সম্পর্কের টান
পর্ব-৪১+৪২
আজ সারাটা দিনে খুব ব্যস্ত সময় কেটেছে তৌহিদের। একবার কল করে অর্থির খবর টাও নিতে পারে নি। সকালে কোর্টে আসবার আগে জোর করেই সামান্য কিছু খাইয়ে এসেছিল অর্থিকে। দুপুরে ঠিকঠাক ভাবে খেলো কিনা কে যানে! অবশ্য তৃষ্ণা কে বলে এসেছিল সে। তবে তৃষ্ণার তনয়কে নিয়ে এতসব কিছু সামাল দেয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবার কথায় আর কান দেয়া যাবে না। এবার একটা কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। কিছুদিন আগেও একটা ছিল। তবে বাবা সেটাকে নানা বাহানা দেখিয়ে তাড়িয়েছে। বাবার মন বোঝা সত্যিই বড়ই কঠিন! ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল টিপলো তৌহিদ। ড্রইংরুম থেকে হাসিঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। কেউ এসেছে নাকি?
-"কেমন আছেন, তৌহিদ ভাই? অনেকদিন হলো দেখা হয় না। শুকিয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।"
-"এই তো ভালো। তা তুমি কোত্থেকে?"
-"এলাম এক দেশ থেকে। আপনারা তো আর খোঁজখবর নেবেন না। তাই আমারই আপনাদের খুঁজতে খুঁজতে আসতে হলো। বিশ্বাস করবেন না কতো টা কষ্টে আপনাদের এই বাসার এড্ড্রেস কালেক্ট করেছি।"
সঞ্চিতার কথায় সামান্য হেসে তৌহিদ বললো,
-"তাই নাকি!"
তৃষ্ণা বললো,
-"মোটেও না ভাইয়া। কাল যখন মুহিব ভাইয়ের সাথে বেড়িয়েছিলাম তখন দেখা হয়েছিল ওর সাথে।"
-"তো তুই বলতে চাচ্চিস আমি কষ্ট করেনি? তোদের আগের বাড়িতে কয় চক্কোর দিয়েছি জানিস?"
-"হয়েছে.. আর ন্যাকামো করতে হবে না। মানলাম তুই আসলেই অনেক কষ্ট করেছিস। হ্যাপি?"
কথাবার্তার এ পর্যায়ে সোফায় বসে পড়লো তৌহিদ। অনেকদিন পর এসেছে সঞ্চিতা এ বাড়িতে। ভদ্রতাবসত হলেও তার কিছুটা সময় এখানে বসতেই হবে। কিন্তু অর্থি টা কোথায়?
-"দেখুন মুহিব ভাই,, যাই হোক আপনার আমার বিয়েতে থাকতেই হবে। হবে মানে মাস্ট থাকতে হবে। বলুন আসবেন?"
-"যাবো রে বাপ। কাল থেকে তো বলার উপরেই আছি।"
-"আপনার কথা আমার একদম বিশ্বাস হয় না। সব কথাই কেমন যেন মনে হয় আপনি ফান করে বলছেন!"
সঞ্চিতার কথায় মন খুলে খানিকক্ষণ হাসলো মুহিব। তারপর বললো,
-"না.. সত্যিই বলছি। আসবো তোমায় বিয়েতে আবার নারায়ণগঞ্জ।"
-"প্রমিজ করুন আসবেন।"
-"করলাম। তবে আমি এটা বুঝছি না, আমাকে তোমার বিয়েতে মাস্ট থাকতে হবে কেন? আমাকে নিয়ে এত টানাটানি কেনো বলোতো? সামথিং সামথিং না তো আবার?"
সঞ্চিতা হতাশা মাখা গলায় জবাব দিল,
-"হলেও বা আর কি করার আছে! বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে। এই বিয়ে টা ঠিকঠাক না হলে আপনার গলায় ঝুলে পড়তাম মাস্ট।"
-"সিরিয়াসলি! একদিনের পরিচয়েই এতোকিছু?"
তৃষ্ণা দুজনের কথার ফাঁকে বলে উঠলো,
-"কি শুরু করলি সঞ্চি? ছেলেদের পটানোর ধান্ধা তোর গেল না!"
-"আমি মোটেও পটাচ্ছি না। আমি সবসময় চাইতাম আমার হাজবেন্ডও যেনো আমার মতো চঞ্চল হয়, সবসময় হাসিখুশি থাকে, মিশুক হয়। যেমন টা মুহিব ভাই। এদের একটা বৈশিষ্ট্য জানিস? এরা নিজেদের নিজেরা ভালো রাখার পাশাপাশি তাদের আশেপাশের লোকজনদেরও ভালো রাখে। এন্ড দ্যা প্লাস পয়েন্ট ইজ এদের রাগ হলেও দ্রুত তা নিজের কন্ট্রোলের আনার উপায় এরা খুব ভালোভাবে জানে..... আর জয়ের স্বভাব পুরোটাই উলটো। একদমই মিশুক না, স্বল্পভাষী, আর অলওয়েজ মুখ গোমড়া করে রাখে। দেখে মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ মাত্র তার উপর দিয়ে গিয়েছে।"
বলেই খিলখিল করে হেসে ফেললো সঞ্চিতা।
-"তো এটাই তো ভালো তোমার জন্য। তুমি সারাদিন প্যানপ্যানিয়ে যাবে আর জয় চুপচাপ তোমার কথা শুনে যাবে। তুমি বাঁচাল উনি স্বল্পভাষী। একদম পারফেক্ট কাপল।"
-"মোটেও না, মুহিব ভাই। আমার দরকার ছিল আপনার মত কাউকে। আপনি প্লিজ আমাদের বিয়েতে আসবেন। আর এসে কিছুদিন থাকবেন সাথে জয়কে প্লিজ কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাবেন।"
-"আমার মত কাওকে কেন? আমি স্বয়ং তোমার সামনে উপস্থিত আছি। যদি বলো তো চার হাত এক করে ফেলি। কি বলো?"
-"ইচ্ছে তো আছেই। তবে বেচারা জয় আবার দেবদাস হয়ে যাবে। আমি চাই না ছাইপাঁশ খেয়ে খেয়ে সে অকালে পরপারে পাড়ি জমাক।"
কথাবার্তার এ পর্যায়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো তৌহিদ। এখানে বসে থাকতে আপাতত তার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। তার মন সেই সকাল থেকেই পড়ে আছে অর্থির কাছে। অথচ তার দেখা কোনোভাবেই মিলছেই না। কেমন আছে, কি করছে, দুপুরে খেয়েছে নাকি মেয়েটা কে জানে! ড্রইং রুমে বসা সবার উদ্দেশ্যে তৌহিদ হালকা কেশে বললো,
-"আচ্ছা,, তোরা বসে আড্ডা দে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।"
বলেই হনহনে পায়ে তৌহিদ নিজের ঘরের দিকে এগুলো।
কপালে তৌহিদের স্পর্শ পেয়েই চোখ খুলে বিশ্বজয়ীর হাসি দিয়ে অর্থি বললো,
-"জ্বর নেই।"
-"তাহলে এভাবে অবেলায় শুয়ে আছো কেনো?"
তৌহিদের প্রশ্ন শুনে উঠে বসলো অর্থি। বললো,
-"তোমার অপেক্ষায় ছিলাম.. দেখি ভালোভাবে বসো তো। তোমার বুকে মাথা রাখবো।"
অর্থিকে টেনে নিজের বাহুডোরে বন্দি করলো তৌহিদ। মাথায় কিছু চুমু দিয়ে বললো,
-"দুপুরে খেয়েছিলে?"
-"হু..."
-"কতো টুকো?"
-"অনেক।"
-"সত্যি তো?"
-"হু..."
-"মেডিসিন?"
-"হু... ভালোবাসি তোমায় খুব খুব খুব খুব খুব।"
অর্থির কথায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরলো তৌহিদ।
সারাদিন একেরপর এক কল দেবার পর রাত ৯ টার দিকে ফোন রিসিভ করলো অতৈন্দ্রিলা। বিরক্তিপ্রকাশ করে বললো,
-"সমস্যা কি তোমার? দেখছোই যে আমি একবার কল রিসিভ করছি না... সেক্ষেত্রে তোমার বোঝা উচিৎ আমি বিজি। তারপরও হাজার বার কেন দাও!!"
শান্ত গলায় মাহসান বললো,
-"তুমি কোথায়, অতৈ?"
-"অবশ্যই বাসায়... তোমাকে তো বলেছিই আমি কিছুদিন রেস্ট নিব বাসায়।"
-"তুমি বাসায় নেই। তুমি কক্সবাজার গিয়েছো আজিজ সাহেবের সঙ্গে।"
মাহসানের কথায় কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইলো অতৈন্দ্রিলা। তারপর আবারো আগের মত কড়া গলায় বললো,
-"তো? থাকতেই পারি।"
-"না থাকতে পারো না।"
-"লল!! হু আর ইউ? আমি থাকতে পারবো কি না এটা বলার তুমি কে?"
-"আমি কি কেউ না?"
-"না... তুমি কেউ নও।"
অতৈন্দ্রিলার কথায় রাগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে মাহসানের। প্রতিটি শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে তা দ্রুত বেগে। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতে মুঠ চেপেও নিজের এই রাগকে আয়ত্বে আনতে পারছে না সে। কিন্তু না.. এখন রাগ দেখানোর সময় নয়। এখন যা করতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে বুজে শুঝে করতে হবে।
-"তুমি কবে ফিরবে ঢাকায়?"
-"যেদিনই ফিরি সেটা তোমাকে বলতে যাবো কেন!"
-"ভদ্র ভাষায় ঠিকঠাক ভাবে কথা বলো, অতৈ। তুমি জানো আমি রাগলে তোমার কি করতে পারি।"
-"থ্রেট দিচ্ছো আমায়?"
-"না। শুধু সুন্দরভাবে কথা বলতে বলছি।"
-"ওকে... আমি কাল ঢাকায় আসছি। এসে তোমার সাথে এ নিয়ে ফেস টু ফেস কথা হবে। বাই।"
-"আসবো, মুহিব ভাই?"
তৃষ্ণার গলার আওয়াজে শোয়া থেকে উঠে বসলো মুহিব। বললো,
-"হুম... এসো।"
-"শুনলাম কাল ভোরে নাকি চলে যাচ্ছেন?"
-"হুম... যাচ্ছি।"
-"কাজ শেষ সব?"
-"হ্যাঁ,, শেষ। দাঁড়িয়ে আছো কেন! বসো।"
-"না,, ঠিক আছি। মেঘ ডাকছে হালকা। শুনতে পাচ্ছেন?"
-"হুম.. পাচ্ছি। এই বৃষ্টিটাই হয়তো পুরো দমে শীত ফেলে দেবে।"
-"হয়তো... শীতকাল কেমন লাগে আপনার?"
-"আমার সব কালই ভালো লাগে। কোনো বাছবিচার নেই কোনোকিছুতেই।"
-"অহ..."
বলেই চুপ হয়ে গেল তৃষ্ণা। এই কথার পিঠে আর কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবে খুব করে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে পুরো রাত টা গল্প করে কাটাতে। কেন যেনো মুহিবের আশেপাশে থাকলেই তার মন টা হাসিখুশি থাকে। বাদবাকি সময়টাতে অতীতের কিছু স্মৃতি তাকে ঠুকরে ঠুকরে জখম করে ফেলে। ভেবেই ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। বললো,
-"সঞ্চির বিয়েতে কি সত্যিই আসবেন?"
-"চেষ্টা করবো।"
-"তাহলে সঞ্চিকে এতোটা জোর গলায় কেনো বললেন যে আপনি আসবেন? এখন যদি আপনি ওর বিয়েতে না আসেন, ও কতোটা কষ্ট পাবে.. জানেন আপনি?"
তৃষ্ণার কথায় কোনো উত্তর দিল না মুহিব। সন্ধ্যের পর থেকে প্রচণ্ড রকমের মন টা খারাপ হয়ে আছে তার। অবশ্য এতোটা খারাপ লাগাও তো উচিৎ নয় তার। যা তার কপালে লেখাই ছিল না.. তার পিছনেই কেন বারবার ছুটছে সে!!
-"প্লিজ আপনি আসবেন, মুহিব ভাই। বেচারি আপনাকে খুব বেশিই পছন্দ করে। আপনি না আসলে ও পুরো দিনটায় মন খারাপ করে থাকবে। বিয়ের আনন্দ টাই মাটি হয়ে যাবে ওর।"
ম্লান হেসে মুহিব বললো,
-"আচ্ছা.. আসবো।"
-"আপনি কিভাবে এত দ্রুত মানুষের মন জয় করে ফেলেন,, বলুন তো? অসাধারণ এক ক্ষমতা!"
-"সত্যিই কি আমি মানুষের মন সহজেই জয় করতে পারি?"
মুহিবের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা বললো,
-"তাতে কোনো সন্দেহ আছে? সঞ্চিকেই দেখুন না! দুদিনেই আপনি বলতে পাগল.."
-"তাহলে আমি যার মন জয় করতে চাই,, তার মন জয় করতে পারছি না কেনো.. বলোতো?
-"আমার কিন্তু তেমন টা মনে হয় না। তার মনও হয়তো জয় করে ফেলেছেন। কিন্তু সে হয়তো সেটা আপনাকে দেখাতে চাচ্চেন না।"
তৃষ্ণার কথায় হুট করেই মুহিব বলে ফেললো,
-"সত্যিই কি আমি তোমার মন জয় করতে পেরেছি?"
হঠাৎ মুহিবের কথায় বুক টা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। অবাক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো মুহিবের দিকে। একপর্যায়ে মুহিবকে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাঁপাকাঁপা গলায় সে বললো,
-"তনয় কাঁদছে...।"
তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল সে মুহিবের ঘর ছেড়ে।
(চলবে)
সম্পর্কের_টান
#পর্ব-৪২
বিছানায় চুপচাপ শুয়ে একেরপর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে মাহসান। বড্ড একা হয়ে পড়েছে সে। আজ তার একজন কে পাশে খুব বেশি দরকার। কিন্তু নেই,, থাকবেই বা কিভাবে? মানুষের পাশে মানুষ থাকে,, কোনো পশুর তো পাশে নয়। হ্যাঁ,, সে পশু। পশু আর তার মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই.... এই সেই ঘর যে ঘরে একদিন তৃষ্ণাকে অনেক আজেবাজে কথা শুনিয়েছিল সে। বিছানার পারফরমেন্স নিয়ে কথা বলেছিল। ছিঃ! সে কিভাবে পারলো এতোটা নিচে নামতে? কিভাবে পারলো সে তৃষ্ণাকে এসব বলতে? একবারো তার বাধলো না? স্বামী স্ত্রীর মাঝের পবিত্র সম্পর্ককে সে কি রেখে কি বানিয়ে দিল? জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রে তে রাখলো মাহসান। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে মেঝেতে পায়চারী করতে লাগলো। একবার তৃষ্ণার সাথে কথা বলা উচিৎ তার। কিন্তু কি বলবে সে? ফিরে আসতে বলবে? কি মুখ নিয়ে বলবে? না... এটা কখনওই বলবে না সে তৃষ্ণাকে। তবুও,, তৃষ্ণার সাথে এখন তার একটাবার কথা বলা দরকার। একবার কল দেবে কি তৃষ্ণার নাম্বারে? কিন্তু কিভাবেই বা দিবে? তৃষ্ণার নাম্বারই তো তার জানা নেই। আগের ফোন টা তো এখানেই ফেলে রেখে গেছে, নতুন ফোন কিনেছে কিনা সন্দেহ! অবশ্য যেহেতু জবের জন্য ট্রায় করছে সেহেতু ফোন কিনেছেই বোধহয়। কিন্তু নাম্বার? নাম্বার তো জানা নেই তার! একরাশ হতাশা নিয়ে আবারো বিছানায় এসে বসলো মাহসান। কি রেখে কি করা উচিৎ এখন তার এসব মাথায় আসছে না। তবে যাই করুক না কেনো সে কখনওই তৃষ্ণাকে নিজের জীবনে ফিরতে বলতে পারবে না। সম্ভবই না কখনো এসব বলা! যা কিছু সে তৃষ্ণার সাথে করেছে, তৃষ্ণাকে যা সব শুনিয়েছে তাতে কোনোভাবেই তৃষ্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার জীবনে আবারো ফিরতে বলতে পারবে না। আর না তৃষ্ণাও ফিরবে.... মাথা টা প্রচণ্ড ফাঁকাফাঁকা লাগছে এখন মাহসানের। কি রেখে কি করবে এখন সে? নিজের পুরো জীবনকে স্বেচ্ছায় নিজের হাতে ধ্বংস করে ফেলেছে সে। নেই.. তাকে এই ধ্বংসের মাঝ থেকে উঠানোর মতো পাশে কেউ নেই। সে একা.. পুরো পৃথিবীতে সে একা। না আছে বাবামা, না আছে ভাই বোন, না স্ত্রী, না ছেলেমেয়ে। এভাবে কিভাবে সে পাড়ি দেবে বাকিটা জীবন? এর চেয়ে কি এই একাকি নিঃসঙ্গ জীবনের সমাপ্তি ঘটানোই সহজ নয়
??
-"তৃষ্ণা? তৃষ্ণা? ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?"
মুহিবের ডাকে চিন্তার জগৎ ছেড়ে বাস্তব জগতে পা দিল তৃষ্ণা। মুহিবের ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার পর থেকে শুধু মুহিবের বলা কথাগুলো নিয়েই ভাবছিল সে। কথাগুলো দ্বারা কি বোঝাতে চাইলো মুহিব ভাই?
-"তৃষ্ণা?"
-"না ঘুমাইনি। বলুন? কিছু লাগবে?"
নিজের ঘর থেকে বলে উঠলো তৃষ্ণা।
-"না কিছু লাগবে না। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। একবার বাইরে আসবে?"
মুহিবের কথায় একবার ভাবলো না বলবে তৃষ্ণা। তবে পরক্ষণেই নিজের মত পালটে ফেলে বললো,
-"আপনি গিয়ে ড্রইংরুমে বসুন। আমি আসছি।"
দুই কাপ কফি বানিয়ে এনে তৃষ্ণা এসে বসলো মুহিবের মুখোমুখি। জানালা খোলা থাকবার কারণে বাইরে থেকে মৃদু বাতাস বয়ে আসছে ঘরের ভেতর টায়। বেশ শীত শীত লাগছে তৃষ্ণার। গায়ে একটা শাল পেঁচিয়ে এল ভালো হতো। শালের জন্য যাবে কি ঘরে একবার?
কফির কাপে একবার চুমুক দিয়ে মুহিব বললো,
-"জানালা টা চাপিয়ে দিয়ে এসো। বেশ ঠাণ্ডা ঠান্ডা লাগছে।"
-"না.. থাক। ভালোলাগছে।"
-"আচ্ছা থাকুক।"
-"কি যেন বলবেন বলছিলেন?"
-"আসলে আমি কিছুক্ষণ আগের ব্যাপারটা নিয়ে সরি। ওভাবে কিছু বলতে চাই নি। তবে.."
মুহিবের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল তৃষ্ণার। বললো,
-"তবে?"
মুহিব একদমে বললো,
-"তবে যেটা বলেছি সেটা সত্যি। মন থেকে বলেছি। মনের ভেতরও যদি কোনো গভীর অংশ থাকে, আমি সেটা দিয়েই বলেছি। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা আমার ধাচে নেই। তাই এতোদিন চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু এখন আর পারবো না নিজের মাঝের আবেগ কে লুকিয়ে রাখতে। ভালোলাগে তোমাকে, আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে তোমার, তোমার মুখের হাসি দেখলে প্রশান্তি পাই আমি, তোমার কষ্ট দেখলে বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। কেন এমন হয় তৃষ্ণা? ভালোবাসি বলেই তো... না?"
মুহিবের কথায় হালকা মাথা ঝাঁকালো তৃষ্ণা। এতোটাই অবাক হয়েছে তৃষ্ণা, যে কিছু বলবার মত মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
-"বিশ্বাস করো যেদিন তৌহিদের মুখ থেকে তোমার বিয়ের খবর টা শুনলাম, আমি পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। কেন তোমাকে আমার মনের কথা গুলো জানাইনি, কেন তৌহিদকে কিছু তোমার ব্যাপারে জানাইনি,, এসব ভাবতে ভাবতে পুরো পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। পারছিলাম সহ্য করতে এসব কিছু। কিন্তু কথায় আছে না, রাখে আল্লাএহ মারে কে? বাট আই সোয়ার, আমি কখনো চাইনি এমন কিছু হোক তোমার সাথে। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, আর আমি মনে করি যাকে সত্যিই ভালোবাসা যায় তার কখনওই ক্ষতি চাওয়া যায় না।"
কথাগুলো বলে থামলো মুহিব। এক হাত তৃষ্ণার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-"এই হাত তুমি সবসময় তোমার পাশে পাবে। ভাইয়ের ফ্রেন্ড বলো বা অন্যকিছু আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, তৃষ্ণা। তোমার আর তোমার হাজবেন্ডের কথাগুলো শোনার পর আমি বারবার আসতে চেয়েছি তোমার সাথে দেখা করবার জন্য, কিন্তু পারি নি। কেন যেন মনে হয়েছে, তুমি ভাববে আমি তোমার বিপদ দেখে সুযোগ খুঁজছি। কিন্তু মোটেও তা নয়। তোমার কাছে আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই, তৃষ্ণা। আমি তোমাকে এখন কথাগুলো জানিয়েছি বলে তোমার আমাকে উত্তর দিতে হবে হ্যাঁ অথবা না তেমন কিছু নয়। তুমি তোমার নিজের মতো স্বাধীন ভাবে যেভাবে চলছো চলো। আমি শুধু আমার নিজের ফিলিংস গুলো তোমার সাথে শেয়ার করেছি। তোমার দিকের কোনো উত্তর চাই নি। যেটা এর আগে করতে পেরেছিলাম না আমি। যার ফলস্বরুপ আমাদের এই জীবন। আমি যদি আগেই আমার ফিলিংসগুলো তোমাকে জানাতাম, তৌহিদকে জানাতাম,, তাহলে হয়তো আমাদের সবার জীবনই আজ অন্যরকম হতে পারতো।"
বলেই একটি স্বস্থির শ্বাস ফেললো মুহিব। তারপর হাতে থাকা কফির মগ রেখে সোফা ছেফে উঠে পড়লো সে। জানালার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"বাইরে বৃষ্টি পড়ছে,,, জানালাটা লাগিয়ে দেই। ছেঁচা এসে লাগছে গায়ে।"
জানালা লাগাতেই জোরে একটা বাজ পড়বার শব্দ হলো, সাথে ঘর জুড়ে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। মুহিব নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। তবে পাওয়া গেল না। ঘরেই ফেলে রেখেছে বোধহয়। হাতরিয়ে হাতরিয়ে এগুতে লাগলো তৃষ্ণার দিকে।
-"তনয় ভয় পাবে না তো আবার? ওর পাশে যাও।"
তৃষ্ণা অসহায় গলায় বললো,
-"আলো লাগবে।"
-"একটু বসো। আমি আমার ফোন নিয়ে আসছি।"
নিজের থাকার ঘরে যাবার পথে চার পাঁচ বার গুঁতো খেল মুহিব। একে তো ঘোর অন্ধকার তার উপর নিজের বাসা নয়। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আবারো ড্রইংরুমে ফিরে এল মুহিব। তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-"চলো।"
ঘরে এসেই চুপচাপ তনয়ের পাশে এসে বসলো তৃষ্ণা। মুহিবের উদ্দেশ্যে বললো,
-"এখন যেতে পারেন।"
-"একবার তনয়কে দেখে যাই। খুব ভোর থাকতেই বের হবো।"
-"অহ...।"
তনয়ের পাশে গিয়ে আলতো করে হাত বুলালো তার মাথায় মুহিব। কপালে, গালে কয়েকটি চুমু দিয়ে উঠে এল বিছানা ছেড়ে। এগুলো দরজার দিকে। দরজার পাশে আসতেই থমকে দাঁড়ালো মুহিব। তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বললো,
-"এখনো কি তুমি চাও আমি সঞ্চিতার বিয়েতে আসি?"
-"চাই।"
তৃষ্ণার উত্তরে ম্লান হেসে মুহিব বললো,
-"শুভ রাত্রি।"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।