সম্পর্কের টান। পর্ব-১৯+২০



সম্পর্কের টান

 পর্ব-১৯+২০

বেশ খানিকক্ষণ হলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ঠিক করে চলছে মাহসান। একবার জেল দিয়ে খাঁড়া করছে তো একবার টেনে একপাশে বসিয়ে দিচ্ছে। মাহসানের এমন অদ্ভুত কিছু আচারণ অনেকদিন হলোই খেয়াল করছিল তৃষ্ণা। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে উঠতে পারছিল না। এমনিতেই প্রচণ্ড রাগ ওর। কি দরকার সাধারণ এই ব্যাপার নিয়ে কথা বাড়িয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করবার! কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপারই আর এখন সাধারণ নেই। ক্রমাগত রূপ নিচ্ছে সন্দেহের। যার বাবা মারা যাবার একমাসও ঠিকঠাক ভাবে হয় নি, তার মনের ভেতর এত ফুর্তি আসে কি করে!!

-"কোথায় যাচ্ছো?"
ভ্রু কুঁচকে মাহসান বললো,
-"কোথায় আবার! অফিসে।"
-"আমার আজ ডক্টরের কাছে এপায়েন্টমেন্ট ছিল।"
-"অহ!"
-"কখন জানতে চাইলে না?"
তৃষ্ণার দিকে ফিরে মাহসান বললো,
-"কখন?"
-"১০ টার দিকে যেতে বলেছে।"
-"তাহলে তো সময় হয়েই এল। রেডি হয়ে নাও। নামিয়ে দিয়ে যাব।"
-"নামিয়ে দিয়ে যাবে শুধু? জরুরী কাজ না থাকলে আমার সাথে একটু যেতে, ডক্টরের সাথে কথা বলতে.."
-"পরে বলে নেব। আজ কাজ আছে।"
তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটলো তৃষ্ণার। বললো,
-"জরুরী কাজ টা কি তোমার অফিসের স্টাফ কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া?"
হতবাক হয়ে মাহসান বললো,
-"হোয়াট.... ননসেন্স!! কি বলছো এসব!"
-"কিছু না। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি চলে যাও। একা যেতে পারবো আমি..."
আর কথা না বাড়িয়ে হনহন পায়ে মাহসান বেড়িয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এতোটা পরিবর্তন কেন হলে তুমি মাহসান? নাকি আগেও এমনটাই ছিলে... হয়তো বুঝে উঠতে পারি নি। মাহসানের প্রতিক্রিয়া টাই বলে দিচ্ছিল,, অফিস স্টাফকে নিয়ে যে খবর তৃষ্ণা পেয়েছিল, সেটা মোটেও ভুল নয়। গলাটা ধরে আসতে লাগলো তৃষ্ণার। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসলো। আজ খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। খুব....

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো নিহাল। বাসার অবস্থা দেখে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো। আজ ২৭ দিন হলো বিয়ে করেছে সে ঐতিহ্য কে। তার মাঝে প্রথম ২ টো দিন ঠিকঠাক ভাবে কেটেছিল তাদের এই দাম্পত্য জীবনের। তারপর থেকেই আর কিছুই ঠিক নেই তাদের মাঝে। না কথা হয় ভালোভাবে, না একসাথে থাকা হয়। ভার্সিটি থেকে এসেই বাসার সব নিজেরই করতে হয় নিহালকে। ভেবেছিল,, বিয়ে করেছি, সব কাজ এখন বউ নিজেই করবে। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে, ঘর গোছাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দুজনের রান্নাবান্না! কি এমন কষ্ট হবে! এমনকি একথা ভেবে বিয়ের দিনই কাজের বুয়া টাকেও আসতে নিষেধ করে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল সে ঐতিহ্য কে নিয়ে। অথচ এখন সব সেগুড়ে বালি! কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না,, শুধু শুধু মাঝখান থেকে কাজের বুয়া হারালো! এখন আর কাজের বুয়াও পাওয়া যাচ্ছে না। রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে ঘর গোছানো সবই করতে হচ্ছে তাকে। কি উপকার হলো বিয়েটা করে! সেই তো ব্যাচেলর লাইফই লিড করতে হচ্ছে তাকে। বউ না করছে কোনো ঘরের কাজ না করছে বিছানার! হাত ধরা তো দুরের কথা, ছুঁলেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। এমন অদ্ভুত তো ছিল না ঐতিহ্য! নাকি তিনমাসে ঐতিহ্য কে চিনতে ভুল করে ফেলেছে সে....

ফ্রেশ হয়ে এসেই ঝাড়ু হাতে নিল নিহাল। এতোটা ধুলোবালি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পা দেয়া যাচ্ছে না। সারাদিন বাসায় চুপচাপ বসে কি এমন করে ঐতিহ্য, যে বাসা টা ঝাড়ু দেবার সময় পায় না! হাজার খঁজেও ঐতিহ্যর এমন ছন্নছাড়া ভাবে চলাফেরার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না নিহাল। সত্যি বলতে ঐতিহ্যর উপর প্রচন্ড রকমের বিরক্ত সে।
-"সারাদিন এভাবে চুপচাপ বাসায় বসে কি এমন করো? রান্নাবান্না বাদই দিলাম,, ঘর গুলোতো গোছাতে পারো... নাকি?"
নিহালের কথায় কোনো উত্তর দিল না ঐতিহ্য।  চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে শুণ্য দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো। নিহাল এগিয়ে গেল ঐতিহ্যর দিকে। হাত ধরে টেনে নিজের দিক ফিরিয়ে বললো,
-"কি দেখছিলে ওইদিক! আমি যে কিছু বলছিলাম, সেটা শুনেছো?"
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ঐতিহ্য।
-"এমন অদ্ভুত কি তুমি আগে থেকেই? তোমার এমন ছন্নছাড়া ভাব আমার মোটেও ভালো লাগছে না, ঐতিহ্য। এমন একটা ভাব নিয়ে কেন চলাফেরা করছো তুমি, যেনো জোর করে বিয়ে করে এনেছি তোমায়?"
সে কথার উত্তর না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো ঐতিহ্য। তবে বেশি একটা এগোতে পারলো না। নিহাল টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে কড়া গলায় বললো,
-"একদম নড়বে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো এখানে। ইগনোর করে চলে যাওয়া কোনো কিছুর সলিউশান না, ঐতিহ্য। প্রশ্নের মুখোমুখি হতে শেখো।"
-"হাত ছাড়ো,, লাগছে।"
আরো জোরে হাত চেপে ঐতিহ্য কে নিজের দিকে টানলো নিহাল। এক হাতে কোমর চেপে বললো,
-"ছাড়বো তো তোমাকে আজীবনেও না। কি হয়েছে তোমার? আমাকে খুলে বলো।"
-"কিছু হয় নি। প্লিজ ছাড়ো।"
-"তাহলে এমন বিহাভ তুমি আমার সাথে করছো কেন! জোর করে বিয়ে করে এনেছি তোমাকে? নাকি তুমি নিজের ইচ্ছায় এসে বিয়েটা করেছো?"
বিষণ্ণ গলায় উত্তর দিল ঐতিহ্য,
-"ওটাই সব চেয়ে বড় ভুল ছিল আমার। যার শাস্তি আমাকে আজীবন পেতে হবে।"
-"মানে? লিসেন ঐতিহ্য,, বলতে চাচ্ছিলাম না। তবে বলতে তুমি আমাকে বাধ্য করছো। একরকম ফোর্স করে আমাকে বিয়ে করিয়েছো তুমি। আমি তোমাকে জোর করি নি।"
-"তাহলে এখন ছেড়ে দাও আমায়... প্লিজ!! তোমার সাথে থাকতে আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়... তোমার দিকে ফিরে তাকালেই বাবার রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে মরামুখ টা আমার সামনে ভেসে উঠে। অসহ্য এক যন্ত্রণা নিয়ে আমি থাকছি তোমার সাথে। ভুল করেছিলাম আমি সেদিন.. ঝোঁকের মাথায় কি ছেড়ে কি করেছিলাম আমি নিজেই জানি না! তবে আমি সেদিন বাড়ি ছেড়ে এসে ভুল করেছিলাম। যার মাশুল আমার পরিবারকে দিতে হচ্ছে এখন। না সেদিন আসতাম তোমার এখানে, না আমার বাবাকে হারাতাম! আমি মাফ করতে পারবো না কখনো নিজেকে। আর না পারবো সব ভুলে সুখে শান্তিতে তোমার সাথে সংসার করতে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না, নিহাল। শুধু শুধু আমার ভুলে তুমি কেনো কষ্ট পাবে! আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তুমি নতুন ভাবে অন্যকারো সাথে জীবন শুরু করো। এতে যেমন আমি শান্তিতে থাকতে পারবো, তেমন তুমিও পারবে....."
ঐতিহ্যর সব কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো নিহাল। সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। কেনো ঐতিহ্যর এমন অদ্ভুত পরিবর্তন!
-"ডিভোর্স দিলেই কি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে?"
ঐতিহ্য নিজেকে নিহালের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
-"হবে। প্লিজ ছাড়ো।"
-"আর আমাদের ডিভোর্সের পর তুমি থাকবে কোথায়? তোমার বাসায় গিয়ে থাকবে? যেখান থেকে অপমান করে বের করে দিল তোমার বোন?"
-"সেটা আমার ব্যাপার... শুধু এটাই জানি আমি থাকতে চাই না তোমার সাথে।"
-"এটা যদি তোমার ব্যাপার হয়ে থাকে,, তাহলে ডিভোর্স দেয়াটাও আমার ব্যাপার। দিচ্ছি না তোমাকে ডিভোর্স আমি। একটু আগেও তোমার হাত ধরে একটা কথা বলেছিলাম,, ছাড়বো তো তোমাকে আমি আজীবনেও না। এখনো ঠিক এটাই বলছি...."
নিহালের কথায় দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো ঐতিহ্য। তারপর ধীর গলায় বললো,
-"জোর করো না, নিহাল। নিজের ভালো টা নিজে বুঝতে শেখ।"
এক গাল হাসলো নিহাল। বললো,
-"ছাত্রী হয়ে শিক্ষক কে জ্ঞান দিচ্ছো! যাকগে,, জোর জিনিশটা এতোদিন করি নি তোমার সাথে। তবে আজ থেকে দেখবে জোর কাকে বলে, কত প্রকার আর কি কি!!"
বলেই নিহাল পাঁজকোলে উঠিয়ে নিল ঐতিহ্য কে। বিছানায় নিয়ে গিয়ে নিজের সব ভর ছেড়ে দিল ঐতিহ্যর উপর। চেপে ধরলো ঐতিহ্যর ঠোঁট।
চিৎকার দিতে গিয়েও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না ঐতিহ্য। নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার জোগাড় হলো তার। কিছুক্ষণ চেষ্টা চালালো নিহালের কাছ থেকে ছাড়া পাবার। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠলো না। নিহাল দুই হাত দিয়ে তার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। ঠোঁট ছেড়ে গলায় নামলো ধীরেধীরে নিহাল। নিহালের ঠোঁট ঐতিহ্যর গলা থেকে বুকে নামতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো শিরায় শিরায়। নিশ্বাসও ধীরেধীরে ভারি হতে শুরু করলো ঐতিহ্যর। একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে নিহালের চুল আঁকড়ে ধরলো সে।

ছেড়ে যাবে,, না? খুব ডিভোর্সের শখ? এমন নেশায় আসক্ত করে ফেলবো, যে কখনো ছেড়ে যাবার নামও মুখে আনতে পারবে না! অবশ্য কাজটা আরো আগে করবার দরকার ছিল। তাহলে হয়তো এই ডিভোর্সের নামও মাথায় আসতো না। কিন্তু তাই বলে, এভাবে জোরাজুরি করা টা কি ঠিক হচ্ছে? সাথেসাথেই উত্তর পেয়ে গেলো নিহাল। এভরিথিং ইস ফেরার ইন লাভ.....

ডিনার শেষে টেবিল গুছিয়ে ফেললো অর্থি। ইদানীং সংসারের কাজগুলো করতে বেশ ভালো লাগে তার। বিশেষ করে শাশুড়ি কে সাহায্য করতে। অসম্ভব ভালো মনের একজন মানুষ তিনি। সারাদিন শাশুড়ির সাথে সময় কাটাতে কাটাতে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই শিখে ফেলেছে অর্থি।
নিজেদের শোবার ঘরে গিয়ে তৌহিদ কে খুঁজতে লাগলো অর্থি। ঘরের কোথাও কেউ নেই.. খেয়েদেয়ে বাইরে কোথাও বেড়িয়েছে হয়তো তৌহিদ। ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো অর্থি। যা গরম পড়েছে তাতে ফ্যান ছাড়া থাকা দায় হয়ে পড়েছে! কি মাস এটা? হঠাৎ করে এত গরম পড়লো কেন! ওড়না বিছানার এক কোণায় খুলে রেখে চুল গুলো ছেড়ে দিল সে। চুলের ভেতর ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে পড়েছে। শুকাতে হবে,, না হলে চুল পরা শুরু হয়ে যাবে। এমনিতেই এ বাড়িতে এসে প্রচুর চুল পরছে তার। হয়তো সুট করে নি পানি। ভেবে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজলো অর্থি।

তৌহিদ ঘরে ঢুকে নিরবে কিছুক্ষণ লক্ষ করলো অর্থিকে। দিনেদিনে এতো সুন্দর হচ্ছে কেন মেয়েটা! সারাদিন শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে... কবে যে মেয়েটাকে নিজের করে পাবে সে! সেদিনই না হয় মন ভরে দেখে নেবে। আপাতত এভাবে ফ্যাল ফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকলে হীতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে...
হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে তৌহিদ অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"বসে বসে ঘুমচ্ছিলে নাকি!"
চোখ খুলে ওড়না গায়ে নিল অর্থি। হেসে বললো,
-"না,, হাওয়া খাচ্ছিলাম।"
-"খাওয়া শেষ?"
-"হু, আপাতত আর খাবো না। বিছানা গুছিয়ে দেব? শুয়ে পড়বেন?"
অর্থির পাশে বসতে বসতে তৌহিদ বললো,
-"না,, কাজ আছে একটু। তুমি শুয়ে পড়ো।"
-"আচ্ছা।"
বলে বিছানা ছেড়ে নামতেই অর্থির হাত টেনে ধরলো তৌহিদ। হঠাৎ তৌহিদের এমন কাজে ঢোক গিলে অর্থি বললো,
-"কি হলো? কিছু বলবেন?"
-"হু।"
-"বলুন..."
-"বসো আগে...."
অর্থি কিছুটা ইতস্তত করে বসলো। বললো,
-"বলুন।"
-"আমরা কি আমাদের মাঝের সম্পর্কটা এর চেয়ে বাড়াতে পারি না? মানে এক ধাপ আগাতে পারি না?"
এই ভয়টাই করছিল অর্থি। আমতাআমতা করে বললো,
-"হ্যাঁ,, মা.. মানে না।"
-"বাড়াতে পারি না?"
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অর্থি। বললো,
-"আপনার না কি যেন কাজ আছে!"
অর্থির কথায় দুষ্টু একটি হাসি দিল তৌহিদ। বললো,
-"ভয় পাচ্ছো? আচ্ছা থাক,, সময় নাও... আমার কোনো তাড়া নেই। না তুমি কোথাও যাচ্ছো আর না আমি! তবে বুঝোই তো....."
কথা না শেষ করেই তৌহিদ এগুলো বুক সেলফের দিকে।

   
   (চলবে)

""সম্পর্কের_টান""

 পর্ব-২০

সকালের নাস্তা শেষে টেবিল গুছিয়ে শোবার ঘরের দিকে এগুলো নিহাল। আজ কেন যেন ভার্সিটি তে যেতে ইচ্ছে করছে না একদম। অবশ্য না গেলে তেমন একটা সমস্যাও হবে না। অন্যকেউ ক্লাস নিয়ে নেবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঐতিহ্য কে নিয়ে। কাল রাতে জোরাজুরি করার পর থেকে ফুলে ফেঁপে রয়েছে সে। আগে হ্যাঁ, না তে প্রশ্নের উত্তর টা দিলেও আজকে তাও দিচ্ছে না। একদম কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের বর্তমান সরকারের সাথে কিছুটা মিল আছে ঐতিহ্যর। দুজনেই জোরাজুরির উপর টিকে রয়েছে। ভেবেই নিজের আনমনে কিছুক্ষণ হাসলো নিহাল।

-"এই যে, ম্যাম!! কি করছেন?"
ঐতিহ্য নিহালের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘুরে বসলো। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে লাগলো।
নিহাল ঝট করে মোবাইল খুলে নিল হেডফোনের পিন থেকে। তারপর ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"গান শুনবা না?? শোনো..."
দাঁতে দাঁত চেপে ঐতিহ্য বললো,
-"আমার ফোন দাও বলছি।"
-"বর পাশে থাকতে ফোনের কি দরকার!"
-"ভালো হচ্ছে না কিন্তু..."
-"আজ্ঞে জানি.."
-"দাও।"
-"দিব,, তবে এক শর্তে।"
ভ্রু কুঁচকালো ঐতিহ্য। বললো,
-"কি শর্ত?"
-"দুপুরে আমার সাথে বাইরে খেতে যাবে... খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করে বিকালে একদম বাসায় ফিরবো। রাজি?"
-"ভার্সিটি?"
-"যাচ্ছি না আজ।"
কিছুক্ষণ ভাবলো ঐতিহ্য। তারপর বিরক্ত প্রকাশ করে বললো,
-"না,, রাজি না। দুপুরের গা ঝাঁঝালো রোদের মধ্যে ঘোরাফেরা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।"
-"তাহলে চলো বিকেলে বেরই।"
-"না.."
-"কেন? বিকেলে কি সমস্যা? বিকেলে তো আর কড়া রোদ থাকবে না।"
-"সমস্যা তুমি। তুমি কাল রাতে যা করেছো তার পরেও তোমার সাথে কথা বলছি এটা কি বেশি না!"
হাসলো নিহাল। বললো,
-"আমি কিন্তু শুধু বিছানা পর্যন্ত জোর করে নিয়ে গিয়েছি। তারপর কিন্তু কোনো জোরাজুরি ছিল না। তুমি যেভাবে চুল, পিঠ...."
নিহালকে থামিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"উফ! অসহ্য.. চুপ করো তো। আমি যাচ্ছি তোমার সাথে দুপুরে। এখন প্লিজ যাও এ ঘর ছেড়ে।"
ঐতিহ্যর এ কথায় ঘর কাঁপিয়ে খানিকক্ষণ হাসলো নিহাল। পাখি আবার পোষ মানবে না! কি করে পোষ মানাতে হয়, তা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার...

ঐতিহ্যর হাতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো নিহাল। খানিকদুর গিয়েই আবার ফিরে এল ঐতিহ্যর কাছে। মৃদু স্বরে বললো,
-"বাচ্চাকাচ্চা তাহলে নিয়েই ফেলি। দেরি কিরে আর কি লাভ! কি বলো?"
প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো ঐতিহ্য নিহালের দিকে। তারপর উঁচু গলায় বললো,
-"মাই ফুট,, ডিভোর্স চাই.. ডিভোর্স। ভদ্রভাবে দিলে দাও না হলে যেভাবে চুপচাপ বাবার বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছি, ঠিক তেমন ভাবেই এ বাসা ছেড়েও বেড়িয়ে যাব।"
নিহাল সে কথার পাত্তা না দিয়ে বললো,
-"ছেলে হলে নাম রাখবো ঐ দিয়ে। আর মেয়ে হলে ন দিয়ে। ভালো হবে না?"
-"না হবে না ভালো... ছেলেমেয়ে কোনোটাই হচ্ছে না আমাদের.. বুঝেছো? ডিভোর্স হচ্ছে,, ডিভোর্স।"
-"আচ্ছা,, ড দিয়ে নাম রাখতে চাচ্ছো? কিন্তু কেনো, সোনা? আমার বংশে ড দিয়ে নামের তো কেউ নেই। তোমার আছে নাকি? দাঁড়াও দাঁড়াও,, আমার দুরসম্পর্কের এক চাচা আছে। যার নাম ড দিয়ে। নাম কি জানো? নাম,, ডাব্বা।"
বলেই আবারো ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলো নিহাল। আজ তার মন টা অসম্ভব ভালো। কিন্তু এর কি তেমন যুক্তিযুক্ত কারণ আছে?
নিহালের এমন বিশ্রী হাসি একদম সহ্য হচ্ছে না ঐতিহ্যর। একদম গা জ্বলে যাচ্ছে। না, এখানে আর একদণ্ড বসে থেকে আর এই হাসি দেখতে পারবে না সে। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুতপদে সে এগুলো অন্য ঘরের দিকে।

রাতের খাবার খেয়ে তৌহিদ বেড়ুলো রাস্তায় সামান্য হাটাহাটি করতে। এই সময়টায় হেটে খুব আরাম পায় সে। নদীর তীরবর্তী এলাকা হবার কারণে মাঝেমাঝে মৃদু বাতাস এসে গায়ে লাগে। তরতরে ভাব চলে আসে শরীরে। রাতের ঘুমটাও বেশ আরামের হয়।

অর্থি কিছুটা ইতস্তত করেই তার ঘরে ডেকে নিয়ে এল শাশুড়ি তৌহিদা বেগমকে। একটা শাড়ি দেখিয়ে বললো,
-"শাড়িটা পড়বো, মা।"
শাড়ি হাতে নিয়ে তৌহিদা বেগম বললেন,
-"বাহ,, সুন্দর তো। পড়ে ফেলো।"
মুখ ছোট করে অর্থি বললো,
-"পড়তে জানি না। এর জন্যই আপনাকে ডাকা।"
মুখ টিপে হেসে তৌহিদা বেগম বললেন,
-"ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে আসো। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।"
-"মা, প্লিজ হাসবেন না।"
অর্থির এ কথায় আর হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না তৌহিদা বেগম। উঁচু শব্দে খানিকক্ষণ হেসে নিয়ে তিনি বললেন,
-"তৌহিদ পড়তে বলেছে নাকি!"
লজ্জায় মুখ লালচে হয়ে এল অর্থির। ইশ! আজ যদি শাড়িটা পড়তে জানতো তাহলে এসবের সম্মুখীন হতে হতো না কখনওই। কি করেছে বাসায় বসে বসে সে! সামান্য শাড়ি পড়াটাও জানে না...

তৌহিদ ঘরে ঢুকেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল। সে কি ভুল করে অন্যের বাসায়, অন্যের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে? তাই হবে হয়তো। না হলে শাড়িপরিহিতা কে দাঁড়িয়ে আছে এই ঘরে?
-"কি হলো! এভাবে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছেন কেন? কোনোদিন মেয়ে দেখেন নি?"
ঢোক গিললো তৌহিদ। শাড়িপরিহিতা মেয়েটি আর কেউ নয়! তার সহধর্মিণী অর্থি। এ যেনো অবাস্তব সত্য! কিছুক্ষণ আগেই তো অর্থিকে দেখে বেড়িয়েছিল সে। তখন তো তার পরণে কামিজ ছিল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে ঘেমে একাকার হয়ে খাবার গুছিয়ে রাখছিল সে। অথচ এখন! সেকসবের কোনো চিহ্নই নেই....

-"কি হলো?"
-"মেয়ে তো দেখেছিই.... তবে স্বর্গের কোনো অপ্সরী দেখা হয়েছিল না।"
তৌহিদের এমন উত্তরে লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললো অর্থি। মুখ না তুলেই বললো,
-"পটানোর ধান্ধা,, না?"
তৌহিদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অর্থির দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ গলায় বললো,
-"এসব কি আমার জন্য?"
-"মোটেও না। শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছিল। তাই পড়লাম। আপনার জন্য হবে কেন!"
-"আচ্ছা!! তাইলে আর কি করা! মশারি টা টানিয়ে দাও তো। ঘুমিয়ে পড়ি।"
তৌহিদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল অর্থি। তৌহিদ তো বিছানার দিকেই এগুচ্ছে। সত্যিই কি ঘুমিয়ে পড়বে নাকি! ভালোই ঝামেলা হয়ে গেলো তো! সে কি মুখ ফুটে বলতে পারে নাকি, পতিদেব এসব তোমার জন্য!!
-"কি হলো? মশারি টা...."
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না তৌহিদ। দৌড়ে এসে অর্থি তাকে বাহুডোরে আটকে নিয়েছে। কি করা উচিৎ এখন তার?
-"এক ধাপ এগুতেই পারি আমরা।"
অর্থির কথায় নিজের সব শক্তি দিয়ে তৌহিদ জড়িয়ে ধরলো তাকে।

অর্থির ভেতর যেমন একটা ভয় কাজ করছে, তেমন একটা আনন্দও কাজ করছে। অনেকদিন হলোই তার মনে হচ্ছিল, এই কয়েকটা দিনেই অজানা এক টান তাদের দুজনকে বেধে ফেলেছে? কি সেই টান? কেন এত্ত ভালো লাগে তার তৌহিদের সঙ?

বিছানায় একপাশে অর্থিকে শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লো তৌহিদ। ধীর গলায় বললো,
-"অর্থি,, তোমাকে জোর করে বিয়েটা দিয়েছিল তোমার বাবা... না?"
-"উহু,, আমি নিজের ইচ্ছেই বিয়েটা করেছি। তবে পরিস্থিতি কেমন ছিল জানেনই তো।"
-"আমাকে তৃষ্ণা জানিয়েছে সব....."
-"ভাবি কি আমার মনের কথা জানে নাকি! আমি নিজের ইচ্ছেই বিয়েটা করেছিলাম। কেউ কোনো জোরটোর করেনি।"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো তৌহিদ। তারপর বললো,
-"তুমি কি আমার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে পারবে?"
সময় নিল না অর্থি। বললো,
-"পারবো।"
-"ভেবে বলো। এক ধাপ আগানোর আগে জিনিশ টা ক্লিয়ার হয়ে নেয়া উচিৎ।"
-"ভেবেই বলছি.."
-"পরে আফসোস যদি হয়, কেন খোঁড়া একজনের সাথে এতোদুর এগুলে!"
-"হলে হবে।"
বলে নিজেই তৌহিদের দিকে এগুলো অর্থি। তৌহিদের বুকে মাথা রেখে বললো,
-"এতোদিন যখন কাছে আসছিলাম না, তখন কত কথা বলতেন!! আর আজ যখন নিজ থেকেই আসলাম তখন আজেবাজে কথা শুরু করে দিয়েছেন!!"
হাসলো তৌহিদ। দুইহাতে চেপে ধরলো অর্থিকে নিজের বুকে। বললো,
-"শাড়িতে কিন্তু মারাত্মক লাগছে আমার পিচ্চি বউটাকে।"
-"থ্যাংকইউ... আপনি আগাবেন নাকি আমি?"
দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে তৌহিদ বললো,
-"তুমিই আগাও..."
বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তৌহিদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো অর্থি।

      (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ