সম্পর্কের টান
পর্ব-১৩+১৪
পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। যে যার মতো নিজের ঘরে গিয়ে ক্লান্তিমাখা শরীর মেলে দিয়েছে বিছানায়। নিস্তব্ধ এই বাড়িটির সাথেসাথে যেন পুরো পৃথিবী টাও নিরব হয়ে এসেছে। রাস্তায় বা আশপাশ থেকে কোনো আওয়াজ কানে ভেসে আসছে না, না ডাকছে রাতের এই অন্ধকারে কোনো কুকুর বা ঝিঝি পোকা। শুধু ঘড়ির কাটা উঠানামার টিকটিক শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে রাতটাও ধীরেধীরে গভীর হচ্ছে। সময়ের সাথেসাথে বাড়ছে তৌহিদের অস্বস্তিও। অনেক্ষণ যাবৎ একাএকা ড্রইং রুমে বসে আছে সে। অর্থির ঘরে যাবার মতো সাহস করে উঠতে পারছে না সে। এদিকে পা টাও ধীরেধীরে লেগে আসছে। টান করতে পারলে একটু ভালো হত! ভেবে উঠে দাঁড়াল তৌহিদ সোফা ছেড়ে। কিছুক্ষণ সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে এগুলো অর্থির ঘরের দিকে।
বিছানার এক কোণায় গাঢ় গোলাপি রঙের একটি শাড়ি পড়ে চুপচাপ বসে আছে অর্থি। তৌহিদ দরজার পাশে কিছু সময় অপেক্ষা করবার পর ধীরেধীরে সেদিকে এগুলো। অর্থির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার পুরো শরীর জুড়ে বেয়ে গেল শীতল এক রক্তস্রোত। অর্থির বাবা মহসিন চৌধুরীর করুণ আর্তনাদ এবং লিয়াকত সরকারের আদেশ মেনেই আজ বিয়েটা করতে হয়েছে তৌহিদের। শারীরিক দিক দিয়ে ছোট বেলা থেকেই কিছুটা দুর্বল সে। এর কারণেই নিজের বুঝ হবার পর থেকে নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রেখেছে সে। তেমনভাবে মেশেনি বাইরের কোনো মানুষের সাথে। যা বড় হবার পর পেশাগত দিকটা বিবেচণায় রেখে কিছুটা কমালেও, নিজেকে তেমন একটা ফ্রি করাতে পারেনি তৌহিদ। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও হাতে গণা কজন! তবুও সে নিজেকে তৈরি করেছে আত্মকেন্দ্রিক হিসেবে। কখনো নিজের প্রতিবন্ধকতার জন্য কারো উপর বোঝা হয়ে থাকতে চায় নি সে। নিজের উদ্দামে সে পৃথিবী কে দেখেছে, চিনেছে, শিখেছে। নিজের প্রতিবন্ধকতার ফলে বিয়েতেও সামান্য আগ্রহ ছিল না তার। কি দরকার শুধু শুধু হেসেখেলে জীবন পার করা একটি মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে কষ্ট দেবার! তাই তিনমাস আগেও ঐতিহ্যর সাথে বিয়ের কথা চললেও সে সামান্য আগ্রহ দেখায় নি তাতে। না যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছে। তাই আজ যখন ঐতিহ্যর জায়গায় অর্থিকে বিয়ে করতে হলো তাকে তখনো সে সামান্য আগ্রহ দেখায় নি। বাবার কথা মত চুপচাপ তিনবার কবুল বলে বিবাহিত এক নতুন জীবনের সূচনা করেছে। তাই বলে তার চেয়ে অর্ধেক বয়সী এক মেয়েকে! ভাবতেই একরাশ অস্বস্তি আবারো এসে ঘিরে ধরলো তাকে। আচ্ছা! বড়দের প্রতি তার এই অদ্ভুত সম্মানের জন্য,, সে কি ধীরেধীরে আত্মমর্যাদাহীন, অনুভূতিহীন রোবটে পরিণত হয়ে যাচ্ছে না??
-"কেমন আছেন...?"
অর্থির গলার স্বরে চিন্তারাজ্যর বেড়াজাল ছিড়ে তৌহিদ ফিরে এল বাস্তবে। কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিল,
-"ভালো,, তুমি?"
অর্থি সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-"বসুন..."
অর্থির পাশেই খানিকটা জায়গা রেখে বিছানায় বসলো তৌহিদ। খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর তৌহিদ লক্ষ করলো অর্থি এক নজরে তাকিয়ে আছে তার পায়ের দিকে। তখনি হঠাৎ বুকটা মুচড়ে উঠলো তার। আচ্ছা,, অর্থি এই বিয়েতে রাজি ছিল তো? মহসিন চৌধুরী জোর করে কিছু করে নি তো?
-"ঘুমোবেন না?"
আবারো অর্থি তৌহিদ কে ফিরিয়ে আনলো বাস্তব দুনিয়ায়। হালকা কেশে জবাব দিল সে,
-"হুম, তার আগে একটু গোছল দরকার ছিল। আসলে সারাদিন বাইরেই ছিলাম। হঠাৎ বিকেলে তৃষ্ণার জরুরী তলবে কোর্ট থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছি। থাকবার মতো কিছু হবে সেটা তো জানা ছিল না। তাই ওভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসি নি।"
-"অহ!! বাবার বাসায় পড়ার লুঙি হবে। ওটা দিয়ে চলবে?"
-"চলবে।"
অর্থি আর দেরি না করে বিছানা ছেড়ে উঠে এগুলো তার বাবা মহসিন চৌধুরীর ঘরের দিকে।
লুঙি এনে তৌহিদ কে দিতেই সে ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে। অর্থি কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে বিছানা গোছাতে শুরু করে দিল।
গোছল সেরে বের হতেই অর্থি তৌহিদের উদ্দেশ্যে বললো,
-"আপনি শুয়ে পড়ুন। বামদিকটায় শোবেন আপনি। আমার আবার ডানদিকে শুতে শুতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এদিকে না শুলে ঘুম হয় না।"
অর্থির এই সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার নিমেষেই মুছে দিল তৌহিদের মনে থাকা দুশ্চিন্তাগুলো কে। জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে, আর যাই হোক কখনোই এত স্বাভাবিক হতে পারতো না অর্থি।
ঠোঁটে হালকা হাশি ফুটিয়ে তৌহিদ বললো,
-"আচ্ছা। তুমি ঘুমুবে না?"
-"ঘুমাবো। আপনি শুয়ে পড়ুন।"
তৌহিদ বিছানায় গাঁ মেলে দিতেই ঘরের আলো বন্ধ করে দিল অর্থি। তারপর ধীরপায়ে এগুলো ব্যালকনির দিকে।
কি অদ্ভুত এই পৃথিবী,, না? যাকে দু চোখে সহ্য করতে পারতো না অর্থি, দেখলেই একরাশ অস্বস্তি হতো, যাকে নিজের বোনের বর হিসেবেই কল্পনা করতে নারাজ ছিল,,, সেই লোকটিই আজ অর্থির নিজের কপালেই এসে জুটলো। এখন থেকে সব সময় এই লোককে চোখের সামনে দেখতে হবে, সব সময় সহ্য করতে হবে! কি করে সে চুপচাপ সহ্য করবে এগুলো! কি করে! যে লোকটির চেহারা দেখলেই অসহ্য লাগে, সেই লোকটির পাশেই আজ থেকে রাতে ঘুমুতে হবে তার। বাবার কথায় সে কয়দিন চুপচাপ সহ্য করবে এগুলো! এসব ভাবতে ভাবতেই মেঝেতে বসে পড়লো অর্থি। দু চোখ বেয়ে ঝরতে লাগলো অঝর ধারায় জল। বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো স্বরহীন গলায় চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, কেন এসবের মাঝে আমাকে ফেললে আল্লাহ! কেন! আমি পারবো না এই লোককে কখনো মেনে নিতে। পারবো না......
তৃষ্ণার বারবার নড়েচড়ে উঠায় প্রচণ্ড রকমের বিরক্ত হলো মাহসান। তৃষ্ণার দিক ফিরে বিরক্ত গলায় বললো,
-"সমস্যা কি তোমার! শান্তিমত ঘুমোতেও দেবে না? বারবার এভাবে নড়ছো কেন!"
-"রাত জেগে তোমার ঘুম ভাঙাবার জন্য ইচ্ছে করে তো নড়ছি না। খারাপ লাগছে আমার,, অস্থির অস্থির লাগছে। ঘুম আসছে না।"
-"প্রেগনেন্সির ৯ সপ্তাহেই এমন অস্থির! আরো তো ৩১ টা সপ্তাহ পড়েই আছে। নিজেকে সামলাতে শেখো। অল্পতেই এত অস্থির হওয়াটা কমাও।"
মাহসানের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। বললো,
-"আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন! আমি ইচ্ছে করে এগুলো করছি নাকি!"
ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো মাহসান। বললো,
-"সরি! মন, মেজাজ, মাথা কিছুই ঠিক নেই।"
-"সেটা তো আমারো ঠিক নেই। তাই বলে কখনো খারাপ ভাবে কথা বলছি তোমার সাথে?"
-"প্লিজ,, তৃষ্ণা! তর্ক না করে ঘুমিয়ে পড়। এমনিতেই মন মেজাজ টা ভালো না।"
-"মেজাজ তো খারাপ থাকা উচিৎ আমার। অর্থির মত বেয়াদব মেয়ে, যে কিনা ল্যাংড়া, প্রতিবন্ধী যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিল আমার ভাইকে। সেই মেয়েই কিনা আজ আমার ভাইয়ের বউ হলো। আর আমি এসব নিজ কানে শুনেও না পেরেছিলাম সেদিন কিছু বলতে, আর আজ না পারলাম কিছু করতে।"
শোয়া থেকে উঠে বসলো মাহসান। কঠিন গলায় বললো,
-"এনাফ! অনেক বলেছো। আর একবার অর্থির নামে কিছু বললে খারাপ হয়ে যাবে তৃষ্ণা।"
-"তুমি বলো নি আমার ভাইকে?"
-"ইউ,,, জাস্ট...."
আর কথা বাড়ালো না মাহসান। বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। তার ছোট্ট বোনদুটির উপর দিয়ে আজ কি ঝড় টাই না বেয়ে গেল। অর্থি, কি করছে ঘরে কে জানে! তৌহিদ জোরাজুরি কিছু করছে না তো! অপরদিকে ঐতিহ্য কার সাথে, কেমন ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে কে জানে! ঠিকঠাক আছে তো ঐতিহ্য! এসব প্রশ্নের উত্তরে শুধু তার বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ নিশ্বাস।
আজ সারাদিনে নিহালের উপর দিয়ে কম ধকল যায় নি। বলতে গেলে ভোরে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই প্যারার মাঝেই আছে সে। তাই এখন বিছানায় শরীর লুটিয়ে দিতে পেরে ঘুমে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এল তার। হঠাৎ ঘরে কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো সে। তারপর তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নেমে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলো ঐতিহ্যর। চুলের খোঁপা খুলে খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিশ্বাস নিতে লাগলো।
নিহালের স্পর্শে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো ঐতিহ্যর। চোখজোড়া বন্ধ করে সে ধীর গলায় বললো,
-"ছাড়ুন,,"
-"হু..."
-"প্লিজ,, ছাড়ুন না!"
চুলের ভেতর থেকে মুখ উঠিয়ে কোমর ছেড়ে ঐতিহ্যকে নিজের দিকে ঘোরালো নিহাল। তারপর ঐতিহ্যর কপালে হাত রেখে বললো,
-"জ্বর তাহলে কমেছে আপনার!"
-"হু।"
-"তাই তো বলি! জ্বর থাকা অবস্থায় নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলেন, বুকে চুমু খেলেন আবার ছাড়তে ও চাইলেন না। অথচ জ্বর কমাতেই ছাড়ুন, প্লিজ ছাড়ুন না!!!"
লাজুক ভঙ্গিতে ঐতিহ্য বললো,
-"ইশ!! মোটেও না! আমি কখনওই ওগুলো করি নি।"
-"আচ্ছা থাক! আর লজ্জা পেতে হবে না! কেমন লাগছে এখানে?"
-"ভালো.."
-"আব্বা আম্মা কে কেমন লেগেছে?"
-"তারাও অসম্ভব ভালো।"
-"আচ্ছা! ঘুমোবে না? রাত তো অনেক হলো।"
এ কথা বলতেই ঐতিহ্যর নজর গেলো বিছানার দিকে। ফুলেফুলে বিছানাটা ভরে আছে। দেখে আস্তো একটা ফুলের বাগান মনে হচ্ছে। ওদিক থেকে নজর সরিয়ে মেঝের দিকে দিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"হু।"
-"তাহলে যাও,, শাড়িটা চেঞ্জ করে আসো। আমার প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগছে। তাড়াতাড়ি করবা, প্লিজ।"
-"আমার শাড়ি চেঞ্জের সাথে আপনার ঘুমানোর কি সম্পর্ক! আপনি যান ঘুমিয়ে পড়ুন।"
নিহাল ঐতিহ্যর মুখ তুলে ধরলো নিজের দিকে। তারপর দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো,
-"ছাত্রী কে বউ করে ঘরে আনলাম। অথচ ছাত্রী আমার ছাত্রীই থাকতে চাচ্ছে। তাহলে আমার আর কি করার! ক্লাস নিতেই হবে। এতোদিন বাংলা নিতাম,, এখন না হয়...."
নিহালকে থামিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর সাথে অসভ্য অসভ্য কথা বলতে বাধছে না আপনার!!"
অট্টহাসি দিয়ে ঐতিহ্য কে পাঁজকোলে উঠিয়ে নিল নিহাল। বিছানার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"জ্বি না, ম্যাম। ছাত্রী পরে, আগে বউ! তো আজ থেকেই তাহলে ক্লাস শুরু করা যাক।"
ঐতিহ্য কে বিছানায় নিয়ে শুয়িয়ে শাড়ির আচল বুকের উপর থেকে সরিয়ে ফেলে দিল নিহাল। অপরদিকে ঐতিহ্য নিহালকে তার কাছাকাছি আসতে দেখে দু চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
-"রাতে অর্থির কল করার কথা ছিল। ও তো কল করলো না!"
নিহাল এমন মুহূর্তে ঐতিহ্যর মুখ থেকে এধরণের কথা শুনে প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেও পরমুহূর্তে নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো।
(চলবে)
""সম্পর্কের_টান"""
পর্ব-১৪
সকালের নাস্তা সেরে লিয়াকত সরকার দেখা করতে গেলেন মহসিন চৌধুরীর সাথে তার ঘরে। মহসিন চৌধুরীর শরীরের অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। প্রেশার টা গতকাল রাতে বেড়ে গেলেও এখন আর নেই। তবুও শরীর দুর্বলতা রয়েই গেছে। অপরদিকে পায়ের অবস্থাও খারাপ। মচকে গেছে। ব্যথানিবারণের জন্য ঔষধ সেবন করলেও তা তেমন একটা কাজে দেয় নি।
-"আসবো বেয়াই?"
চোখ মেলে তাকিয়ে জবাব দিলেন মহসিন চৌধুরী,,
-"আসুন, আসুন। বসুন।"
-"কিছু কথা ছিল।"
-"জ্বি,, বলুন।"
চেয়ারে বসতে বসতে রাতের ঠিক করা কথা গুলো মনে মনে একবার আওড়িয়ে নিল লিয়াকত সরকার। তারপর বললো,
-"আপনার শরীরের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এ বাড়ির সবার মনের অবস্থাও এখন খারাপ। এর মাঝে অনুষ্ঠান করে বউ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া টা ঠিক হবে না। তাই আমরা আজই অর্থি মা কে নারায়ণগঞ্জ আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে না হয় একটা রিসিপশনের ব্যবস্থা করা যাবে। কি বলেন?"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মহসিন চৌধুরী বললেন,
-"আপনার যা ভালো মনে হয় করুন। এই মেয়েদের নিয়ে আমার আর কোনো কথা নেই।"
মহসিন চৌধুরীর কথায় মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো লিয়াকর সরকার। প্রচণ্ড রকমের খুশি ও সে আজ। কি দরকার টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার!! অন্যদের দাওয়াত দিয়ে খাবার খাওয়ানো সাথে বিনামূল্যে কিছু কথা শোনার কোনো মানে হয় না!!
অর্থিকে নিয়ে তৌহিদরা যখন নারায়ণগঞ্জ পৌছালো, তখন বেলা বাজে দুপুর ২ টা। বাড়ির ভেতর ঢুকেই চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল অর্থি। তার বলা মুরগির খোঁপেই আজ এসে উঠতে হলো তাকে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
মাঝারি সাইজের একটি ঘর তৌহিদের। অর্থির নিজের ঘরের তুলনায় এ ঘরটি খুব ছোট। ছোটমোটো এ ঘরের মাঝে জিনিশপত্র দিয়েই ভরে আছে চারিদিক। ঘরের তুলনায় বড়সড় একটি খাট,, একটি পড়ার টেবিল.. যার উপর কাগজপত্রে ভর্তি,, বড়সড় একটি বুক সেলফ.. যাতে নানা ধরণের বই সহ কিছু ফাইলে ঠাসা,, একটি স্টিলের আলমারি যার এক পাল্লার সাথে আয়না লাগানো,, বাসায় পড়ার কাপড়চোপড় রাখার জন্য একটি আলনা.. যা ময়লা অগোছালো কাপড় চোপড়ে ভরে আছে,, একটি ছোট প্লাস্টিকের র্যাক.. যেটিতে জিনিশপত্র রাখার পর কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কি আছে ওতে? সেদিকে পা বাড়ানোর সাথেসাথেই ঘরে ঢুকলো তৌহিদ। অর্থির বাড়ি থেকে আনা ব্যাগটি মেঝেতে নামিয়ে রেখে বললো,
-"জলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। গোছল দিলেও দিয়ে নিতে পারো।"
তারপর সে এগুলো বাথরুমের দরজার দিকে। দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বললো,
-"তুমি এটাতে ঢোকো। আমি অন্যটাতে যাচ্ছি।"
ব্যাগ খুলে বাসায় পড়ার একটি টপস হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুলো অর্থি। দরজার সামনে দাঁড়াতেই ঘেন্নায় মুখ ভর্তি বমি এসে গেল অর্থির। পিচ্ছিল উঁচুনিচু স্যাঁতসেঁতে মেঝের নিচ দিয়ে, কোণায় কোণায় শ্যাওলা পড়ে আছে। ট্যাপ, বেসিন, আয়না, বালতি, মগ কোনকিছুর দিকে মুখ ফিরেই তাকানো যাচ্ছে না। কি করে এই জাহান্নামের ভেতর ঢুকবে সে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বন্ধ করে সে ধীরেধীরে পা রাখলো ভেজা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। দরজা বন্ধ করে জামাকাপড় ঝুলিয়ে রেখে বালতির দিকে তাকাতেই অর্থির নজর গেল টয়লেটের প্যানের দিকে। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে। ঘড়ঘড়িয়ে মুখ ভর্তি বমি করে দিল অর্থি।
ছোট বয়স থেকেই কিছুটা শুচিবায়ু টাইপের অর্থি। কখনওই বাড়ি ছেড়ে এখানে ওখানে বা গ্রামে গিয়েও থাকে নি সে। পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, ফিটফাটের সাথেই বড় হয়ে উঠেছে সে। এমনকি দূরে কোথায় যাবার পথেও কখনো পানি খেয়ে বের হয় নি অর্থি। বলা তো যায় না, মাঝপথে যদি প্রস্রাবের চাপ পেয়ে বসে!! তখন তো পাব্লিক টয়লেট ইউস করতে হবে। আর পাব্লিক টয়লেট নামের সাথেই এলার্জি আছে অর্থির।
বমি, শ্যাওলা, প্যান সব এক হয়ে ঘুরতে লাগলো অর্থির মাথার ভেতর। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো তার। রাগ, অভিমান, কষ্ট, দুক্ষে নিজে চুল টেনে ছিঁড়তে লাগলো সে। চোখের পানি আর বাঁধ মানলো না। উপচে পড়তে লাগলো চোখের কোণা বেয়ে।
গোছল সেরে নিজের ঘরে এসে একটি টিশার্ট পড়ে নিল তৌহিদ। কিছুক্ষণ অর্থির জন্য অপেক্ষা করে আলমারির দুটো তাক খালি করতে লাগলো সে অর্থির জন্য। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সেদিকে ফিরে তাকালো তৌহিদ।
মাথায় টাউয়েল পেঁচিয়ে ঢোলাঢুলা একটি টিশার্ট সাথে একটি প্লাজো পড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো অর্থি। তৌহিদ অবাক হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নজর সরিয়ে নিল সে। হালকা কেশে বললো,
-"তুমি কামিজ আনো নি?"
অর্থি সে কথায় উত্তর না দিয়ে টাউয়েল চুল থেকে খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো বিছানায়।
সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে নিহাল। এখন বাজে বিকাল ৫ টা। দুপুরে খেতেও বাসায় ফেরেনি সে। না ঐতিহ্যর কাছে একটা কল করেছে! অবশ্য কল করবেই বা কিভাবে! ঐতিহ্য তো বাবার ভয়ে ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু নিহাল তাকে এই বাসায় একা ফেলে কিভাবে সারাদিন বাইরে কাটাচ্ছে!! নিহালের ঘরের সাথেই ছোট্ট একটি ব্যালকনি লাগানো। সেখানে বসার ব্যবস্থা হিসেবে রয়েছে ছোট একটি দোলনা। সেখানে বসেই এসব চিন্তায় ডুবে ছিল ঐতিহ্য। কখন যে তার পাশে এসে নিহাল বসে পড়েছে সেদিকটাও লক্ষ করেনি সে। হঠাৎ কোমরে ব্যথা পেয়ে কাতরিয়ে উঠলো সে।
-"সরি,, সরি.. জোরে লেগেছে খুব?"
নিহালের কথায় চোখমুখ কুঁচকে তার দিকে তাকালো ঐতিহ্য। বললো,
-"আপনি কখন এলেন? আর এসেই এভাবে ব্যথা দিলেন কেন! এমনিতেই শরীর ভালো না। ব্যথায় ভরে আছে।"
-"তোমার দৃষ্টি আকর্ষন করলাম। তুমি তো গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলে।"
-"তাই বলে ব্যথা দিতে হবে!"
-"সরি, আমার বউ, লক্ষি বউ, ময়না বউ।"
বলতে বলতে জোর করে নিজের কোলে বসালো ঐতিহ্য কে। চুল সরিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-"রাগ করে আছো.. না?"
-"উহু.."
-"আমি জানি, রাগ করে আছো তুমি।"
অভিমানী গলায় ঐতিহ্য বললো,
-"জানেন যেহেতু তাহলে রাগ করানোর মতো কাজ কেন করেন! কাল মাত্র এসেছি আমি এ বাড়িতে। আর আজ আমাকে একা ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন!"
-"একা হবে কেন! বাবামা, নিশু তো ছিল।"
-"ওরা থাকা আর আপনি থাকা কি এক!"
-"আচ্ছা, যাও সরি! আর কখনওই এমন করবো না। ফ্রেন্ড রা মিলে ধরেছিল। দুপুরে নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ানোর পর ছেড়েছে।"
-"অহ! দেখি ছাড়ুন, নেমে বসি। এভাবে বসা দেখলে কে কি ভাব্বে!"
নিহাল আরো জোরে চেপে ধরলো ঐতিহ্য কে। বললো,
-"কে কি বলবে,, হুহ! আমার বউকেই কোলে নিয়ে বসে আছি,, অন্যের বউ কে তো না!"
নিহালের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো ঐতিহ্য। তারপর বললো,
-"আপনার ফোনটা একটু দিন তো। অর্থিকে কল করবো একটা।"
হালকা উঠে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে ঐতিহ্যর হাতে দিল নিহাল। বললো,
-"আমার শালিকা যে ছবি চেয়েছিল,, পাঠিয়েছিলে ওকে?"
-"হুঁ.."
কয়েকবার কল দেবার পর অর্থির ফোন বন্ধ পেলো ঐতিহ্য। ঝামেলা হয় নি তো বাসায়? বাসার পরিস্থিতি ভাবতেই হাতপা ঠান্ডা হয়ে এল ঐতিহ্যর। ঐতিহ্যর মন খারাপ দেখে তাকে নিজের দিকে ঘোরালো নিহাল। বললো,
-"একটা গান শোনাই?"
-"না.."
-"প্লিজ..."
-"আচ্ছা,, শুনান।"
ঐতিহ্যর অনুমতি পেয়ে আর দেরি করলো না নিহাল। গলা ছেড়ে গাইতে লাগলো সে,,,
""হয়তো আমি এখনও আঁধারে তোমায় হাতরে বেড়াই,,,
এখনও যেন স্বপ্নলোকে তোমাকেই ফিরে পাই।
হয়তো এখনও বেহায়া এ মন লুকিয়ে আলতো করে,
ভাবছে তোমায় আঁকছে ছবি নিজেরই অজানায়।
সবটুকুই হোক তোমার যেন সূর্য চাঁদের মাঝে
লেখা থাক এ গল্পের ইতি নতুন এর শব্দে......
আমি হাটতে চাই তোমার সাথে শুরু থেকেই পথের শেষে,,
হঠাৎ থমকে দিয়ে বলতে চাই ধন্য ঐতি তোমায় ভালবেসে।।
ভালবেসেও মিথ্যে বলেছি, অজান্তে অনেক বার,,,
সবকিছু জেনে তবু ভেবেছি তোমায়, ছিলেনা তুমি এ বৃত্তে আমার।
বিধাতার কাছে চাইছি আমি ক্লান্ত হয়ে আজ আনমনে,
দিয়ে দাও আমার স্বপ্ন গুলো আমায়....
আমি হাটতে চাই তোমার সাথে শুরু থেকেই পথের শেষে ,
হঠাৎ থমকে দিয়ে বলতে চাই ধন্য ঐতি তোমায় ভালবেসে।।
আজ যেন এই নতুন এই আকাশ, চাইছে তোমায় এখানে,,,
বাতাসেও এই নতুন শব্দে, সাক্ষ্য দেয়ার সুর প্রতিক্ষণে।
তবে আজ কেন দ্বিধা মনে, সম্পূর্ণতার পুরনক্ষনে,
ভেবে নিয়েছি তোমায় নিজের করে...
আমি হাটতে চাই তোমার সাথে শুরু থেকেই পথের শেষে ,
হঠাৎ থমকে দিয়ে বলতে চাই ধন্য ঐতি তোমায় ভালবেসে।""
গান শেষ হতেই লাজুক একটা হাসি দিল ঐতিহ্য। নিহালের গালে ঠোঁট ঠেকিয়ে হঠাৎ একটি চুমু দিয়েয়ে বসলো সে। তারপর বললো,
-"ধন্যবাদ আপনাকে! বাই দা ওয়ে, গানে কি ঐতি শব্দ টা ছিল?"
-"উম্ম,, ছিল না, তবে আমি এড করে নিয়েছি। দেখো কতো সুন্দর শোনায়, 'আমি হাটতে চাই তোমার সাথে শুরু থেকেই পথের শেষে, হঠাৎ থমকে দিয়ে বলতে চাই ধন্য ঐতি তোমায় ভালবেসে।"
রাত ১২ টার দিক বাসায় ঢুকলো মাহসান। সেই সকালে বেরিয়েছিল অফিসের উদ্দেশ্যে। ফিরলো মাত্র। আজ মহসিন চৌধুরী অফিসে না থাকায় সব মাহসান কে একাই সামলাতে হয়েছে। সব দিক সামলিয়ে, বোনদের চিন্তায় চিন্তায় একদিনেই পাগল হবার উপক্রম হয়ে পড়েছে সে। এসব অশান্তির মাঝে বাসায় থাকতেও অসহ্য লাগে। তাই অফিসের কাজ শেষ করে ফ্রেন্ডের সাথে একটু বেরিয়েছিল সে।
মাহসান ক্লান্তশরীর নিয়ে ঘরে ঢুকতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো তৃষ্ণা। মাহসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"এতো রাত হলো যে!!"
মাহসান সে কথার উত্তর না দিয়ে শার্ট খুলতে লাগলো। তৃষ্ণা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষার পর আবারো বললো,
-"খাবার দিতে বলবো টেবিলে?"
-"না।"
বলেই মাহসান ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েই ফোনটা চার্জে লাগালো মাহসান। তারপর দেরি না করে আলো নিভিয়ে শরীর লুটিয়ে দিল বিছানায়। তৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে মাহসানের শরীরে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো,
-"না খেয়েই ঘুমাবে? নাকি খেয়ে এসেছো?"
-"হু,, খেয়ে এসেছি।"
-"অহ.. আচ্ছা শোনো, অর্থির কাছ থেকে ঐতিহ্যর হাজবেন্ডের নাম্বার রেখে দিয়েছি। একবার যোগাযোগ করে দেখো।"
তৃষ্ণার কথায় মেজাজ টা চরম খারাপ হয়ে গেল মাহসানের। রাগত্ব স্বরে সে তৃষ্ণাকে বললো,
-"আমার বোনদের নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাতে হবে না তোমার। তুমি তোমার মতো থাকো। আর প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দাও। কাল রাতে তোমার জন্য ঘুম হয় নি আমার। আবার আজও সেই ধান্ধা করছো!"
-"আচ্ছা,, ঘুমাও।"
বলেই মাহসানের শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বিছানার এক কোণা ঘেঁষে অপরপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো তৃষ্ণা। চোখ দিয়ে তার অনবরত জল পড়েই যাচ্ছে। কি এমন করেছে সে, যে মাহসান দুদিন হলো এমন দুর্ব্যবহার করছে তার সাথে! শুধু কাল রাতে রাগের মাথায় অর্থিকে বেয়াদব বলেছিল। তাই বলে কি অর্থি বা ঐতিহ্যর জন্য খারাপ লাগছে না ওর নিজের? ভাই বলে সব চিন্তা শুধু মাহসানের একারই হচ্ছে? আর সে ভাবি বলে কি কোনো চিন্তাই হচ্ছে না ওদের জন্য!!!
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।