সম্পর্কের টান । পর্ব-১৫+১৬

সম্পর্কের টান
 পর্ব-১৫+১৬

আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলতেই তৌহিদের সামনে পড়লো অর্থির ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখ। জড়সড়ভাবে সে ঘুমিয়ে আছে বিছানার এক কোণা ঘেঁষে। গতকাল সকালে ঘুম ভাঙার পর তৌহিদের এমন একটি দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য না হলেও আজ হয়েছে। প্রতিদিন এভাবে সকালটা শুরু হলে কিন্তু মন্দ হয় না! ভেবেই হালকা হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো তৌহিদ। এখন বাজে ভোর ৬ টা। যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আবার ৯ টার দিকে কোর্টের উদ্দেশ্যে বেরুতে হবে। আজ অনেক কাজ পড়ে আছে তার। কখন, কিভাবে কোন কাজটা করবে সব রাতে ভেবেই ঠিক করে রেখেছে সে। এখন শুধু সে অনুযায়ী ঠিকঠাক ভাবে কাজ করতে হবে। সবার প্রথমে যেটা করতে হবে সেটা হলো ঘরটা পরিষ্কার করা, তারপর বাথরুম টা। কাল খুব ভালো করেই সে বুঝতে পেরেছে অর্থির এই বাথরুম ব্যবহার করতে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছে। অবশ্য হবারই কথা। ছোট বেলা থেকেই অন্যরকম এক পরিবেশে বড় হয়েছে অর্থি। আর এখন এসে পড়েছে এই পরিবেশে। গুছিয়ে উঠতে কিছু সময় লাগবে। আর এই কিছু সময়ই অর্থিকে যথেষ্ট সহায়তা করতে হবে তার। স্বামী হিসেবে ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করবে তাকে। কতোটা দ্রুত গুছিয়ে উঠতে পারবে সেটা অর্থির উপর নির্ভর করবে। তবে যাই হোক না কেন, স্বামী হিসেবে সে সব দিক দিয়ে নিখুঁত হবা চেষ্টা করবে। পারবে কি সে? প্রশ্নের উত্তরে তার মনে পড়ে গেল গতকাল দুপুরের কথা। গোছল সেরে এসে না খেয়েদেয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিল অর্থি সন্ধ্যা পর্যন্ত। কয়েকবার ডাকার পরেও উঠে খেতে যায় নি। তখন মাথায় কিছু না এলেও পরে রাতে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল তৌহিদ না খাবার কারণ। আসলে তারই উচিৎ ছিল বাড়িতে বউ আসার আগে বাড়িটা চেইঞ্জ করা অথবা ঠিকঠাক করে নেওয়া। সে যা আয় করে, এতে এর চেয়ে ভালো বাড়িতে থাকতে পারবে তারা। কিন্তু তার বাবা লিয়াকত সরকার তো অযথা এক পয়সাও খরচ করতে নারাজ! তার মতে থাকার মত একটা জায়গা হলেই হলো, মানুষ করে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছে কি আরাম আয়েশে দিন পাড় করার জন্য!! সেখানে বাবার উপর দিয়ে কিভাবে কথা বলবে সে! আর বলাটা ভালো ও দেখায় না। এই বাবার কারণেই সে হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ সমাজের এই অবস্থানে আসতে পেরেছে...

আলনা, টেবিল, বুক সেলফ পরিষ্কারের পর তৌহিদ ঘরটা মুছে দিল। এরপর ছোট্ট একটি ঝাড়ু, সাবান আর সামান্য বালু হাতে ঢুকলো বাথরুমে। চারপাশে সাবান এবং বালু ছিটিয়ে দেবার পর ঝাড়ু দিয়ে চারপাশটা পরিষ্কার করতে লাগলো। এই বাথরুমটা তৌহিদ একাই ব্যবহার করে। আর ড্রইংরুমের সাথে লাগানো টা ব্যবহার করে বাড়ির অন্য সদস্যরা। এদিকে তৌহিদ নিজেও তেমন একটা বাড়িতে থাকে না। কোর্ট, নিজের চেম্বার নিয়েই তাকে পড়ে থাকতে হয় রাত দিন। শুধু রাত টা বাড়িতে কাটিয়ে আবারো সকালে ছুটতে হয় বাইরে। তাই বাথরুমের এই শ্যাওলা পড়ে করুণ অবস্থা যে কবে হয়েছে সেটাও নজরে আসে নি তার। হয়তো তার মা তৌহিদা বেগম সুস্থ থাকলে এদিকটায় নজর দিত। কিন্তু তার শরীরও ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। বাতের ব্যথায় ধীরেধীরে তার শরীরটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। নীচু হয়ে কোনো কাজই করতে পারে না। তৌহিদ মায়ের এ সমস্যার কথা ভেবে বাড়িতে একটি কাজের বুয়া ঠিক করতে চেয়েছিল। কিন্তু এতেও তার বাবা লিয়াকত সরকারের অমত...

চারপাশটা ভালোই পরিষ্কার হয়েছে। ঝকঝক করছে। তৌহিদ কিছু সময় বসে জিরিয়ে নিল। তারপর আবার শুরু করলো বেসিন পরিষ্কারের কাজ। বেসিন পরিষ্কারে তাকে তেমন একটা কষ্ট করতে হলো না। এরপর বালতির দিকে তাকাতেই সে ভাবলো,, বালতি, মগ আর বদনা টার মনে হচ্ছে একযুগ হয়ে এসেছে। পালটাতে হবে। তবে কাজটা করতে হবে চুপেচাপে। বাবা জানতে পারলে এ নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দেবে!

সব কিছু ধুয়েমুছে পরিষ্কারের পর একবারে গোছল সেরে ঘরে ঢুকলো তৌহিদ। এখনো ঘুমিয়েই রয়েছে অর্থি। শরীরের জামা কাপড় একটিও ঠিক জায়গা মত নেই। প্লাজো টা উঠে রয়েছে হাটুর উপরে, টিশার্টের গলা খানিকটা নিচে নেমে এসেছে, পেটও সামান্য বের হয়ে আছে। অর্থির ধবধবে সাদা শরীরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তৌহিদ। একটা ঘোড় কাজ করছে তার মাঝে। খুব ইচ্ছে করছে একটিবার ছুঁয়ে দিতে অর্থিকে। ভাবতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৌহিদ। নিজের ইচ্ছাকে দাবিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো ঘর ছেড়ে। খাবার টেবিলে বসতেই তৌহিদের মাথায় এল, কাল রাতে যখন খেতে এসেছিল অর্থি, তখন তাকে এমন পোষাকে দেখে বাবামা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। আজ বাড়ি ফেরার সময় না হয় কয়েকটি কামিজ কিনে আনবে সে অর্থির জন্য। সাথে বালতি আর মগটাও আনতে হবে....

বিছানাটা ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে নিল ঐতিহ্য। নিহাল মসজিদ থেকে ফিরলেই একসাথে খেতে বসবে। এ বাড়িতে সময় কাটাতে তেমন একটা খারাপ লাগে না ঐতিহ্যর। বরং খুব ভালো লাগে। তবে নিহাল পাশে থাকলে। বাদবাকি সময়টা কেমন একটা অস্থির অস্থির লাগে। শুধু কখন ফিরবে নিহাল এটা ভাবতে ভাবতেই কাটে। বিছানায় বসে ফোন হাতে নিল ঐতিহ্য। আজ সকালেই ফোন খুলেছে সে, অর্থিকে কল করে বাসার পরিস্থিতি জানবার জন্য। কিন্তু অর্থির নিজের ফোনই তো অফ। এদিকে বাসার আর কারো কাছে কল করবার সাহসও হচ্ছে না ঐতিহ্যর। তাহলে এখন কিভাবে খোঁজখবর নিবে সে! হঠাৎ ফোনের ম্যাসেজ টোনে স্ক্রিনের দিকে তাকালো সে। তৃষ্ণা ভাবি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে! তাড়াহুড়ো করো ম্যাসেজ ওপেন করে পড়তে লাগলো সে।
Vabi - Babar obostha valo na. Hospital a admit kora hoice. Parle dekhte eso..
ম্যাসেজ পুরোটা পড়েই থরথর করে হাত পা কাপতে শুরু করলো ঐতিহ্যর। কি হয়েছে বাবার!

নিহাল নামাজ না পড়েই মসজিদ থেকে বাসায় ফিরলো। তাড়াহুড়ো করে শোবার ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল ঐতিহ্য বিছানায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। অপরদিকে নিহালের উপস্থিতি টের পেয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো ঐতিহ্য। চোখের পানি মুছে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
-"বা..বাবা অসুস্থ,, ভাবি..."
-"আমাকেউ ম্যাসেজ করেছিল। পরে আমি কল দিলাম,, কি হয়েছে, কেমন অবস্থা জানার জন্য। তখনই সব বললো ভাবি। ঐতিহ্য, তুমি কি যেতে চাও?"
-"হু..."
-"তাহলে রেডি হয়ে নাও। খাওয়াদাওয়া করেই বেড়িয়ে পড়ি।"
ঐতিহ্য নিহালকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-"খাবো না আমি। তাড়াতাড়ি চলো, প্লিজ। কিছুই ভালোলাগছে না আমার। আমার জন্যই আজ বাবার এই অবস্থা। কেন সেদিন বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম আমি!!"

মহসিন চৌধুরীর গুলশানের চারতলা বাসা যা চারিদিকে একসময় হাসি, খুশি, আড্ডায় ভরে থাকতো,, আজ তা ভরে আছে করুণ আর্তনাদের আহাজারিতে । স্ত্রীর তার স্বামী, ছেলেমেয়ের তাদের বাবা, ছেলের বৌয়ের তার শ্বশুর হারানোর কষ্টে আর্তনাদধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আপনজনকে হারানোর দুঃখ তো সহ্য করবার মত নয়..

দুপুরের দিকে মহসিন চৌধুরীর শরীর হঠাৎ করে খারাপ হয়ে পড়ে। হসপিটালে সাথেসাথে নিয়ে ভর্তি করা হলেও বিকেল ৫ টার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মহসিন চৌধুরী। ডাক্তারদের মতে দুদিন আগে ওয়াশরুমে পড়ে যাবার সমই প্রথম স্ট্রোক করে মহসিন চৌধুরী। তবে সেটা গুরুতর আকারে রূপ না নিলেও আজকের দুপুরে করা দ্বিতীয় স্ট্রোকটির জন্য শরীর খারাপ হয়ে পড়ে তার। হসপিটালে ভর্তির পর অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে গেলেও বিকেলে তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করে সে। যার আধাঘণ্টা পরেই মারা যায় মহসিন চৌধুরী।

মহসিন চৌধুরীর মৃতদেহ এনে রাখা হয়েছে তার নিজের গড়া গুলশানের বাড়িতে। ড্রইংরুম লোকজনে ভরে আছে। পাশের একটি রুম খালি করে দেয়া হয়েছে মাদ্রাসার ছাত্রদের দোয়াদরুদ পড়ার জন্য। সেখানে বসেই তারা জোরে জোরে কোরআন পাঠ করছে। মহসিন চৌধুরী এবং শান্তি বেগমের ঘরে বসে বসে চিৎকার করে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে অর্থি এবং তার মা। তাদের কান্না  আর করুণ আর্তনাদ দেখে আশেপাশের মানুষ গুলোর হৃদয়ও কেঁদে উঠছে, চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

মহসিন চৌধুরীকে ধোয়ানো শেষ। কাফনের সাদা কাপড় পড়িয়ে এখন নিয়ে রাখা হয়েছে ড্রইং রুমে। মাথার পাশে ধুপ জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ধুপের গন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। পাশে চুপচাপ বসে আছে মাহসান। তাকে একা করে তার বাবা চলে গেল? কেনো গেলো? তার সাথে অভিমান করে? তার অভিমান তাকেই ফিরিয়ে দিয়ে গেল বাবা? কেনো বাবা? তোমার উপর রাগ করে ছিলাম বলে তুমি আমাকে ফেলেই চলে গেলে? বকতে পারলে না? বুঝাতে পারলে না আমাকে? তুমি তো ভালো চেয়েই সব করেছিলে, তাহলে সবার ভালো দেখার আগেই কেন চলে গেলে তুমি, বাবা? তোমার ছেলে মেয়েদের উপরই তুমি অভিমান করে চলে গেলে আমাদের সবাইকে এতিম করে??

বাবার পাশ থেকে উঠতে ইচ্ছে না করলেও উঠে মাহসান সবাইকে জানালো,, এশার নামাযের পর জানাজা হবে, তারপর মাটি। তারপর তৃষ্ণার খোঁজে এগুলো ভেতরের দিকে।

-"ঐতিহ্য রা কতোদুর?"
-"আর ১০ মিনিটের মত লাগবে বললো।"
আর কোনো প্রশ্ন না করে মাহসান আবারো এগুলো ড্রইংরুমের দিকে। তৃষ্ণা ফোন হাতে নিয়ে আবারো কল করলো নিহালের নাম্বারে।

  (চলবে)

"""সম্পর্কের_টান"""

 পর্ব-১৬

দুদিন আগে যেখান থেকে চুপেচাপে বের হয়ে গিয়েছিল ঐতিহ্য আজ সুখের সেই নীড়ে ফিরে সবকিছু দেখে, কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল সে। এত মানুষজন কেন এই বাড়িতে? আর নিহালই বা তাকে হসপিটালে না গিয়ে বাড়িতে কেন নিয়ে এল? মুহূর্তের মাঝেই উত্তর পেয়ে গেল সে। অর্থির চিৎকার করে আর্তনাদধ্বনিতে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। বাবা ঠিক আছে তো! সিঁড়ি বেয়ে দোঁতালায় উঠে বাসার ভেতর ঢুকতেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটি চোখে পড়লো ঐতিহ্যর। ধীরেধীরে সেদিকে এগুতেই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এল তার। ফর্সা, সাদা দাড়িওয়ালা, লম্বা চেহারার একজন শুয়ে আছে মেঝেতে। চোখদুটো বুঁজে রয়েছে। কত আরামের ঘুমই না ঘুমিয়েছে সে!!

ঐতিহ্য কে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে এল মাহসান। শুয়িয়ে দিল বিছানায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ঐতিহ্য। তার এই বোনটি বড়ই শান্তশিষ্ট, বোকা স্বভাবের, একথায় অবুঝ। এসব সহ্য করার মত শক্তি ওর নেই। অর্থির মতো কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে হয়তো হালকা হতো। কিন্তু ও তো এমন কখনওই করবে না। একলা ঘরের এক কোণায় বসে নিরবে কেঁদে বুক ভাসাবে! কাওকে কিচ্ছুটি জানতেও দেবে না। কি হবে এক সময়ের ছোট্ট আদরের বোনটার সাথে রাগ করে থেকে? ও না হয় না বুঝে একটা ভুল করেই ফেলেছে,, বুঝেশুঝে তো কিছু করেনি। আর এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ওকেই সাপোর্ট করা দরকার। হয়তো ও নিজেকে এসবের জন্য দায়ী মনে করছে। কিন্তু আসলেই তো সেটা নয়! বাবার মৃত্যু এভাবে লেখা ছিল বলেই আজ আমাদের ৩ ভাইবোনকে এতিম করে চলে গেল সে। সব দায়দায়িত্ব দিয়ে গেল ওর নিজের উপর। আর বড় ভাই হিসেবে ঐতিহ্যর করা ভুলটাকে বড় করে দেখে ঝামেলা করে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় না সে, পরিবার টা ভাঙতে চায় না। বাবা যেমন দুদিন আগেপাছে মাফ করে দিত ঐতিহ্য কে, ঠিক তেমনিভাবে সেও দেবে। ছোট্ট এতিম দুই বোনকে কখনওই কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট পেতে দেবে না। তার দুই চোখের দুই মণি, তার এই দুটি বোন।

এশার নামাযের আগ দিয়ে মহসিন চৌধুরীর গুলশানের বাসা থেকে খাটিয়ায় করে সারাজীবনের জন্য বের করে নিয়ে এল তাকে। আর কখনওই এই বাড়িতে ঢুকবে না সে। বাড়ির ভেতর পায়চারী করবে না, ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসাথে খেতে বসে আড্ডায় মেতে উঠবে না, স্ত্রীকে আদরমাখা গলায় আর কেউ ডেকে বলবে না খাবার দাও। বড়ই নিষ্ঠুর এই দুনিয়া! কেন আপন মানুষগুলোর কাছ থেকে কেড়ে নেয় তাদের প্রিয়জন কে!!

মহসিন চৌধুরী কে মাটি দিয়ে আসতে আসতে রাত ৯ টার মত বেজে গেল। প্রায় সব আত্মীয়স্বজনই লাশ নিয়ে বেরুবার পরপরই চলে গেছে। বাদবাকি যারা ছিল তারাও ১০ টার মাঝে চলে গেল। সাথে দিয়ে গেল শান্তনার কিছু বাণী। অবশ্য এই জিনিশ টাই এখন খুব বেশি দরকার মহসিন চৌধুরীর পরিবারের।

রাতে মাহসান এবং নিহালকে সাথে নিয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিল তৌহিদ। তারপর এগুলো তৃষ্ণার ঘরের দিকে। দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
-"আছিস?"
ভেতর থেকে তৃষ্ণা বলে উঠলো,
-"আছি ভাইয়া,, কিছু বলবে?"
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে তৌহিদ বললো,
-"খেয়েছিস?"
-"হুম,, আম্মাকে সাথে নিয়ে খেলাম একটু। কিন্তু অর্থিকে তো কোনোভাবেই খাওয়াতে পারলাম না। সেই দুপুরের খাওয়াই ওর শেষ খাওয়া।"
-"ফাস্ট ফুডের ভেতর ও কী খেতে বেশি পছন্দ করে?"
তৃষ্ণা ভেবে বললো,
-"উম্ম,, বার্গার হয়তো।"
-"তাহলে যাই নিয়ে আসি। না খেয়ে তো পুরো রাত কাটানো সম্ভব না।"
-"এতো রাতে! ১১ টার বেশি বাজে!"
-"এইটা আবার রাত নাকি! তোর জন্য কিছু আনবো? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?"
-"না, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আবার তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।"
ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়িয়েও আগালো না তৌহিদ। তৃষ্ণার দিকে আবারো ফিরে কিছুটা ইতস্তত করে জানতে চাইলো,
-"ঐতিহ্য? ও খেয়েছে কি?"
-"না,, ওর জন্যও পারলে কিছু এনো।"
আর কথা না বাড়িয়ে তৌহিদ বেড়িয়ে পড়লো।

কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা ভার হয়ে এসেছে অর্থির। মহসিন চৌধুরী কে নিয়ে যাবার পর গোছল করে নিয়েছে বাড়ির সব সদস্যরা। অর্থিও করেছে। তারপরেও মাথার ব্যথা টা কোনোভাবেই কমছে না। মাঝেমাঝে মারাত্মকভাবে জ্বিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে মাথার চুল গুলো টেনে ছিড়ে ফেললে শান্তি পেত। কিন্তু সেটা তো করা যাচ্ছে না.. একটা প্যারাসিটামল খেয়ে দেখবে কি! যদি কমেই যায়। নিজের ঘরে খুঁজেখুঁজে ঔষধ না পেয়ে তার মনে পড়লো বাবার ঘর সকল প্রকারের ঔষধ এর কারখানা। সেখানে পাওয়া যাবেই। বাবা সব রকমের ঔষধ নিজের কালেকশনে রাখতেন। বলা তো যায় না কখন কার কি হয়ে যায়! কিন্তু এখন সেসব ঔষধ দিয়ে কি হবে! বাবাই তো নেই। ছেড়ে চলে গেছে তাকে ফেলে। কেন এমন টা করলে বাবা? এক মেয়ের উপর অভিমান করে অন্য মেয়েকে ফেলে রেখে কেন চলে গেলে তুমি? একবারো তোমার এই মেয়ের কথা মনে পড়লো না? যে তোমার কথামত নিজের জীবন, স্বপ্ন সব বিসর্জন দিয়েছে! তুমি ভালো থাকবে বলে হাসিমুখে তোমার ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করেছে। শুধুমাত্র তোমার চোখ দিয়ে যেন জল না পড়ে এরজন্য আজ ওই নোংরা পরিবেশে গিয়েও থাকছে....

মহসিন চৌধুরীর ঘরে ঢুকতেই অর্থি দেখতে পেল ঐতিহ্য তার মা শান্তি বেগমের কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। নিমেষেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল অর্থির। চেঁচিয়ে উঠে বললো সে,
-"আম্মা,, তোমার গুণ গাইতেই হয়! একটু আগে স্বামীকে হারানোর দুঃখ ভুলে গেলে নাকি মেয়েকে ফিরে পেয়ে!"
শান্তি বেগম অর্থির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
-"কি বলছিস এসব!"
-"বাংলা কথা বুঝো না তুমি? কেন ঐতিহ্য কে কোলের মধ্যে নিয়ে বসে আছো তুমি? লজ্জা থাকা উচিৎ তোমার।"
এ পর্যায়ে মায়ের কোল ছেড়ে মাথা উঠালো ঐতিহ্য। বোনের দিকে চেয়ে রইলো অবাক দৃষ্টিতে। অপরদিকে অর্থির চিৎকারে বাড়িতে থাকা বাদবাকি সদস্যও ছুটে এল মহসিন চৌধুরীর ঘরের দিকে।
-"এতক্ষণ বাড়িতে লোকজন ছিল বলে একটা কথাও উচ্চারণ করি নি। কিন্তু আর চুপ থাকতে পারছি না। এই মেয়ের জন্য আমার ফুল লাইফ টা নষ্ট হয়েছে। শুধু আমার না, এই মেয়ের জন্য আমাদের ফ্যামিলির সবাইকেই সাফার করতে হচ্ছে। আর তোমরা মানো আর নাই মানো, বাবার মৃত্যুর জন্যও দায়ী ও। বাবা ওর চিন্তায় চিন্তায়ই স্ট্রোক করেছে। না হলে সুস্থ স্বাভাবিক হেটে চলাফেরা করা মানুষ কখনো স্ট্রোক করে না। ওর বাড়ি ছেড়ে যাবার খবর শোনার পরই বাবা প্রথম স্ট্রোক টা করেছিল। ভুলে যাচ্ছো তোমরা? সব ভুলে মাফ করে দিয়ে কোলে টেনে নিচ্ছো ওকে! পারোও তোমরা! এতো উদারতা আসে তোমাদের কোথায় থেকে? আমার তো আসে না! আর আসবে ও না। আমি ওকে কখনওই মাফ করবো না। আমার লাইফে আমার বাবা কি ছিল আমার জন্য আমি জানি। বাবার চোখ দিয়ে যেন পানি না ঝরে, এর জন্য আমি প্রতিবন্ধী একটা ছেলেকে বিয়ে করার জন্যও দুই বার ভাবি নি। বাবা যেন খুশি থাকে, এর জন্য আমি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটা ওই মানুষটির হাত ধরেছি। তাদের ছোট্ট সেই বাড়িতে গিয়ে থাকছি। অথচ এই মেয়ে,, যে কিনা বাবার কথা না ভেবে স্যারের সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, বিয়ে করে নিয়েছিল, তাকেই তোমরা মাফ করে দিলে এতো সহজে? বাবা মারা যাবার সময় বুকে ঠিক কতোটা কষ্ট নিয়ে মারা গেছে সেটা তোমরা ভুলে গেলেও আমি ভুলবো না। কারণ আমি ছাড়া আর কেউ, এই বাড়ির আর কেউ বাবাকে কখনো ভালোবাসেই নি।"
মাহসান এ পর্যায়ে অর্থির পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে। মাথায় ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বললো,
-"তুই যা বলছিস সব ঠিক আছে। কিন্তু দেখ ঐতিহ্য আমাদের বোন। ও অনেক বোকা, অর্থি। ও যদি আগে জানতো এমনটা হবে তাহলে কি ও পালিয়ে যেত? বুঝেশুঝে কেউ এমন ভুল করে না। আর বাবা কি আগেপাছে মাফ করে দিত না ওকে! দিত তো। তাহলে আমরা বাবার দেখানো পথেই হাটি।"
-"কিন্তু ও ভুল করেছে, ভাইয়া। আর যার মাশুল আর আমরা সবাই গুনছি। আর বাবা ওকে কখনওই মাফ করতো না। বাবা মারা যাবার পর এখনো তোমরা বুঝতে পারছো না,, সে কতো টা কষ্টে ছিল এই দুই দিন এই মেয়ের জন্য!"
-"কিন্তু..."
মাহসান কে থামিয়ে দিয়ে অর্থি বললো,
-"এখানে কোনো কিন্তুর জায়গা নেই। তোমাদের এমন চিন্তা আসলো কই থেকে! এতো সহজেই বাবা হারানোর কষ্ট তোমরা ভুলে যাচ্ছো!"
অর্থির কথাগুলো এতক্ষণ নিরব হয়ে শুনলেও এ পর্যায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসলো ঐতিহ্য। বোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার এক হাত ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
-"তুই আমার সাথে এমন করছিস কেন! আমি সেদিন কি করেছি নিজেও জানি না। ভুল করে ফেলেছি আমি। স্বীকার করছি তো আমি। আর সেদিন তো নিজে তুই আমাদের বিয়ের কথা শুনে বললি আমরা যা করেছি ভালো করেছি। তাহলে আজ এমন কথা বলছিস কেন, অর্থি? তুই বাবাকে হারিয়েছিস আমি হারাইনি? তোর কষ্ট হচ্ছে আমার হচ্ছে না?"
-"না তোর কষ্ট হচ্ছে না। তুই নিজের দোষে বাবাকে হারিয়েছিস। আর তোর এই দোষে আমিও হারালাম আমার বাবাকে। সে আর আমাকে অর্থি অর্থি বলে ডাকবে না, আমার সাথে ফাজলামি করবে না, আদর করে হাত বুলিয়ে দেবে না আমার মাথায়। আমি আর কাওকে বাবা বলে ডাকতে পারবো না।"
বলেই থামলো অর্থি। নিজের হাত ঐতিহ্যর হাতের মাঝ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
-"সেদিন আমি তোকে কথা গুলো বলেছিলাম, কারণ তখন আমি এসব ভাবি নি। বাবার চোখের জল কতোটা মর্মস্পর্শী হতে পারে তা জানা ছিল না সেদিন। কিন্তু আজ তা খুব ভালো করেই জানি। শুধুমাত্র তোর জন্য আমি আমার বাবা হারিয়েছি।"
চোখের জল আজ কোনো যেন বাঁধ মানছে না। অঝর ধাড়ায় গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। অর্থি তো ভুল কিছু বলছে না। তার জন্যই আজ বাবা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কেন এমন করলে তুমি বাবা? নিজের করা এত বড় একটি ভুল নিয়ে বাকিটা পথ চলতে পারবে তো সে! চোখ মুছে অর্থির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"এখন কি করতে বলছিস তুই আমাকে? কি করলে আমি শাস্তি ভোগ করবো। বল?"
-"তুই এখনি এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যা। আর কখনওই এই বাড়িতে ঢুকবি না তুই। এটা আমার বাবার বাড়ি। এই বাড়িতে তোর কোন জায়গা নেই...."
দুই মেয়ের তর্ক শুনে দীর্ঘ একটি নিশ্বাস বেড়িয়ে এল শান্তি বেগমের বুক চিড়ে। স্বামী তাকে এই নরকের মাঝে না রেখে গেলেও পারতো। এসব দেখার বা শোনার মত মনমানুষিকতা কোনোটাই আপাতত নেই তার। কিন্তু কি বলে বুঝ দেবে এদের?
-"থাম এবার তোরা। কি শুরু করেছিস এগুলো? এসব দেখার আগে তোর বাবা মরে বেঁচে গেছে। আর আমাকে ফেলে গেছে এসব সহ্য করতে। তোদের বাবার জন্য হলেও তোরা থাম। কম ভালোবাসতো না সে তোদের। তোদের সুখের জন্য কি না করেছে সে! ভালো চরিত্র, মনের কোনো ছেলের হাতে মেয়েদের তুলে দিতে চেয়েছিল সে। সবসময় নিজেদের চেয়ে কিছুটা নীচু পরিবার খুঁজেছে। যাতে তাদের কাছে নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়েও তোদের সুখী রাখতে পারে। তার তো টাকার কোনো অভাব ছিল না। সারাজীবন দুই মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য তার ছিল। তাই সে তৌহিদকে ঐতিহ্যর জন্য ঠিক করেছিল। তৌহিদ খুব ভালো একজন ছেলে। তার বিশ্বাস ছিল ঐতিহ্য কে সুখে রাখবে সে। আর তোরা কি করলি সেদিন? প্রতিবন্ধী, ল্যাংড়া, খোঁড়া যা নয় তাই বলে তৌহিদকে গালাগালি করলি তোদের বাবার সামনে। একজন মানুষ শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল মানে এই না যে,, তার মন, চরিত্র কিছুই ভালো না। একজন মেয়ে কিন্তু সবার আগে এটাই চায়, তার স্বামীর চরিত্র যেন ভালো হয়। আর এটা ভেবেই তৌহিদ কে নিজের মেয়ের জন্য বেঁছে নিল সে। আর মেয়ে কি করলো? মুখে চুনকালি মাখিয়ে পালিয়ে গেল স্যারের সাথে। একবারো ভাবলো না বাবার কথা, পরিবারের কথা। ঐতিহ্যর কাছ থেকে এমন ধরনের কাজ কখনোই আশা করে নি তোদের বাবা। ঐতিহ্য কে সবসময় আলাদা চোখে দেখতো সে। ঐতিহ্যর জায়গায় অর্থি হলেও হয়তো তার পক্ষে মেনে নেয়া টা সম্ভব হত। কিন্তু ঐতিহ্যর এ কাজ মেনে নিতে পারেনি সে। সারাটা রাত কষ্টে সে কেমন করে ছটফট করেছে আমি দেখেছি। অপর মেয়েকে হারানোর ভয়ে যখন হাতে থাকা ভালো একটি ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইলো সে, তখন শুরু হলো ছেলের জ্ঞান দেয়া। এই দুই দিন একটা বারো মাহসান কিন্তু কথা বলে নি তোদের বাবার সাথে। কেন? কি দোষ করেছিল সে! মেয়ের ভালোর জন্য জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তাতে কি এমন অন্যায় করে ফেলেছিল সে! রাস্তার কোনো ছেলেকে ধরে এনে তো বিয়ে দিয়েছিল না। ভদ্র ঘরের প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথেই বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে সে কি খুশি ছিল? তার খারাপ লাগে নি? কাল সারাটা রাত ভর সে একটা কথাই বারবার বলেছে, ভুল করলাম না তো জোর করে অর্থিকে বিয়ে দিয়ে! বাচ্চা একটা মেয়ে আমারা! সে তোদের এই ব্যবহারে দ্বিধায় ভুগছিল। কারো এক জনের জন্য না, তোদের ৩ জনের চিন্তায় চিন্তায়ই আজ স্ট্রোক করে আমাদের ফেলে চলে গেল। বিধবা করে দিয়ে গেল আমাকে। আর তোরা ৩ জনই এতে দায়ী। কেউ বেশি বা কম। কিন্তু সব কিছুর উর্ধ্বে আমি একজন মা। হ্যাঁ, আমার লজ্জা নেই বলেই এখনো তোদের ৩ জনকে আঁকড়ে ধরে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটি পথ খুঁজে যাচ্ছি।"
শান্তি বেগমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। অর্থি কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকার পর চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। ঐতিহ্য অর্থির যাবার পথের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিহালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"চলো।"
মাহসান ঐতিহ্যর কথায় তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"অর্থি ছোট। না বুঝে বলে ফেলেছে কথাগুলো। ২/৩ দিন পর আবার সরি বলবে দেখিস। ওর কথায় রাগ করিস না।"
-"আমি রাগ করি নি ভাইয়া। তবে ও ভুল কিছু বলেনি।"
বলেই ঐতিহ্য পা বাড়ালো বাড়ির বাইরের দিকে। নিহাল ঐতিহ্যর পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এখন কি করবে সে? আটকাবে ওকে? কিন্তু কেন আটকাবে? উত্তর না পেয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নিহাল ও বেড়িয়ে এল ঐতিহ্যর পিছুপিছু।

তৌহিদ খাবার নিয়ে বাসায় ঢোকার সময় দেখতে পেল নিহাল এবং ঐতিহ্য রিকশায় উঠছে। এত রাতে কোথায় যাচ্ছে ওরা? কিছু বলতে গিয়েও বললো না তৌহিদ। ধীরপায়ে এগুলো বাসার ভেতরের দিকে। বাসার পরিবেশ একদম ঠান্ডা। কিছু হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাহলে হঠাৎ ওরা চলে গেলো কেনো! ঐতিহ্য ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

মাত্র আনা বার্গারগুলো টেবিলে রেখে একটি বার্গার প্লেটে নিয়ে তৌহিদ পা বাড়ালো অর্থির ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে অর্থির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-"ভাত না খেলে, বার্গার খেতে কি কোনো সমস্যা হবে? প্লিজ, খেয়ে নাও। না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।"
অর্থি তৌহিদের স্বর শুনতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তৌহিদকে। দু হাতে তৌহিদের পিঠ খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-"আমি তো ভুল কিছু বলি নি। ওর জন্যই আজ আমাদের সবাইকে সাফার করতে হচ্ছে। বলুন, ভুল বলেছি?"
অর্থির স্পর্শে তৌহিদের বুকের বাম পাশ থেকে ধুকধুক শব্দ বেড়িয়ে আসছে। হাতপাও জমে যাচ্ছে ধীরেধীরে। একটা ঘোর কাজ করছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে তৌহিদ বললো,
-"উহু।"
-"বাবা কম কষ্ট বুকে জমিয়ে রেখে মারা যায় নি।"
-"হু।"
-"আমার বাবার চোখের পানিই আমি সহ্য করতে পারি না। সেখানে বাবার মৃত্যু কিভাবে সহ্য করবো আমি!"
-"হু।"
-"আমার বাবা আজ একা অন্ধকার কবরে ঘুমিয়ে আছে। একা... কেউ নেই তার পাশে। কার জন্য? শুধুমাত্র ওর জন্য..."
-"হু।"
-"আমি যাবো আমার বাবার কাছে। বাবা একা একা ওই কবরস্থানে কি করছে! নিয়ে আসবো বাসায় আমার বাবাকে আমি। একা একা থাকতে দেবো না ওখানে বাবাকে।"
তৌহিদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকে। বললো,
-"হুম,, যাবো...."

কিছুক্ষণ হলো নিহাল এবং ঐতিহ্য এসে পৌছেছে নিহালের ফ্লাটে। আসার পর থেকেই বিছানায় গিয়ে নিরব হয়ে পড়ে রয়েছে ঐতিহ্য। নিহাল কিছুক্ষণ সময় দিয়ে একা থাকতে দিল ঐতিহ্য কে। ততোক্ষণে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। তারপর বিছানায় এসে পাশে শুয়ে পড়লো ঐতিহ্যর। কিছুসময় এভাবে যাবার পর ধীর স্বরে তাকে ডাকলো নিহাল।
-"ঐতিহ্য? ঘুমিয়েছো? উঠে জামাকাপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে নিলে পারতে। ভালো লাগতো।"
অপরপাশ থেকে ঐতিহ্যর কোনো সাড়া না পেয়ে ঐতিহ্যর গায়ে হাত রেখে নিহাল হালকা ধাক্কা দিতেই উঠে বসলো ঐতিহ্য। কেঁদেকেটে একদম ফুলিয়ে ফেলেছো চোখ। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ফ্যানের বাতাসে হালকা উড়ছে, চোখদুটি তে মনে হচ্ছে রক্তের কুণ্ডলী পাকিয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সেই অবস্থায় ঐতিহ্য বিরক্তমুখে নিহালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"হাত দেবে না একদম আমার গায়ে। আর প্লিজ আমাকে একটু আমার মত করে থাকতে দাও।"

     (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ