সম্পর্কের টান । পর্ব-১৭+১৮


সম্পর্কের টান

 পর্ব-১৭+১৮

-"আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল, তারা কতো বাজেবাজেই না কথা শুনাচ্ছিল!"
-"স্বাভাবিক,, কথা শুনাবার মতো কোনো টপিক পেলে কেউ ছেড়ে কথা বলে না।"
-"তবুও! তারা কিভাবে পারে মৃত একজন মানুষকে দেখতে এসে তাকে নিয়ে, তার পরিবারকে নিয়ে কানাঘুষা করতে!"
-"ওসব ভেবো না তুমি,, আসলে না চাইতেও এ পরিবারে এমন কিছু ঘটে গেছে, যা নিয়ে আশেপাশের লোকজন সমালোচনা করবেই।"
তৃষ্ণার বুকে মুখ গুঁজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহসান। তৃষ্ণা ঠিকই বলেছে। না চাইতেও অনেক কিছু ঘটে গেছে এই ৩/৪ দিনে। যা এখন চাইলেও ঠিকঠাক করা সম্ভব না। আজ বাবা মারা না গেলে কখনওই এসব কিছুর সম্মুখীন হতে হত না তাদের। হে আল্লাহ,, কেন তুমি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিলে আমাদের বাবাকে! এতিম করে কেন দিলে আমাদের!
মাহসানের চোখ দিয়ে জল ঝরছে, বুঝতে পেরে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো তৃষ্ণা তাকে। মাথায় পরম ভালোবাসায় আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
-"একদম কাঁদবে না! আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমানোর চেষ্টা করো।"

তৌহিদের জোরাজুরির সাথে না পেরে উঠে বার্গার সামান্য খেয়ে নিল অর্থি। অর্থি বার্গার খেতে পছন্দ করতো বলে, প্রায় রাতেই বাসায় ফেরার সময় মহসিন চৌধুরী বার্গার নিয়ে আসতো। অর্থিও সেই রাতে আর ভাতের মুখোমুখিই হতো না। এ নিয়ে শান্তি বেগম কিছু বললেও মহসিন চৌধুরী হেসে বলে উঠতো,
-"এক রাত ভাত না খেলে তেমন কিছু হবে না।"
-"তুমি তো এক রাত না, প্রায় রাতেই এসব হাবিজাবি নিয়ে আসো।"
-"থাক না! মেয়ে ভালোবাসে। খেতে দাও।"

বাবামার এসব কথোপকথন মনে হতেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো অর্থির। বাবা আর নেই। আর কেউ তার এসব ছোট ছোট আবদার পুরণ করবে না। কেউ পরম মমতায় বলবে না,, মেয়ে ভালোবাসে, খেতে দাও! কেন এতো তাড়াতাড়ি আমাদের সবাইকে ফেলে তুমি চলে গেলে বাবা? তোমার এই ছোট্ট মেয়ের আবদার গুলো কে পুরণ করবে এখন?
-"অর্থি, আলো নিভিয়ে দেব?"
ছোট একটি নিশ্বাস ফেলে অর্থি বললো,
-"দিন।"
তৌহিদ আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শরীরটা মেলে দিল। আজ সকাল থেকে কম ধকল যায় নি তার উপর দিয়ে। সেই ভোরে উঠে ঘর, বাথরুম পরিষ্কার করা, কোর্ট, তারপর দুপুরে শ্বশুরের অসুস্থতার খবর শুনে সাথেসাথেই অর্থিকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসা, হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি, সবশেষে তো শ্বশুরের কবর খোঁড়ানো, ধোয়ানো সব দিকটা সামাল দিতে হয়েছে তাকে। আবার এসব ধকল শেষে বউ এর সেবাই নিজেকে লাগিয়ে দেওয়া। ভেবেই স্বস্থির একটি নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। তারপর অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"ঘুমিয়েছো?"
নাক টানতে টানতে অর্থি বললো,
-"উহু।"
-"কাঁদছো,, না?"
-"উহু।"
-"আমি বুঝি অর্থি। অযথা কিছু লুকানোর কি দরকার!"
অপর পাশে থেকে অর্থির সাড়া না পেয়ে তৌহিদ আবারো বললো,
-"ঘুম আসছে না?"
-"উহু।"
-"মাথা ব্যথা করছে? অবশ্য করবেই বা না কেন! এতো জোরেজোরে চিৎকার করে কাঁদলে মাথা ব্যথা করবেই। দেখো অর্থি, কোনো মানুষই অমর নয়। একদিন না একদিন আমাদের সবারই আল্লাহর কাছে চলে যেতেই হবে। আমি, তুমি, তোমার বাবামা, আমার বাবামা সব। বল যেতে হবে না?"
-"হু।"
-"তাহলে? হ্যাঁ, আপনজন হারানোর কষ্ট আছে। তাই বলে কি সেই কষ্টে দুঃখে না খেয়ে থেকে, সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে কাটাতে হবে? এসব করে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। বড়ং এমন কিছু কাজ করো, যাতে তোমার বাবার কাজে লাগে। নামায পড়ে তার জন্য দোআ করো, কোরআন পড়ে তার নামে বখশিয়ে দাও। যাতে তোমার করা এসব কাজের দ্বারা সে আল্লাহর কাছে গিয়েও উপকৃত হয়। তোমরা ছেলেমেয়েরা নিজে তার জন্য দোআ চাইলে সে যা পাবে,, তার ১% ও পাবে না আশেপাশের মানুষ বা মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে দোআ চাওয়ালে, কোরআন খতম দেয়ালে। এই যে তুমি কান্নাকাটি করছো কখন থেকে, এটা করে কি লাভ হচ্ছে? তোমার বাবার কিন্তু এই কান্না টা কোনো কাজেই আসবে না।"
কথাগুলো বলে ছোট একটি নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। তারপর আবারো বললো,
-"এশার নামায পড়েছিলে?"
চোখজোড়া মুছে অর্থি বললো,
-"হু,,"
-"গুড,, নামায পড়বে ঠিকঠাক ভাবে। দোয়া চাইবে বাবার জন্য। মোনাজাতে কান্নাকাটি করবে।"
-"পড়বো।"
দুজনেই নিরব। শুধু মাঝেমাঝে একেকজনের দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। অর্থি হয়তো এখনো ঘুমাইনি। বারবার নড়েচড়ে উঠছে। মাথা ব্যথাটা হয়তো বেড়েছে। কিছু বলবে কি তৌহিদ?
-"কমছে না মাথা ব্যথা?"
-"উহু।"
তৌহিদ কিছুটা ইতস্তত করে এগিয়ে গেল অর্থির দিকে। কিছু দুরত্ব বজায় রেখে অর্থির মাথায় হাত রাখলো তৌহিদ। বললো,
-"তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি মাথাটা টিপে দিচ্ছি।"

আজ মহসিন সাহেবের কুলখানি। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল তিনদিন। এভাবে একসময় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে। ধীরেধীরে পরিবারের মানুষদের ভেতর বুঝ আসবে। তারাও শিখে নেবে মৃতব্যক্তিকে পথ ছাড়া চলা। এটাই যে প্রকৃতির নিয়ম।

তৌহিদ যোহরের নামায শেষে রান্নাবান্নার খোঁজ নিয়ে বাসায় ঢুকলো। তিনদিন হলো এ বাড়িতে আছে সে। ওদিকে কোর্টকাছারির কি অবস্থা কে জানে! তাই লোকজন খাওয়ানোর পর আজ বিকেলে সে চলে যাবে নারায়ণগঞ্জ। আর এখানে থাকা সম্ভব হবে না। তবে অর্থিকে এখানে ফেলে যাবার একদম ইচ্ছে করছে না। মেয়েটার চেহারার দিকে তাকালেই একধরণের মায়া কাজ করে তৌহিদের। এ কয়দিনেই অজানা একটা টান পড়ে গেছে তাদের সম্পর্কে। কিছুক্ষণ চোখের সামনে না দেখলেই অস্থির অস্থির লাগে।
-"ব্যাগ গোছাচ্ছেন কেনো?"
অর্থির কথায় ফিরে তাকালো তৌহিদ। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"বাড়িতে যাবো আজ বিকেলে।"
-"কেনো? এখানে থাকলে কি সমস্যা?"
-"কাজকর্ম আছে না? এখানে বসে থাকলে হবে?"
তৌহিদের কথায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল অর্থির মুখ। কেন যেতে হবে ওনার? এ বাড়িতে থেকে বুঝি কাজকর্ম করা যায় না?
-"মন খারাপ করো না। তুমি তো যাচ্ছো না। শুধু আমি যাচ্ছি। তুমি কটা দিন এখানে থাকো। চাইলে ১/২ মাসও থাকতে পারো বা তার বেশি।"
খানিকটা সময় চুপচাপ থাকার পর অর্থি বললো,
-"আমিও যাবো আপনার সাথে।"
অবাক হয়ে তৌহিদ বললো,
-"কেনো? থাকো কিছুদিন। তোমার মা ভাই সবার ভালো লাগবে।"
-"আমাকে নিতে চাচ্ছেন না কেন আপনি? আমার বাবাকে ছাড়া এ বাড়িতে থাকতে কষ্ট হয়, সেটা কি আপনি বোঝেন না? বাবার ঘরে ঢুকলে আমার বুকটা ফেটে যায়। জামাকাপড়, চশমাসহ ব্যবহার্য সব জিনিশ দেখে আমার খারাপ লাগে। কষ্ট হয় আমার। বাবা নেই অথচ বাবার স্মৃতি এ বাড়িজুড়ে রয়েছে। আমার কষ্ট হয় নিজের চোখে এসব দেখতে।"
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো অর্থি। তৌহিদ অর্থির দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"আবার কাঁদছে কেন এই মেয়ে! দেখি একদম কাঁদবে না। নিয়ে যাবো তোমাকে। আমার সাথেই তুমি যাবে। এবার কান্না বন্ধ করো, প্লিজ।"
-"হু...."
-"হু কি! বন্ধ করো কান্না আর জামাকাপড় গুছিয়ে নাও।"
চোখ মুছে অর্থি বললো,
-"খেয়ে এসে গোছাবো। আসুন আপনি। আপনাকেই ডাকতে এসেছিলাম।"
তৌহিদ আবারো ব্যাগের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"তুমি যাও। আমি আসছি।"
অর্থি দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকালো তৌহিদের দিকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"থ্যাংকস, সেদিন ওয়াশরুম টা পরিষ্কার করার জন্য।"
বলেই তৌহিদের উত্তরের অপেক্ষা না করে অর্থি এগুলো ডাইনিং এর দিকে।

নিহালের সাথে চুপচাপ বসে রাতের খাবার খেলো ঐতিহ্য। বাবা মারা যাবার আজ তিনদিন হলো। মাহসান কল করেছিল সকালে। বারবার যেতে বলছিল আজ বাসায়। কিন্তু গেলো না ঐতিহ্য। কোনমুখে যাবে সে?
প্লেট টেবিলে ছেড়েই উঠে পড়লো ঐতিহ্য। হাত ধুয়ে বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। ভালো লাগে না তার আর এমন জীবন। কেন সে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এলো সেদিন?

খাবার টেবিল গুছিয়ে, প্লেট ধুয়ে সব কিছু ঠিকঠাক করে ঘরে ঢুকলো নিহাল। সারাদিনের ক্লান্তিমাখা শরীর মেলে দিল বিছানায়। কিছু সময় এভাবে কাটার পর ঐতিহ্যর দিকে হাত বাঁড়ালো নিহাল। জড়িয়ে ধরে তাকে আনতে চাইলো নিজের দিকে।
-"উফফ!! সবসময় এসব ভালো লাগে না। হাত সরাও বলছি।"
-"সবসময় কোথায় করলাম! আজ সারাদিন তো ছিলামই না!"
-"না থাকলে নাই। হাত সরাও,, বিরক্ত লাগছে।"
বলেই কিছুটা দূরে সরে গেল ঐতিহ্য। নিহাল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-"কয়দিন হলো এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছো কেন তুমি!"
অপরপাশ থেকে ঐতিহ্যর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিহাল আবারো বললো,
-"আচ্ছা, ঠিকাছে,, সরি। অনুমতি ছাড়া আর তোমার গায়ে হাত দেবো না। এবার বলো কি হয়েছে তোমার?"
-"কিছু না।"
-"আচ্ছা, এটাও বলতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। আর শোনো, কাল তুমি ভার্সিটি তে যাবে আমার সাথে। ক্লাস করবে, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেবে। ভালো লাগবে তোমার। মনটাও ভালো থাকবে।"
-"কোথাও যাবো না আমি। আমি ঠিক আছি। আমার মন ও ঠিক আছে। দয়া করে আর কথা বলো না। ঘুমাবো আমি।"
-"ওকে, গুড নাইট।"

অর্থি চুপচাপ শুয়ে অপেক্ষা করছে তৌহিদের জন্য। আজ রাত ৮ টার দিকে তারা নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছেছে। আর এখন বাজে রাত ১২ টা। চারটা ঘন্টা কেটে গেছে এর মাঝে। ভেবেই ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো অর্থি। কখন আসবে তৌহিদ! আর কখনই বা আনবে তার আইসক্রিম! আর তো সহ্য হচ্ছে না!
তৌহিদ দোকানে গিয়েছে অর্থির জন্য আইসক্রিম আনতে। এই বাড়ির সামনেই একটা দোকান আছে। ওখান থেকেই আনতে গিয়েছে। কিন্তু যত রাত হয়েছে, দোকান আবার খোলা পাবে তো! যদি না পায়!! ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে এল অর্থির। সাথেসাথেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো তৌহিদ। হাতে তার আইসক্রিম! মনের আনন্দে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল অর্থি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-"আসলেন তাহলে! কতক্ষণ লাগে একটা আইসক্রিম আনতে?"
-"দোকান বন্ধ করে ফেলেছিল। সামনের মোড়েও গেলাম, সেখানেও বন্ধ। পরে আবার কল করে জুবায়ের কে ডেকে আনলাম। তারপর দোকান খুলিয়ে এই যে আপনার আইসক্রিম উদ্ধার করলাম!"
বলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ।
আইসক্রিম হাতে নিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে অর্থি বললো,
-"থ্যাংকইউ সো মাচ!!"
-"আর কতো ধন্যবাদ দেবে তুমি! কথায় কথায় ধন্যবাদ দেয়া টা এবার বন্ধ করে ফেলো। না হলে দেখা যাবে, আমার কাজেকর্মে মুগ্ধ হয়ে, সারাজীবন তোমার কেটে যাবে আমাকে ধন্যবাদ দিতে দিতেই!"
বলেই হেসে ফেললো তৌহিদ। কিছুসময় চুপচাপ তৌহিদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর অর্থিও যোগ দিল তার সাথে হাসির খেলায়। খারাপ না তৌহিদ। বিশেষ করে মনটা! অসম্ভব সুন্দর মনের অধিকারী সে। বাবার মতোই ছোটখাটো সব বিষয়ে কতো সুক্ষ্ম ভাবেই না নজরদারী করে! পুরণ করবার চেষ্টা করে সেগুলো। যে লোকটাকে কয়েকদিনে আগে অসহ্য লাগতো, দেখলেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলতো অর্থি,, সেই লোকটার সাথেই এই কয়েকটা দিন কাটানোর পরও খারাপ লাগছে না তার। বরং ভালোই লাগছে। আসলেই সে ঠিক বলেছে। তার কাজকর্ম গুলো মুগ্ধ করবার মতই। কোনো মেয়েই মুগ্ধ না হয়ে হয়তো থাকতেই পারবে না...... একজন লোকের সাথে না মিশে, তার সম্পর্কে আন্দাজে কিছু ধারণা করা ভুল। যেমনটা সে নিজে করেছিল তৌহিদের বেলায়। তৌহিদকে নিয়ে মনে যে ভয়ংকর, বিশ্রী একটা মানুষের ছবি একে রেখেছিল, সেটা মোটেও তার সাথে যায় না। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র এবং যত্নশীল তৌহিদ। আর এমন একটা লোককে আর যাই করা যাক না কেনো, তার সাথে বাজে ব্যবহার করা যায় না। আর কেনই বা করবে সে তৌহিদের সাথে বাজে ব্যবহার? শুধুমাত্র তৌহিদ প্রতিবন্ধী বলে? তাহলে সে নিজেই তো আসল প্রতিবন্ধী। কারণ বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ কখনো স্বাভাবিক মানুষ হতে পারে না.....

   (চলবে)

""সম্পর্কের_টান""

 পর্ব-১৮

চোখ খুলেই অর্থি হাত বাড়ালো ফোনের জন্য। বালিশের নিচে, আশেপাশে কোথাও ফোন না খুঁজে পেয়ে চোখ কুঁচকে ফেলল সে। ফোন কোথায় রাখলো! হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তার সাথে তৌহিদের বিয়ের দিন থেকে সে তো আর ফোন হাতেই নেয় নি। সেই যে কবুল বলার আগে ফোন অফ করে ড্রয়ারে তুলে রেখেছিল,, এখনো হয়তো সেভাবেই পড়ে রয়েছে তার বাসায়। ভেবে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল অর্থি। সকাল ৯.৩৫ বাজে। তার মানে তৌহিদ বেড়িয়ে গেছে। আরেকটু আগে উঠতে পারলেই দেখা হতো তৌহিদের সাথে!!

ফ্রেশ হয়ে মাথায় হালকা চিরুনি লাগিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো অর্থি। ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তৌহিদা বেগম রান্নাঘর থেকে বললেন,
-"অর্থি নাকি?"
-"জ্বি..."
-"কখন উঠলে, মা?"
-"মাত্রই..."
-"আচ্ছা,, তুমি বসো। আটা গুলিয়েই রেখেছি, এখন শুধু বানিয়ে ভেজে দিচ্ছি। গরম গরম খেতে পারবে।"
অর্থি কিছুটা ইতস্তত করে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-"আমি হেল্প করি আপনাকে?"
তৌহিদা বেগম হেসে জবাব দিলেন,
-"আসো,, এটা আবার জিজ্ঞাস করতে হবে! তৌহিদ কিন্তু আমাকে রান্নার কাজে অনেক সাহায্য করে। ভাজতে পারো পরোটা?"
এগিয়ে এসে তৌহিদা বেগমের পাশে দাঁড়ালো অর্থি। বললো,
-"হুম,, আম্মাকে ভাজতে দেখেছি।"
-"বাহ! তাহলে তো হলোই। আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি ভেজে ফেলো।"
-"আচ্ছা..."
তৌহিদা বেগম আটা বেলে চারকোণা আকৃতি করতে করতে অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"একটা কথা বলতাম,, যদি কিছু মনে না করো।"
-"জ্বি,, বলুন।"
-"আসলে দেখো, তুমি এই বাড়ির বউ। আর তুমি তো দেখোই, বাসায় প্রায় সময়ই তোমার শ্বশুরের বন্ধুবান্ধব যাওয়াআসা করে। আড্ডা খানা তাদের এই বাড়িটা। কাজ নেই কর্ম নেই, কি আর করবে! সারাদিন বসে আড্ডাবাজী করে। তো যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, এসব পোশাকাদি পড়ে তাদের সামনে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। তারাও ভালো চোখে দেখে না। কিছু মনে করলে না তো আবার!"
অর্থি বললো,
-"না.. শাড়ি পড়তে হবে?"
-"আরে না! এখন আর শাড়ির যুগ আছে নাকি! কামিজ নেই তোমার? কামিজ পড়বা। আর নিজের ঘরে যখন থাকবা তখন না হয় পড়ো এসব।"
ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে অর্থি বললো,
-"আচ্ছা।"

মাহসানের নাম্বারে ডায়েল করতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো মাহসান। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
-"বলো?"
-"তোমার তো দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে যাবার কথা ছিল। এলে না যে!"
-"কাজ ছিল।"
-"অহ,, খেয়েছো দুপুরে?"
-"হ্যাঁ.. বিজি আছি,, রাখছি এখন।"
বলেই কল কেটে দিল মাহসান। এপাশ থেকে তৃষ্ণার কোনো উত্তরের জন্যও অপেক্ষা করলো না। এতো কিসের ব্যস্ততা তার! যে স্ত্রীকে দিনে একটা মিনিট সময় দিতে পারে না!! কি এমন হতো একটা মিনিট কথা বলে তারপর ফোনটা রেখে দিলে! ভাবতেই দীর্ঘ একটি নিশ্বাস বেড়িয়ে এল তৃষ্ণার বুক চিরে। অনেক বেশি পরিবর্তন হয়ে গেছে মাহসান। এই মাহসান আর আগের মাহসান নেই......

-"প্লিজ,, ঐতিহ্য। একটু...."
-"বললাম তো ভালো লাগছে না এখন.."
-"ভালো লাগবে.... প্লিজ।"
-"তুমি চাচ্ছো আমি এ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাই এখন?"
অবাক হয়ে নিহাল বললো,
-"সেটা চাইবো কেন!"
-"তাহলে প্লিজ, আমাকে জোর করো না। মানুষের মনমেজাজ সব সময় ঠিক থাকে না।"
কিছুটা বিরক্ত হলো নিহাল। বললো,
-"তো তোমার মনমেজাজ ঠিক থাকে কখন? কাল রাতেও গায়ে হাত দিতে দাও নি। আজ রাতেও আবার এই বাহানা! আগে তো এমন করতে না তুমি! নিজে থেকেই আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো? আমার স্পর্শ কি এখন ভালো লাগে না তোমার?"
নিহালের কথায় উত্তর না দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো ঐতিহ্য। ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা ফোন টা হাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেল শোবার ঘর ছেড়ে।

অর্থি এবং তৌহিদ শুয়ে আছে পাশাপাশি। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। গভীর চিন্তায় মগ্ন দুইজনই। কি দিয়ে কথা শুরু করা যায়!! চিন্তার অবসান ঘটিয়ে অর্থিই সূচনা করলো আলাপন।
-"ঘুমিয়েছেন?"
-"না। কিছু বলবে?"
-"হু,, কাল সময় হবে আপনার?"
-"কেনো বল তো?"
-"কিছু কেনাকাটা করতাম।"
-"তোমার যাবার কি দরকার! আমাকে বলে দিও, আমিই এনে দেবো।"
অর্থি ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"কেন! আমি গেলে কি হবে?"
-"কি আবার হবে! কিছুই না।"
-"তাহলে?"
-"তাহলে কিছুই না। বিকেলে কোর্ট থেকে ফিরে নিয়ে যাবো। রেডি হয়ে থেকো।"
-"থ্যাংকইউ।"
হাসলো তৌহিদ। বললো,
-"মাই প্লেজার। কি কেনাকাটা করবে? বলা যাবে কি?"
-"হু,, কিছু কামিজ। বাসায় পড়ার মত। আমার অবশ্য আছে কিছু। কিন্তু সেগুলো বাসায় পড়ার মত না। যে গরম পড়েছে!"
গরমের কথা শুনে মুখ থেকে হাসি মিলে গেল তৌহিদের। বললো,
-"এসি ছাড়া থাকতে কষ্ট হয় তোমার?"
-"সত্যি বলবো?"
-"অবশ্যই।"
-"হয়।"
অর্থির কথা শুনে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। এসি কেনার মতো সামার্থ তার আপাতত আছে। কিন্তু বাবা! কখনওই রাজি হবে না সে....
-"তবে ততোটাও না।"
অর্থির এ কথায় মনটা শান্ত হলো না তৌহিদের। বললো,
-"অহ!"
তৌহিদের মন সামান্য খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরে অর্থি বললো,
-"আজ কিন্তু আইসক্রিম পেলাম না!"
-"এনে দেবো এখন?"
-"আরে না! সময় দেখেছেন! একটার উপরে বাজে। কোনো দরকার নেই। আপনি বরং কাল দু টো আইসক্রিম আনবেন। কালকের টা আর আজকের পাওনা টা।"
অর্থির কথায় ঠোঁটে হাসি ফুটলো তৌহিদের। এখনো অর্থির ভেতর বাচ্চামি রয়েই গেছে। অবশ্য থাকবেই বা না কেন! অর্থি তো এখনো বাচ্চাই। মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে সে। পড়ার কথা মনে হতেই তৌহিদের মনে পড়লো অর্থির কলেজের কথা। সে অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"আচ্ছা... তোমার ক্লাসের কি করবে? এখান থেকে তো ডেইলি ঢাকায় গিয়ে ক্লাস করা পসিবল না।"
-"অসম্ভব! জার্নি টার্নি একদম বিরক্ত লাগে আমার।"
-"তাহলে একটা কাজ করতে পারো, তুমি তোমার বাবার বাসায় থেকে ক্লাস করতে পারো।"
বিরক্ত গলায় অর্থি বললো,
-"কোনো দরকার নেই। আমি এতোটাও ভালো স্টুডেন্ট না যে পড়াশোনা করতেই হবে আমার।"
অর্থির কথায় অবাক হয়ে তৌহিদ বললো,
-"কি বলো এসব! পড়াশোনা করবে না!"
-"না,, ওসব পড়াশোনা টড়াশোনা ভালো লাগে না আমার। রেজাল্ট জানেন না আমার?"
-"লেখাপড়া করতে কারোরই ইচ্ছে করে না। তাই বলে কি লেখাপড়া করে না কেউ! আর মাত্র তুমি স্কুল ছেড়ে কলেজে এডমিট হলে। এখনি লেখাপড়া নিয়ে এতো বিতৃষ্ণা তোমার!"
-"পড়া নিয়ে জ্ঞান দিতে আসবেন না, প্লিজ। আর আমি ঢাকায় বাসায় থেকে ক্লাসও করতে পারবো না।"
-"আচ্ছা দেব না। তোমার ঢাকায় গিয়েও পড়তে হবে না। টিসি এনে এখানের কোনো কলেজে এডমিট করিয়ে দেব। এখান থেকেই পড়বে তুমি। রাজি?"
হতাশ গলায় অর্থি বললো,
-"রাজি,, তবে রেজাল্টের কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবো না। ফেল আসলেও তা নিয়ে কোনোরকম বকাঝকা করতে পারবেন না। এখন বলুন, আপনি রাজি?"
অর্থির কথায় গা দুলিয়ে হেসে উঠলো তৌহিদ। বললো,
-"রাজি...."
মেয়েটা দেখতে যেমন মিষ্টি, তার কথাও তেমন মিষ্টি! মাঝেমাঝে এমন কথা বলে ওঠে যে না হেসে থাকা যায় না। এতো ভালোলাগে কেন মেয়েটাকে! অর্থির দিকে সামান্য এগিয়ে গেল তৌহিদ। হাত বাড়াতে গিয়েও বাড়ালো না। নিজেকে সামলে নিল। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যেভাবে চলছে সেভাবেই আরো কিছুদিন চলুক....

    (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ