সম্পর্কের টান
পর্ব-৩৫+৩৬
-"কল রিসিভ করতে এতো সময় লাগে!"
-"লাগতেও তো পারে।"
-"কেন লাগবে!"
-"ঝগড়া করতে চাচ্ছো?"
-"না,, আমার এতো সময় নেই। আচ্ছা শোনো..."
-"হু,, বলো।"
-"আমার ৫ দিন ছুটি লাগবে। আজ অফিসেই ব্যাপার টা জানাতে চেয়েছিলাম। তবে কাজের চাপে মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল।"
-"হঠাৎ?"
-"শরীর খারাপ টা হঠাৎই হয়। বলে কয়ে আসে না।"
অতৈন্দ্রিলার কথায় ভ্রু কুঁচকালো মাহসান। অতৈন্দ্রিলা অসুস্থ? কই! আজ তো দেখে তেমন মনে হলো না!!
-"কি হয়েছে তোমার?"
-"একবার তো বললাম। তুমি প্লিজ ছুটির ব্যাপার টা দেখো। আমি এই পাঁচটা দিন একটু বাসায় থেকে রেস্ট নিতে চাই।"
-"তা না হয় দেখবো। কিন্তু হঠাৎ করে কি এমন হলো তোমার! ডক্টর দেখিয়েছো?"
হাই উঠাতে উঠাতে অতৈন্দ্রিলা জবাব দিল,
-"হুম,, আচ্ছা এখন রাখছি। ঘুম পেয়েছে।"
-"দাঁড়াও,, আমার কথা তো শেষ হয় নি। আমি তোমার এই ব্যাপার টা নিয়ে যে টেন্সড সেটা তুমি বুঝতে পারছো না!"
-"পারছি।"
-"তাহলে খোলাখুলি বলছো না কেনো! আমি কি আসবো তোমার ওখানে? ডক্টর কি বলেছে?"
-"প্লিজ স্টপ ইট ইয়ার। অভার জিনিশগুলো আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। আগেও বলেছি।"
শোয়া থেকে উঠে বসলো মাহসান। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-"কেয়ার করাটা তোমার কাছে অভার মনে হচ্ছে!"
-"হচ্ছে।"
-"তাহলে তুমিই আমাকে বলে দাও, কোনটা নরমাল? কিভাবে তোমার কেয়ার করলে সেটা তোমার কাছে অভার লাগবে না?"
-"এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে ঝগড়া বাধানোর জন্য একটা ওয়ে খুঁজছো।"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মাহসান বললো,
-"রাখছি এখন। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।"
কল কেটে দিয়েই স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো মাহসান। আজকাল জীবনটা বড় কষ্টের মনে হয়। এই একলা জীবনের শেষ কোথায়? যার জন্য মা বাবা, বোন, জীবনসঙ্গী, বাচ্চা সব হারালো, তাকেই আজ আর আপন ভেবে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে না। অবশ্য ইচ্ছে করলেও উপায় নেই.. অতৈ আর আগের মত নেই। তার পাশে দুদণ্ড বসে সুখ দুঃখের কথা শোনার মত সময় এখন আর অতৈ এর নেই। তাহলে কি অর্থির কথাই ঠিক? নতুন কাওকে পেয়ে মাহসান কে ঘাড় থেকে নামানোর চেষ্টা করছে? না.. তেমন কিছু না। সে নিজেই বেশি ভেবে ফেলছে।
ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো মাহসান। চোখ টা একটু লাগালাগা ভাব ঠিক সেসময়ই হঠাৎ করে তৃষ্ণার কথা মনে পড়ে গেল মাহসানের। আচ্ছা তৃষ্ণা কি ওই জব টা করছে? করার তো কথা নয়। বারবার নিষেধ করে দিয়েছে সে তৃষ্ণাকে, চোখে আঙুল দিয়ে শরীফ নামের লোকটার চরিত্র দেখিয়ে দিয়েছে সে তৃষ্ণাকে। এরপরও কি তৃষ্ণা জব টা করবে?? ওপর পাশ ফিরলো মাহসান। তৃষ্ণাকে নিয়ে অযথা সে এত ভাবছে কেন! যাকে ছেড়ে দিয়েছে তো দিয়েছেই। তাকে নিয়ে এত ভাবাভাবির কি আছে! যাকে নিয়ে বিয়ের পরেই এত ভাবে নি তাকে নিয়ে এখন ভাবার কোনো মানে হয় না। আচ্ছা,, সে তৃষ্ণাকে নিয়ে ভাবে নি কেনো? তৃষ্ণার সাথে অযথা দুর্ব্যবহার করেছে কেনো? তৃষ্ণার তো এগুলো প্রাপ্য ছিল না। না... যা হবার হয়ে গিয়েছে। তৃষ্ণার ওগুলো প্রাপ্য ছিল বলেই সে পেয়েছে। কেন পেয়েছে, কি কারণে পেয়েছে এগুলো তার ভাব্বার বিষয় না। তবে সে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইদানীং খুব বেশিই মিস করছে সে তৃষ্ণাকে। গতকাল দুপুরে দেখা হবার পর থেকে এই মিস করাটা বেড়ে গেছে আরো দশগুণ। বারবার শুধু তৃষ্ণার মায়াবী মুখের ছবি ভেসে উঠছে তার চোখের পাতায়.... এ পর্যায়ে বিছানা ছেড়ে আবারো উঠে পড়লো মাহসান। ওয়ালেট বের করে কালকের দেয়া শরীফ আহমফের কার্ড টি হাতে নিল। কিছুক্ষণ কার্ডটি নিয়ে পায়চারী করবার পর সে কল করে বসলো শরীফ আহমেদের ব্যক্তিগত নাম্বারে।
-"শরীফ সাহেব বলছেন?"
ফোনের অপর পাশ থেকে ঘুমন্ত গলায় শরীফ আহমেদ জবাব দিলেন,
-"জ্বি হ্যাঁ। কে বলছেন?"
-"আমি মাহসান চৌধুরী বলছিলাম।"
-"ঠিক চিনতে পারছি না। কোন মাহসান?"
-"তৃষ্ণার হাজবেন্ড।"
কিছুটা বিরক্ত হলেন শরীফ আহমেদ। কপাল কুঁচকে বললেন,
-"তা এতো রাতে?"
-"একটা ইনফরমেশন লাগতো।"
-"কি ইনফরমেশন?"
-"তৃষ্ণা কি জব টা করছে?"
-"জ্বি,, না করবার কোনো কারণ আছে কি!"
-"তো কারণ নেই?"
হালকা কেশে উঠলেন শরীফ আহমেদ। বললেন,
-"কাল থেকে উনি জয়েন করবেন। আপনার আর কিছু জানবার আছে?"
-"না...।"
বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দিল মাহসান। তার উপরে জেদ দেখিয়ে হলেও তৃষ্ণা যে জব টা করবে, এটা মনে হচ্ছিলই মাহসানের। কিন্তু সব টা জেনেশুনে নিজের ক্ষতি কেন ডেকে আনছে তৃষ্ণা??
অর্থির কপালে হাত রেখে তৌহিদ চিন্তিত গলায় বললো,
-"হঠাৎ করে এত জ্বর! দেখি ওঠো, অর্থি। অল্প কিছু খেয়ে মেডিসিন নাও।"
নড়লো না অর্থি। চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে রইলো সেভাবেই। বাড়ির কাওকেই ফেস করতে চায় না সে। আজ বাদে কাল যখন সবাই তার আর রায়ানের ওই ছবি দেখবে তখন তাদের সামনে কি মুখ নিয়ে যাবে সে! ছবিটা এতোটাই নিখুঁত ভাবে ইডিট করেছে, সবাই এক দেখাতেই সেটাকেই সত্যি বলে মেনে নেবে। একবারো ওই ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যের সন্ধানও কেউ করবে না। এই যে তৌহিদ, এই তৌহিদও তাকে ভুল বুঝবে। আর কেনই বা বুঝবে না! তৌহিদ এমন কোনো মহামানব হয় নি যে, বউ এর এমন অশ্লীলতা দেখেও তাকে সব ভুলে বুকে টেনে নেবে!
-"আসবো, ভাইয়া?"
রায়ানকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৌহিদ বললো,
-"এসো। কিছু লাগবে?"
-"না,, মানে শুনলাম ভাবি নাকি অসুস্থ। তাই দেখতে এলাম আর কি!"
-"অহ,, এসো.. বসো। আমি দেখি ওর জন্য অল্প কিছু খাবার নিয়ে আসি।"
বলেই তৌহিদ বেড়িয়ে গেল। রায়ান তৌহিদের যাবার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অর্থির পাশে গিয়ে বসলো। কপালে আলতো করে হাত ছুয়িয়ে বললো,
-"একটা ছবি দেখেই কি জ্বর বাধালে নাকি!"
রায়ানের স্পর্শ পেতেই চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেড়িয়ে এসে চোখ মিললো অর্থি। পাশে রায়ানকে বসে থাকতে দেখে ধরমড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,
-"প্লিজ,, তৌহিদ কে এই ছবি দেখিও না। তোমার পায়ে পড়ি আমি। প্লিজ রায়ান।"
-"আচ্ছা... দেখাবো না।"
রায়ানের কথায় আত্মায় পানি ফিরে এল অর্থির। উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে সে বললো,
-"সত্যি? প্রমিস করো আমায়। বলো দেখাবে না..."
-"বললাম তো দেখাবো না। এখানে প্রমিসের কি আছে!"
-"সত্যিই দেখাবে না তো?"
-"না..."
ঠিক সেই মুহূর্তেই তৌহিদ খাবার প্লেট হাতে ঘরে ঢুকলো। অর্থিকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"কি ব্যাপার রায়ান? কি এমন বলেছো যে আমার বউ একদম উঠে বসে পড়েছে! এতোক্ষণ আমি কত কিছু বললাম অথচ এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলাম না।"
হালকা হেসে রায়ান জবাব দিল,
-"সিক্রেট ভাইয়া। বলা যাবে না।"
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো সে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারো ফিরে এল। তৌহিদ কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-"কিছু কথা ছিল, ভাইয়া। ভাবিকে খাওয়ানো হলে আমাকে একটু ডাকবেন। আমি ড্রইংরুমে আছি।"
রায়ানের এ কথায় হতভম্ব হয়ে অর্থি তাকিয়ে রইলো তার দিকে........
(চলবে)
সম্পর্কের টান
পর্ব-৩৬
ভাতের একটি দানাও মুখে তুললো না অর্থি। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠছে। কি চাচ্ছে রায়ান? কেন অর্থিকে মিথ্যে আশ্বস্ত করলো আবার পরমুহূর্তেই আবার কেন তৌহিদ কে ডাকলো!!
তৌহিদ নিজেও বেশি জোরাজুরি করলো না অর্থির সাথে। ভাতের প্লেট নামিয়ে রেখে মেডিসিন হাতে নিয়ে বললো,
-"খেতে হবে না ভাত। মেডিসিন টা নাও।"
অর্থি হালকা মাথা নেড়ে না বোধক জবাব দিল। এ পর্যায়ে তৌহিদ ধমকের সুরে বললো,
-"আর একটা কথাও শুনতে চাই না। দেখি হা করো। বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছো কিন্তু তুমি।"
অর্থি নিজেও আর কথা বাড়ালো না। লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নিল মেডিসিন। তারপর তৌহিদের উদ্দেশ্যে বললো,
-"তুমি কোথায় যাচ্ছো?"
-"ভাতের প্লেট টা রেখে আসি। আর দেখি রায়ান ডাকলো কেনো!"
-"আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে, তৌহিদ। প্লিজ, তুমি কোথাও যেও না। আমার পাশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো... আমার হাত পা কাঁপছে।"
অর্থির অসহায় কণ্ঠ গিয়ে বিঁধল তৌহিদের বুকের মাঝটায়। প্লেট হাত থেকে নামিয়ে রেখে দরজা লক করে ঘরের আলো নিভিয়ে এগিয়ে এল অর্থির দিকে। পাশে বসে অর্থিকে টেনে নিল নিজের বুকে।
কিছুক্ষণ সেভাবে কাটানোর পর অর্থির শরীরের কাঁপুনি কিছুটা কমেছে বুঝতে পেরে আদুরে গলায় বললো,
-"শুয়ে পড়ি... কি বলো?"
-"হু।"
অর্থিকে বিছানার একপাশটায় শুয়িয়ে দিয়ে অপরপাশে গিয়ে নিজের শরীর টাও মেলে দিল তৌহিদ। নিজের দিকে টানলো অর্থিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-"খুব খারাপ লাগছে কি?"
-"উহু।"
-"তাহলে ঘুমানোর চেষ্টা করো। মেডিসিন খেয়েছো না,, ঠিক হয়ে যাবে সকালের মাঝেই ইনশাআল্লাহ।"
বলে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো অর্থির মাথায়। অপরদিকে অর্থিও গুটিসুটি মেরে চুপচাপ পড়ে রইলো তৌহিদের বুকে।
শরীফ আহমেদের সাথে ফোনে কথা শেষ হবার পর স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। বাসার এই পরিস্থিতির মাঝে আজ অফিসে জয়েন করাটা তার সম্ভব নয়। একে তো কাল রাতে জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে অর্থি। তার উপর বাড়িতে মেহমান এসেছে। এই পরিস্থিতির মাঝে তনয়কে কার কাছে ফেলে রেখে যাবে সে! আর কেই বা দুপুরের রান্নাবান্না করবে! সকালের রান্না টা সে নিজেই করেছে। অর্থির জ্বর, মায়ের শরীরটাও খারাপ। এর মাঝে অবশ্যই সে রান্নাবান্না সহ তনয়কে অসুস্থ অর্থির ভরসায় রেখে ঢ্যাং ঢ্যাং করে অফিস করতে যেতে পারে না। তাই অন্য কোনো উপায় না পেয়ে শরীফ আহমেদকে কল করে জানাতে হলো তার সমস্যার কথা। ভাগ্যিস শরীফ আহমেদ ব্যাপার টা বুঝতে পেরে তাকে ২/৩ দিন পর জয়েন করতে বলেছে। লোকটি খারাপ নয়। বরং যে কেউ তার সাথে মিশে, কথাবার্তা দেখে তাকে অনায়সে ভালো মানুষের তালিকাতেই ফেলবে। অথচ উনার চরিত্র এতোটা বাজে সেটা কে বলবে!!
-"আসবো?"
মুহিব কে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা হাসলো তৃষ্ণা। বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-"আসুন না..."
ঘরের ভেতরে ঢুকে একটি চেয়ার টেনে বসলো মুহিব। বললো,
-"তনয় কে দেখছি না যে! কোথায় ও?"
বিছানার এক কোণায় মুহিবের মুখোমুখি বসে তৃষ্ণা বললো,
-"মার কাছে।"
-"অহ... তা খালাম্মা সকালে চেঁচামেচি করছিল কেন?"
মুহিবের কথায় লজ্জা পেয়ে গেল তৃষ্ণা। তৌহিদা বেগম সকালে অর্থিকে নিয়ে হালকা বকাবকি করছিল। সেটাও লোকটা শুনে ফেলেছে! হায় কপাল!
-"তেমন কিছু না,, অর্থির জ্বর ঠান্ডা নিয়ে কথা বলছিল। আপনি তো জানেনই মার স্বভাব। বিকেলে গোছল করে করে অর্থি জ্বর ঠান্ডা বাধিয়েছে এসব হাবিজাবি বলছিল।"
হাসলো মুহিব। বললো,
-"বয়সও তো বাড়ছে। তা ভাবির কি অবস্থা?"
-"ভাইয়া কোর্টে যাবার আগে তো বললো জ্বর কমেছে।"
-"যাক! কমলেই ভালো।"
আর কোনো কথা খুঁজে পেল না তৃষ্ণা। এই কথার প্রতিত্তরে কি বলবে সে! তবে ভদ্রতার খাতিরে কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু কি??
-"মাস্টার্স করা নিয়ে কিছু ভাবছো?"
মুহিবের প্রশ্ন শুনে হালকা হাসলো তৃষ্ণা। যাক! সে পালটা প্রশ্ন করেছে!
-"হু,, ভর্তি হবো।"
-"কোথায় থেকে করবে?"
-"এখানেই... ন্যাশনাল থেকেই।"
অবাক হয়ে মুহিব বললো,
-"এখান থেকে কেন করবে! ঢাকার কোনো ভালো ভার্সিটি থেকে করো।"
মুহিবের কথায় ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"ঢাকা আমার জন্য না। যদি আমার জন্যই হতো তাহলে...."
কথার মোড় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মুহিব বলে উঠলো,
-"আরইউ থেকে করতে পারো। আর রাজশাহী শহরটাও শান্তির শহর। কোনো জ্যাম নেই, বেশি কোলাহল নেই, দিনশেষে ক্লান্তি মেটানোর জন্য রয়েছে পদ্মার পাড়। আহ! রাজশাহীর মতো সুন্দর আর শান্তির শহর আমি আমার জীবনে আর কোথাও দেখি নি।"
-"দেখি..."
-"দেখাদেখির কিছু নেই, তৃষ্ণা। আমি তোমাকে এই বিষয়ে সব রকম হেল্প করতে পারবো। প্লাস আমার জন্য তুমি অনেক ফ্যাসিলিটিস ও পাবে। এখন তুমি বলো, তুমি ইন্টারেস্টেড কিনা?"
চিন্তিত ভঙ্গিতে তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"ভাইয়া আসুক। ভাইয়ার সাথে আগে কথা বলি।"
-"অহ... হ্যাঁ। আচ্ছা তৌহিদ আসুক। আমি নিজেই এ নিয়ে কথা বলবো ওর সাথে।"
-"থ্যাংকইউ।"
-"প্লেজার.... তা আজ বিকেলে ফ্রি আছো?"
ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"কেনো বলুন তো?"
-"তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো।"
-"আমি কেনো! ভাইয়া আসুক। ভাইয়াকে নিয়ে যাবেন।"
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুহিব। বললো,
-"ওকে নিয়ে তো অনেক ঘুরেছি। আজ না হয় তোমাকে নিয়ে ঘুরি। আগে যখন আসতাম তখন তো পড়াশোনার বাহানা দেখিয়ে দিতে। এখন তো আর পড়াশোনা টা নেই। বলো,, যাবে?"
-"তনয় তো অনেক ছোট আর...."
তৃষ্ণাকে থামিয়ে মুহিব বললো,
-"আমি আছি কি কাজে! তোমার তনয় কে নিয়ে ভাবতে হবে না। যাবে?"
-"আচ্ছা.... যাবো।"
তৃষ্ণার উত্তরে হাসি ফুটলো মুহিবের মুখে।
রায়ান বেশ কিছুক্ষণ হলো নিজের ঘরে পায়চারী করছে। কিছু একটা করতে হবে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকার জন্য তো সে আসে নি। ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো রায়ান।
-"আপু, ভাইয়া কোথায় গেল? দেখছি না যে!"
তৃষ্ণা পেছন ফিরে বললো,
-"মুহিব ভাই তনয়কে নিয়ে নিচে গেছে। কিছু লাগবে তোমার?"
-"না কিছু লাগবে না। অনেকক্ষণ হলো দেখছিলাম না তো। তা কি রান্না করছেন?"
-"তেমন কিছু না রে ভাই। মাছ ভাজি করছি। চা করে দেব তোমায়? চা খাবে?"
-"না, আপু। লাগবে না। আপনি কাজ করুন।"
রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে চারপাশটায় চোখ বুলালো রায়ান। তারপর খুব সাবধানে ঢুকে পড়লো অর্থির ঘরে।
অর্থি মাত্রই শাউয়ার নিয়ে বেড়িয়েছে। ঘরের মাঝেই দাঁড়িয়ে পেঁচানো টাউয়াল চুল থেকে খুলছিল। ঠিক তখনি ঘরে আগমন ঘটলো রায়ানের। অর্থির কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজা লক করলো রায়ান। তারপর গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকে।
ঘটনার আকস্মিকতা হতভম্ব হয়ে গেল অর্থি। চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়েও কাল রাতের দেখানো ছবিটি গলা চেপে ধরলো তাকে। দাঁতেদাঁত চেপে অর্থি ধীর গলায় বললো,
-"এসব কি হচ্ছে, রায়ান? ছাড়ো আমাকে।"
ছাড়ার পরিবর্তে অর্থিকে আরো জোরে চেপে ধরলো রায়ান। অপরদিকে খানিকক্ষণ চেষ্টার পরও ছাড়াতে পারলো না অর্থি নিজেকে রায়ানের বাহুডোর থেকে। রায়ানের শরীরের স্পর্শে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে অর্থির। তবুও নিজেকে ঠাণ্ডা রাখলো অর্থি। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-"ছাড়ো আমাকে। না হলে আমি চিৎকার করবো।"
-"তো করো..."
-"প্লিজ, রায়ান। ছাড়ো,, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।"
-"আমার মত একটা ছেলের স্পর্শে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে? তো কিসে স্বস্থি হয় তোমার? তৌহিদ ভাইয়ের মত অটিস্টিকের স্পর্শে?"
-"বুঝে শুনে কথা বলো।"
-"তো তুমি কি বলতে চাচ্ছো তৌহিদ ভাই অটিস্টিক নয়?"
-"না.. নয় সে অটিস্টিক। তুমি অটিস্টিক, তোমার চিন্তাধারা অটিস্টিক, তোমার কাজ কর্মগুলোও অটিস্টিকদের মত। আমাকে ব্লাকমেইল করে আমার সাথে যে শুতে চাচ্ছো,, তুমি কি মনে করেছো সেটা আমি বুঝি না?"
কপাল কুঁচকে রায়ান বললো,
-"সত্যিই বোঝো? তাহলে চলো বিছানায়.... চলো।"
-"আমি চিৎকার করবো, রায়ান। লাস্ট বার বলছি। আমাকে ছাড়ো আর ঘর ছেড়ে বের হও।"
-"তোমাকেও ছাড়বো আর ঘর ছেড়েও বেড়িয়ে যাবো। তবে তার পরিবর্তে তোমাকে কি কি সহ্য করতে হবে তার কোনো আইডিয়া আছে তোমার? আমি এ ঘর ছেড়ে বেরুনোর সাথে সাথে রাতের দেখানো ছবিটি চলে যাবে সবার ফোনে ফোনে। তুমি কি চাচ্ছো আমি এই কাজ টা করি?"
-"আমি চাচ্ছি... ছাড়ো আমাকে।"
অর্থির এ কথায় ছেড়ে দিল রায়ান অর্থিকে। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"তুমি সত্যিই চাচ্ছো আমি ছবিটি সবাইকে দেখাই?"
ছাড়া পেয়ে প্রথমে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো অর্থি। তারপর বললো,
-"সেটাই কি ভালো না ডেইলি এমন পরিস্থিতি তে পড়ার চেয়ে? আর কতোদিন তোমার ভয়ে চুপচাপ সহ্য করবো এগুলো? আজ এসে জড়িয়ে ধরেছো, কাল এসে সরাসরি বিছানায় নিয়ে যেতেও তোমার বাধবে না। এই ব্লাকমেইলের খেলা আর আমার সাথে চলবে না। তুমি যা করার করো। তৌহিদ কে দেখাবে? দেখাও। শুধু তৌহিদ কেন! পুরো দুনিয়া কেই দেখাও। তবুও তোমার ফাঁদে পা দেবো না আমি। ভয়ে চুপচাপ অন্যায় সহ্য করবার মত মেয়ে আমি না।"
-"ওকে!! দেন তুমি চাচ্ছো আমি ছবি টি তৌহিদ ভাইকে দেখাই?"
দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো অর্থি। তারপর রায়ানকে বেড়িয়ে যেতে ইশারা করে বললো,
-"এর আগেও একবার বলেছি। শুধু তৌহিদ কেন যাকে ইচ্ছে তাকে দেখাও। ব্লাকমেইল করে তোমার অন্যায়কে আর প্রশয় দেব না আমি। পরবর্তীতে আমার নিজের সাথে যাই হোক সেটা আমি বুঝে নেব। আমার বিশ্বাস আছে তৌহিদের উপর। শুধু বিশ্বাস না দৃঢ় বিশ্বাস। তোমার এই মিথ্যে আর কেউ বিশ্বাস করুক তৌহিদ করবে না.... তুমি এখনই আমার চোখের সামনে থেকে বের হও।"
রায়ান ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই বিছানায় এসে বসলো অর্থি। মাথা ঠান্ডা রেখে কিভাবে প্রব্লেমটাকে ফেস করবে সে নিয়ে ভাবতে লাগলো। না.. সে কাঁদবে না, সে ভেঙে পড়বে না। কেন ভয় পাচ্ছে সে! ছবিটা তো মিথ্যে। তাতে এক বিন্দুও সত্যতা নেই। তার উচিৎ ছিল তৌহিদ কে গতকাল রাতেই সব খুলে বলা। কিন্তু সে বলে নি... বলতে পারে নি। তৌহিদকে হারানোর ভয় টা তার মনে এতো করেই চেপে বসেছে যে সে বলতে পারে নি। যদি হীতে বিপরীত হয়? যদি তৌহিদ ভুল বোঝে? যদি তৌহিদ ভাবে নিজের অপরাধ ঢাকতে অর্থি এসব বানিয়ে বলছে তাকে? আর কিছু ভাবতে পারলো না অর্থি। মাথাটা ঘুরে উঠলো... শরীর লুটিয়ে পড়লো বিছানায়।
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।