সম্পর্কের টান
পর্ব-৬৭+৬৮
সপ্তাখানিকের বেশি হলো নিখোঁজ মাহসান। কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে! আদৌ বেঁচে আছে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ জাগে তৃষ্ণার মনে। সারাটা সময় যায় মনে কু ডাকতে ডাকতে। এসব মৃত্যুর চিন্তা মাথায় না আনতে চাইলেও মাহসানের তাকে বলা শেষ কথা তাকে ভাবতে বাধ্য করে। মাহসান নেই, তার জন্য উলোটপালোট কিছু করে ফেলেছে.. ভাবতেই বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠে তৃষ্ণার। চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয় বুকে, খুব বেশিই খালিখালি লাগে বুকটা। তবুও মনকে নানান জিনিস বলে কয়ে বুঝ দেয়ার উপরেই আছে তৃষ্ণা। মাহসানের যা ইচ্ছা হোক.. তাতে তার কি? মাহসানের কোনো মূল্য তো তার জীবনে নেই। আর না কোনো সম্পর্ক আছে তার মাহসানের সাথে। তাহলে কেনো ভাবে সে মাহসানের কথা? আর ভাববে না সে মাহসানের কথা। গোল্লায় যাক মাহসান... তবে পরমূহুর্তেই আবারো মন টা কেঁদে উঠে মাহসানের জন্য। আসলেই কি কোনো সম্পর্ক নেই তার আর মাহসানের মাঝে? মাহসানের সাথে দুই দিন পর তার ডিভোর্স হয়ে গেলে মাহসান আর তার স্বামী হিসেবে গণ্য না হলেও তার বাচ্চার বাবা হিসেবে তো আজীবনই মাহসানের নামই থাকবে। কিন্তু এই মাহসানই তো তার বাচ্চার জন্ম নিয়ে যা নয় তাই শুনিয়েছিল। আর এখনও যে মাহসান আফসানা নামের মেয়েটার সাথে নেই তার কি গ্যারান্টি? হ্যাঁ,, মাহসানের মত ছেলে শুধুশুধুই তৃষ্ণার মত একজন সাধারণ মেয়েকে না পেয়ে এত বড় একটা কদম উঠাবে কেন! মাহসান নিশ্চিত এখন আফসানা নামের মেয়েটার সাথে অপবিত্র, নোংরা এক খেলায় মেতে আছে। আর সে কিনা এই মাহসানকেই নিয়ে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছে! এতটা বোকা কেন সে? এতটা বেহায়া কেন তার এই মন? বারবার কষ্ট, অবহেলা, অপমান করার পরও কেন সে তাকে নিয়েই ভাবে!
তৌহিদের ডাক শুনে রান্না ফেলে তাড়াহুড়ো করে ঘরে এল অর্থি। বললো,
-"কি হলো? কিছু লাগবে?"
-"না.. তোমার ফোন।"
অর্থি বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-"কে? আপু?"
-"না.. বললো, তোমার বাবার বন্ধু।"
তৌহিদের কথায় ভ্রু কুঁচকে ফোন কানে নিতেই ওপাশের ব্যক্তির গলার স্বর শুনে হাসি ফুটলো অর্থির চোখেমুখে।
-"কালাম চাচ্চু?"
মহসিন চৌধুরীর খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু আবুল কালাম আজাদ, পেশায় একজন উকিল। মহসিন চৌধুরীর সবধরনের আইনি কাজের দেখাশুনা তিনিই করতেন। ফোনের অপর পাশ থেকে অর্থির গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি বললেন,
-"হ্যাঁ। কেমন আছিস?"
-"আমি তো ভালই। তুমি কেমন আছো?"
-"বয়স তো অনেকই হলো! কেমন আর থাকি বল!"
-"বয়স হলে ভালো থাকা যায় না বুঝি?"
অর্থির কথায় সামান্য হেসে কালাম সাহেব বললেন,
-"তা আর যায়! আচ্ছা শোন.. কাল তোরা সকাল সকাল ঐতিহ্যর বাড়িতে চলে আয়।"
কালাম সাহেবের কথা শুনেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলে অর্থি বললো,
-"কেনো?"
-"তোদের প্রোপার্টি তোর বাবার নাম থেকে কাল তোদের ভাই বোন সবার নামে ট্রান্সফার করা হবে। মহসিন যেহেতু মারা যাবার আগে কোনো উইল করে রেখে যায় নি.. তাই ভাগটা ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ীই হবে।"
হঠাৎ সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা শুনে অবাক হয়ে অর্থি বললো,
-"কিন্তু হঠাৎ এসব কেনো! যেটা যেভাবে আছে থাক। ভাইয়া ভাইয়ার মত সব চালাক। আর এতে আমাদের দুই বোনের কোনো সমস্যাই নেই।"
-"তোর ভাইয়ের কথামতোই কাজ টা হচ্ছে, অর্থি। সবকাজ মোটামুটি শেষ। সামান্য কিছু বাকি আছে.. যা তোদের ছাড়া হবে না। কাল তাহলে ঠিক সময় মত চলে আসিস.. কেমন?"
অর্থির বিস্ময় কোনোভাবেই কাটছে না। ভাইয়া বলেছে এসব করতে? কিন্তু ভাইয়া কেনো বলবে? আর সবচেয়ে বড় কথা,, ভাইয়ার তো কয়দিন যাবৎ কোনো খোঁজখবরই পাওয়াই যাচ্ছে না! খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকার পর এসব মাথায় আসতেই অর্থি ফোনের ওপাশে কালাম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
-"কিন্তু ভাইয়া কোথায়?"
-"কাল আয়.. তারপর সব খুলে বলছি। স্মার্ট কার্ড সহ বাদবাকি ডকুমেন্টস যা লাগবে আমি এই নাম্বারে টেক্সট করে দিচ্ছি। অহ হ্যাঁ.. মাহসানের বউ কেউ সাথে নিয়ে আসবি। মাহসান ওর বউএর যে নাম্বার দিয়েছিল সেটা তে অনেকবার কল করলাম। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে।"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থি বললো,
-"আচ্ছা।"
তৌহিদের কথামত পরদিন সকাল সকাল অর্থি এবং তৃষ্ণা বেড়িয়ে পড়লো ঢাকার উদ্দেশ্যে। সম্পত্তি নিয়ে সামান্যতমও আগ্রহ নেই তৃষ্ণার। সে যাচ্ছে মাহসানের আশায়। মাহসানকে কিছু কড়া কথা না শোনালে কোনোভাবেই শান্তি পাবে না সে। আফসানার সাথে থাকবি.. থাক! কিন্তু এভাবে ফোন বন্ধ করে, আজেবাজে কথা শুনিয়ে উধাও হয়ে যাবার কি দরকার ছিল?
অর্থির ১৮ বছর পূর্ণ না হবার কারণে তৌহিদকে মোক্তারনামা করে অর্থির নামে মোট সম্পত্তির ২৫% এবং ঐতিহ্যর নামে ২৫% রেজিস্ট্রি করে দেয়া হলো। অপরদিকে বাদবাকি ৫০% সম্পত্তির মালিক হিসেবে মাহসান তার স্ত্রী তৃষ্ণার নামে ২৫% এবং বাকি ৭৫% তৃষ্ণাকে মোক্তারনামা করে তনয়ের নামে উইল করে রেখেছিল। সেই কাগজগুলোও অর্থিদের হাতে হস্তান্তর করে কালাম সাহেব বললেন,
-"আমার কাছে মাহসান এসেছিল ৫ দিন আগে। তো তখন আমাকে সব খুলে বলার পর এই কয়দিন যাবৎ আমি কাগজ গুলো ঠিকঠাক করলাম। তারপর তোমাদের খবর দিলাম। তাই আপাতত ও কোথায় আছে সেটা আমার জানা নেই।"
পাশ থেকে নিহাল বললো,
-"তাহলে ভাবি আর তনয়ের নামে যে উইল করে দিয়েছে... সেটার সাইন কখন দিল মাহাসান ভাই? আপনার মতে উনার সাথে ৫ দিন যাবৎ আপনার কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই।"
নিহালের কথায় কালাম সাহেব কিছুটা নড়েচড়ে বসে বললেন,
-"আমার সাথে যে দেখা হয় নি এটা সত্য। আমি কাল যখন দুপুরে খেতে বাসায় এসেছিলাম.. তখনই আমার চেম্বারে এসে ও সব কাগজপত্রে সাইন করে গেছে.. তবে আমাকে কল করেছিল ওইসময় টায় মাহসান। আমি অপেক্ষাও করতে বলেছিলাম। কিন্তু ওর তাড়া ছিল।"
ভারী গলায় অর্থি বললো,
-"কিন্তু ভাইয়া কোথায়? আর এসবই বা কেনো করলো?"
-"বলতে পারছি না.. মা।"
-"চাচ্চু,, প্লিজ। ভাইয়া কোথায় সেটা অন্তত বলুন।"
-"আমার সাথে মাহসানের শেষ কথা হয়েছিল কাল দুপুরে। রাতে তোর সাথে কথা বলবার পর আমি ওকে কল করেছিলাম। কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিল। অবশ্য ওর নাম্বারটা এই কয়েকদিনও বন্ধ ছিল। ও নিজেই ফোন অন করে আমাকে কল দিত। আমি আসলে.. তোদের মাঝে যে এত বড় এক সমস্যা হয়েছে জানতাম না। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছিলাম.. কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে। মাহসানকে নিজের সব সম্পত্তি ওর বউ আর বাচ্চার নামে করতে দেখে আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তবে ওর উত্তর ছিল, 'সমস্যা কি চাচা! বউ বাচ্চা সবই তো আমার!' উত্তর শুনে খুশি হয়েছিলাম, সত্যি বলতে সন্দেহটা কেটেও গিয়েছিল। কিন্তু ও যে..."
কালাম সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই অর্থি কান্নামাখা গলায় বলতে লাগলো,
-"আপু, আমি তোকে বারবার বলেছিলাম! ভাইয়া যা শাস্তি পাচ্ছে সেটা কম না। তুই ভাইয়ার সাথে কথা বল, ভাইয়াকে মেন্টালি সাপোর্ট দে, ভাইয়ার সাথে রুড বিহাব করিস না। আমার হাত পা বাঁধা ছিল.. কিন্তু তোর তো ছিল না। ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক রাখলে তৌহিদ আমার সাথে সম্পর্ক রাখতো না। কিন্তু তোর সাথে তো নিহাল ভাই তেমন করতো না!"
ঐতিহ্য ছলছলে চোখে অর্থির দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আমি তো পরবর্তীতে ভাইয়ার কাছে এ নিয়ে ক্ষমা চেয়েছি। আর তুই কাঁদছিস কেনো শুধুশুধু? কিছুই হয় নি ভাইয়ার। আর ভাইয়া অনেক স্ট্রং পারসোনালিটির একজন মানুষ। ভাইয়া এমন তেমন কিছু করবে না।"
দুই বোনের কথোপকথনের কিছুই কানে গেল না তৃষ্ণার। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে আশেপাশের কিছুই চোখে বা কানে যাচ্ছে না তার। মাহসানের করা কার্যক্রমে পুরো বিচলিত হয়ে পড়েছে সে....
(চলবে)
#সম্পর্কের_টান
#পর্ব-৬৮
পুরোঘর জুড়ে বিরাজ করছে গভীর নিস্তব্ধতা। মাঝেমাঝে কাগজ উলটানোর কাচরমরচ শব্দ আসছে ড্রইংরুমে বসে থাকা সদস্যদের কানে। সকলের দৃষ্টি কাগজ উলটেপালটে দেখা তৌহিদের দিকে। একদৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে তৌহিদের দিকে। অপেক্ষা করছে তৌহিদের মুখ থেকে কিছু শোনার। তৌহিদও হয়তো ব্যাপার বুঝতে পারলো। তাই বেশি একটা সময় নিল না। হাতে থাকা দলিলপত্রাদি টেবিলের উপরে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-"হুম... সব ঠিকঠাকই আছে।"
তৌহিদের কথা শুনে পাশে বসা লিয়াকত সরকার চিন্তিত গলায় বললেন,
-"কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? এত বিষয়াশয়.. এত সম্পত্তি কিভাবে এত সহজে তৃষ্ণা আর তনয়ের নামে করে দিল মাহসান?"
তৌহিদ নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে মাহসানের করা কাজে। কোনোভাবেই কোনোদিক দিয়ে হিসেব মেলাতে পারছে না সে। হাজার ভেবেও এর কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত মাহসান নিয়েছে শুধু সে অনুতপ্ত এটাই প্রমাণ করার জন্য?
-"তৌহিদ তুই ভালো করে দেখ। নকল দলিল টলিল দিয়ে তৃষ্ণা কে মানানোর চেষ্টা করছে না তো?"
তৌহিদা বেগমের কথায় তৌহিদ জবাব দিল,
-"না.. মা।"
তৌহিদা বেগম টেবিলের উপর থেকে কাগজগুলো হাতে নিয়ে একের পর এক পাতা উলটাতে উলটাতে বললো,
-"এসব নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার কি আছে? দিয়েছে.. দিয়েছেই। ও আমার মেয়ের সাথে যা করেছে তার প্রতিদান দিতে হবে না? আর আমার কি মনে হচ্ছে.. শোন! এসব ওর নাটক। এসব লিখে দিয়ে ও নিজেকে মহৎ প্রমাণ করতে চাচ্ছে। ভাবছে সম্পত্তি দেখে আমরা গলে গিয়ে মেয়েকে ওর কাছে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু ওই হারামজাদা এটা ভুলে গেছে আমরা ভাত খাই, ছাই না।"
এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবার কথাই খুব মন দিয়ে শ্রবণ করছিল অর্থি। তবে এপর্যায়ে শাশুড়ির কথাগুলো ঠিক গিয়ে বিধলো বুকের মাঝটায়। একেতো ভাইয়ের কোনো খোঁজখবর নেই, সেটা নিয়ে বলতে গেলে চিন্তায় চিন্তায় পাগল হতে বসেছে। তার উপর ভাইয়ের বিরুদ্ধে শাশুড়ির মুখ থেকে এমন কথা শুনে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না অর্থি। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সে বললো,
-"হ্যাঁ,, নাটকই তো। সবটাই নাটক। সারাজীবন আমার বাপ কষ্ট করে আমাদের জন্য এসব রেখে গেছে মানুষদের বিলাই বিলাই বেড়ানোর জন্য। পাশের ফ্লাট থেকে কেউ লবণ বা মরিচ ধার হিসেবে চাইতে আসলেও তো আপনার বের হয় না। সেখানে আমার ভাই এত্ত সব সম্পত্তি বিলাই বিলাই নাটক করতেছে... নিজের সম্পত্তি এভাবে অন্যের নামে করে দেয়া খুব সহজ ব্যাপার আপনাদের কাছে.. না? সম্পত্তির মানে বোঝেন আপনারা?"
হতভম্ব হয়ে অর্থির কথা শুনতে লাগলো তৌহিদা বেগম। অর্থি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে প্রায় একবছর হলোই। কিন্তু এর মাঝে কখনোই তার উপর দিয়ে কোনো কথা বলে নি অর্থি। সে নিজে হাজার বকলেও চুপচাপ শুনেছে.. কিন্তু এসবের জন্য অর্থি তার সাথে কখনো উচু গলায় কথা বলে নি। হ্যাঁ.. তার করা ব্যবহার নিয়ে অর্থি আর তৌহিদের মাঝে ঝগড়া হতো। নিজের ঘরে বসেই চুপচাপ শুনতো সে। কিন্তু কখনোই ছেলে আর ছেলের বউ এর মাঝে গিয়ে এ নিয়ে নাক গলাতে যেত না। সে শাশুড়ি হিসেবে শাষন করেছে,, অর্থি স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে সে নিয়ে অভিযোগ করছে। সে নিজেও করেছে.. তৌহিদের দাদী বেঁচে থাকতে সারাদিন তাকে এক আঙুলের উপর তুলে নাচিয়েছে, এটা কর সেটা কর বলে হুকুম দিতে দিতে একদম চোখের পানি নাকের পানি এক করে ছেড়েছে। তবুও তো সে মুখ ফুটে শাশুড়িকে কিছু বলে নি। রাতে তৌহিদের বাবা ফেরার পর দিনের সব অভিযোগ তাকে একেএকে শুনিয়েছে। এতে নিজের ভেতরই একটা শান্তি এসেছে.. যা নতুন উদ্যমে পরবর্তী দিন শুরু করতে তাকে অদ্ভুত এক অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে...
ড্রইংরুমে বসা কারো মুখ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে অর্থি আবারো বলতে শুরু করলো,
-"আর কতভাবে ভাইয়ার প্রমাণ করতে হবে, যে সে অনুতপ্ত? নিজের সব কিছুই তো সে হারিয়েছে। মাথা গোজার, তিনবেলা খাবার মত যা ছিল.. তাও তো এখন লিখে দিল। তবুও আপনাদের কাছে মনে হচ্ছেই, ভাইয়া নাটক করছে, মহৎ হবার চেষ্টা করছে! আর কি করতে হবে ভাইয়ার? আর কি করলে আপনারা মেনে নিবা ভাইয়া অনুতপ্ত? মরতে হবে? নিজের জান টাও দিয়ে দিতে হবে? আর তারপরই আপনারা সবাই মানবেন, সে অনুতপ্ত?"
অর্থির ছোড়া প্রশ্নে ঘরে উপস্থিত থাকা সকলের বুকচিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস.. সকলকে নিশ্চুপ দেখে অর্থি আবারো বলতে শুরু করলো,
-"আর মা, আপনি.. আপনি নিজে কখনো কোনো অন্যায় করেন নি? আপনার ছেলে কখনো কোনো অন্যায় করে নি? হোক সেটা ছোট! অন্যায় তো অন্যায়ই.. না? তো আপনাদের করা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত কি নিজের জীবন দিয়ে করতে হয়েছে? আচ্ছা.. আপাতত সব বাদ দিলাম। এখন বলুন, আপনার ছেলে তৌহিদ যদি কখনো এমন কোনো অন্যায় করে বসতো, তখন আপনি মা হিসেবে কি করতেন? মারতেন, বকতেন, বাড়ি থেকে বের করে দিতেন.. তারপর? কিছুদিন যাবার পর আপনার নিজেরই কষ্ট হতো.. হাজার হলেও আপনি মা তো! তারপর কি ফিরিয়ে আনতেন না আপনার ছেলেকে? আনতেন.. প্লাস আপনার ছেলে যেন ওসব কাজ থেকে বিরত থাকে এর জন্য বুঝাতেন, গাইড করতেন, সাপোর্ট দিতেন। বলুন.. করতেন না? নাকি আমার ভাইয়ের মতই হারামজাদা নাটক করছে, মরলে ভালো হয়, জীবনেও সুখী থাকতে পারবে না.. এসব বলে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেন, উঠতে বসতে তার মৃত্যু কামনা করতেন?"
এবারো সকলেই নিরব.. লম্বা কিছু দম ফেলে অর্থি তৌহিদা বেগমের উদ্দেশ্যে আবারো ভারী গলায় বলতে লাগলো,
-"আপনি কেনো ভাইয়াকে নিজের ছেলে ভাবতে পারছেন না? কেন নিজের ছেলে ভেবে তাকে শাষন না করে তার মৃত্যু কামনা করছেন? অন্যায় করেছে,, শাস্তিও পেয়েছে। বাবামা, দুই বোন, পরিবার সব হারিয়েছে। নিজের ছেলেকেউ একটাবার চোখের দেখা দেখতে পায় নি, তাকে বুকে নিয়ে আদর করতে পারে নি। এসব কি খুবই কম? এখন যখন সে অনুতপ্ত, বারবার ক্ষমা চাচ্ছে তখন কি আপনি মা হিসেবে পারেন না ছেলের করা অন্যায় কে ক্ষমা করে তাকে সঠিক পথ দেখাতে? এই যে আমরা তিন ভাই বোন এতিম। মা নেই বাবা নেই... পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটাই আমাদের নেই। এসব ভেবে কি কখনোই খারাপ লাগে না আপনার? ভাইয়া যখন ভুল করেছিল আমি তার বিপক্ষে গিয়েছি, তাকে যা নয় তাই শুনিয়েছি... কিন্তু আপনি কি করলেন? হঠাৎ করে বদলে গেলেন। দজ্জাল শাশুড়ির ভূমিকায় নিজেকে বসালেন। ভাইয়ের করা ভুল নিয়ে আমাকে উঠতে বসতে কথা শোনালেন... এসব কি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির কাজ? আমি কি আপনার মেয়ের মত নই? আপনার মেয়েকে কখনো এভাবে কথা শুনাতে পারতেন? কখনোই না... আম্মা মারা যাবার পর আমি নিজেকে সান্তনা দিয়েছি.. এক মা গেলেও আমার আরেকটা মা তো আছে... যে আমাকে নিজের মায়ের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আমার এসব ভাবনা আপনি ভুল প্রমাণ করেছেন। আমাকে ভাবাতে বাধ্য করেছেন, শাশুড়ি কখনোই নিজের আপন মা হতে পারে না। শাশুড়ি শাশুড়িই থাকে।"
কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো অর্থি। আজ খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে তার। খুব করে মনে পড়ছে বাবা মায়ের কথা। আজ তারা বেঁচে থাকলে হয়তো জীবন অন্যরকম হতো...
লিয়াকত সরকার খানিকটা সময় কেটে যাবার পর উঠে পড়লো সোফা ছেড়ে। খানিকটা দুরে টুলে বসা অর্থির পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,
-"দেখি বৌমা,, কাঁদে না। উঠো.. ঘরে যাও। কিছুক্ষণ রেস্ট নাও।"
নড়লো না অর্থি। চুপচাপ বসে রইলো টুলের উপর। নিঃশব্দে তার চোখের কোণা বেয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা।
অর্থির পাশ থেকেই লিয়াকত সরকার ছেলের উদ্দেশ্যে বললো,
-"কিছু ভাবলি? কি করবি?"
-"তৃষ্ণার সাথে কথা বলে যা সিদ্ধান্ত নেবার নেব।"
-"তো ডাক তৃষ্ণাকে।"
-"আজ থাক। ওকে কিছুটা সময় দাও।"
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরেধীরে বেড়ে যাচ্ছে দিনের সংখ্যা। কিন্তু কোনো খোঁজ মিলছে না মাহসানের। চেনাজানা সবার সাথেই যোগাযোগ করা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খোঁজাখুঁজির উপরই আছে নিহাল। তবুও কোনোভাবেই কোনো খোঁজ মিলছে না তার। এদিকে হঠাৎ মাহসানের উধাও হওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ঐতিহ্য। কেনো যেন আবারো বাবার মৃত্যুর মতই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। ভাইয়ের কষ্টটা সে যদি বুঝতো, তাকে সান্তনা দিয়ে দুটো কথা শোনাতো, ভাবি কে হাবিজাবি বলে বুঝ না দিত... তাহলে হয়তো আজ তার ভাইয়ের জীবনের দৃশ্য অন্যরকম হতো!
-"কি করছো এভাবে একাএকা?"
নিহালের কথায় চিন্তার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এসে ঐতিহ্য বললো,
-"কিছু না... ভালো লাগছে না কিছু। নিহন কোথায়?"
-"খালার কাছে।"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ঐতিহ্য বললো,
-"ভাইয়ার কোনো খবর কি পাবো না আমরা?"
-"পাবো ইনশাআল্লাহ। থানায় কমপ্লেইন তো করেই রেখেছি। থানার অসি আমার এক ফ্রেন্ডের বড় ভাই। উনারা বিষয় টা খুব ভালোভাবেই দেখছেন।"
-"কচু দেখছেন! এসব পুলিশ টুলিশে কোনো বিশ্বাস নেই। এরা কিছুই উদ্ধার করতে পারবে না।"
ঐতিহ্যর কথায় ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে নিহাল বললো,
-"তাহলে তুমিই নেমে পড়!"
নিহালের কথায় ভ্রু কুঁচকে ঐতিহ্য বললো,
-"ফাজলামি করো না তো!"
নিহাল বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললো,
-"আচ্ছা করলাম না। যাইহোক শোনো, সিম ট্রেস করে লাস্ট লোকেশন জানা গেছে... গাজীপুর কালাম চাচার চেম্বারই তার লাস্ট লোকেশন। সেদিনের দুপুরের পর আর ফোন অন করে নি মাহসান ভাই। অন করামাত্রই তার লোকেশন আমরা পেয়ে যাব। কিন্তু কথা হলো, অন করবে কিনা! আর আমার যেটা সন্দেহ হচ্ছে.. মানে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া! এমন যদি কোথাও গিয়ে থাকে সেটাও জানা যাবে। যেহেতু মিসিং কমপ্লেইন দেয়া হয়েছে সেহেতু কোনো ক্লু তো অবশ্যই পাবো। ভেঙে না পড়ে আল্লাহ আল্লাহ করো।"
নিহালের কথায় তেমন একটা ভরসা পেল না ঐতিহ্য৷ তবুও ঠোঁটে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-"হু...."
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।