরের সত্ত্বা আমাকে স্বরণ করে দেয়, আমার জন্যই বাবা মারা গেছে। অথচ তোমার এসব অনুশোচনা কখনো হয় নি? নির্দ্বিধায় তুমি স্বাভাবিক একটা লাইফ লিড করছো। অবশ্য স্বাভাবিক বললে ভুল হবে,, তুমি তো রাজকীয় একটা লাইফ লিড করছো! এক মেয়ে দিয়ে তোমার দিন চলে না! কি বলেছিলে তুমি ভাবিকে? মনে পড়ছে? নাকি বলে মনে করিয়ে দেব?"
এ পর্যায়ে ঐতিহ্যর দিকে এগিয়ে এসে তৃষ্ণা বললো,
-"তোমাকে এসব কে বলেছে?"
-"যেই বলুক,, সেটা আপাতত দেখার বিষয় না।"
-"এইটা কি সময় এসব কিছু আলোচনা করার? কাল আম্মা মারা গেছে... আর একদিন না যেতেই তোমরা কি শুরু করলে এগুলো!"
এবারে মুখ খুললো অর্থি,
-"এই সময়ে ভাইয়ারও উচিৎ ছিল তোমাকে সাপোর্ট দেওয়া, দিয়েছে?"
-"সেটা তোমার ভাইয়া আর আমার মাঝের ব্যাপার। তোমরা অযথা এর মাঝে নিজেদের টেনে এনে শুধুশুধু ভাই বোনের সম্পর্কটা নষ্ট করছো কেন! এর কারণেই তোমাকে আমি কিছু জানাতে চাইছিলাম না।"
-"তোমার মতো আমরা বড় আত্মার বা বড় মনমানুষিকতার মেয়ে না। না আমরা কোনো সিরিয়াল অথবা সিনেমার নায়িকা। তাই তোমার মত এত বড় মন এখনো আমাদের হয় নি। অন্যায় দেখলে চুপচাপ সহ্য করা আমার দ্বারা সম্ভব না।"
অর্থির এমন উস্কানিমূলক কথায় থেমে গেল তৃষ্ণা। কিভাবে কি রেখে কি হয়ে যাচ্ছে! সে তো এমন ঝৈ-ঝামেলা চেয়েছিল না। তাও আম্মা মারা যাবার দিনই! আর এটা চাইতেই সিরিয়ালের নায়িকা হয়ে গেল সে! অদ্ভুত সব মানুষ এই পরিবারে! বাবা মারা দিন রাতেও দুই বোনের মাঝে তুমুল ঝগড়াঝাটি চললো,, আবার আজ আম্মা মারা যাবার দিনও!! কি হবে এসব করে? মাহসান কি তাদের কথায় নাঁচতে নাঁচতে অতৈন্দ্রিলা নামের মেয়েকে ছেড়ে তার কাছে ফিরে আসবে? না,, তাহলে কি দরকার এসব নাটকের! তাও আবার এই পরিস্থিতি তে!!!

-"ঠিকই তো নিহাল ভাইয়ের সময় বললে, কেন সে বিয়ে করলো আপুকে! বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে সময় কাটালেই পাড়তো। এখন এই কথাটাই আমি তোমাকে বলছি। কেন বিয়ে করে একটা মেয়ের লাইফ নষ্ট করলে এভাবে! যদি শুধুমাত্র সেক্স এর জন্যই বিয়ে করেছিলে তাহলে তো বেশ্যাপাড়া থেকেই নিত্যনতুন একেকটা মেয়েকে আনলেই পাড়তে। শুধুশুধু সাধারণ একটা মেয়ের লাইফ এভাবে নষ্ট করার রাইট কে দিয়েছে তোমায়?"
মাহসান চুপ। মুখ দিয়ে একটা কথাও বেড়ুচ্ছে না। এভাবে বোনদের পাতা জালে ফেশে যাবে সেটা কখনওই ভাবতে পারি নি মাহসান। আজ শুধুমাত্র এই তৃষ্ণার জন্য হাটুর বয়সী বোনগুলো তাকে জ্ঞান দিচ্ছে। আর তাকে চুপচাপ তা গিলতে হচ্ছে। মনটা চাইছে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতে ওই রাসকেল টাকে। কিন্তু না,, বোনদের সামনে এসব কিছুই করা যাবে না। এমনিতেই বোনদের চোখে অনেক নিচে নেমে গিয়েছে সে!
-"তুমি যেমন স্ট্যান্ডার্ডের তেমন স্ট্যান্ডার্ডের কোনো মেয়েকেই বিয়ে করলে পারতে। সাধারণ ঘরে মেয়ে,, তোমার ভাষায় যে তোমাকে বিছানায় সুখ দিতে পারে না তাকে বিয়ে করলেই বা কেন! আর বিয়ে করেও তো থেমে থাকো নি। একমাস না যেতেই প্রেগন্যান্ট করে ফেলেছো..."
ঐতিহ্য থামতেই অর্থি শুরু করলো আবারো,
-"আর এখন প্রেগন্যান্ট বউকে দিয়ে সুবিধা করতে না পারায় বাইরে গিয়ে লুচ্চামি করে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা,, আপাতত সবই বাদ দিলাম। তৃষ্ণা ভাবি কারো বোন, কারো মেয়ে সব ভুলে গেলাম। কারণ সব সম্পর্ককে ফেলে রেখে ভাবি তোমার ভরসায় তোমার হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল তোমার বউ হয়ে। তাই আপাতত শুধু তৃষ্ণা ভাবি তোমার বউ। আর কিছুদিন পর সে তোমার বাচ্চার মা ও হবে। স্বীকার করো তো এটা?"
মাহসানকে চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্থি বললো,
-"কথা বলছো না কেন? স্বীকার করো না? অবশ্য তোমার স্বীকার দিয়ে কিছু আসবে বা যাবেও না। তো যেটা বলছিলাম,, তৃষ্ণা ভাবি তোমার বউ। আর তুমি তার স্বামী হিসেবে বিনাকারণে ভাবিকে অসম্মান করতে পারো না, তুইতোকারি করে গালিগালাজ করতে পারো না, তার সাথে বাইরের মেয়ের বেড পারফরমেন্স নিয়ে তুলনা করতে পারো না। আর না পারো এভাবে ভাবিকে ঠকাতে। সব কিছুর উর্ধ্বে ভাবি একজন মানুষ। তোমার এসব ব্যবহারে ভাবির যে কষ্ট হয় সেটা কি বোঝো না তুমি! কিভাবে এতোটা খারাপ হতে পারলে তুমি, ভাইয়া? আমার তো তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকতেও এখন ঘৃণা হচ্ছে।"
অর্থির কথায় নিজেকে সামলাতে পারলো না তৃষ্ণা। দুচোখের কোণা বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়তে লাগলো জল... কি বলবে সে অর্থি এবং ঐতিহ্য কে? এ অবস্থায় ভাইকে সাপোর্ট না করে ভাবিকে সাপোর্ট করছে, তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার হয়ে লড়ছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি থাকতে পারে তার জন্য? সত্যিই এমন ননদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এইসময়টায় এভাবে অশান্তি হোক সেটা তো তৃষ্ণা চায় না......
-"অর্থি,, প্লিজ। আজ অন্তত থাক। আজ আম্মার কথা ভেবে তোমরা প্লিজ শান্ত হও। পরে সময় নিয়ে বসে এসব আলোচনা করা যাবে। আমার আজ এসব দেখতে ভালো লাগছে না।"
তৃষ্ণার এই আদিখ্যেতা দেখানো একদম সহ্য হলো না মাহসানের। অনেক কষ্ট করেও নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না সে। তৃষ্ণার দিকে তেড়ে গিয়ে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল গালে। হঠাৎ মাহসানের এমন কাণ্ডে ঘরে থাকা সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। সবার সামনে দাঁড়িয়ে মাহসান এমন একটা কাজ করার সাহস পাবে সেটা মোটেও জানা ছিল না কারোর। দৌড়িয়ে এগিয়ে গেল অর্থি এবং ঐতিহ্য তৃষ্ণার দিকে। এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব দেখলেও এই ঘটনার পর আর চুপ করে থাকতে পারলো না নিহাল।
-"কি করছেন আপনি এগুলো? নিজের ওয়াইফের গায়ে হাত তুলছেন! তাও ভাবি প্রেগন্যান্ট। আপনি কি মানুষ! এখন যদি এই বাচ্চার এমন থেকে তেমন কিছু হয়ে যায়,, তাহলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবেন?"
দাঁতে দাঁত চেপে কড়া গলায় উত্তর দিল মাহসান,
-"তুমি এর ভেতর কথা বলতে এসো না, নিহাল। এই স্টুপিডের যদি এতোই দরদ এখন উতলে উঠছে তাহলে এসব কথা ও ছড়াইছে কেন! শালীর চেহারার সাইজ দেখ,, এমন একটা ভাব করে আছে যেন ভাজা মাছ টাও উলটে খেতে জানে না।"
-"তুমি খারাপ কাজ করলে সমস্যা নেই,, অথচ ভাবি ছড়াইলে সমস্যা? আর ভাবি এ নিয়ে কাওকেই কিছু বলেছিল না। আমি জোর করার পর ভাবি শুধু আমাকে বলেছিল। এমনকি তোমার এই বোনের সংসারে যেনো কোনো সমস্যা না হয়,, এই কারণে তৌহিদ কে পর্যন্ত কিছু যানায়নি ভাবি।"
-"তুই ওকে চিনিস না,, অর্থি। নাটক করতে এক্সপার্ট ও..."
-"আমার যতোটুকু চেনার আমি চিনেছি ভাবি কে। বরং তুমি আমার চেনার, বোঝার বাইরে। কোন সাহসে তুমি ভাবিকে থাপ্পড় টা মারলে?"
মাহসান চোখ বুজে দু হাত মুঠ পাকিয়ে বললো,
-"আমি জাস্ট ওকে নিতে পারছি না। সরা ওকে আমার সামনে থেকে। না হলে...."
-"পাগল হয়ে গেছো তুমি? ওই মেয়ে এই কয়েকটা দিনের মাঝে তোমাকে কতোটা পরিবর্তন করে ফেলেছে সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো! ডাইনী একটা মেয়ের জন্য তুমি ভাবিকে....."
-"অতৈন্দ্রিলা কে এর মাঝে টেনে আনবি না।"
-"১০০ বার টেনে আনবো। ও একটা প্রোস্টিটিউট। সব জেনেশুনেও ও কিভাবে বিবাহিত কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায়? ওর মতো মেয়েদের জন্য কতো মেয়ের ঘর ভাঙছে তার কোনো হিসেব নেই। যারা অফিসে জব করার নামে ছোট ছোট পোষাক পড়ে শরীর দেখিয়ে বেড়ায় তারা কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। বাজারী মেয়ে এগুলো। এসব মেয়ে টাকার বিনিময়ে শরীর দেখায়। কাল যখন তোমার চেয়ে বড় মাপের কোনো ক্লাইন্ট পাবে,, লাত্থি মেরে ফেলে যাবে তোমায়। আর তুমি কিনা ওই মেয়ের সাথে নিজের বউ এর তুলনা করে সংসারে অশান্তি করছো!"
-"শ্যাট আপ... অর্থি। আর কি বউ বউ করছিস! ওকে বউ আমি মানি না। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স.... আমি ওর সাথে থাকতে চাই না।"
মাহসানের এই কথায় যেনো বাজ পড়লো পুরো ঘর জুড়ে। সকলেই নিশ্চুপ। বলার মতো কেউ কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। কি হতে কি হয়ে গেল! ভাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সব ঠিক করতে চেয়েছিল অর্থি এবং ঐতিহ্য। কারণ তৃষ্ণার এই পরিস্থিতি কে মাহসানকে পাশে দরকার তৃষ্ণার। অথচ মাহসান কিনা নির্দ্বিধায় সেপারেশনের কথা বলে ফেললো!! ভাইয়ের এই রূপ এখনো ধাতস্থ করতে পারছে না অর্থি এবং ঐতিহ্য। অপরদিকে মাহসানের মুখ থেকে ডিভোর্স এর কথা শোনার পরপরই মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরাচ্ছে তৃষ্ণার। কি এমন করেছে সে যে আজ তাকে মাহসান এতো বড় শাস্তি দিতে চাচ্ছে! সে তো এই শাস্তিরর যোগ্য নয়। তাহলে কেন চুপচাপ সহ্য করবে এগুলো! মাহসানের দিকে সামান্য এগুলো তৃষ্ণা। তাতেই একদম মাহসানের শরীরের সাথে লেপ্টে গেল। দু হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে মাহসানকে। তারপর ভাঙা গলায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
-"তুমি বললেই ডিভোর্স দেবো নাকি আমি! স্বামী তুমি আমার, আমার বাচ্চার বাবা তুমি। ভালোবাসি তোমাকে আমি। আর কিছুদিন পরেই বাচ্চা হবে আমাদের। তার কিছুদিন পরেই তোমাকে বাবা বলে ডাকবে ও,, দৌড়িয়ে কোলে উঠবে। আমাদের খুব ছোট একটি পরিবার হবে। আমরা সুখি থাকবো.."
তৃষ্ণাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিল মাহসান। বললো,
-"এসব ইমোশনাল কথাবার্তা শুনিয়ে তোর দোষ ঢাকতে চাইছিস!"
-"আমি সব ভাবে তোমাকে খুশি করবার চেষ্টা করবো। যখন যা বলবে সব মানবো।"
চেঁচিয়ে উঠলো মাহসান,
-"আমার খুশি অতৈন্দ্রিলা তে। এন্ড আই ওয়ান্ট ডিভোর্স। ডিভোর্স......"
হঠাৎ পিছন থেকে একটা টান অনুভব করলো মাহসান। সাথেসাথেই মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকের উপর ধামুরধুমুর লাত্থি। অর্থি হঠাৎ এভাবে তৌহিদ কে দেখে চমকে গেল। তাড়াহুড়ো করে এগুলো তৌহিদ কে থামাতে।
-"কি করছো এসব? তৌহিদ, সরে এসো।"
তৌহিদের কোনোদিকে তাল নেই। ওর কানে শুধু মাহসানের বলা শেষ কথা বাজছে... আমার খুশি অতৈন্দ্রিলা তে, এন্ড আই ওয়ান্ট ডিভোর্স...

নিহাল গিয়ে কোনোমতে তৌহিদ কে সরিয়ে আনলো মাহসানের কাছ থেকে। মাহসান তখনো চুপচাপ মেঝের মধ্যে পড়ে রয়েছে। তৌহিদের ইচ্ছে করছে হারামজাদা টাকে গিয়ে আরো কিছু উত্তমমধ্যম দিতে। কিন্তু শরীরে কুলোচ্ছে না। পায়ে একদম জোর পাচ্ছে না। এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতেই প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে বোনের মুখের দিকেও তাকিয়ে থাকতেও পারছে না। পুরো ঘটনা সে এখনো ধাতস্থ না করতে পারলেও এতটুকু বুঝতে পেরেছে মাহসান আর তৃষ্ণার সাথে থাকতে চায় না। অতৈন্দ্রিলা নামক কোনো মেয়ের সাথে থাকতে চায়। এটা জানার পরও সে কি বোনকে এই লোকটার কাছে রেখে যাবে? অসম্ভব! পরে যা হবে দেখা যাবে। তবে আপাতত তৃষ্ণাকে এই হারামিটার আশেপাশেও রাখবে না তৌহিদ।
-"তৃষ্ণা, চল।"
ভাইয়ের কথায় মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল তৃষ্ণার। কান্না থামিয়ে সে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
-"আমি কোথাও যাবো না। ও যা বলেছে রাগের মাথায় বলেছে। আমি কোথাও যাবো না ওকে এই পরিস্থিতি তে ফেলে।"
-"তুই কি মানুষ, তৃষ্ণা?এই অমানুষ টার সাথে থাকতে চাস তুই? যে বউ কে ডিভোর্স দিতে চায় অন্য মেয়ের জন্য?"
-"ভাইয়া, ওর আম্মা মারা গেছে। ওর মাথা ঠিক নেই। ও তাই ডিভোর্সের কথা বলে ফেলেছে।"
-"এতো কৈফিয়ত তো আমি শুনতে চাই না। তুই যাচ্ছিস আমার সাথে, ব্যস।"
তৃষ্ণার কিছু বলার আগেই অর্থি বললো,
-"এতো তাড়াহুড়ো করে ডিসিশন নেয়াটা ঠিক না। ভাবি প্রেগন্যান্ট। ভাইয়ার বাচ্চা ভাবির পেটে। সব দিক ভেবে ডিসিশন নাও।"
-"তুমি আমাদের মাঝে কথা না বললেই সব চেয়ে বেশি খুশি হবো। আর নিজের বোন এবং তার বাচ্চাকে পালনের এবিলিটি আমার আছে।"
বলেই তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলো তৌহিদ। দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"কোনো ধরনের ঝামেলা আমি চাচ্ছি না। শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি। আর ঠিক সেভাবেই কাজ গুলো করতে চাচ্ছি।"
তৃষ্ণা ভাইয়ের দিকে অনুরোধের দৃষ্টিতে তাকালেও তা হৃদয় স্পর্শ করলো না তৌহিদের। তৃষ্ণেকে টেনে দরজা পর্যন্ত এনে থমকে দাঁড়ালো তৌহিদ। পিছন ফিরে অর্থির দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,
-"তোমাকে কি আলাদাভাবে বলতে হবে? নাকি আজীবন এই বাড়িতেই পড়ে থাকার ইচ্ছে তোমার?"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে পা বাড়ালো তৌহিদের দিকে।

-"ওরা এত রাতে কিভাবে যাবে নারায়ণগঞ্জ? তারপর আবার সাথে ভাবি আছে। আমি বরং তৌহিদ ভাইকে বুঝাই। আজ রাত টা ওদের আমাদের সাথে থাকতে বলি। তুমি ফ্লাটের চাবি নিয়ে চলে এসো নিচে।"
বলেই তৌহিদদের পিছুপিছু নিহালও বেড়িয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। ঐতিহ্য কিছুক্ষণ মেঝেতে পড়ে থাকা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে এল। পার্সে ফোন উঠিয়ে আবারো ফিরে এল ড্রইং রুমে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-"উঠে বসো। চলে যাচ্ছি আমি.... আর ছোট বোন হিসেবে একটা অনুরোধই করবো। এখনো সময় আছে,, নিজেকে সুধরে নাও। না হলে জীবনে এতোটাই একা হয়ে পড়বে যে পাশে দাঁড়ানোর মতো তখন কাওকে খুঁজে পাবে না।"
বলেই বের হয়ে গেল ঐতিহ্য। মাহসান কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর ধীরেধীরে উঠে বসলো। বুকে প্রচণ্ড লেগেছে,, নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। খোঁড়া একজন লোক এতোটা জোরে কিভাবে মারতে পারলো এটাই মাথায় আসছে না মাহসানের..... একাএকা এই বাড়িতে বসে এখন কি করবে সে! সেও কি চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে? না,, সে কেনো যাবে! তাও আবার ওই তৃষ্ণা বলদটার জন্য!! তাহলে পুরো রাত একা এই বাড়িতে কিভাবে কাটাবে সে! একটাবার কি কল দেবে অতৈন্দ্রিলা কে? দিয়ে আসতে বলবে বাড়িতে???

      (চলবে)

সম্পর্কের টান

 পর্ব-২৬

-"হোয়াট আ কোইন্সিডেন্স!! মাত্রই তোমার কথা ভাবছিলাম...."
-"আচ্ছা!!"
-"হুম.. একদম সত্যিইইই।"
-"কি করছিলে? একবার আসতে পারবে?"
-"আবার এখন কেনো? কাল সারাদিন রাত তো ছিলামই তোমার সাথে।"
-"আজ সারাদিন তো দেখা হয় নি।"
-"১১টার দিকই তো আমার ফ্লাট থেকে বেড়ুলে। অথচ বলছো আজ দেখা হয় নি?"
-"প্লিজ, অতৈ। চলে এসো না.. একা আছি বাড়িতে।"
-"ওহ মাই গড! তুমি তোমার বাড়িতে আমাকে আসতে বলছো!"
-"হু..."
-"তোমার বউ নেই বাড়িতে?"
-"না।"
-"বাট সরি বেবি,, এখন আর বের হবো না। অনেক টায়ার্ড।"
-"গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি..."
-"নো,, আই কান্ট... বাট আই প্রমিজ,, কাল সকালে তোমার বাসায় যাবই যাব। এনিওয়ে,, এখন রাখছি। বা বাই।"

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে কল ডিসকানেক্ট করলো মাহসান। একা এই বাড়িতে একদম ভালো লাগছে না তার। মাবাবা, বোনদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর স্মৃতি বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এই সময়টায় খুব একা বোধ করছে সে। ঐতিহ্যর শেষ কথাটি ঠিক হবার সম্ভাবনা আছে কি কোনোভাবে? না,, কখনওই না। আর কেউ না থাকলেও অতৈন্দ্রিলা তার পাশে থাকবে আজীবন। আর এতটুকু আস্থা তার আছে অতৈন্দ্রিলার উপর..... বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে বালিশে মাথা রাখলো মাহসান। হঠাৎ তৃষ্ণার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এল মাহসানের। তৃষ্ণা যেনো কি একটা তেল ব্যবহার করতো? মনে পড়ছে না... ড্রেসিং টেবিলের উপরই আছে হয়তো। একবার কি উঠে আলো জ্বালিয়ে নামটা দেখে আসবে? না থাক.. আচ্ছা,,  তৃষ্ণা যদি এখন এই বাড়িতে এই ঘরে মাহসানের পাশে থাকতো, তাহলে কি সেদিনের মত তার বুকে মাথা গুঁজতে দিত তাকে? ধীরেধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত??
অন্যপাশে ফিরলো মাহসান। সে কি সব আজেবাজে চিন্তাভাবনা করছে এগুলো? তাও আবার ওই তৃষ্ণাকে নিয়ে! তার মাথা টা কি দিনে দিনে রসাতলে যাচ্ছে নাকি! চোখ বুঝলো মাহসান। আপাতত তার ঘুমের দরকার,, গাঢ় ঘুম। এসব স্ট্রেসের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘুম ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। তবে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করলে মন্দ হতো না। গলাটা শুকিয়ে এসেছে.... চোখ না খুলেই সে ডাকলো তৃষ্ণাকে,,
-"তৃষ্ণা, তৃষ্ণা,, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিয়ে যাও তো....."

ছোটখাটো একটা ফ্লাট। দুই রুম, দুইটি ওয়াশরুম, ড্রইং রুম, খুব স্বল্প জায়গায় ভেতর ডাইনিং প্লেস, একটি কিচেন। ঐতিহ্য ফ্লাটের দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালো সব রুমে। তার সাথে অর্থিরাও এসেছে। অনেক কষ্টে তৌহিদ কে রাজি করিয়ে এখানে এনেছে নিহাল...... ঐতিহ্য এবং নিহালের শোবার ঘরে তৃষ্ণাকে নিয়ে এলো ঐতিহ্য। তৃষ্ণার রেস্ট দরকার। সেই ভোর থেকে বলতে গেলে ঝামেলার মাঝেই আছে... ঐতিহ্য ওয়াশরুমে আলো জ্বালিয়ে ফিরে এল তৃষ্ণার কাছে। মৃদু কন্ঠে বললো,
-"ফ্রেশ হয়ে এসে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো। ভালো লাগবে।"
তৃষ্ণার কোনো ভাবান্তর না দেখে আবারো বললো কথাটি ঐতিহ্য। এ পর্যায়ে হালকা মাথা নাড়ালো তৃষ্ণা। ঐতিহ্য আর কিছু না বলে এগুলো ঘরের বাইরের দিকে। দরজার কাছে এসেই পিছন ফিরে তাকালো। তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বললো,
-"একটু সাবধানে... ওয়াসরুমের জুতোটা কিন্তু একটু পিচ্ছিল।"

রান্নাঘরে এসে কাল রাতের রেখে যাওয়া আধা সিদ্ধ খাসির মাংস ফ্রিজ থেকে বের করলো ঐতিহ্য। কাল ভালোভাবে কশানো হয়েছিল না। এখন কি এই মাংস আবারো কিছুক্ষণ জ্বাল করলে খাওয়া যাবে? বেশি চিন্তাভাবনা না করে মাংসের হাড়ি চুলোয় বসিয়ে দিল ঐতিহ্য। তারপর পা বাড়ালো চালের কৌটোর দিকে। ঠিক সেসময়ই অর্থি প্রবেশ করলো রান্নাঘরে। তীক্ষ্ণ গলায় সে ডেকে উঠলো তার বোনকে,
-"আপু...?"
পিছন ফিরে উত্তর নিল ঐতিহ্য,
-"কি হয়েছে?"
-"কি করছো? আমি হেল্প করবো?"
-"ওরে বাবা! তুই করবি রান্নাঘরে হেল্প!"
মুখ কিছুটা বাকিয়ে অর্থি বললো,
-"আমি টুকিটাকি অনেক কিছু শিখেছি। মা আমাকে তৌহিদের পছন্দের প্রায় সব কিছুই শিখিয়েছে।"
-"মা মানে তৌহিদের আম্মা?"
-"হু.."
বোনের কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ঐতিহ্য। তার নিজের করা ভুলের জন্য অর্থি যে শাস্তিটা পেয়েছিল,, সেটাকে মেনে নিয়ে যে সুন্দরভাবে অর্থি জীবন গুছিয়ে নিয়েছে.. এটার চেয়ে বড় আনন্দ আর তার কাছে কিছু নেই। সে সবসময় একটা জিনিশই আল্লাহর কাছে একয়দিন চেয়ে এসেছে। তার ভুলের শাস্তি যেনো অর্থি না পায়....
-"তুই সুখী তো, অর্থি?"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-"আমার খুব খারাপ লাগছে, আপু। কাল আমি এইসময় আম্মার পাশে ছিলাম। অথচ আজ আম্মা.... একাএকা অন্ধকার ওই কবরে...."
ঐতিহ্য এগিয়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। মমতাময়ী স্পর্শ পিঠে ছুয়িয়ে বললো,
-"কাঁদবি না.. আমাকেই দেখ,, কতোটা শক্ত হয়ে গেছি। হাজার চেষ্টা করলেও চোখ দিয়ে পানি বের করতে পারি না।"
-"হু..."
-"আমার কথার তো উত্তর দিলি না... তৌহিদ ভাইয়ের সাথে সুখে আছিস তো?"
-"এতোদিন ছিলাম... তবে এখন থাকবো কিনা জানি না।"
অর্থিকে ছেড়ে দিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"এটা আবার কেমন কথা?"
-"জানি না আপু,, ভাইয়া আর ভাবির সম্পর্ক নিয়ে আমাদের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা জানি না। তবে আমি তৌহিদ কে আগেভাগেই এসব না জানিয়ে ভুল করেছি।"
চিন্তিত গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"আমি একবার কথা বলে দেখবো কি তৌহিদ ভাইয়ের সাথে?"
-"না,, থাক।"
-"তাহলে তুই নিজেই বুঝিয়ে বল উনাকে। আমি যতটুকু তৌহিদ ভাইকে চিনি,, সে হয়তো এটা নিয়ে সিনক্রিয়েট করবে না। তারপরও বলা যাচ্ছে না... বোনের ব্যাপার তো!! তবে তুই টেনশন করিস না। এদিকে এসে তরকারি টা দেখ তো..."
অর্থি ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে চুলোর দিকে এগুলো। তার আজ কেন যেনো মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে মায়ের পর স্বার্থ ছাড়া যদি কেউ ভালোবেসে থাকে,, সে হচ্ছে বোন....

বিছানার এক কোণায় চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে তৌহিদ। আজকের সন্ধ্যার ঘটানার পর তৌহিদের সাথে আর কোনো কথা হয় নি অর্থির। এমনকি রাতে খেতে বসেও চুপচাপ খেয়ে উঠেছে। তারপর এ ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। রেগে আছে কি তৌহিদ তার উপর?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের আলো নিভিয়ে তৌহিদের অপরপাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো অর্থি। অনেক কথা বলার থাকলেও বলার মতো সাহস পাচ্ছে না সে। হ্যাঁ,, সে তৌহিদ কে না জানিয়ে ভুল করেছে। তবে সে নিজেই তো জানতে পেরেছে দুই দিন হলো। আর সবচেয়ে বড় কথা, সে কোনো ঝামেলা না করে নিজের মত করেই হ্যান্ডেল করতে চেয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু তা যে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে সেটা তো আর জানা ছিল না তার.....
-"তুমি এ ঘরে এলে যে! নিহাল তাহলে কোথায় শুলো?"
তৌহিদের গলার শব্দে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অর্থি। বললো,
-"নিহাল ভাইএর জন্য ড্রইং রুমে ফ্লোরে বিছানা করেছে।"
-"আবার অযথা কষ্ট করলো কেন! এ ঘরে থাকলেই পাড়তো। তুমি তৃষ্ণা আর ঐতিহ্যর সাথে ও ঘরে থাকলেই পাড়তে।"
-"তুমি তো আমার শোবার ছিঁড়ি জানোই... হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার অবস্থা। আবার যদি ঘুমের মাঝে ভাবির লেগে যেত!"
-"সেটাও,, ভালই করেছো না শুয়ে।"
দুজনেই চুপ। অর্থির কি এখন মাহসান এবং তৃষ্ণার ব্যাপারটা নিয়ে কথা উঠানো ঠিক হবে? হলে হবে, না হলে নাই। তবে সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে নেওয়া ভালো......
-"তুমি কি আমার উপরে রেগে আছো?"
অর্থির কথায় সামান্য নড়েচড়ে উঠলো তৌহিদ। বললো,
-"না,, অযথা তোমার উপর রাগ করবো কেনো! তোমার ভাই ভুল করেছে,, তুমি বা তোমার পরিবার তো নয়।"
-"কিন্তু আমি তো জানতাম....."
অর্থিকে থামিয়ে তৌহিদ বললো,
-"বেশিদিন হলোও তো জানো না.... আপাতত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমিয়ে পড়ো।"
অর্থি সামান্য এগুলো তৌহিদের দিকে। তারপর বললো,
-"তুমি এ ব্যাপারে যে ডিসিশনই নেবে আমি তার পাশে আছি।"
-"হু..."
-"একটু কাছে আসি তোমার?"
অর্থির কথায় ঠোঁটে হাসি ফুটলো তৌহিদের। নিজেই এগিয়ে এল অর্থির দিকে। জড়িয়ে নিল নিজের বাহুডোরে।
-"আসলে সন্ধ্যায় মাথাটা ঠিক ছিল না। আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিলে?"
অর্থি তৌহিদের বুকে মুখ গুঁজে উত্তর দিল,
-"উহু..."
-"আম্মার জন্য খারাপ লাগছে?"
-"হু..."
আর কথা বাড়ালো না তৌহিদ। চোখ বুজে ঘুমিয়ের প্রস্তুতি নিল.. আদৌ ঘুমের দেখা মিলবে কিনা তা জানা নেই তার,, তবুও চেষ্টা তো চালানোই যায়...

    (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ