সম্পর্কের টান
পর্ব-৩৩+৩৪
অর্থির কথা শুনেও না শোনার ভান করে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তৌহিদা বেগম। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ শুণ্য দৃষ্টিতের পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে যা করছে সেটা অন্যায়। শুধু অন্যায় বললে ভুল হবে। অর্থির সাথে চরম অন্যায় করছে সে। সে তো এমন শাশুড়ি হতে চায় নি। তাহলে হঠাৎ এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেনো করছে সে অর্থির সাথে? অর্থির তো কোনো দোষ নেই এতে। বরং অর্থি নিজেও ভাইয়ের বিপক্ষে কথা বলে তৃষ্ণাকে সাপোর্ট দিয়েছে। তাহলে কেন এতোটা কঠোর হচ্ছে সে অর্থির সাথে? পিচ্চি একটা বাচ্চা মেয়ে। যার কিনা এখন পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়ানোর সময়। আর সে কিনা এই পাখাটাই কেটে দিতে চাচ্ছে! ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালেন তৌহিদা বেগম। আবারো এগুলেন রান্নাঘরের দিকে।
-"আমার কথায় বা কর্মে কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে মাফ করে দিস, মা। আমি আসলে তৃষ্ণার দিকটা নিয়ে সারাদিন এতো বেশিই ভাবতাম যে আমার ঘরে যে আমার আরেকটা মেয়ে আছে সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি নিজেই আমার কাজের জন্য খুব লজ্জিত।"
অর্থি তৌহিদা বেগমের মুখ থেকে এমন কথা মোটেও আশা করে নি। তাই হঠাৎ শাশুড়ির মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনে বিস্ময় কাটছেই না অর্থির। অপরদিকে তৌহিদা বেগম বলেই যাচ্ছে,
-"পরিস্থিতি টা এতোটা গোলমেলে হয়ে গিয়েছিল যে আমার কি রেখে কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছিল না। বয়স্ক একজন মানুষ হয়ে আমার বাচ্চাদের মতো আচারণ করাটা মোটেও উচিৎ হয় নি। আর তাছাড়া..."
এ পর্যায়ে অর্থি নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
-"না, মা। ঠিকই আছে। আসলে পরিস্থিতিটাই ওমন ছিল।"
তৃষ্ণা বাড়িতে ঢুকেই চলে গেল নিজের রুমে। কোনোমতে ব্যাগটা টেবিলের এক কোণায় রেখে ঢুকে পড়লো বাথরুমে।
তৌহিদ ড্রইংরুমে তনয়কে কোলে নিয়ে বসে টিভি দেখছিল। ঠিক সেসময় রুমে প্রবেশ করলো তৃষ্ণা। তৌহিদের পাশে গিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে উঠিয়ে নিল তনয়কে। তারপর খুব ধীরগলায় বললো,
-"ভাইয়া, কিছু কথা ছিল।"
তৌহিদ টিভিতে খবর দেখছিল। তাই তৃষ্ণার কথায় তেমন একটা তাল না দিয়ে বললো,
-"হু..."
-"যে ইন্টার্ভিউ টা আজ দিতে গিয়েছিলাম, ওটার জয়েনিং লেটার দিয়ে দিয়েছে। আর আমি নিজেও জব টা করতে চাই। তোমার কিছু বলার আছে এতে?"
-"না..."
আর কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা। উঠে চলে এল নিজের নিজের ঘরে।
খুব সকাল সকাল তৌহিদ বের হলো কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে। বাজারটা সেরেই আবার কোর্টের উদ্দেশ্যে বেরুতে হবে। তবে আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না কোর্টে। দুপুরের মাঝেই বাসায় ফিরতে হবে। মুহিব আসছে। অবশ্যই তার আপ্যায়নে কমতি রাখা যাবা না।
তৃষ্ণা সকাল থেকেই যতোটুকু পারছে সাহায্য করে যাচ্ছে অর্থিকে। বাচ্চা একটা মেয়ে। অথচ এখনি তার ঘাড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়াটা মোটেও উচিৎ হয় নি। এ বিষয়ে মা বাবাকে বলে এর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ভেবেই ছোট একটা নিশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। তারপর অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"আর কিছু করতে হবে?"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ... একটু মসলার ব্যাপারটা দেখে যাও। আমার হাত থেকে কখনো ঠিকঠাক মসলা উঠে না। হয় বেশি আর না হয় কম হয়। তোমরা তাও চুপচাপ খেয়ে নাও। কিন্তু বাইরের মানুষ কি আর চুপচাপ খাবে নাকি!"
তৃষ্ণা অর্থির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-"আমার তো ঠিকঠাকই মনে হয় তোমার হাতের রান্না।"
-"কচু... দেখিয়ে দাও না একটু!"
-"আচ্ছা... দেখি তুমি সরো।"
অর্থি সরে দাঁড়াতেই তৃষ্ণা মাংসের মাঝে গুড়ো মসলা দিতে শুরু করলো। অর্থি কিছুক্ষণ সেদিকে লক্ষ করার পর বললো,
-"আগে কখনো এসেছে মুহিব ভাই তোমাদের বাড়িতে?"
-"অনেক এসেছে। এসে অনেক অনেক দিন থেকেও গেছে। যখনি ভাইয়া ছুটিতে বাড়িতে এসেছে সাথে মুহিব ভাইও এসেছে।"
-"তাহলে তো তোমাদের সবার খুব কাছের মানুষই মুহিব ভাই।"
অর্থির কথায় সামান্য হাসলো তৃষ্ণা। বললো,
-"তা বলতেই পারো। প্রচণ্ড রসিক একজন মানুষ মুহিব ভাই। সবসময় রসিকতার মাঝেই থাকে সে।"
ভ্রু কুঁচকে অর্থি বললো,
-"কেমন ধরণের রসিকতা? আমার জানামতে পুলিশরা অশ্লীল রসিকতা..."
অর্থির কথা শেষ করবার আগেই তৃষ্ণা বলে উঠলো,
-"আরে না না... মুহিব ভাই পুরোই অন্য এক জগতের মানুষ। আসুক,, তখন নিজের চোখেই দেখবে।"
দুপুর ২ টোর মাঝেই সব কাজ শেষ করে শাওয়ারটাও সেরে নিল অর্থি। আজ সে গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি পড়েছে। অবশ্য তার নিজের পড়ার ইচ্ছে ছিল না। শাশুড়ির জন্যই পড়তে হলো। বাড়িতে একজন অতিথি আসছে অথচ বাড়ির বউ তাদের সামনে শাড়ি পড়ে যাবে না! এ কথার কোনো যুক্তিসংগত কারণ না খুঁজে পেলেও শাশুড়ির মন রক্ষা করতেই শাড়িটা পড়তে হয়েছে তাকে।
অর্থি ফোন হাতে নিয়ে কল করতে যাবে তৌহিদকে, ঠিক সেইসময়ই কলিংবেল বেজে উঠলো। ফোন রেখে আয়নার সামনে গিয়ে শাড়িটা ঠিকঠাক করলো অর্থি। তারপর মুখে হাসি নিয়ে বেড়িয়ে এল ঘর ছেড়ে।
-"এটাই অর্থি... তোদের ভাবি। আর অর্থি ও মুহিব.. আমার কতোটা কাছের তোমাকে আগেও বলেছি। আর ও রায়ান... মুহিবের ছোট ভাই।"
অর্থির শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল এক রক্ত স্রোত বয়ে গেল রায়ানকে দেখে। এটাই কি সেই রায়ান? রিয়াদ আহমেদ রায়ান? না.. নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। হাতপা থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে, মাথাটাও বেশ ঘুরছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেন হচ্ছে তার মাঝে!
-"এই যে ভাবি? কি হলো? আমাদের দেখে এমন ভাবে অবাক হচ্ছেন যেন আমরা আপনার বিয়ের আগের প্রেমিক ছিলাম!"
বলেই ঘর কাপিয়ে হাসতে শুরু করলো মুহিব। সেই হাসিতেই ঘোর কাটলো অর্থির। কোনোরকমে ঢোক গিলে বললো,
-"জ্বি... কেমন আছেন?"
-"ভালো না, ভাবি। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি কি করে ভালো থাকে!"
-"আচ্ছা,, আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।"
বলেই খুব দ্রুত বেড়িয়ে এল অর্থি ড্রইংরুম ছেড়ে। রান্নাঘরে এসে চুপচাপ খাবার বাড়তে শুরু করলো।
-"এক্সকিউস মি... আমাদের থাকার রুম টা কোনদিকে? তৌহিদ ভাই বললো আপনাকে দেখিয়ে দিতে।"
হঠাৎ এক পুরুষকন্ঠ শোনায় চমকে পেছনে ফিরলো অর্থি। চোখ দুটি বড় বড় করে ঢোক গিলে জবাব দিল,
-"ওপাশটায়..."
-"কোনপাশ? একটু দেখিয়ে দিলে সুবিধা হতো।"
কথা বাড়ালো না অর্থি। হাতে থাকা চামচ টা রেখে অর্থি এগুলো গেস্ট রুমের দিকে। দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। ধীরগলায় বললো,
-"এটা..."
-"থ্যাংকইউ।"
বলেই ঘরে ঢুকলো রায়ান। পরমুহূর্তেই আবার বের হয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো অর্থির। মুগ্ধ চোখে অর্থির দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললো,
-"এটলাস্ট তাহলে দেখা হলো.... তুমি যে বাস্তবে দেখতে এতোটা সুন্দর হবে, এটা কিন্তু ভুলেও কল্পনা করি নি আমি। তা কেমন আছো? হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ করবার কারণ টা কি এই বিয়েটা?"
মেঝের দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা ঝাকালো অর্থি। রায়ান ঘরের ভেতরে আবারো পা বাড়ালো। ঘরের আলো জ্বেলে অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"ভেতরে এসো..."
নরলো না অর্থি। বরফের মত পা দুটো শক্ত হয়ে আছে তার। পারছে না এ ঘরের সামনে থেকে চলে যেতে....
-"কি ব্যাপার! এসো।"
বলেই হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল রায়ান অর্থিকে। গালে হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
-"তোমার ফোনটা এর মাঝে অন করো নি কেনো? না ফেসবুকেও একটাবার ঢুকেছো! কেনো অর্থি?"
নিজের গাল থেকে রায়ানের হাত সরিয়ে দিল অর্থি। তারপর কিছুটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
-"সরি... তবে প্লিজ তুমি এ বাড়িতে এসে সেসব কথা উঠাবে না। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আর আমাদের মাঝে তো তেমন কিছু ছিল না। শুধু তিনটা মাস ফেসবুকে কিছু কথা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।"
-"ভুল বললে,, কিছু কথা নয়। অনেক বেশি কথা হয়েছে...."
-"যাই হোক আর না হোক সেটা অনেকদিন আগের ব্যাপার।"
বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল অর্থি। ঠিক সেসময়ই উচ্চকন্ঠে রায়ান বলে উঠলো,
-"তুমি আমায় ঠকিয়েছো, অর্থি।"
রায়ানের কথা কানে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠলো অর্থির। বুকের মাঝে ধামুরধুমুর হাতুড়ি পেটানো শুরু হলো। খুব দ্রুত আবার সে ফিরে এল রায়ানের কাছে। অসহায় গলায় বললো,
-"প্লিজ, ধীরে কথা বলো। কেউ শুনে ফেলবে তো। প্লিজ তুমি এমন করো না আমার সাথে। আমাদের তো শুধু তিনটা মাস ফেসবুকে কথা হয়েছে। এছাড়া তেমন কিছু হয় নি। না আমি তোমার সাথে কোনো কমিটমেন্টে ছিলাম! তাহলে কেন ঠকানোর কথা আসছে এখানে! প্লিজ, রায়ান। হাতজোড় করে বলছি, ছোট একটা বিষয়কে টেনে এতোটা বড় করো না।"
উত্তরে রায়ান হালকা হেসে বললো,
-"ফোনে তোমার আমাকে বলা কথা গুলো কি একবার শুনতে চাও? নাকি কল রেকর্ড গুলো তৌহিদ ভাইকেই সরাসরি শোনাবো?"
(চলবে)
সম্পর্কের_টান
পর্ব-৩৪
-"ওরে আমার বাচ্চাটাহ!! দেখো তৃষ্ণা, কিভাবে হাসছে তোমার ছেলে আমার কোলে উঠে। কি রে ব্যাটা? এভাবে হাসছিস কেন!! হু?"
মুহিবের কথা হেসে উঠলো তৃষ্ণা। বললো,
-"সবই আপনাকে পটানোর ধান্ধা। নতুন কেউ বাসায় এলেই তাকে এই ভুবনজয়ী হাসি দেখিয়ে তাকে পটিয়ে ফেলবার ওস্তাদ আমার ছেলে।"
-"ব্যাটা দেখছি আমার শেয়াল মামা। কি রে ব্যাটা! এই ছোট বয়সেই পটানোর ধান্ধা নিয়ে ঘোরাঘুরি করিস? আরো তো দিন পরেই আছে! তৃষ্ণা তোমার ছেলে বড় হলে পাক্কা রোমিও হবে। তার এই একটা হাসিতেই সব মেয়ের হৃদয় ফুটো হয়ে যাবে। হা হা....."
বলেই শরীর দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো মুহিব। তৃষ্ণা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজেও যোগ দিল মুহিবের সাথে হাসিতে।
ফ্রেশ হয়ে এসেই মুহিব এবং রায়ান খেতে বসলো তৌহিদদের বাড়ির সকল সদস্যদের সঙ্গে। অর্থি বসেছে তৌহিদ এবং রায়ানের মাঝে। তার এখন খেতে বসবার ইচ্ছে না থাকলেও মুহিবের জোরের কাছে পেরে উঠে নি। তাই তো এখন এই জাহান্নামের মাঝে বসে থাকতে হচ্ছে তার এভাবে! ভেবেই ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থি তাকালো তৌহিদের দিকে। খেতে খেতে মুহিবের সাথে দারুণ এক আড্ডায় মেতে আছে সে। দেখতে কি সুন্দরই না লাগছে! ভাবতেই অর্থির ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা দেখা দিল। চোখ দুটি বন্ধ করে মনে মনে আওড়ালো,, ভালোবাসি তোমার এই পবিত্র মন টাকে, ভালোবাসি তোমার এই পবিত্র হাসি কে, ভালোবাসি তোমাকে..... হঠাৎ পায়ে কিছু একটার ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠলো অর্থি। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই তার মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। তার পায়ের সাথে পা লাগিয়ে আরামসে হাড্ডি চিবুচ্ছে রায়ান। যেনো কিছুই হয় নি!! না.. আর এসব সহ্য করা যায় না। এই ছেলেটার সাহস দেখে রীতিমত অবাক সে। মাত্র তিনটা মাস কথা বলেছে সে রায়ানের সাথে। তাও তেমন কোনো কথাও নয়। অথচ এই ছেলে তাকে সেসবেরই ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। তৌহিদকে কি না কি জিনিশ দেখানো নিয়ে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে। অথচ তার নিজের যতোটুকু মনে পড়ছে, তেমন কোনো কথা বা তেমন কোনো কাজ সে করে নি,, যেটা নিয়ে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে রায়ান তাকে। তাহলে সে নিজেই বা কেনো এতো ভয় পাচ্ছে?? দাঁতমুখ কুঁচকে রায়ানের দিকে তাকালো অর্থি। নিজের পায়ের নখ দিয়ে যতোটা সম্ভব শক্তি দিয়ে একটি ঘাঁ বসিয়ে দিল রায়ানের পায়ে।
হঠাৎ অর্থির করা কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেল রায়ান। খুব দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে সে কাশতে শুরু করলো। প্রচণ্ড ভাবে লেগেছে তার পায়ে। হয়তো রক্ত টক্তও বেড়িয়ে পড়েছে। খাবার বন্ধ করেই উঠে পড়লো রায়ান টেবিল ছেড়ে। পানি টানি কিছু একটা আপাতত দিতে হবে সেখানটায়। জ্বলে যাচ্ছে পা টা।
-"কি ব্যাপার! খাবার রেখেই উঠছেন যে! খাবেন না? নাকি আমার রান্না ভালো লাগে নি?"
অর্থির কথায় থমকে দাঁড়ালো রায়ান। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
-"না,, ঠিক আছে। আমার একটা কল এসেছে। কথা বলে আসছি।"
মুহিব রায়ানের কথার পিঠে বলে উঠলো,
-"সত্যি করে বল তো কি হয়েছে? ফোনে কল এসেছে নাকি টয়লেট থেকে কল এসেছে? হা হা...."
বলে আবারো ঘর কাপিয়ে হাসতে শুরু করলো মুহিব। এবারের মুহিবের হাসিতে যোগ দিল অর্থি সহ বাড়ির সকলে।
অর্থির মুখে রায়ান সম্পর্কে সব শুনে ঐতিহ্য বললো,
-"ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে। জানোয়ার থেকে মানুষ করে দেব।"
-"উফ!! আপু কাজের কথায় আসো। এখন বলো কি করবো আমি!!"
-"বললাম তো আমার কাছে পাঠিয়ে দে।"
অর্থি বিরক্ত হয়ে বললো,
-"তুমি ব্যাপার টা এতো টা নরমালি কেনো নিচ্ছ!"
-"কারণ এটা সিরিয়াসলি নেবার মত কোনো ব্যাপারই না।"
-"তুমি বুঝতে পারছো না, আপু। আমার জায়গাটায় নিজেকে কল্পনা করে ভেবে দেখো।"
-"দেখ অর্থি,, এটা তেমন বড় কোনো ব্যাপার না যে এটাকে এতোটা সিরিয়াসলি নিতে হবে। মাত্র তিন মাসের পরিচয় তাও ফোন প্লাস ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ ছিল। তুই এটা নিয়ে এতো ভাবছিস কেন! আর তুই নিজেই তো বললি তোর সাথে ওর তেমন কোনো কথা হয় নি যেটা তৌহিদ ভাই দেখলে বা শুনলে তোকে ভুল বুঝবে। তাইলে এখন তুই নিজেই বল, ব্যাপারটা কি সিরিয়াসলি নেবার মত?"
চুপচাপ বোনের কথা শুনে চিন্তিত গলায় অর্থি বললো,
-"না,, তবুও। যদি বানিয়ে কিছু বলে!"
-"ছেলেটা যথেষ্ট বেয়াদব আছে। তাই বানিয়ে বললেও বলতে পারে। তুই এক কাজ কর। তুই নিজেই তৌহিদ কে ব্যাপার টা জানিয়ে দে ওর উলোটপালোট কিছু করবার আগে। আমার মনে হয় তৌহিদ ভাই ব্যাপার টা বুঝবে।"
-"যদি না বোঝে? যদি উলটো আমাকেই ভুল বোঝে?"
-"বি পসিটিভ, অর্থি। আর ভুল বোঝারই বা এখানে কি আছে! রায়ান ছিল তোর পাস্ট। তুই তো আর প্রেসেন্টে ওকে টেনে আনিস নি। সব মানিয়ে নিয়ে তৌহিদ ভাইয়ের সাথেই আছিস। আর বিয়েটাও তোর অমতেই হয়েছে। তাই আমার মনে হয় না এখানে তোকে ভুল বোঝার কোনো অপশন তৌহিদ ভাইয়ের আছে। এভরিবডি হ্যাস আ পাস্ট এন্ড দ্যাট উই কান্ট চেঞ্জ। তবে তুই যদি সেটা এক্সেপ্ট করে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগুতে পারিস তাহলে এখানে ক্ষতিটা কোথায়!"
কিছু সময় নিয়ে ঐতিহ্যর কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো অর্থি। অর্থি তৌহিদ কে কিভাবে এসব জানাবে, কি দিয়ে কথাগুলো শুরু করবে সব একেএকে বুঝিয়ে দিল ঐতিহ্য। তারপর হাই তুলতে তুলতে বললো,
-"ঘুম পাচ্ছে রে। রাখি এখন তাহলে।"
-"এই ভর সন্ধ্যায় আবার কিসের ঘুম! মাত্র বাজে ৭ টা।"
-"রাতে ঘুমোতে পারি না রে। তাই সারাটা দিন এভাবে হাই তুলতে তুলতেই কাটে। এই যেমন এখন ঘুম ঘুম লাগছে। বিছানায় গেলেই এই ঘুম টা আর থাকবে না। কি যে কষ্টের মাঝে আছি রে!"
আগ্রহ নিয়ে অর্থি বললো,
-"কেন! রাতে ঘুমোতে পারো না কেন!"
-"সাধে ঘুমাই না। ইচ্ছে করেই চোখ টা খুলে রাখি।"
-"রাগ করছো কেনো! আমি তো এমনিতেই একটু জানতে চাইলাম!"
-"এমনিতেই তোর জানতে হবে না। তুই তোর নিজের কাজে লেগে পর। তৌহিদ ভাইয়ের কাছে যা।"
-"উনি তো বাসায়ই নেই। বেড়িয়েছে মুহিব ভাই কে নিয়ে। এই সুযোগে আমিও ছাঁদে চলে আসলাম তোমার সাথে এ নিয়ে ডিসকাস করতে।"
-"তুই একা এখন ছাঁদে?"
-"হ্যাঁ।"
-"আর রায়ান?"
-"কি জানি! ওর রুমে হয়তো।"
-"শিগগির নিচে যা। আর একা থাকবি না কখনো। সবসময় ভাবি বা তৌহিদ ভাইয়ের আশেপাশে থাকবি।"
হঠাৎ ঐতিহ্যর কথায় বিস্মৃত হয়ে অর্থি বললো,
-"কেনো!"
-"এত কথা বলছিস কেন! যা বলছি তাই কর। আর আমি এখন রাখছি। সকালে কল করে জানবো রেজাল্ট কি হলো।"
বলেই ওপাশ থেকে কল কেটে দিল ঐতিহ্য। এদিকে অর্থি বোনের বলা কথাগুলোর সারমর্ম খুঁজতে লাগলো ছাঁদে দাঁড়িয়েই। হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে,, শীত আসার পূর্বাভাস বোধহয়। তাই হালকা বাতাস বয়ে যাওয়ায় শরীরে কিছুটা শীত অনুভব হচ্ছে অর্থির। শাড়ির আঁচল টেনে শরীর টা ঢেকে নিল অর্থি। তারপর আকাশের মুখপানে চেয়ে জোরে একটা নিশ্বাস টেনে নিল নিজের মাঝে। ঠিক সেসময়ই ছাঁদে আগমন হলো রায়ানের। ধীরেধীরে অর্থির দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে চেপে ধরলো অর্থির কোমর।
-"কি হচ্ছে এগুলো! দেখি ছাড়ো। তোমার তো সাহস কম না! ছাড়ো বলছি।"
রায়ানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতেই কিছুটা দূরে সরে গেল অর্থি। ঐতিহ্যর বলা কথা গুলোর মানে বুঝতে এখন আর বেগ পেতে হচ্ছে না।
-"সমস্যা কি তোমার! কি চাও তুমি! এভাবে ছ্যাঁচড়ামি শুরু করেছো কেন!"
হাসলো রায়ান। অর্থির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-"আই হ্যাভ নো প্রবলেম।"
বলেই পকেটে থাকা ফোন বের করলো রায়ান। গ্যালারি তে গিয়ে একটি ছবি বের করে মেলে ধরলো অর্থির দিকে।
ছবির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো অর্থি। সে আর রায়ান শুয়ে আছে একটি বিছানায়। দুজনের কারো গায়েই কিছু নেই,, শুধু পাতলা একটা কাপড় দিয়ে রেখেছে অর্থির শরীরের উপরটায়। কিন্তু সে আর রায়ান একসাথে এল কিভাবে! তাও এমন এক বিশ্রী অবস্থায়! তাদের তো দেখাই কখনো হয় নি!!!
-"তুমি হঠাৎ করে আমার জীবনে এসে তোমার মায়াজালে জড়িয়ে ফেলবে, তোমার নেশায় নেশাগ্রস্ত করে ফেলবে, ভালোবাসতে বাধ্য করবে,, তারপর আবার হঠাৎ করেই আমাকে নেশার সেই জগতে ডুবিয়ে ফেলে রেখে চলে যাবে! আর আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো মেনে নিব?"
ছবি টি দেখার পর থেকে অর্থি ভয়ে জমে গেছে। ঘাম চুয়ে চুয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে, দমটা বন্ধ হয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে আসছে ধীরেধীরে। কথা বলবার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। এদিকে অর্থির জবাব না পেয়ে আবারো রায়ান বললো,
-"যার পুরো রাত ছিলে তুমি, দিন ছিলে তুমি,, তাকে কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়ে নতুন আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তুমি! একবার মনে পড়লো না তোমার এই ছেলেটার কথা! কতো অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য,, কতো খুঁজেছি কিন্তু পাই নি তোমাকে। পাবোই বা কিভাবে! সব উপায় তুমি নিজেই তো বন্ধ করে রেখেছিলে। কেন এমন করেছিলে তুমি, অর্থি?"
-"কা... কারণ আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল না। যা ছিল সব ভালো লাগা।"
অর্থির কথায় ক্ষেপে গেল রায়ান। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ফ্লোরের মাঝে। কড়া গলায় বললো,
-"জাস্ট শাট আপ অর্থি। তুমি জানো আমি এখানে কেন এসেছি? তোমার জন্য এসেছি। শুধুমাত্র তোমার জন্য। ভাইয়ার ফোনে তোমার আর তৌহিদ ভাইয়ের ছবি দেখার পরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে আমি সুখে শান্তিতে থাকতে দেব না। আমি ঠিক যতোটা কষ্ট পেয়েছি, ঠিক ততোটাই কষ্ট আমি দেখতে চাই তোমার চোখে। আমি তো তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। একজন মানুষকে সামনাসামনি না দেখেও তার স্পর্শ না পেয়েও যে কাওকে নিজের মনে এতোটা জায়গা দেয়া যায় এটা আমি নিজেও জানতাম না অর্থি। তুমি আমাকে জানিয়েছো, বুঝিয়েছো। আমি তো মিথ্যা ভালোবাসি নি তোমায়। আমি নিজের করে পেতে চাই তোমাকে। শুধুই আমার। প্রতিশোধের পর্ব টা শেষ হলে তোমাকে আবারো নিজের করে পেতে চাই আমি, অর্থি। হবে তো আমার?"
অর্থির কোনো উত্তর না পেয়ে রায়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
-"আচ্ছা,, তৌহিদ ভাই এই ছবিটা দেখে কেমন রিয়াকশন দিতে পারে? এনি আইডিয়া?"
রায়ানের কথায় অর্থির বিস্ময় পৌছে গেল তুঙ্গে। কি বলে যাচ্ছে এগুলো রায়ান? ছবিটা তৌহিদ কে দেখাবে? কিন্তু ছবিটা তো সত্যিই না। ছবি টা মিথ্যে.....
-"ফটোশপ একজন মানুষের জীবন কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে আনতে পারে এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।"
বলেই চুল হালকা নেড়ে শিশ দিতে দিতে রায়ান এগুলো সিঁড়ির দিকে।"
মাহসান ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিল। ফোন হাতে নিয়ে ওয়ালপেপারে হাত বুলালো কিছুক্ষণ। একসময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-"মিস ইউ, বাবা। তোকে অনেক বেশিই ভালোবাসে তোর বাবা। বুঝেছিস নাকি বুঝিস নি? বুঝলে বল তোর বাবা কি ভুল করে ফেলেছে? এখন তোর বাবার কি করা উচিৎ?"
ঠিক তখনি কল এলো অতৈন্দ্রিলার নাম্বার থেকে। অতৈন্দ্রিলার ছবি স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই আবারো একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহসান। ছেলের উদ্দেশ্যে আবারো বললো,
-"আমি প্রচণ্ড দোটানায় আছি বাবা। কোনটা সঠিক পথ আমার জন্য প্লিজ আমাকে দেখিয়ে দিয়ে যা।"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।