সম্পর্কের টান
পর্ব-২৩+২৪
-"ভাইয়া?"
তৃষ্ণার ডাকে শোয়া থেকে উঠে বসলো তৌহিদ। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"শুভ জন্মদিন...."
-"হু,, কিছু কথা ছিল।"
বিছানা ছেড়ে নেমে এসে তৃষ্ণাকে ধরলো তৌহিদ। কেমন যেনো হেলেদুলে চলছে তৃষ্ণা। মনে হচ্ছে গায়ের সব বল যেন হারিয়ে ফেলেছে। চোখটাও ফুলে লাল হয়ে রয়েছে...
-"দেখি এদিকে আয়,, বস।"
বিছানায় এক কোণায় তৃষ্ণাকে বসিয়ে তার পাশেই বসলো তৌহিদ। বললো,
-"শরীর খারাপ নাকি? এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন হঠাৎ করে তোকে!"
-"না,, ঠিক আছি। আর এমন সময় এরকম একটু আকটু হয়। মাথাটাও প্রচণ্ড ধরেছে তাই হয়তো.."
-"এরকম যে সবসময় মাথা ব্যথা করে সেটা তোর ডক্টরকে জানিয়েছিস?"
-"হু..."
-"কি বলেছে ডক্টর? ঔষধ দিয়েছে?"
-"হু..."
-"তাহলে এখন একটা খেয়ে নেয়ে। কোথায় রেখেছিস ঔষধ? অর্থিকে বল, ও এনে দিক।"
-"না থাক,, লাগবে না এখন।"
-"লাগবে।"
বলেই অর্থিকে ডাকতে ডাকতে তৌহিদ বললো,
-"মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে সেই রান্নাঘরে কি সব ঘাটাঘাটি করছে! বাইরে থেকে তো কেকটেক সব আনলামই। আবার কি বানাচ্ছে আল্লাহ জানে!"
-"অর্থিকে এসব করতে না করো, ভাইয়া। আমি কেকটেক কাটবো না।"
অবাক হয়ে তৌহিদ বললো,
-"কেনো?"
-"তোমার বোন আর বাচ্চা নেই ভাইয়া। বড় হয়ে গেছে। কিছুদিনের মাঝে তো আবার বাচ্চার মাও হয়ে যাবে।"
তৃষ্ণার কথায় মনটা আনন্দে ভরে গেল তৌহিদের। এটাই তার পিচ্চি ছোট্ট বোনটা! হঠাৎ করে এত বড় হয়ে গেল কবে!!
-"ভাইয়া,, আমি বাড়ি যেতে চাই। প্লিজ, ভাইয়া,, না করো না। অনেকদিন হলো বাবামা কে দেখি না। কষ্ট হয় বাবামার জন্য। প্লিজ, ভাইয়া। আমাকে বাবামার কাছে নিয়ে চলো।"
-"তা না হয় যাস। আর মা ও বলেছিল ৭ মাস পড়লে তোকে নিয়ে যাবার কথা।"
তৌহিদের হাত চেপে ধরে আকুলতা নিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"৭ মাস পড়ার দরকার নেই, ভাইয়া। আমি এখনি যেতে চাই। কাল তো তুমি যাবেই। সাথে আমাকে নিয়ে যাও। প্লিজ, ভাইয়া।"
চিন্তিত গলায় তৌহিদ বললো,
-"কিন্তু হঠাৎ..."
তৌহিদ কে থামিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"হঠাৎ না। তুমি মেয়েদের সমস্যা বুঝবে না। এই সময় টায় আমার মাকে খুব প্রয়োজন। আমি বাড়ি যাবো ভাইয়া। প্লিজ, নিয়ে যাও।"
-"আচ্ছা,,, হয়েছে হয়েছে। আর নাকে কাঁদতে হবে না। নিয়ে যাবো। মাহসানও কি যাচ্ছে তোর সাথে?"
মাহসানের নাম কানে যেতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল তৃষ্ণার। কোনোরকম ধীর গলায় বললো,
-"না,, ওর কাজ আছে অফিসে।"
-"আচ্ছা,, আমি মাহসানের সাথে কথা বলে নেব। যা এখন তুই রেস্ট নে। তোর শরীরের অবস্থা আমার মোটেও ভালো মনে হচ্ছে না।"
স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে তৌহিদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"হু,, যাচ্ছি।"
তৌহিদের সাথে কথা শেষ করেই তৃষ্ণা ঢুকলো তার শাশুড়ি শান্তি বেগমের ঘরে। আলো বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে শান্তি বেগম। মাঝেমাঝে কাতরিয়ে উঠে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। তৃষ্ণা সরাসরি গিয়ে পাশে বসলো শান্তি বেগমের। ভারি গলায় বললো,
-"আম্মা, কাল আমি চলে যাচ্ছি।"
শান্তি বেগম চোখ না খুলেই হাত রাখলো তৃষ্ণার হাতে। বললো,
-"কোথায় বৌমা?"
-"নারায়ণগঞ্জ।"
-"আচ্ছা,, যাও ঘুরে আসো।"
-"আপনি সময়মত মতো খাবারটা খাবেন, আম্মা। ঔষধ গুলো কখন কোনটা আমি অর্থিকে একবার দেখিয়ে দিয়ে যাবো।"
-"আচ্ছা..."
দুজনেই নিরব। দুজন দুজনকে বলার মতো হাজারো কথা থাকলেও কথাগুলো বলতে পারেছেনা কেউ। কিছুসময় চুপচাপ বসে থাকার পর তৃষ্ণা যখন উঠতে যাবে তখনই মুখ খুললো শান্তি বেগম।
-"আসলে ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি নি আমি আর তোমার শ্বশুর। যদি পারতাম তাহলে আজ হয়তো আমাদের পরিবারের দৃশ্য অন্যরকম হতো।"
বলেই ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো শান্তি বেগম। ধীরেসুস্থে উঠে বসে আবারো বললো,
-"কম পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে যা হয় আর কি! কি করবে না করবে ভেবে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে লাফালাফি শুরু করে দেয় তারা। আমার ছেলেটাও এই মাছের ব্যতিক্রম নয়।"
-"না, আম্মা। তেমন কিছু না।"
শান্তি বেগম তৃষ্ণার পিঠে হাত রেখে আদরমাখা গলায় বললো,
-"আমি বুঝি, বৌমা। বাসায় কোথায় কি হয় না হয় সবই আমার কানে আসে। তুমি যাও,, গিয়ে কিছুদিন বাপের বাড়িতে গিয়ে থেকে এসো।"
নিজেকে আর সামলাতে পারলো না তৃষ্ণা। এতোটা সময় নিজের কষ্টগুলো কে খুব কষ্টে জমিয়ে রেখেছিল বুকের ভেতরটায়। হঠাৎ শাশুড়ির মমতাময়ী স্পর্শে তা গলে বেড়িয়ে এল বাইরে। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো তৃষ্ণা। এ কান্নার যেনো আজ কোথাও শেষ নেই। এতোদিনের অবহেলা, দুঃখ-কষ্ট সব বেড়িয়ে এল এ কান্নায়। শান্তি বেগমও নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-"মানুষ করতে পারলাম না ছেলেটাকে। শুধুশুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলাম। মাফ করে দিস মা আমাকে। মাফ করে দিস।"
অর্থি ফ্রিজ থেকে কোল্ডড্রিংক্স বের করে ড্রইং রুমের দিকে আসছিল। হঠাৎ কাঁদার মতো আওয়াজ পেল। কেউ কি কাঁদছে? কান খাঁড়া করতেই অর্থি টের পেল, ব্যাকুল গলায় কেউ কাঁদছে। আর কান্নার শব্দ আসছে তারই মায়ের ঘর থেকে। আম্মা ঠিক আছে তো!! ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠলো অর্থির। তাড়াহুড়ো করে মায়ের ঘরের দিকে এগুলো সে। ঘর পুরো অন্ধকার করে রাখলেও অন্যঘর থেকে সামান্য আলো এসে পড়েছে শান্তি বেগমের ঘরে। আর সেই আবছা আলোতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তৃষ্ণা শান্তি বেগমকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল গলায় কেঁদে যাচ্ছে। অপরদিকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে শান্তি বেগম। তার চোখেও হালকা জল....... অর্থি কিছুক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। তারপর ধীর পায়ে এগুলো আবারো ড্রইং রুমের দিকে।
তৃষ্ণা শাশুড়ির ঘর থেকে বেড়িয়ে এদিকওদিক পায়চারী করতে লাগলো। ঘরে যাবার মত ইচ্ছা বা মনমানুষিকতা কোনোটাই আপাতত নেই তার। কিন্তু পুরোটা রাত এভাবে এদিকওদিক পায়চারী করেও তো কাটানো যায় না। ঐতিহ্যর ঘরটা তো ফাকাই পড়ে আছে। ও ঘরটায় যাবে কি!
-"ভাবি?"
অর্থির ডাকে পেছন ফিরে তাকালো তৃষ্ণা।
-"এভাবে হাটছো কেন! যেনো কোনো শক্তি নেই তোমার শরীরে! আর এতো হাটাহাটিরই বা কি আছে! ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেই তো পারো।"
-"হু...."
বলে তৃষ্ণা এগুলো ঐতিহ্যর ঘরের দিকে। অর্থি তৃষ্ণার গমনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ডাইনিংয়ে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢাললো। তারপর পা বাড়ালো ঐতিহ্যর ঘরের দিকে।
-"নাও,, পানিটা খাও।"
গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে পুরো এক গ্লাস পানি গিলে ফেললো তৃষ্ণা। যেনো কত যুগ হলো তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে সে!!
-"ভাবি, তোমাদের মাঝে কি কোনো বড় সমস্যা হয়েছে?"
অর্থির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তৃষ্ণা তার শরীর মেলে দিল বিছানায়। তারপর বললো,
-"যাবার আগে আলোটা নিভিয়ে দরজাটা লক করে দিয়ে যেও।"
-"আচ্ছা,, যাবো। ভাবি,, প্লিজ। কি হয়েছে আমাকে অন্তত খুলে বলো।"
-"কিছুই হয় নি।"
-"তাহলে আম্মার ঘরে তুমি ওভাবে কাঁদলে কেন?"
-"কাল নারায়ণগঞ্জ যাবো। তাই আম্মাকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে খারাপ লাগছিল। তুমি প্রেসক্রিপশন দেখে আম্মার ঔষধ গুলো ঠিক মতো দিও। বাবা মারা যাবার পর আম্মা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। খুব ভালোবাসে আম্মা বাবা কে।"
ভ্রু কুঁচকে অর্থি বললো,
-"তুমি হঠাৎ নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছো কেন!"
তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"তোমার একারই বুঝি তোমার মা কে দেখতে আসতে ইচ্ছে করে!! আমার বুঝি আমার মা কে দেখতে যেতে ইচ্ছা করে না!"
-"সেটা বলি নি। ভাবি,, প্লিজ। কি হয়েছে আমাকে বলো। লুকিয়ো না কিছু।"
-"বললাম তো কিছুই হয় নি।"
-"হয়েছে তো অবশ্যয়। আর কিছু না অনেক কিছু। ভালোভাবে তুমি কি আমাকে বলবে? নাকি আমি এমন কিছু করবো, যে কথা তুমি আমাকে জানাতে চাচ্ছিলে না সে কথা পুরো বাড়ি জানবে!!"
অর্থির কথায় উঠে বসলো তৃষ্ণা। সে যদি ভাবতে ভুল না করে তাহলে আসলেই অর্থি খারাপ কিছু ঘটাবে। দরকার কি এতো ঝামেলার! নিজের মাঝের দোষকে পুরো দুনিয়ায় জানানোর মতো সাহস তার নেই। তাই একেএকে প্রথম থেকে অর্থিকে সব খুলে বলতে লাগলো তৃষ্ণা। প্রথমে যেভাবে স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলতে শুরু করেছিল, শেষে আর নিজেকে তেমন স্বাভাবিক রাখতে পারলো না তৃষ্ণা।
অপরদিকে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেল অর্থি। সে কি ঠিকঠাক শুনছে এগুলো? তার ভাই, যাকে কিনা এতোদিন ফেরেশতার চোখে দেখে এসেছে... সে এসব করেছে!! অসম্ভব! তার ভাইকে খুব ভালো করেই চেনে সে। এমন চরিত্রহীন তার ভাই নয়। কিন্তু ভাবিই বা অযথা মিথ্যে বলবে কেন!
-"অর্থি, এসব ভাইয়াকে কিছুই বলো না। আমি চাই না আমার জন্য আমার ভাইয়ের জীবন টা খারাপ হয়ে যাক। তোমার আর ভাইয়ার সম্পর্কে আমাকে নিয়ে কোনো টান পড়ুক সেটা একজন বোন হিসেবে আমি চাই না। আর মাহসানকেই বা কেউ খারাপ চোখে দেখুক, সেটাও চাই না...."
রাতের খাবারের শেষে মায়ের ঘর থেকে ঘুরে নিজের ঘরে ঢুকলো অর্থি। তৌহিদ অর্থিকে এগিয়ে আসতে দেখে বললো,
-"এতো দেরি করলে যে!"
-"আম্মার সাথে কথা বলছিলাম।"
-"খেয়েছেন আম্মা?"
-"হু।"
-"আর তৃষ্ণা? আমাদের সাথে তো খেলো না। বারবার বললাম ডেকে আনি অথচ ডাকতে দিলে না তুমি।"
-"তখন ঘুমিয়েছিল ভাবি। তাই ডাকতে নিষেধ করেছিলাম। এটাই কি ভুল হয়ে গেলো আমার?"
হঠাৎ অর্থিকে এভাবে রেগে যেতে দেখে তৃষ্ণার প্রসংগ বাদ দিল তৌহিদ। বললো,
-"তাড়াতাড়ি এসো। ঘুমিয়ে পড়বো। কাল আবার সকাল সকাল উঠে নারায়ণগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে বেরুতে হবে।"
-"তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।"
বলেই অর্থি ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। পুরো মাথাটা একদম খালিখালি লাগছে। মায়ের মুখ থেকে নিজের কানে সব শোনার পর মাহসানকে নিজের ভাই হিসেবে মানতেও ঘৃণা লাগছে। তৃষ্ণার কথাগুলো শোনার পর কেন যেনো এগুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না অর্থির। পরের বাড়ির মেয়ে, বানিয়ে বলতেই পারে এসব আজেবাজে কথা!! সে নিজে এতোটা পাষাণ কিভাবে হতে পারলো! একজন মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের কান্না, আহাজারি তার মন ছুঁতে পারলো না! কেন সে তখন বিশ্বাস করতে পারলো না তৃষ্ণার কথা! ভাইয়ের ভালোবাসা তাকে এভাবে অন্ধ করে রেখেছিল যে, বাকি দুনিয়া ভুল আর মাহসান কে ঠিক মনে হচ্ছিল তার। অথচ তার এই ভাই মোটেও ঠিক ছিল না। সে একজন চরিত্রহীন, লম্পট, বদমাশ লোক। কিভাবে পারলো প্রেগন্যান্ট একজন মেয়েকে এভাবে নির্যাতন করতে! কিভাবে পারলো তৃষ্ণার মত সাধাসিধে একজন মেয়েকে ঠকাতে! পুরুষ জাতের নামে কলঙ্ক সে। এই স্বল্পকালের জীবনে তার ভাইয়ের মত নিকৃষ্ট কোনো মানুষ এখনো দেখেনি অর্থি। কিভাবে এসব চুপচাপ মুখ বুঝে সহ্য করছে ভাবি! সে নিজে ভাবির জায়গায় থাকলে পারতো এসব সহ্য করতে! কখনওই না। তৌহিদ অন্য একটা মেয়ের সাথে.... অসম্ভব! কল্পনাতেও ভাবতে পারবে বা সে এগুলো.. আর সেখানে বাস্তব!!!
বিছানায় এসে একপাশে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো অর্থি। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে তার। একজন মেয়ে হয়ে তৃষ্ণার কষ্টটা খুব ভালো করেই এখন উপলব্ধি করতে পারছে সে। পৃথিবীতে আল্লাহ এত নিকৃষ্ট মানুষ কেন তৈরি করে!!
তৌহিদ ধীরেধীরে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকে। অর্থির গলার ফাকে মাথা রেখে আগে চুমু দিল কয়েকটা। তারপর বললো,
-"এতো সময় ওয়াশরুমের ভেতর কি করলে? পিরিয়ড হলো নাকি? কিন্তু ডেট আসার তো আরো ৫/৬ দিন বাকিই আছে।"
-"উহু..."
-"তাহলে মনমেজাজ এত খারাপ যে! আবার দূরে দূরে থাকছো!"
-"কই! ঠিক আছি তো।"
-"তাহলে ওদিকে কি করো! এদিকে ঘোরো..."
অর্থি না ঘুরে চুপচাপ শুয়ে রইলো সেভাবেই। কিছু সময় যাবার পর তৌহিদ কোমরে হালকা চাপ দিতেই অর্থি হালকা নড়ে উঠলো। বললো,
-"প্লিজ, বিরক্ত করো না। ঘুমাও।"
-"কি হয়েছে, অর্থি?"
ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থি বললো,
-"কিছু না। কাল তোমার সাথে ভাবিও যাবে?"
-"হুম, হঠাৎ কি হলো ওর বুঝছি না। মাহসানের সাথে কথা বললাম, যে ও নারায়ণগঞ্জ যেতে চাচ্ছে। মাহসানও না করলো না,, নিয়ে যেতে বললো।"
মাহসানের কথা আসতেই মনে মনে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলো অর্থি মাহসানের। শালা লুচ্চা, হারামজাদা তো না করবেও না। এখন তো দরকার নেই ওর বৌকে। প্রেগন্যান্ট বৌকে দিয়ে তো সেক্স করে সেভাবে শান্তি পাচ্ছে না। তাই বাইরে মাগীদের সার্ভিসের জন্য রেখে নিছে। তাইলে এখন আবার কি দরকার বৌএর!!
-"মন খারাপ করো না। তৃষ্ণাকে রেখে কাজটাজ দেখে আবার বিকেলেই ফিরে আসবো।"
-"না,, আসতে হবে না।"
হঠাৎ অর্থির এমন কথায় অবাক হয়ে তৌহিদ বললো,
-"কেনো?"
-"এখন তোমার বোনের তোমাকে বেশি দরকার। এখানে বাসায় সারাদিন একা থাকে ভাবি। আম্মাও অসুস্থ। নিজের খেয়ালই ঠিকমত রাখতে পারে না। সেখানে ভাবির খেয়াল কিভাবে রাখবে! ভাবির এই অবস্থায় সেবার দরকার, মানুষিক প্রশান্তির দরকার। তুমি ভাবিকে টাইম দাও। বিকেলে সাথে করে কাছের কোনো জায়গা থেকে ঘুড়িয়ে আনো, রাতে সাথে নিয়ে খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ হাটাও, ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খাওয়াও।"
-"হু,, সেসব ঠিক আছে। কিন্তু তুমি..."
তৌহিদকে থামিয়ে তৌহিদের দিকে ঘুরে অর্থি বললো,
-"আমি আছি। হারিয়ে যাচ্ছি না কোথাও। দেখি ভালোভাবে সোজা হয়ে শোও। মাথা রাখবো বুকে।"
অর্থির এ কথায় হেসে ফেললো তৌহিদ। টেনে অর্থিকে বুকের মাঝে নিল সে।
-"আচ্ছা,, তুমি যদি আমাকে দিয়ে বিছানায় স্যাটিস্ফাইড না হও, তখন কি তুমি অন্য কোনো মেয়ে..."
কথাটা পুরো করতে দিল না তৌহিদ। ধমকের সুড়ে বললো,
-"কি সব আজেবাজে কথা বলো এসব! বসে বসে সারাদিন সিরিয়াল দেখো আর এসব মাথার ভেতর ঢোকাও। আর সেটা নিয়েই মন খারাপ করে বসে থাকো।"
-"যদি সত্যিই এমন টা কখনো ঘটে?"
-"নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। মরে গেলেও এমনটা কখনোই করবো না আমি। এতোদিনে আমার সাথে থেকে এখনো আমায় বুঝতে পারো নি?"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো তৌহিদ কে। সে জানে, তার তৌহিদ এমন কাজ করার মতো ছেলে নয়। আরো একবার অর্থি প্রমাণ পেলো,, চেহারা বা শারীরিক দূর্বলতা দিয়ে মানুষকে যাচাই করে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করা যায় না। তার ভাই মাহসান,, রূপকথার রাজপুত্রর মতো চেহারা, শরীরের গড়নও ফিটফাট। অথচ মনটা তার কতোটা জঘন্য!!
মাহসান বেড়িয়ে যাবার পর অর্থি ডাকতে গেল তৃষ্ণাকে। এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে তৃষ্ণা, যে বিছানা ছেড়ে উঠতেও পাড়ছে না। কিন্তু এখানে এভাবে চুপচাপ ফেলে রাখাও কোনো সমাধান না। তাই অর্থি ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল তৃষ্ণাকে।
সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ নেবার পর নিজেকে কিছুটা সুস্থ মনে হলো তৃষ্ণার। ধীরেধীরে হেটে সে ঢুকলো তার আর মাহসানের শোবার ঘরে। সাতমাস আগে এই ঘরে মাহসানের বউ হয়ে ঢুকেছিল সে। আজও নামমাত্র মাহসানের বউই সে। কিন্তু সেই সাতমাস আগের মত সম্পর্ক আর তাদের মাঝে নেই। সব কিছু উলটে পালটে গেছে। নিজেদের জায়গায় আর কোনো কিছুই নেই। আর আদৌ হবে কিনা তারও কোনো ঠিক নেই.... এসব ভেবে আর সময় নষ্ট না করে কিছু কাপড়চোপড়, ঔষধ, আর জরুরী কিছু জিনিশ ভরে নিল তৃষ্ণা লাগেজে।
সকাল ১০ টার মাঝেই তৌহিদের সাথে বের হয়ে এল তৃষ্ণা শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে.....
তৌহিদকে কল করা দরকার। সেই দুপুরে নারায়ণগঞ্জ পৌছবার পর একবার কথা হয়েছিল। সেটাই শেষ কথা। ভাবির কি অবস্থা, কি করছে তা শোনা উচিৎ। কিন্তু এখন কল দেবে নাকি একবারে ঘুমোনোর আগে দেবে! থাক,, একদম ঘুমানোর আগেই দেবে। তাহলে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারবে তৌহিদের সাথে। অবশ্য তৌহিদ নিজেই কিছুক্ষণের মাঝে আম্মার ফোনে কল দেবে শিউর। দিয়েই বলবে তার ফোনটা খোলার জন্য। কিন্তু অর্থি নিজেই তো ফোনটা অন করতে চাচ্ছে না। কি দরকার নিজের ইচ্ছায় অতীতকে বর্তমানে টেনে এনে! ভালো আছে তো সে তৌহিদের সাথে! কিন্তু এই কথাটায় তৌহিদকে কে বুঝবে! অবশ্য তৌহিদ ভুল কোনো কথা বলে না। এই তো ঐতিহ্য আপুকে নিয়ে প্রায়ই বলে,, কল দিতে, কথা বলতে, আগের মত সব ঠিকঠাক করে নিতে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব! বাবা মারা যাবার দিন যা নয় তাই বলেছে সে ঐতিহ্য কে। বড় বোন হিসেবে ছেড়ে কথা বলে নি। এমনকি বাড়ি ছেড়েও বেড়িয়ে যেতে বলেছে। হ্যাঁ,, সে যা করেছে রাগের মাথায় করেছে। কিন্তু মোটেও ঠিক করে নি। তৌহিদের কথাই ঠিক.. ঐতিহ্য আপু তো আর ইচ্ছে করে মেরে ফেলেনি বাবাকে। যার যখন যেভাবে মৃত্যু লেখা থাকবে, সে তখন সেভাবেই মারা যাবে। তাহলে অযথা শুধুশুধু ঐতিহ্যকে দোষ দেয়া বোকামি ছাড়া কিছু না। এই যেমন আজ মাহসানের সাথে তৃষ্ণাকে নিয়ে কিছু কথা বলবে অর্থি। তার পাশে এই সময়টায় ঐতিহ্য থাকলে মন্দ হতো না। কোনো একটা পয়েন্ট সে ভুলে গেলে ঐতিহ্য তাকে মনে করিয়ে দিত। কিন্তু সেগুলো শুধু এখন অবাস্তব কল্পনাই। একটা বার কি সে কল দেবে ঐতিহ্যকে? না থাক! আগে সে নিজেই একা কথা বলুক মাহসানের সাথে। কিন্তু এই মাহসানটাই কই! রাত ৯ টার উপরে বাজে। কতো রাতে আসবে কে জানে!!
-"অর্থি? অর্থি?"
মায়ের ডাকে সোফা ছেড়ে উঠে মায়ের ঘরের দিকে এগুলো অর্থি। মায়ের পাশে বসে বললো,
-"কিছু লাগবে?"
-"হু,,"
বলেই এলোমেলো ভাবে দু একটা কথা বলতে লাগলেন শান্তি বেগম।
-"তোর বাবা কাল রাতেও এসেছিল। আজও আসবে। দেখবি তোর বাবাকে? আজ রাতে আমার সাথে থাক। দেখতে পাবি।"
-"আম্মা, প্লিজ। আবার শুরু হয়ো না। এমনিতেই শরীর মন কিছুই ভালো নেই।"
-"হ্যাঁ, তোর শরীর কেমন আছে এটাও জিজ্ঞেস করলো তোর বাবা। বললাম, তুমি চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে সুখে আছে। বল, ঠিক বলেছি না?"
-"হু,, বলেছো।"
-"তোর বাবা আমাকে বারবার বলে তৃষ্ণার একটা ছেলে হবে। সে নিজেই নাকি নাতির মাধ্যমে ফিরে আসবে তোদের কাছে। তোর বাবা তৃষ্ণাকে খুব স্নেহ করতো রে। নিজের মেয়ে হিসেবেই দেখতো। অথচ তার এই মেয়ের কপালই আজ পুড়লো!"
বিরক্ত গলায় অর্থি বললো,
-"তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো তো, আম্মা। আমি তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসি। খেয়ে ঔষধ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।"
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে আসলো অর্থি। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে চুলোয় বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। ওদিক থেকে শান্তি বেগম ডেকেই যাচ্ছে একাধারে।
-"অর্থি,, ও অর্থি? তোর বাবা এসেছে। তাড়াতাড়ি আয়,, দেখে যা। ডাকছে তোকে।"
অর্থি মায়ের কথার তাল না দিয়ে প্লেটে ভাত বাড়তে লাগলো....
(চলবে)
""সম্পর্কের_টান""
#পর্ব-২৪
-"অর্থি,, ও অর্থি? তোর বাবা এসেছে। তাড়াতাড়ি আয়,, দেখে যা। ডাকছে তোকে।"
অর্থি মায়ের কথার তাল না দিয়ে প্লেটে ভাত বাড়তে লাগলো। দুধ টা গরম হবে কখন কে জানে! আম্মা তো আবার ঘন জ্বাল পড়া দুধ ছাড়া খায় না। এর ভেতর কি একবার গিয়ে দেখে আসবে সত্যিই কি বাবা এসেছে তার মায়ের ঘরে?? হুর.... এটা কি আদৌ সম্ভব নাকি! মায়ের কথা শুনে শুনে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি ধীরেধীরে লোপ পাচ্ছে তার....
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে দুধ টা জ্বাল করলো অর্থি। তারপর ভাতের মাঝে ঢেলে নিয়ে একদম নরম করে মাখিয়ে দিয়ে নিজের হাত ধুয়ে ফেললো সে। চিনির কৌটো খুলে পাশেই সামান্য চিনি ঢেলে সে পা বাড়ালো মায়ের ঘরের দিকে। এই টুকু সময়ের ভেতর মা একটা বার ডাকেও নি। সেই যে বাবা এসেছে বলে ডাকছিল সেটাই শেষ ডাকা। ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়লো নাকি আবার কে জানে!
ঘরে ঢুকতেই অর্থি দেখলো সে যা ভেবেছিল সেটাই। তার মা ঘুমিয়েই পড়েছে। ডাকবে কি? ভাতের প্লেট আর গ্লাস একপাশে নামিয়ে রেখে হালকা গলায় ডাকলো অর্থি,
-"আম্মা, আম্মা? ঘুমিয়ে পড়েছো?"
শান্তি বেগম এ ডাকের কোনো জবাব দিলেন না। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। দ্বিতীয়বার মাকে ডাকতে গিয়ে গলা কেপে উঠলো অর্থির। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেও তো আম্মা নিশ্বাস ফেলছে না! আম্মা কি তাহলে আর কোনোদিন তার ডাকের জবাব দেবেন না? ভাবতেই বুকটা কেপে উঠলো অর্থির। খুব ধীরগতিতে সে হাত রাখলো তার মায়ের বুকে। উহু,, বুক ওঠানামা করছে না। এরপর হাতের পালস দেখার জন্য হাত ধরতেই সে টের পেল তার মায়ের হাত টি ঠাণ্ডা বরফ হয়ে রয়েছে। এক অদ্ভুত ঠান্ডা,, এমন ঠাণ্ডাভাব সে কখনওই অনুভব করে নি। মায়ের হাত হাত থেকে নামিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো অর্থি। সে বুঝতে পারছে না এখন কি করবে সে! চিৎকার করে কাঁদবে? ছুটে বের হয়ে যাবে রাস্তায়? লোক ডাকবে? না.. আপাতত একটিও করতে ইচ্ছে করছে না তার। সে মায়ের ফোনটি খুঁজতে লাগলো। কোথায় রেখেছে আম্মা ফোনটি??
ঐতিহ্য চুলোয় রান্না বসিয়েছে। নিহাল সন্ধ্যায় ফেরার সময় খাসির মাংস এনেছে। বায়না ধরেছে আজ রাতে খাসির মাংস দিয়ে গরম ভাত খাবে। প্রথম প্রথম এই গরমের ভেতর এসব ঝামেলা করতে রাজী না হলেও পরবর্তীতে নিহালের বায়নায় কাছে হারতে হয়েছে তাকে। অবশ্য এখন তেমন একটা গরমও লাগছে না। আকাশে মেঘ ধরিয়েছে। বৃষ্টি হবে হয়তো....
-"এই ঐতিহ্য? তোমার ফোন বাজে.."
রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে উত্তর দিল ঐতিহ্য,
-"দিয়ে যাও।"
-"আমি কাজ করছি। তুমি নিয়ে যাও।"
কথাটা শোনার সাথে সাথেই মেজাজ টা চরম লেভেলের খারাপ হয়ে গেল ঐতিহ্য। এই ব্যাটার আবদার পূরণ করতেই এতো রাতে এসব রাঁধতে বসেছে সে!!
ঘরে এসে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলো ঐতিহ্য। আম্মার নাম্বার থেকে কল এসেছে। বাবা মারা যাবার দিন ওভাবে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসার পর থেকে কখনোই তার মা তাকে কল করেনি। তাহলে হঠাৎ আজ কি এমন মনে করে কল দিল? তার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়েছে নাকি কোনোভাবে!! ফোন রিসিভ করে মৃদু গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"হ্যালো,, আম্মা...."
সাথেসাথেই ওপাশ থেকে শুনতে পেল অর্থির গলার আওয়াজ।
-"আপু.......?"
আপু ডাক শোনার সাথে সাথেই বুকের ভেতর থেকে এতদিন পুষিয়ে রাখা অভিমানের পাথর টি নেমে গেল ঐতিহ্যর। এতোদিনের তীব্র এক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল শেষমেশ...
-"কেমন আছিস রে তুই? রাগ করেছিলি আমার উপর.. না?"
ধীর গলায় উত্তর দিল অর্থি,
-"উহু..."
-"তাইলে এতোদিন একটাবার কল দিস নি কেন! এতোটাই খারাপ কি তোর এই বোনটা? বল,, খুব খারাপ?"
-"উহু...."
-"এই কয়টা মাস এভাবে আমাকে ভুলে থাকতে পারলি তুই? একবারো আমার সাথে কাটানো সময় গুলোর কথা তোর মনে পড়লো না?"
-"মাফ করে দাও আমায়, আপু। আমার ওভাবে সেদিন কথা বলা উচিৎ হয় নি।"
-"আরে বোকা,, কাঁদছিস কেন? আমি তোর ওদিনের কথায় কিছুই মনে করিনি। তুই তো ভূল কিছু বলিস নি।"
-"ভুলই বলেছি.. বাবার যখন যেভাবে মৃত্যু লেখা ছিল সেভাবেই হয়েছে। শুধুশুধু সেদিন না বুঝে যা নয় তাই বলেছি। প্লিজ, আপু আমাকে মাফ করে দাও..."
-"আমি কিছুই মনে করিনি... বাদ দে এসব কথা। তুই কোথায়? কেমন আছিস? আর আম্মার নাম্বার দিয়ে কল দিলি যে!"
মায়ের কথা উঠতেই হুশ ফিরলো অর্থির। সে কি বলতে কল করেছিল,, আর কি বলছে!!
-"হ্যাঁ,, আপু। আ.. আম্মা আর নেই।"
বলেই ব্যাকুল স্বরে কাঁদতে শুরু করলো অর্থি। ঐতিহ্য কিছু সময় নিল সব কিছু বুঝে উঠার। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
-"ইন্নালিল্লাহ... কখন কিভাবে? আর কোথায় তোরা?"
-"বাসায়, আপু। প্লিজ, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। এখনি আসো, আপু। আম্মাকে এভাবে একা নিয়ে থাকতে ভয় লাগছে।"
হতভম্ব হয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"একা মানে? ভাইয়া ভাবি কোথায়?"
-"নেই,, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।"
-"হু,, আমি আসছি। তুই একদম ভয় করিস না। পারলে নিচ তলার ভাড়াটিয়া দের কাওকে ডাক।"
-"তুমি তাড়াতাড়ি আসো, আপু।"
ফোন কেটে দিয়ে আর একসেকেন্ড দেরি করলো না ঐতিহ্য। চুলো বন্ধ করে দিয়ে নিহালের সামনে এসে বললো,
-"ওঠো, তাড়াতাড়ি। গুলশান যেতে হবে। আম্মা মারা গেছে। বাসায় কেউ নেই অর্থি ছাড়া। ও খুব ভয় পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।"
ঐতিহ্যর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল নিহাল। কি সব বলছে ঐতিহ্য?
-"উঠছো না কেনো? তুমি কি যাবে না আমার সাথে?"
-"যাবো..... কে কল করেছিল?"
ঐতিহ্য বিরক্ত গলায় জবাব দিল,
-"যার ইচ্ছে সে কল করেছিল.. তোমাকে এখন বলতে আমার হবে কে কল করেছিল! আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? আমার নিজের আম্মার মৃত্যুর খবর নিয়ে মজা করবো আমি!!"
ঝাড়ি খেয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলো না নিহাল। যে অবস্থায় ছিল দুজন সেই অবস্থায়ই বেড়িয়ে পড়লো গুলশান ২ এর উদ্দেশ্যে।
সারারাতে মাহসানের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। ফোনটাও বন্ধ। হয়তো অতৈন্দ্রিলা নামের মেয়েটার সাথে এক অপবিত্র খেলায় মেতে আছে। তাই আর রাতে শান্তি বেগমকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিল না অর্থিরা। দুই বোন মিলে সারারাত মায়ের পাশে বসে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো মায়ের। মাঝে সামান্য মাহসান এবং তৃষ্ণার ব্যাপার নিয়েও হালকা আলোচনা হয়ে গেল অর্থি এবং ঐতিহ্যর মাঝে।
খুব ভোরের ট্রেনে তৃষ্ণাকে নিয়ে তৌহিদ রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাতে শাশুড়ি মারা যাবার খবর পেলেও তৃষ্ণার এই অবস্থা নিয়ে রাতেই রওনা হবার সাহস পাচ্ছিল না তৌহিদ। ওদিক থেকে অর্থিও নিষেধ করছিল। তাই ভোরের অপেক্ষাতেই পুরো রাত নির্ঘুমে কাটিয়ে ভোর হবার সাথে সাথেই তৃষ্ণাকে নিয়ে রওনা হলো তৌহিদ। সিটে বসেই বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
-"কাঁদছিস কেন! আল্লাহর জিনিশ আল্লাহ নিয়ে গেছে। কেঁদে কেঁটে কি লাভ?"
-"লাভ লোকসান হিসেব করে কেউ কাঁদে না, ভাইয়া।"
-"তারপরও কাঁদবি না। কান্নাকাটি করে নিজের শরীর খারাপ করার কোনো মানে আছে!"
-"তুমি বুঝবে না। আম্মা আমার কাছে কি ছিল আমি জানি.... কেন আমি কাল আসতে গেলাম! আমি না আসলে বোধহয় আম্মার কিছু হতো না।"
-"বোকার মত কথা বলছিস কেন! তোর আশা যাওয়ার সাথে মারা যাবার কি সম্পর্ক! পৃথিবী টা দিনেদিনে কুসংস্কারে ভরে যাচ্ছে।"
তৌহিদের কথার পিঠে কোনো কথা বললো না তৃষ্ণা। পুরো রাস্তা নিরবে অঝোর ধারায় চোখের জল ফেললো সে।
দুপুর ১২ টার দিক বাসায় ফিরলো মাহসান। বাসার সামনে এত ভিড় দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। গাড়ি থেকে নেমে উপরে উঠতে যাবে এমন সময় এক ভাড়াটে এসে বললো,
-"আরে ভাই! কোথায় ছিলেন আপনি?"
মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে মাহসান জবাব দিল,
-"আপনাকে বলতে হবে!"
মাহসানের উত্তরে কিছুটা লজ্জিত বোধ করলো লোকটি। হালকা কেশে বললো,
-"আমাকে বলতে হবে তেমন কিছু বলি নি। আপনার মা কাল রাতে মারা গেছে। অথচ আপনার কোনো খোঁজখবর নেই। আপনার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যোহরের নামাযের পর মাটি ঠিক করেছে। তাই বলছিলাম....."
লোকটির কথা শুনে আর দেরি করলো না মাহসান। দৌড়িয়ে উঠে গেল দোতালায়...
যোহরের নামায শেষে মাটি হয়ে গেল শান্তি বেগমের। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন পরিবার ছেড়ে চিরকালের মতো সেও বিদায় নিল স্বার্থপর এই পৃথিবী ছেড়ে। তাকে ধোয়ানো থেকে শুরু করে মাটি পর্যন্ত সব দিকের দায় দায়িত্ব পালন করলো তৌহিদ।
বিকেলের মাঝে সব আত্মীয় স্বজন যে যার মত চলে গেল। মহসিন চৌধুরী এবং শান্তি বেগমের একসময়কার এই সুখের নীড়ে শুধু রয়ে গেল তার ছেলেমেয়েরা। নিহাল এবং তৌহিদ মাগরিবের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হতেই ঐতিহ্য ঢুকলো তার ভাই মাহসানের ঘরে। মাহসান এই ভরা সন্ধ্যায় ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। ঘুমিয়েছে কি?
-"ভাইয়া,, ঘুমিয়েছো?"
চোখ খুলে উঠে বসলো মাহসান। বললো,
-"না,, আয়।"
-"নামাযে গেলে না?"
-"না।"
-"অন্যদিন নাই বা পড়লে। আজ তো আম্মার খাতিরে নামাযে যেতে পারতে।"
ওপাশ থেকে মাহসানের সাড়া না পেয়ে ঘরের আলো জ্বালালো ঐতিহ্য। তারপর ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলো।
-"কিছু কথা ছিল..."
-"বল।"
নিজের মনকে সাহস যুগিয়ে ঐতিহ্য তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-"আমি আর নিহালের সাথে থাকতে চাই না।"
ঐতিহ্যর এ কথায় হতবাক হয়ে মাহসান বললো,
-"কেন! কি সমস্যা?"
-"অনেক সমস্যা।"
-"আমাকে খুলে বল। কিছু করেছে নিহাল?"
-"ও একটা ক্যারেকটারলেস ছেলে, ভাইয়া। ওর মতো বাজে স্বভাবের ছেলের সাথে আমি সারাজীবন কাটাতে পারবো না। ওর আমাকে ছাড়াও বাইরে হাজার টা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপ আছে। আমি নিজে চোখে ওকে বাজেবাজে সব মেয়েদের সাথে দেখেছি।"
-"কি সব বলছিস এগুলো! নিহালকে দেখে, ওর সাথে কথাবার্তা বলে তো এসবের কিছুই বোঝা যায় না। তুই কি ঠিকঠাক জেনে বলছিস?"
-"হু... আমি নিজ চোখে দেখেছি।"
বোনের কথায় নিজেকে আর সামলাতে পারলো না মাহসান। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-"কেন! নিজে ওর হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলি না! তাহলে আজ আমাকে এসব বলতে আসছিস কেন! পালানোর সময় এসব মনে ছিল না! এখন যা হবে নিজে সামলা। হারামজাদা নিহালের বাচ্চা নিহাল। ওরে দেখেই আমার ক্যারেকটারলেস মনে হইছে। ক্যারেকটারলেস না হলে কোনো শিক্ষক ছাত্রীর সাথে প্রেম করতে পারে! পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারে! ওই কুত্তার বাচ্চা কই রে! ওরে যদি আজ আমি ওর জায়গা না দেখাই দিছি আমার নাম মাহসান না। শালার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার বোনের সাথে বাটপারি করে! কোথায় ওই কুত্তার বাচ্চা?"
বলতে বলতেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল মাহসান। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ঐতিহ্যও পিছু নিল তার ভাইয়ের।
নিহাল এবং তৌহিদ মসজিদ থেকে বের হতেই তৌহিদ বললো,
-"আপনি বাসার দিকে এগোন। আমি দেখি হালকা নাস্তা টাস্তা নিয়ে আসি।"
-"চলুন,, একসাথেই যাই।"
-"আমার সামান্য কাজও ছিল। আপনি যান,, আমি আসছি।"
আর কথা বাড়ালো না নিহাল। মৃদু হেসে রওনা দিল বাড়ির দিকে।
বাসায় ঢোকার সাথেসাথেই মাহসান এসে সরাসরি পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো নিহালের। পরিস্থিতি কিছু বুঝে উঠবার আগেই নিহালের গালে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল মাহসান।
-"শুয়ারের বাচ্চা। ঘরে বউ রেখে বাইরে বেশ্যা দরকার পড়ে তোর? তাইলে বিয়ে করছিলি কেন! বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে নিজের শরীরের ঝাঁজ মেটাইতে পারিস নাই? আমার বোনের সাথে চিটারী করিস তুই? চিনোস আমারে? তোর কি হাল করতে পারি আমি সে সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? ছোটলোকের বাচ্চা ছোটলোক। আমার বোনকে কষ্ট দিছোস তুই! বান্দির পো আমার বোনরে কষ্ট দিছোস!"
অর্থির ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল তৃষ্ণা। হঠাৎ মাহসানের চেঁচামেচি শুনে বেড়িয়ে এল ঘর ছেড়ে। ড্রইং রুমে এসে অবাক হয়ে গেল সে। মাহসান ঐতিহ্যর হাজবেন্ডের কলার ধরে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করছে। পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই কান্ড দেখছে ঐতিহ্য এবং অর্থি। কি হচ্ছে এসব!! এগিয়ে গিয়ে মাহসান কাঁধে হাত রেখে তৃষ্ণা বললো,
-"কি করছো এসব! ছাড়ো ওকে! এভাবে গালিগালাজ করছো কেন!"
মাহসান তৃষ্ণার হাত কাঁধ ছেড়ে নামিয়ে দিয়ে বললো,
-"তুই সর এখান থেকে। তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমার!"
তৃষ্ণার সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে এবারে মুখ খুললো ঐতিহ্য। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-"ছাড়ো ওকে,, ভাইয়া।"
-"ওকে ছাড়বো কি! ওকে আজ বুঝাই দিব কি ভুল টা করেছে ও!"
ভাইয়ের কথায় উঁচু গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"ছাড়তে বলেছি ছাড়ো। আর তুমি কি বুঝাবে ওরে! তুমি নিজেই তো একটা ক্যারেকটারলেস। ঘরে বউ রেখে বাইরে শরীরের ঝাঁজ মেটাও। প্রেগন্যান্ট বউকে এই সময়টায় সাপোর্ট না করে বাজে ব্যবহার করো তার সাথে। মাত্রই তো তার নমুনা দেখলাম।"
বোনের এমন কথায় হতভম্ব হয়ে নিহালকে ছেড়ে দিল মাহসান। ওদিক থেকে ঐতিহ্য বলার উপরেই আছে....
-"নিহাল এমন ধরনের ছেলে নয়। নিহালের সাথে সারাজীবন কেন, মরনের পরও আমি ওর সাথে থাকতে চাই। এতোক্ষণ তোমাকে মিথ্যা বলেছি। শুধুমাত্র এটাই বোঝানোর জন্য,,,,, নিজের বোন বোন আর অন্যের বোন কারো বোন নয়? নিজের বোন মেয়ে আর অন্যের বোন কারো মেয়ে নয়? নিজের বোন মানুষ আর অন্যের বোন মানুষ নয়? নিজের বোনের কষ্ট আছে আর অন্যের বোনের কষ্ট নেই? নিজের বোনের বেলায় ঠিকই ষোলো আনা অথচ অন্যের বোনের বেলায় এক আনা!! তুমি ভুলে গেলে আবারো তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, তৃষ্ণা ভাবিও কারোর বোন।"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।