সম্পর্কের টান ।পর্ব-৩৯+৪০


সম্পর্কের টান
পর্ব-৩৯+৪০

-"তুমি ধীরেধীরে সামনে এগোও। আমি একটু অফিসরুম থেকে ঘুরে আসছি। বেশি না... দুই মিনিট লাগবে।"
নিহালের কথায় হ্যাঁ না কিছুই বললো না ঐতিহ্য। প্রচণ্ড রকমের রাগ হচ্ছে তার নিহালের উপর। শুধু একবার বাসায় যাই! ভার্সিটির নাম ভুলিয়ে ছাড়বো তোমার! মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে হেটে সামনের গেটের দিকে এগুতে লাগলো ঐতিহ্য।

রিকশায় বসেই নিহাল একহাতে জড়িয়ে ধরলো ঐতিহ্যকে। কোমরে হাত রেখে হালকা চাপ দিয়ে বললো,
-"কোনো অসুবিধা হয়েছে কি এক্সাম দিতে?"
হালকা মাথা ঝাঁকাল ঐতিহ্য। যার অর্থ হ্যাঁ ও হতে পারে আবার না ও হতে পারে। নিহাল আড়চোখে ঐতিহ্যর দিকে তাকিয়ে ঐতিহ্যর মনে কি চলছে বুঝতে চেষ্টা করলো। কোনো কারণে কি রেগে আছে ঐতিহ্য? এক্সাম কি ভালো হয় নি? নাকি শরীর টা খারাপ? প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস চলছে এখন ঐতিহ্যর। শরীর প্রায় সময়ই খারাপ থাকে। এর মাঝেই আবার মিড টার্ম এক্সামের ডেট পড়াই এক্সাম গুলোও দিতে হচ্ছে। এতে ব্রেইনের উপর হয়তো প্রচণ্ড চাপ পড়ছে ওর। তার কি ঐতিহ্য কে এক্সাম গুলো দেয়া থেকে মানা করা উচিৎ ছিল?

রিকশায় আর দুজনের মাঝে তেমন কোনো কথা হলো না। নিহাল দু একটা প্রশ্ন করলেও ঐতিহ্য তেমন একটা পাত্তা দিল না সেগুলোর। ফ্লাটে ঢুকতেই ঐতিহ্য চলে এল নিজের ঘরে। তাড়াহুড়ো করে জামাটা বদলিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো বিছানায়। প্রস্তুতি নিতে লাগলো একদফা ঝগড়া বাধানোর। অপরদিকে নিহাল বাসায় ঢুকেই আগে ফ্রিজে রাখা খাবার গুলো বের করলো। কাল রাতে খাবারগুলো দুজন মিলে রান্না করে রেখেছিল আজকের জন্য। যেহেতু দুজনই সকালেই বেড়িয়ে পড়বে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ফিরবে ভর দুপুরে। এসে রান্নাচড়ানো, খাওয়া দেরি হয়ে পড়বে.... খাবারগুলো গরম করে টেবিলে খাবার গোছালো নিহাল। দুপুর তিনটের বেশি বেজে গেছে। ঘরে কি করছে ঐতিহ্য? ক্ষুধা পেয়ে গেছে বোধহয় ওর খুব!!

-"ঐতি,, উঠো পড়। সব গরম করে টেবিলে রেখে এসেছি। উঠো.. উঠো।"
বলেই নিহাল ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে। ভার্সিটি যাবার আগেই শাওয়ার সেড়ে নিয়েছিল। তাই এখন শুধু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লো। গায়ের শার্ট খুলে একটি টিশার্ট, প্যান্ট বদলিয়ে টাউজার পড়ে নিল সে। তারপর ঐতিহ্য কে ডেকে বললো,
-"কি ব্যাপার? উঠছো না কেন? ক্ষুধা পায় নি?"
থমথমে গলায় জবাব দিল ঐতিহ্য,
-"না।"
-"তোমার না পেলেও আমার বাচ্চাটার পেয়েছে। দেখি চলো। উঠো তো।"
বলে গায়ে হাত রাখতেই নিহালের হাত ছিটকে ছড়িয়ে দিল ঐতিহ্য। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-"শরমির সাথে এত কি কথা তোমার? তুমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কি কথা বলছিলে?"
ঐতিহ্যর কথায় আকাশ থেকে পড়ল নিহাল। অবাক হয়ে বললো,
-"কোথায় ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তো গার্ড দিচ্ছিলাম পুরো রুম ঘুরে ঘুরেই। কোথাও তো সেভাবে দাঁড়াই নি।"
-"আমি মিথ্যে বলছি? আমার চোখ নেই? আমি কি দেখতে পাই না?"
ঐতিহ্যর কথায় হাসি পেয়ে গেল নিহালের। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সে বললো,
-"তার মানে তুমি পরীক্ষায় খাতায় না লিখে আমি কি করছি না করছি সেদিকে লক্ষ রাখছিলে?
এ পর্যায়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো ঐতিহ্য। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দিল,
-"একদম হাসবে না। হাসার মত কি বলেছি? হ্যাঁ? তুমি গার্ড দেয়ার বাহানায় লুচ্চামি করবে, ছাত্রীদের সাথে আড্ডাবাজি করবে আর আমি সেদিকে লক্ষ রাখলেই দোষ! যার হাজবেন্ড এত লুচু প্রকৃতির হবে সে কিভাবে আরামসে বসে বসে খাতায় লিখে যাবে?"
-"আরে বাবা!! কি বলো এসব! লুচ্চামি করবো কেন আমি!"
-"তাহলে শরমির সাথে কি কথা বলছিলে? তাও একবার না। যখনি আমি তোমার দিকে তাকিয়েছি দেখেছি তুমি শরমির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছো।"
-"এমনি একটা! দুইবার শুধু শরমির পাশে গিয়েছিলাম আমি। প্রথমবার ও একটা প্রশ্ন বুঝতে পারছিল না। সেটার জন্য ডেকেছিল। আর দ্বিতীয় বার লুজ শিট নেবার সময়। তাছাড়া তো..."
নিহালকে থামিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"আমি দেখেছি... হ্যাঁ! তুমি ওর পাশে শুধু দুইবার না অনেকবার গিয়েছিলে। আর ধরলাম তুমি দুইবারই গিয়েছিলে। কেন যাবে দুইবার? আর কিসের প্রশ্ন বোঝা? পরীক্ষা দিতে এসে আবার কিসের প্রশ্ন বোঝা? পড়ে আসে নি বাসায় থেকে কিছু! আর বললেই তোমার বুঝিয়ে দিতে হবে কেন?"
-"তো কেউ ডাকলে শুনবো না সে কি জন্য ডাকছে! ইচ্ছা করে তো আর যাই নি।"
ভ্রু কুঁচকে ঐতিহ্য বললো,
-"যেভাবেই যাও গিয়েছো তো! কই আমার পাশে তো একবারো আসো নি তুমি। কেন এলে না আমার পাশে? বলো?"
-"তোমার পাশ দিয়ে তো কতবারই হেটে গেলাম।"
-"পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া আর পাশে দাঁড়ানো এক?"
নিহাল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-"তোমার পাশে গিয়ে তো আর ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কে না কে কি ভেবে বসবে! তখন আবার বলে বেড়াবে পুরো ক্যাম্পাসে, নিহাল স্যার তার বউরে এক্সাম হলে বলে দেয়। জিনিশ টা শুনতে কি ভালো লাগবে?"
-"যার যা ইচ্ছা বলুক। আমি কারো ধার ধারি না। তুমি শরমির পাশে কেন দাঁড়িয়ে থাকবা? আমার পাশে কেন দাঁড়িয়ে থাকবা না? কেন কেন কেন?"
ঐতিহ্যর এ কথায় ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলো নিহাল। বিছানায় ঐতিহ্যর পাশে বসে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। পুরো মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে বললো,
-"কাল থেকে তোমার পাশে না একদম তোমার কোলের মধ্যে গিয়ে বসে থাকবো। যার যা ইচ্ছা বলুক। কারো কথার ধার ধারি নাকি আমি!"
অপরদিকে ঐতিহ্য নিহালের বুকে কিল ঘুষি দিতে দিতে বলতে লাগলো,
-"কাল যদি দেখেছি তোমাকে শরমির আশেপাশে, একদম তখন তখনি রুম থেকে বেড়িয়ে আসবো আমি। কোনো এক্সাম টেক্সাম মানবো না! তোমার ভার্সিটির যাওয়ার চৌদ্দ গুষ্টি একদম উদ্ধার করে ছাড়বো... বলে দিলাম।"
ঠিক তখনি দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। তাদের ফ্লাটে সচরাচর কেউ আসে না। ঢাকার মাঝে তেমন আত্মিয়স্বজন নেই বললেই চলে। তাই হঠাৎ এই ভর দুপুরে কলিংবেলের আউয়াজ শুনে দুজনেরই কপাল কুঁচকে গেল। নিজেরা একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে দুজনেই পা বাড়ালো দরজার দিকে।

-"তুমি?"
-"কেন? আসতে পারি না বোনের বাসায়?"
-"পারবে না কেন! এসো।"
দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো ঐতিহ্য। এই ভর দুপুরে মাহসানকে দেখে তার বিস্ময় যেনো কাটছেই না। লাস্ট এসেছিল মাহসান তাদের কাছে তনয়ের ব্যাপারে কথা বলতে, নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল তনয়কে। তাও সেই দুইমাস আগের কথা। কিন্তু হঠাৎ আবার আজ এল যে? নিশ্চয় সেদিনের মত আবার কোনো দাবিদাওয়া নিয়েই এসেছে...
সোফায় আরাম করে বসলো মাহসান। তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"কেমন আছিস তোরা?"
-"ভালো।"
-"লাঞ্চ করে ফেলেছিস নাকি?"
ঐতিহ্যর কিছু বলবার আগেই নিহাল বলে উঠলো,
-"না.. এখনো করি নি। আসুন একসাথেই লাঞ্চ টা সেরে ফেলি।"
-"চলো... আসলে আমি কিছু কথা বলতে এসেছিলাম তোমাদের। খেতে খেতে না হয় কথাগুলো বলবো।"

(চলবে)

সম্পর্কের টান
 পর্ব-৪০

অর্থি চুপচাপ বসে রয়েছে নিজের ঘরে। বেলা অনেক হয়ে এসেছে। তবুও ঘর ছেড়ে বেরুতে একদম ইচ্ছে করছে না। এদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধার্তও। সেই যে সকালে তৌহিদ জোর করে অর্ধেক পরোটা খাইয়ে দিয়ে গেছে.... অবশ্য দুপুরের খাবারের জন্য এখনো কেউ ডাকতেও আসে নি। ডাকতে এলে না হয় খেতে যাওয়া যায়। কিন্তু সত্যি বলতে এখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কাওকে ফেস করতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বারবার ভাবাচ্ছে। দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ করে রায়ান তার ঘরে ঢুকে যাবার পর তার এবং রায়ানের মাঝে কিছু কথা কাটাকাটি হয়। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো এর মাঝেই মুহিবের কোথায় থেকে যেন উদয় ঘটে। সে রায়ানের গালে কষে থাপ্পড় লাগানোর পর রায়ানকে টেনে এ ঘর ছেড়ে বের করে নিয়ে যায়। তারপরের কোনো ঘটনা আর জানা নেই অর্থির। কি হলো না হলো জানার ইচ্ছেও নেই তার.. যা হবার হবে! তবে একদিক দিয়ে তার ভালোই হয়েছে। যেহেতু রায়ানের বড় ভাই ব্যাপার টা জানতে পেরেছে, সেহেতু সে তার ভাইয়ের নোংরামির বিরুদ্ধে কোনো স্ট্যান্ড অবশ্যই নেবে। তবে এখানে একটা কিন্তু রয়েছে। তার এবং রায়ানের কথোপকথনের কতোটুকু শুনেছে মুহিব ভাই? পুরোটুকো কি শুনেছে? পুরোটুকু বলতে ফটোশপের ব্যাপার টা কি শুনেছে? নাকি শোনেনি? যদি না শুনে থাকে তাহলে বড্ড বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে অর্থি সামনে। আর যদি শুনে থাকে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ!! আচ্ছা.. যদি ফটোশপের ব্যাপার টা মুহিব ভাই না শুনে থাকে তাহলে কি সেও ওই মিথ্যে ছবিকে বিশ্বাস করে বসবে? তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে? তৌহিদ কেও কি সেভাবেই সব বলে দেবে? আর তৌহিদ নিজেও কি বিশ্বাস করবে সেসব কথা? ভাবতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল অর্থির। খানিকক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজে বসে রইলো সে। কি হবে আজ তার সঙ্গে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল তার বুক চিরে।

-"ভাবি আছেন?"
মুহিবের ডাকে ঝটপট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অর্থি। পরণের কামিজ ঠিকঠাক করে বললো,
-"জ্বি.. আসুন ভেতরে।"
দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো মুহিব। তার পেছনে পেছনে রায়ানও। রায়ানকে মুহিবের সাথে নিজের ঘরে ঢুকতে দেখেই অর্থির বুকের মাঝের কাঁপন আবারো শুরু হয়ে গেল।
মুহিব অর্থির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রায়ানকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
-"দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা করতে বলেছি কর।"
মুহিবের এ কথা শোনার সাথেসাথেই হাটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়লো রায়ান। তার দুইহাতে জড়িয়ে ধরলো অর্থির দু পা। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
-"আমি ভুল করেছি। শুধু ভুল না অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে আমাকে মাফ করে দাও। আমি জানি আমার কর্মের কোনো মাফ হয় না। তারপরও যদি মাফ করা যায় করে দিও।"
মুহিব রায়ানের মাথায় আঘাত করে ধমকের সুরে বললো,
-"পরের টুকু কে বলবে? আমি বলবো? বল হারামজাদা।"
ভায়ের কথায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে একরাশ অস্বস্থি নিয়ে বললো,
-"আজ থেকে তুমি আমার মা। নিজের মা কে যে চোখে দেখি আজ থেকে তোমাকেও সেই চোখেই দেখবো....."
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল অর্থি। কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি সে এমন একটা কান্ড ঘটাবে মুহিব! পা ধরে মাফ চাওয়ানো পর্যন্ত তাও মানা যায়,, কিন্তু এখন রায়ান যা বললো সেটা কি ঠিক শুনছে সে?
-"আমি আর কখনওই এমন কোনো কাজ করবো না যাতে কোনো মেয়ের সম্মানহানি হয়। প্লিজ, মাফ করে দাও আমায়।"
-"হু... এবার উঠে দাঁড়া। আর তোর ফোন বের কর।"
মুহিবের কথা শোনামাত্রই অর্থির পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রায়ান। আসামী বেসে তাকালো অর্থির দিকে। ভাইয়ের চোখের অগোচরে হালকা ঠোঁট নাড়িয়ে অনুনয় করলো মাফ করে দেবার।
-"কি রে! ফোন বের করতে বললাম না?"
মুহিবের ধমকে তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে ফোন বের করলো রায়ান। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে ধরে বললো,
-"নাও।"
মুহিব ফোন টা নিয়ে অর্থির হাতে দিয়ে বললো,
-"ডিলিট করে দাও পিকচার গুলো।"
অর্থি স্বাভাবিক ভাবেই ফোন হাতে নিয়ে বললো,
-"শুধু ফোনেই তো আর রাখে নি। ফোন থেকে না হয় এখন ডিলিট করলাম... বাদবাকি গুলো?"
-"বাদবাকি গুলোও আমি ডিলিট করাবো। এই পিকচার এবং রায়ানকে নিয়ে তোমার আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। এর গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। বিশ্বাস রাখতে পারো আমার উপর।"
খানিকক্ষণ চুপচাপ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর অর্থি ধীর গলায় বললো,
-"ছবিগুলো সত্যি ছিল না, মুহিব ভাই।"
-"জানি আমি.... সবই শুনেছি।"
আর কথা না বাড়িয়ে রায়ানের ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে ছবিগুলো খুঁজতে লাগলো অর্থি। মিশন ৪ নামের একটি ফোল্ডারে পেয়েও গেল ছবিগুলো। এটা আবার কেমন নাম? মিশন ৪? থাক.. ফোল্ডারের নাম যা ইচ্ছা হোক! তা দিয়ে তার কোনো কাজ নেই। ছবিগুলো অল সিলেক্ট করে ডিলিট করে ফোন মুহিবের হাতে ফিরিয়ে দিল অর্থি।
মুহিব ফোন রায়ানের হাতে দিয়ে বললো,
-"কাল ভোরে আমরা রাজশাহী চলে যাচ্ছি.... ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেল। আর আপাতত এ বাড়িতে থাকতে এই বিষয় নিয়ে আমি তোর সাথে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। বাড়িতে গিয়ে তোর এইসব মিশন নিয়ে কথা হবে। তুই কি এমন মিশন করছিস তা আমারো জানা দরকার... এখন যা আমার চোখের সামনে থেকে।"
মুহিবের কথামত রায়ান ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মুহিব তার উদ্দেশ্যে বললো,
-"ওয়েট... অর্থি তোর কি হয়?"
মেঝের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় রায়ান জবাব দিল,
-"মা।"
রায়ান ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই মুহিব বললো,
-"আমি সত্যিই জানতাম না রায়ান কেন হঠাৎ আমার সাথে এখানে আসতে চাচ্ছিল! তবে আজ ক্লিয়ার হলো। যাকগে সেসব কথা... আমি খুবই লজ্জিত। আমার জন্য, রায়ানের জন্য তোমাকে যে এত বড় একটা ঝামেলায় পড়তে হবে এটা জানলে কখনওই আমি আসতাম না এখানে।"
অর্থি কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
-"তবে হ্যাঁ,, এখন তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো। তোমার আর তৌহিদের মাঝে কোনোধরনের প্রব্লেম ক্রিয়েট আমি রায়ানকে নিয়ে হতে দেবো না। আর না রায়ানকে অন্যায় কিছু করতে দেব।"
মুহিবের কথায় কৃতজ্ঞতা বসত হালকা হাসলো অর্থি। অপরদিকে অর্থির মুখে হাসি দেখে মুহিবের মাথার উপরে জমে থাকা বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হলো। সে নিজেও এক গাল হেসে বললো,
-"তোমাকে তুমি করে বলায় আবার রাগ করছো না তো?"
-"আরে না... ঠিক আছে। সমস্যা নেই।"
-"ধন্যবাদ, ভাবি। আর একটা কথা বলতাম,, কথা না অবশ্য উপদেশ দিতাম একটা এস এ ব্রাদার অর ওয়েল উইশার। তুমি তৌহিদ কে রায়ানের কথা টা জানিয়ে দাও।"
-"জানাবো। তবে আপনাদের ফ্রেন্ডশিপ...."
অর্থিকে থামিয়ে মুহিব ম্লান হেসে বললো,
-"আপাতত নিজেদের কথা ভাবো। তোমাদের দুজনের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ।"

মাহসানের মুখ থেকে সব শুনে ঐতিহ্য বললো,
-"তো এখন তুমি কি করতে চাইছো? ভাবির সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চাইছো? ভাবিকে ফিরিয়ে আনতে চাইছো?"
মাহসান ছোট্ট একটি নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
-"জানি না আমি..."
-"তো এখন তুমি যেতে পারো। যেদিন জানতে পারবে তুমি কি করতে চাইছো সেদিন না হয় আবার এসো।"
ঐতিহ্যর মুখ থেকে এমন কথা শুনে মাহসান খাওয়া বন্ধ করে বললো,
-"আই নিড সাম কেয়ার, মেন্টালি সাপোর্ট... ঐতিহ্য।"
-"সরি.. তবে তুমি ভুল যায়গায় এসে পড়েছো। না তুমি আমার কাছে তোমার দুঃখের গান শুনিয়ে কোনো কেয়ার পাবে,, না মেন্টালি সাপোর্ট। লোকজনদের বিলিয়ে বিলিয়ে বেড়াবার মত সহানুভূতি আমার কাছে নেই। মাফ করো।"
-"এভাবে কথা বলছিস কেনো! তোর বিপদে আমি তোর পাশে দাঁড়াই নি? তোকে সাপোর্ট দেই নি?"
-"দাঁড়াবে না কেন! দাঁড়িয়েছো। তাই বলে এখন আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সেগুলো আবার ব্যাক করতে হবে নাকি! তেমন কোনো চুক্তি করেই তুমি কি আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিলে?"
-"আমি কোনো কাজ প্রতিদানের আশায় করি না। এটা খুব ভালো করেই জানিস তুই।"
-"এতো বড় বড় কথা বলো না তো। এসব কথা জাস্ট তোমার মুখে মানায় না। খেতে এসেছো... খেয়ে বিদায় হও।"
মাহসান উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে। এতগুলো কথা নিজের ছোট বোনের মুখ থেকে শোনার পর আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না তার। কি মনে করে সে এসেছিল এখানে? বোনের কাছ থেকে দুটি শান্তনার বাণী শুনতে। ভেবেছিল আগে যাই হোক না কেন, আজ ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে, ভেঙে না পড়তে বলবে, মেন্টালি সাপোর্ট দেবে। অথচ.....!!! শাস্তির শুরু টা কি তার এখান থেকেই??

-"যাচ্ছি আমি।"
ঐতিহ্য খাবার প্লেট থেকে চোখ উঠিয়ে মাহসানের দিকে দিয়ে বললো,
-"যাও যাও। এতসব কিছু হবার পরও যে তুমি তোমার প্রিয়তমার কাছে কক্সবাজারে না গিয়ে এখানে এসছো... এতে ফুল্লি শকড আমি!! সত্যি করে বলো তো কি কারণ এর? নিশ্চয় প্লেনের টিকেট পাও নি... না?"
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো ঐতিহ্য। মাহসান কিছুক্ষণ বোনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর একসময় বেড়িয়ে এল ঐতিহ্যর ফ্লাট ছেড়ে।

-"এটা কি ঠিক হলো, ঐতি? উনি তোমার কাছে এসেছিল কিছু এক্সপেকটেশন নিয়ে। তুমি তাকে সাপোর্ট নাই বা দিলে ভালোভাবে অন্তত কথা বলতে পারতে।"
নিহালের কথায় ভ্রু কুঁচকে ঐতিহ্য বললো,
-"এক্সপেকটেশন কাকে বলে এটা জানে নাকি সে! একটা মেয়ে ঠিক কতোটা এক্সপেকটেশন নিয়ে স্বামীর বাড়িতে আসে.. আর স্বামী কি করলো! তার সব এক্সপেকটেশনকে কেটে টুকরোটুকরো করে ভাসিয়ে দিল। আর আজ তার এক্সপেকটেশনের কথা ভাববো আমি!! কেন ভাববো? তার অতৈ বেবি আজ তার সাথে চিট করেছে বলে সে এখানে এসেছে। তৃষ্ণা, তনয়ের সাথে অন্যায় করেছে সে আজ তার মনে হচ্ছে এগুলো! আগে কেনো মনে হয় নি তার?"
-"পয়েন্ট।"
-"ওর শাস্তি কেবল তো শুরু। এমন আরো অনেক কিছুই দেখতে হবে, অনেক ভাবেই ভেঙে পড়বে ও। আর তখনও কাউকে পাশে পাবে না। তাই ভালো হয় এখন থেকেই যদি নিজেকে একা সামলাতে শেখে। তবে বোন হিসেবে একটা চাওয়াই আমার। শাস্তির মেয়াদ টা যেনো খুব বেশি দীর্ঘ না হয়। মুখের উপর চটাং চটাং কথা বললেও দিনশেষে সেগুলো আমাকে ভাবায়। বোন তো.... মাঝেমাঝে খারাপ লাগে। আজ যদি বাবা মা বেঁচে থাকতো.....!"
কথাগুলো শেষ না করতেই চোখের কোণা বেয়ে বেড়িয়ে পড়লো এক ফোটা জল। তবে তেমন একটা পাত্তা দিল না ঐতিহ্য তার আবেগকে। তাড়াহুড়ো করে চোখ টা মুছে হাসি মুখে বললো,
-"আমদের মাঝে কি নিয়ে যেন ঝগড়া চলছিল? অহ... হ্যাঁ,, শরমি। আমি মেয়েটাকে দেখেছি তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে। বেহায়া মেয়ে একটা। অন্যের হাজবেন্ডের দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে কি মজা পায় ও? আর তুমিও দেখি ভার্সিটি তে যাবার আগে হিরো সেজে যাও.. কেন রে? এত কেন শখ তোমার? সব মেয়ে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকুক এটাই চাও তুমি... না? কাল থেকে তোমার হিরো সেজে যাওয়া বের করবো। এখন থেকে হিরো আলম সেজে ভার্সিটি তে যাবে তুমি। বুঝেছো? হিরো আলম..."
বলেই আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো ঐতিহ্য। নিহাল কিছুক্ষণ সময় নিল হিরো আলম কথা টা বুঝতে এবং শেষে নিজেও যোগ দিল ঐতিহ্যর সাথে এক হাসির খেলায়...

   (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ