সম্পর্কের টান
পর্ব-২৭+২৮
রাত ১২ টার উপরে বাজে। অথচ এখনো ঘুমের কোনো নাম গন্ধ নেই। প্রচণ্ড রকমের মাথা ধরেছে। এক কাপ চা খেলে হয়তো মাথা ব্যথা কিছুটা হলেও কমতো। কিন্তু এতো রাতে চা খেলে পুরো রাতটাই জেগে কাটাতে হবে। তারউপরে পাশে আজ নিহালও নেই। নিহাল ড্রইং রুমে বিছানা করে সেখানে শুয়েছে। হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে... চোখ চেপে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করলো ঐতিহ্য। না,, ঘুম আজ আসছেই না কোনোভাবে। মাথার যন্ত্রণাটাও তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে এককাপ চা খেতেই হবে,, শুধু চা দিয়েও হবে না। সাথে একটা প্যারাসিটামলও নিতে হবে... ঐতিহ্যর পাশেই ঘুমিয়ে রয়েছে তৃষ্ণা। সারাদিনের ধকল সামলে মেয়েটা একদম নির্জীব হয়ে পড়েছে। তাই হয়তো বিছানায় শরীর মেলে দেয়ার সাথসাথেই সব ভুলে ঘুমে তলিয়ে গেছে। গভীর নিশ্বাস পড়ছে মাঝেমাঝে। সাথে ড্রিমলাইটের হালকা আলোতে তাকে দেখতে কি মায়াবীই না লাগছে! আচ্ছা! তৃষ্ণার এই মায়াবী চেহারা দেখে কি একদম কষ্ট হয় না মাহসানের? নিজের কর্মের জন্য কখনো খারাপ লাগে না তার? বিনা কারণে মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিতে বাধে না? না... হয়তো মাহসানের নজরে কখনো তৃষ্ণার এই মায়াবী রূপটি ধরাই পড়েনি। কারণ, তৃষ্ণার এই অসহায় মায়াবী চেহারা উপেক্ষা করার শক্তি কোনো মানুষের থাকার কথা নয়। অবশ্য ইদানীং যে কাজগুলো মাহসান করছে, তাতে তাকে মানুষ হিসেবে ভাবাও যায় না। আবার পশু ডাকলেও ভুল হবে না.... দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরেসুস্থে বিছানা ছেড়ে নামলো ঐতিহ্য। তারপর এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
চুলোতে চায়ের পানি দিয়ে চুলে হাত দিল ঐতিহ্য। শোবার আগে হাত খোঁপা করেছিল। যা বিছানা ছেড়ে উঠার সাথেসাথেই খুলে পিঠ ভরে লেপ্টে রয়েছে। এই গরমে আজকাল চুলগুলোর উপর প্রচন্ড রকমের বিরক্ত সে। এতো লম্বা চুল অযথা নিজের সাথে বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে আছে! এর আগে দুইবার চুলগুলো কেটে ছোট করতে চাইলেও নিহাল তা করতে দেয় নি। তার মতে, মেয়েদের আসল সৌন্দর্যই হলো তাদের চুল। আর সেই চুল যদি হয় কোঁকড়ানো হাটু সমান তাহলে তো কথাই নেই। সে নারীরই নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর খেতাব পাওয়া উচিৎ... ভাবতেই মুখ টিপে কিছুক্ষণ হাসলো ঐতিহ্য। মাঝেমাঝে নিহাল এমন সব কথা বলে, যা শুনে না হেসে থাকা যায় না।
-"ঘুমোও নি?"
বলতে বলতেই পেছন থেকে এসে ঐতিহ্যকে জড়িয়ে ধরলো নিহাল। কোমড়ে দু হাত চেপে ঐতিহ্যর কাঁধে থুঁতনি রেখে বললো,
-"আমাকে ছাড়া ঘুম আসছে না... তাই না?"
-"জ্বি না,, মোটেও সেটা না।"
-"তাহলে কোনটা?"
-"যেটাই হোক,, তোমাকে বলবো কেন! আর তুমিই বা ঘুমাও নি কেন!"
-"আমি আবার তোমার মত মিথ্যে বলতে পারি না... তাই সত্যিটাই বলছি। ঘুম আসছে না তোমাকে ছাড়া।"
ঐতিহ্য কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললো,
-"চা খাবে?"
-"খাওয়াই যায়।"
-"তাহলে ছাড়ো আমাকে। আর ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করো... আনছি আমি।"
-"একসাথেই যাই..."
মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"বড্ড জালাতন করো তুমি।"
ঐতিহ্যর কথায় গা দুলিয়ে কিছুক্ষণ হাসলো নিহাল। যেনো দুনিয়ার সবচেয়ে হাসির কথা মাত্র ঐতিহ্য শুনিয়েছে তাকে.... ঐতিহ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আরেকটি কাপে চা ঢালতে লাগলো।
-"আচ্ছা, ঐতি?"
-"হু?"
-"আজ সন্ধ্যায় তুমি কি বলেছিলে তোমার ভাইকে.... মনে পড়ে?"
ভ্রু কুঁচকে ঐতিহ্য জবাব দিল,
-"আপাতত পড়ছে না।"
-"বলেছিলে তুমি সারাজীবন কেন মরণের পরেও আমার সাথে থাকতে চাও..."
-"তো?"
ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে নিহাল বললো,
-"তো এসব নাটকের আর দরকার নেই। সবসময় এমন একটা ভাব নিয়ে চলো, যেনো আমার উপর প্রচণ্ড রকমের বিরক্ত তুমি। অথচ এই আমার সাথে পরকালেও থাকতে চাইছো.. কেন? বলো তো?"
নিজেকে নিহালের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিহালের দিকে ফিরলো ঐতিহ্য। একটি কাপ নিহালের দিকে এগিয়ে ধরে বললো,
-"তখন যা বলেছি,, বলেছি। ওটা ধরে বসে না থেকে চায়ের কাপ টা ধরো। নাও..."
হঠাৎ কোথাও থেকে কোঁকানোর আউয়াজ কানে এল তাদের। দুজনই প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো দুজনের দিকে। ধীরেধীরে গোঙানোর শব্দ স্পষ্ট হয়ে আসতে শুরু করলো তাদের কানে। শব্দটা ভেসে আসছে তাদেরই শোবার ঘর থেকে। ঘরে তো তৃষ্ণা ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। তাহলে তৃষ্ণার কি কিছু হলো? ভাবতেই বুকটা কেপে উঠলো ঐতিহ্যর। চোখেমুখে আতংক নিয়ে চায়ের কাপ রেখে সে পা বাড়ালো তাদের শোবার ঘরের দিকে। নিহালও পিছু নিল তার।
তৃষ্ণা ধীরেধীরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে.... মুখ তার আতঙ্কে ভরে আছে। নিচ থেকে তৌহিদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তৃষ্ণাকে আকাশে উড়তে। কিছু বলতে গিয়েও বলছে না সে। একমাত্র বোন তার তৃষ্ণা, ছোট থেকেই অসম্ভব আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে বাবামা তাকে। তবে ছোট থেকেই একটা শখ তার অপূর্ণ রয়ে গেছে। সে কেন পাখিদের মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে না? পাখি আর তার মাঝে কি অনেক তফাৎ! তৃষ্ণার সেই আশা আজ পূর্ণ হচ্ছে। তৃষ্ণাও পাখিদের মত আজ আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখতে কি সুন্দরইনা লাগছে তৃষ্ণাকে! কোনো অংশে রূপকথার পরীদের চেয়ে কম লাগছে না। আচ্ছা সে কি কখনো পরী দেখেছে? না... তাহলে তৃষ্ণার সাথে কিভাবে পরীদের তুলনা করছে সে!! হঠাৎ তৃষ্ণার চিৎকারে তৌহিদ চিন্তার রাজ্য ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো। তৃষ্ণা অনেকটা উঁচুতে উঠে গিয়েছে। দূর থেকে বলে খুব ছোট দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু এভাবে চিৎকার করছে কেন তৃষ্ণা?? ভাইয়া, আমি আর কখনওই উড়তে চাইবো না... আমাকে প্লিজ নামিয়ে নাও... আমার ভয় করছে খুব, ভাইয়া।... তৃষ্ণার কথায় নীচ থেকে শান্তনা দিয়ে তৌহিদ চেঁচিয়ে বললো, আরে,, পাগলি ভয়ের কি আছে! আমি আছি না তোর পাশে। তুই উড়। যতো ইচ্ছে উড়। কিচ্ছু হবে না... আমি পাশে আছি। উত্তরে তৃষ্ণা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি পাখি হতে চাই না ভাইয়া। আমি তৃষ্ণাই থাকতে চাই.......... আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তৌহিদের। ঘেমে একদম ভিজে গেছে সে, বুকটাও ধড়ফড় করছে, পানি পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ভয়ংকর কিছু স্বপ্নতে দেখলে এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে তো ভয়ংকর কিছু দেখে নি,, বরং অনেক সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখেছে। তার বোন তৃষ্ণা মেঘেদের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে... এভাবে ঘেমে যাওয়াটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না তৌহিদের কাছে। এমন তো নয় যে সে গরমে এভাবে ঘেমে একাকার হয়েছে। কারণ, তার কোনো চান্সই নেই। ঘরে ফুল স্প্রিডে এসি চলছে। সেক্ষেত্রে গরমে ঘেমে ভিজে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাহলে......? আর কিছু ভাবার আগেই পাশ থেকে ঘুমন্ত গলায় অর্থি বলে উঠলো,
-"কি গুণ গুণ করছো এভাবে! দরজায় নিহাল ভাই নক করছে হয়তো। গিয়ে দেখো তো। এতো রাতে আবার কি কাজ তার!"
বলেই অপর পাশ ফিরে আবারো ঘুমে তলিয়ে গেল অর্থি। তৌহিদ কিছুক্ষণ সময় নিল অর্থির কথাগুলো বুঝবার। তারপর বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে এগুলো। দরজা খুলতেই নিহালের আতংকিত চেহারা ভেসে উঠার আগে তৌহিদের কানে তৃষ্ণা গলার আওয়াজ পৌঁছালো। গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তৌহিদ পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে... ঘরের ভেতর তো কেউ নেই,, তাহলে আওয়াজ টা আসছে কোথা থেকে? বাথরুম? পাশ ফিরে বাথরুমের দিকে এগুলো তৌহিদ। ক্রমেই তার কানে তৃষ্ণার গোঙানির শব্দ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। সেই শব্দের সাথেসাথে তার পা কাজ করাটাও ধীরেধীরে বন্ধ করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পায়ের সাথে ধীরেধীরে পুরো শরীরটাও অবশ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই আতঙ্কে চোখমুখ বড় হয়ে গেল তৌহিদের। বাথরুমের কিছু অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর সেই রক্ত আসছে তৃষ্ণার পা বেয়ে। পরণের জামার নিচের টুকু রক্তে ভিজে উঠেছে.. কমোডের পাশেই পড়ে ব্যথায় অনবরত কাতরিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা।
তৌহিদ কে আসতে দেখে তৃষ্ণার পাশ থেকে উঠে আসলো ঐতিহ্য। সে এতোটাই ভয় পেয়ে গেছে যে, কি রেখে কি করবে কিছুই তার বুঝে আসছে না। এমন পরিস্থিতি তে কখনো নিজে পড়ে নি সে। বা কখনো কাওকে পড়তেও দেখে নি। এখন কি করা উচিৎ তার? হঠাৎ করে বুদ্ধির উদয় হলো তার মাথায়। এসব পরিস্থিতি কে হ্যান্ডেল করতে আবার এসব সমস্যায় পড়তে হয় নাকি! আর এই পরিস্থিতিতে তার নিজেরই বা করার আছে! যা করবে ডক্টর করবে। ডক্টর তো আর দুনিয়া ছেড়ে উঠে যায় নি... তৌহিদের পাশে দাঁড়িয়ে সে বললো,
-"খুব দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে ভাবিকে..."
হসপিটালে তৃষ্ণাকে নিয়ে ঢুকতেই এগিয়ে এল দুজন নার্স। তাদের মাঝে একজন ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
-"প্রেগন্যান্ট?"
ঐতিহ্য ভাঙা গলায় উত্তর দিল,
-"হু..."
-"হঠাৎ করেই এমন রক্তপাত শুরু হয়েছে নাকি পড়ে টড়ে গিয়েছিল?
-"বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল..."
-"কয় মাস?"
-"৬ মাস চলছে..."
-"এই সময়টায় এভাবে অসাবধানে চললে হবে? কতক্ষণ আগের ঘটনা?"
-"বেশি না... আধাঘণ্টা।"
নার্স ঐতিহ্য কে ধমকের সুরে বললো,
-"আধাঘণ্টা কে আপনার কম সময় মনে হচ্ছে? যান তাড়াতাড়ি ভর্তি করুন রোগীকে।"
কেবিনে নেবার সাথেসাথেই নাইট ডিউটির একজন ডক্টর দেখতে এল তৃষ্ণাকে। সময় নিয়ে দেখে কিছুটা চিন্তিত গলায় বললেন,
-"পেশেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ। আর্জেন্ট সার্জারি করতে হবে। কিন্তু প্রেশার দেখছি ১৮০/১১০। এই অবস্থায় সার্জারি করাও যাচ্ছে না। প্রেশার কমিয়ে নরমাল করার পরেই আমরা উনাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাব। আমি একটা মেডিসিনের নাম লিখে দিচ্ছি। আনিয়ে নিন। তবে..."
কথা শেষ না করেই থামলেন ডক্টর। রোগীর সাথে আসা আত্মীয়স্বজনের দিকে তাকিয়ে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন সকলের মুখেই একরাশ আতঙ্ক। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ডক্টর বললেন,
-"ভয় পাবেন না। এক কাজ করুন,,, আপনাদের মাঝে একজন গিয়ে হসপিটালের বাকি ফর্মালিটিস গুলো ঠিকঠাক করুন। অহ, হ্যা.. রক্তের ব্যবস্থা টাও করে রাখুন।"
ঐতিহ্য কিছুটা ইতস্তত করে বললো,
-"আর বাচ্চাটা?"
-"কিছু বলতে পারছি না..."
""সম্পর্কের_টান""
#পর্ব-২৮
রাত দুটোর পর অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো তৃষ্ণাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে সকলেই আল্লাহর নাম জপতে লাগলো। কারণ, একমাত্র সেই পারে তাদের এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু আল্লাহ কি শুনবে তার এই অধম বান্দাদের ডাক?
-"চলো, কেবিনে গিয়ে বসি..."
অর্থির কথায় তার দিকে বিরক্তের দৃষ্টিতে তাকালো তৌহিদ। এই অবস্থায় আর যাই হোক কেবিনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকা যায় না।
-"তুমি যাও।"
অর্থি তৌহিদের কথায় কেবিনের দিকে রওনা দিল। মাথার যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। হঠাৎ করে তৌহিদের ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠবার কারণে হয়তো এই অবস্থা হয়েছে। তার উপর নানা সমস্যা... এত সমস্যাদি শুধু তাদের জীবনেই কেন ঘটে কে জানে!
আধাঘণ্টা হলো তৃষ্ণাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। এখনো ভেতর থেকে কোনোরকম খবর আসে নি। ঠিকঠাক আছে তো তৃষ্ণা? তৃষ্ণার কথা ভাবতেই বুকটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে তৌহিদের। চোখটা বার ঝাপসা হয়ে আসছে। এতটা কষ্ট কি পাওনা ছিল তার বোনের? কপালে কি সুখ নিয়ে জন্মেছিল না সে! হসপিটালে নিয়ে আসার সময় তৃষ্ণা বারবার তাকে একটা কথাই বলছিল,, আমার বাচ্চাটাকে বাচাও, ভাইয়া.. এই বাচ্চাটা হারালে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো। বাচ্চাটা কি আদৌ বাঁচবে? ডক্টরের সাথে কথা বলে এটুকু তো সিউর হয়েছে ছয় মাসে মিসক্যারেজের কোনো ভয় নেই। তবে যতোটা রক্তপাত হয়েছে তাতে বাচ্চার টেকারও কথা নয়.... হয়তো পেট থেকেই মৃত শিশুকে বের করা হবে। এসব নিজের চোখে দেখে সহ্য করতে পারবে তো তৃষ্ণা? অপরদিকে তৃষ্ণার অবস্থাও অসম্ভব খারাপ। ডক্টর তেমনভাবে কিছু না বললেও কিছু কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে সে কথা। কি ঘটতে যাচ্ছে তার বোনের জীবনে? নতুন একটা দিনের দেখা সে পাবে কি? আবার নতুন একটা দিনের দেখা পেয়েও নিজের মাঝের অস্তিত্ব কে হারাতে হবে না তো? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল তৌহিদ। তারপর আবারো থিয়েটারের সামনে পাইচারী করতে লাগলো।
ঠিক একঘন্টা পর একটি নার্স বেড়িয়ে এল অটি থেকে। চোখ তার চকচক করছে, ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসাধ্য কিছু সফল করার হাসি তার ওই মুখে। তারপরও তার মুখ থেকে সব কিছু না শোনার আগে মন মানবে না। তাড়াহুড়ো করে তৌহিদ এগুলো সেদিকে। পিছুপিছু এগুলো ঐতিহ্য এবং নিহাল।
-"কংগ্রাচুলেশনস... ছেলে হয়েছে। সাথে মাও সুস্থ আছে।"
নার্সের কথায় স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জোর গলায় বললো,
-"আলহামদুলিল্লাহ।"
-"আপনারা অপেক্ষা করুন। ডক্টর আপু এসে কথা বলবে আপনাদের সাথে।"
তৃষ্ণাকে কেবিনে নেবার কিছুক্ষণের মাঝে ডক্টর এল কেবিনে। জানালেন, সময়ের আগেই অর্থাৎ ৬ মাস চলতেই তৃষ্ণার সিজার করবার কারণে প্রিম্যাচুয়ার বেবির জন্ম দিয়েছে সে। আমাদের দেশে পূর্ণ সময় মায়ের পেটে থেকে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের ওজন হওয়া উচিত দুই কেজির ওপরে বা আড়াই কেজি। কিন্তু অপরিণত এসব বাচ্চাগুলো সাধারণত এক কেজি, দেড় কেজির হয় এখন, এসব বাচ্চার বৃদ্ধি ভালো হয় না। কারণ, ১০ মাস যেই বাচ্চার গর্ভে থাকার কথা, সেই বাচ্চা সময়ের আগেই বেরিয়ে আসে। যার ফলে দেহের কোনো অঙ্গই পরিপূর্ণভাবে গঠন হয় না বাচ্চাগুলোর। যেমন তার মস্তিষ্কও পরিপূর্ণতা লাভ করে না, ফুসফুসও পরিপূর্ণতা পায় না, স্বাভাবিকভাবে তার চোখও তৈরি হয় না, শ্বাস ভালো ভাবে নেই না, মস্তিষ্ক ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় না। এই বাচ্চাগুলোকে জন্মের পরপরই এনএসইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে গিয়ে তারা উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন পায় জীবন বাঁচানোর জন্য। তৃষ্ণার ক্ষেত্রেও তেমন টাই ঘটেছে। তার প্রিম্যাচুয়ার বেবি হবার কারণে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে বাচ্চাটাকে। পরিবারের যেকোনো একজন সদস্য গিয়ে দেখে আসতে পারে বাচ্চাটাকে। সবশেষে ডক্টর তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
-"মেয়েটা যে ভাগ্যবতী সেটা স্বীকার করতেই হবে। না হলে এমন একটা কেসে মা বাচ্চা দুজনই সুস্থ আছে, ঠিক আছে এটা আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। যতোটা রক্তপাত হয়েছে তাতে আমরা ভেবেছিলাম বাচ্চাটা হয়তো আর নেই। তবে একটা কথা আছে না? রাখে আল্লাহ মারে কে...."
বাচ্চার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তৌহিদের পুরো শরীর বেয়ে এক শীতল রক্ত স্রোত খেলে গেল। খুবই ছোট একটি শিশু। নিজের হাতের পাতার সমান হবে কিনা সন্দেহ। চুপচাপ মায়ের পেটে যেমন ভাবে জড়সড় হয়ে থাকে ঠিক সেভাবেই ভাবেই শুয়ে আছে। চোখ ফুটেনি ভালোভাবে। হাতপা গুলো অসম্ভব ছোটছোট, সাথে পলিথিন এর মত একটা আস্তরণ। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরাতেই টিউবের দিকে নজর পড়লো তৌহিদের। বাচ্চাটির বুকে, নাকে, মাথায় কিছু টিউব লাগানো। নাকের টিউবের সাহায্যেই খানিকটা সময় পরপর জোরেশোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। অনেকটা সময় নিয়ে দেখলো তৌহিদ বাচ্চাটাকে। তারপর ধীরপায়ে বের হয়ে এল সেখান থেকে। খুব অস্থির লাগছে তার। ঘেমেঘেমে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। এতোটা খারাপ লাগছে কেন তার? ভাবতেই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো তার।
পরদিন দুপুরের দিকে নিজে কিছুটা সুস্থ বোধ করলো তৃষ্ণা। তারপরেও মাথাটা ঝিম ধরে আছে। একপায়ে কোনোমতে বল পেলেও অন্য পায়ে সামান্য শক্তিও পাচ্ছে না। সাথে কাটা জায়গাতেও মাঝেমাঝে জ্বলছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও তার বাচ্চাটা যে ভালো আছে সেটা ভেবেই মনে এক আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটাবার যে বাচ্চাটাকে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, ছুঁয়ে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে, নিজের বুক উজার করা ভালোবাসা দিতে ইচ্ছে করছে....
-"ভাবি? একটু ভালো লাগছে এখন?"
দুচোখ বুজেই মৃদু গলায় জবাব দিল তৃষ্ণা,
-"হু.. বাবুকে দেখতে আমাকে নিয়ে যাবে কখন?"
অর্থি আশেপাশে তৌহিদকে খুঁজতে লাগলো। এ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। ডক্টরের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে তৌহিদের। তাই তৌহিদই বলতে পারতো। তবে আশেপাশে কোথাও তৌহিদ কে না দেখতে পেয়ে সে উত্তর দিল,
-"আমি সেটা জানি নি। তোমার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে এ ব্যাপারে...."
খানিকটা সময় নিরব থাকার পর কিছুটা ইতস্তত করে তৃষ্ণা বললো,
-"মাহ... মাহসানকে খবর দিয়েছো?"
মাহসানের নাম উঠতেই মুখটা ছোট হয়ে গেল অর্থির। কালরাতেই ঐতিহ্য কল দিয়ে খবর টা দিয়েছিল মাহসানকে। তবে....
-"জানতাম। ভাইয়া হয়তো জানাইতে দেই নি... না?"
-"উহু... জানিয়েছি।"
ঠোঁটে কিছুটা হাসির রেখা টেনে তৃষ্ণা জানতে চাইলো,
-"কি বলেছে ও? এসেছিল বাবুকে দেখতে?"
-"না,, আসে নি। এমন কি আপু খবরটা তাকে জানানোর পর তার উত্তর টা ছিল, খুব ভালো খবর, তবে আমার কাজের নয়। আর শোন,, এতো রাত বিরেতে এসব জানানোর জন্য কল করে ঘুম টা না ভাঙালেও পাড়তি।"
অর্থির মুখ থেকে এ কথা শুনে আর কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা। ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চুপচাপ পড়ে রইলো বেডে।
তিন দিন হসপিটলে কাটানোর পর তৃষ্ণাকে এনে তোলা হলো ঐতিহ্যর ফ্লাটে। আপাতত একটা মাস এখানেই রাখা হবে তৃষ্ণাকে। সাথে তৌহিদ এবং অর্থিও থাকবে। একমাস পর বাবুকে ইনকিউবেটর থেকে বের করা হলে একদম তৃষ্ণাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হবে তারা। অপরদিকে তৃষ্ণার খবর শুনে বাড়ি থেকে তৌহিদা বেগম এবং লিয়াকত সাহেবও দেখতে আসতে চাইছেন। কিন্তু তৌহিদের নিষেধের কারণে আসতেও পাড়ছে না। এমনিতেই ছোট্ট একটা ফ্লাট ঐতিহ্যদের। তাদের নিজেদের থাকাই দায় হয়ে পড়েছে,, এর মাঝে অতিরিক্ত কাওকে এনে ভেজাল লাগানোর দরকার টা কি!
দুপুরেরে খাবার শেষে সব কিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করে তৃষ্ণার পাশে এসে বসলো ঐতিহ্য এবং অর্থি। অর্থি গতকাল বিকেলে তৌহিদ ফেরার পর তার সাথে হসপিটালে গিয়ে বাবুকে দেখে এসেছে। এই কয়েকটা দিনেই অনেকটা বেড়েছে বাবু... সে নিয়েই টুকিটাকি কথা হচ্ছিল তাদের মাঝে। হঠাৎ আসরের মাঝে তৃষ্ণা বলে উঠলো,
-"মাহসানের সাথে আমি একটাবার কথা বলতে চাই...."
তৃষ্ণার কথার প্রতিউত্তরে অর্থি বললো,
-"কি দরকার ভাবি! বউ তো দুরের কথা.. যে তার নিজের বাচ্চার খোঁজখবর রাখে না তার সাথে কথা বলে হবে টা কি!"
-"ও হয়তো জরুরি কোনো কাজে আটকে পড়েছে... না হলে ও এমনটা কখনওই করবে না। প্লিজ,, একটাবার কথা বলিয়ে দাও। ওর কাছে বাবুর একটা ছবিও সেন্ড করো। আমি নিশ্চিত ও বাবুকে দেখার পর দূরে থাকতে পারবে না।"
অর্থির তৃষ্ণার কথা শুনে মায়া লাগলেও তা বাইরে প্রকাশ করলো না। মুখে কিছুটা বিরক্ত ফুটিয়ে বললো,
-"সম্ভব না, ভাবি। তৌহিদ জানলে রাগারাগি করবে।"
-"ভাইয়া জানবে না... ঐতিহ্য প্লিজ,, একটাবার কথা বলিয়ে দাও। তোমরা চাও না.. বাবু তোমার ভাইয়াকে নিয়ে আমরা একসাথে থাকি?"
অতৈন্দ্রিলার সাথে এই ভরদুপুরে শপিং এ বেড়িয়েছে মাহসান। আজ বিকেলের ফ্লাইটে তারা কক্সবাজার যাচ্ছে। ৪/৫ দিনের জন্য সেখানে নিজেদের মত কিছুদিন সময় কাটাবে তারা। অতৈন্দ্রিলা ট্রায়াল রুমে ঢুকেছে একটি ড্রেস নিয়ে। তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়েই চুপচাপ অপেক্ষা করছিল মাহসান। ঠিক সেসমই তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিক তাকাতেই ঐতিহ্যর নাম ভেসে উঠলো।
-"হ্যালো,, বল।"
-"আমি বলছিলাম..."
তৃষ্ণার গলার আওয়াজে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মাহসান। কন্ঠে বিরক্ত ফুটিয়ে বললো বললো,
-"অহ,, তুমি। হু বলো?"
-"কেমন আছো তুমি?"
-"ভালো।"
-"আমিও ভালো আছি..."
-"অহ।"
-"কি করেছিলে? ব্যস্ত নাকি?"
-"হু.. যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো।"
-"বাবুর নাম এখনো রাখা হয় নি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি এসে ওকে দেখার পর নামটা রেখে দিয়ে যাবে। আসবে তো??"
তৃষ্ণা কথায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মাহসানের। তবে সেদিকটায় মন না দিয়ে মাহসান জবাব দিল,
-"আমি অযথা নাম রাখতে যাবো কেন! আর শোনো,, আমি দেখতে যেতে পারবো না। শুনলাম তো,, কি অপুষ্ট বাচ্চাটাচ্চা জন্ম দিয়েছো তুমি। কার না কার সাথে শুয়ে পেট বাধিয়ে এসে এখন এসব পাপ জন্ম দিয়েছো। আবার তার নামটাও আমাকে ঠিক করে দিতে বলছো! হাউ ফানি!"
মাহসানের কথায় হতভম্ব হয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"কি বলছো এসব! তুমি পাগল হয়ে গিয়েছো? এটা তোমার আর আমার বাচ্চা। আমাদের দুজনের বাচ্চা। বিশ্বাস না হলে একটা বার ওকেই দেখেই যাও। ঠিক তোমার মত হয়েছে ও। যে কেউ দেখা মাত্রই বলবে এটা মাহসানেরই ছেলে। আর তুমি এসবই বা বলছো কেন! তুমি আমাকে চেনো না? আমি কেমন মেয়ে তুমি জানো না? মাহসান, তুমি চেয়েছিলে আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আমাদের বাবু আমাদের সাথে থাকুক। আল্লাহ তোমার কথা শুনেছে। এনে দিয়েছে ওকে আমাদের মাঝে... প্লিজ একটাবার এসে ওকে দেখে যাও..."
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললো তৃষ্ণা। মাহসানের কি করা উচিৎ এখন? একবার গিয়ে দেখে আসবে বাচ্চাটকে? ঠিক তখনি ট্রায়াল রুম ছেড়ে বের হলো অতৈন্দ্রিলা। হাতাকাটা, হাটু সমান হলুদ রঙের ড্রেসে তাকে দেখতে একদম উর্ভাশি রাউতেলার ফটো কপি লাগছে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না তার দিকে থেকে। বিশেষ করে ফিগারটা... কান থেকে ফোন নামিয়ে কল ডিসকানেক্ট করে দিয়ে মাহসান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে এগুলো অতৈন্দ্রিলার দিকে।
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।