সম্পর্কের টান
পর্ব-৬৯+৭০ (শেষ)
তৃষ্ণার সঙ্গে মাহসানের ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলাটাই উত্তম। এতে তৃষ্ণার মনে কি চলছে না চলছে তা খুব ভালো করে জানা যাবে। বাদবাকি রইলো সম্পর্কের ব্যাপার! সেখানে অর্থি আজ তৌহিদের স্ত্রী নয়, মাহসানের বোন হয়েই কথা বলবে তার ভাবির সাথে। সেই ভাবি.. যার জন্য অন্যায় কে অন্যায় বলতে পিছপা হয়েছিল না সে..
-"আসবো ভাবি?"
পড়ন্ত এই বিকেলে তৃষ্ণা নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল। ভাবছিল মাহসানের কথা.. এভাবে পুরো সম্পত্তি তার আর তনয়ের নামে লিখে দিয়ে মাহসান কি প্রমাণ করতে চায়? নিজেকে খুব মহৎ প্রমাণ করতে চায়? আর তাকে এক লোভী মেয়ে হিসেবে দেখাতে চায় এই সমাজের সামনে? হ্যাঁ.. সেটাই চায় মাহসান! মাহসানের মত ছেলের মাথায় এসব দুষ্ট বুদ্ধি ছাড়া কোনো ভালো কিছু থাকতে পারে না... হঠাৎ অর্থির ডাক কানে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। অর্থি তাকে ভাবি বলে ডাকলো? নাকি সে ভুল শুনছে?
-"ঘুমিয়েছো নাকি?"
এপর্যায়ে শোয়া থেকে উঠে বসে তৃষ্ণা বললো,
-"না.. এসো।"
অর্থি ঘরের মাঝে ঢুকে বিছানার এক কোণায় বসতে বসতে বললো,
-"কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে?"
-"অবশ্যই.. "
-"ভাইয়ার যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায় বা ভাইয়া নিজেই যদি ফিরে আসে.. তাহলে তুমি কি ভাইয়ার কাছে ফিরে যাবে? নতুনভাবে সম্পর্ক টা শুরু করার আরেকটি বার সুযোগ দেবে?"
অর্থির প্রশ্ন শুনে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তৃষ্ণার। অর্থি মেয়েটা কত বোকা! ভাই যেভাবে যেটা করে বুঝ দেয়.. সেটাই মেনে নেয়! কিন্তু এটাই জানে না এসব তার ভাইয়ের নাটক! সে কোথাও হারিয়ে যায় নি। নিজের ইচ্ছেতেই নিজেকে আড়াল করে আফসানার সাথে নষ্টামি করে বেড়াচ্ছে হয়তো!
-"কি হলো ভাবি? জবাব দাও।"
এবারে লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে তৃষ্ণা বললো,
-"ফিরবো না..."
-"কারণ টা কি?"
-"অনেক কারণ আছে, অর্থি। শুধু একটা কারণ থাকলে অনায়াসে ফিরে যেতাম!"
তৃষ্ণার উত্তরটা সন্তুষ্ট করতে পারলো না অর্থিকে। সে তৃষ্ণার দিকে খানিকটা এগিয়ে বসে বললো,
-"যে কয়টায় কারণ থাকুক... তুমি আমাকে সব খুলে বলো।"
-"আমি ওসব নিয়ে আর কথা বলে নিজের কষ্ট টা বাড়াতে চাই না.. আমি এভাবেই ভালো আছি। আমাকে ভালো থাকতে দাও।"
-"এসব বললে চলবে না, ভাবি। তুমি এসব করে আমার ভাইকে শুধুশুধু কষ্ট দিচ্ছো, আবার নিজেও কষ্ট পাচ্ছো!"
তৃষ্ণা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
-"না তোমার ভাই কষ্ট পাচ্ছে আর না আমি। তোমার ভাই হয়তো এখন আফসানার সাথে রাসলিলা করে বেড়াচ্ছে।"
ভ্রু কুঁচকে অর্থি বললো,
-"মানে? আফসানা টা আবার কে? নাকি অতৈন্দ্রিলার কথা বলতে চাচ্ছো? কিন্তু অতৈন্দ্রিলার সাথে তো ভাইয়ার আর... "
অর্থির কথার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিল তৃষ্ণা। সেদিন অফিসের সামনে অতৈন্দ্রিলার সাথে দেখা হবার পর, তার বলা সব কথা খুলে বললো তৃষ্ণা অর্থিকে। সব শুনে অর্থি নিজের মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বললো,
-"হায় আল্লাহ! এর মাথায় একটু বুদ্ধি দান করো! এমন একজন মেয়ের কথা তুমি কিভাবে বিশ্বাস করো, ভাবি? যার নিজের কোনো ঘর সংসার নেই। যার কাজই অন্যের সংসার ভাঙা.. কারো সংসার জোড়া লাগুক, সেটা এই মেয়ে কখনোই চাবে না!"
-"ছবি গুলো? আমি নিজ চোখে ছবিগুলো দেখেছি।"
তৃষ্ণার পুরো ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে অতৈন্দ্রিলা। আর সেটা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারছে অর্থি.. ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সে বললো,
-"এটা ২০১৮ সাল, ভাবি। ডিজিটাল যুগ... এ যুগে এসব ফটোশপ করে একজনের বডির সাথে অন্যজনের ফেস লাগানো কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।"
বলেই থামলো অর্থি। রায়ান তার সাথে যে কাজ গুলো করেছিল, তাকে যেভাবে ব্লাকমেইল করেছিল.. সেটা ভাবলেই এখনো বুকটা কেঁপেকেঁপে উঠে। এই ফটোশপের চেয়ে জঘন্য কোনো কাজ পৃথিবীতে আর একটাও আছে বলে মনে হয় না! সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল অর্থি। সবটাই আজ তৃষ্ণা কে খুলে বলবে....
অপরদিকে অর্থির মুখ থেকে সবটা শুনে তৃষ্ণা হতভম্ব হয়ে গেল। রায়ান ছেলেটা কে দেখে একদম নিষ্পাপ বাচ্চাবাচ্চা লাগে। অথচ তার পেটে পেটে এত শয়তানী বুদ্ধি। এর কারণেই মানুষের বাইরেটা দেখে কখনোই কাওকে বিচার করা উচিৎ নয়।
-"তুমি এক কাজ করো। অতৈন্দ্রিলা কে কল করে দেখা করতে বলো। আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে! তবে ওর মুখ থেকে সত্যিটা শুনলে হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে।"
অর্থির কথা শুনে তৃষ্ণা বললো,
-"অতৈন্দ্রিলা যদি মিথ্যা বলেও থাকে.. তাহলে ও শুধুশুধুই বা আমার কাছে সত্যিটা স্বীকার করবে কেনো?"
-"স্বীকার কি আর শুধুশুধু করবে নাকি! করাতে হবে। এইসব মেয়ে টাকার পাগল। এরা নিজেদের সবার সামনে স্মার্ট, ক্লেভার হিসেবে প্রেজেন্ট করে। টাকা ঢালো, কৌশলে কথা বলো.. দেখবে এদের চেয়ে বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।"
-"কিন্তু আমি ওকে কিভাবে দেখা করতে বলবো? ওর ফোন নাম্বার তো আমি জানি না!"
অর্থি খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে বললো,
-"অতৈন্দ্রিলার ফেসবুক একাউন্ট তো আমরা চাইলেই বের করতে পারি। ভাইয়ার আইডিতে গেলেই হয়তো পেয়ে যাবো। ফ্রেন্ডলিষ্টে যদি এখন নাও থাকে,, আগের পিকগুলোর লাইক কমেন্টে ওর আইডি অবশ্যই পাবো। দেখি,, তাড়াতাড়ি এফবিতে লগ ইন করো!"
-"আমার আইডি তো আমি ডিলিট করে দিয়েছি।"
তৃষ্ণার কথা শুনে অস্থির হয়ে অর্থি বলতে লাগলো,
-"উফ!! ভাবি... তুমি না! দেখি ফোন দাও। আমার আইডিতে লগইন করি..."
-"কিন্তু এসবের দরকার টা কি! যা যেমন আছে তেমনই থাক না!"
অর্থি তৃষ্ণার দুই হাত চেপে ধরে বললো,
-"মনের শান্তির জন্য হলেও তোমার সত্যিটা জানা উচিৎ, ভাবি।"
খানিকক্ষণ ঘাটাঘাটির পর অতৈন্দ্রিলার ফেসবুক আইডি খুঁজে পাওয়া গেল। সাথে এবাউটে গিয়ে তার ফোন নাম্বার সহ তার ফ্যামিলি মেম্বার লিস্টে পাওয়া গেল আফসানা নামের মেয়েটির আইডিও।
প্রায় বিশ মিনিটের বেশি সময় হলো রেস্টুরেন্টে বসে তৃষ্ণা অপেক্ষা করে যাচ্ছে অতৈন্দ্রিলার। এই মেয়ের সময়জ্ঞান বলতে কিছুই নেই। দুপুর ১২ টার মাঝে আসতে বলেছিল,, সেখানে এখন বাজে সাড়ে বারোর উপরে.. কখন আসবে কে জানে!
-"হায়.. তৃষ।"
মেয়েলী গলার স্বর শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো তৃষ্ণা। বললো,
-"আমার নাম তৃষ্ণা... তৃষ না।"
এক গাল হেসে অতৈন্দ্রিলা তৃষ্ণার মুখোমুখি বসে বললো,
-"হোয়াটেভার! কিছু অর্ডার করেছো?"
-"না.."
-"ওয়েট, দেন আই অর্ডার।"
তৃষ্ণা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে গ্যালারি তে গিয়ে একটি ছবি বের করে তা মেলে ধরলো অতৈন্দ্রিলার সামনে।
-"এটাই তো আফসানা... না?"
ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল অতৈন্দ্রিলার। আমতা আমতা করে বললো,
-"না.. মানে হ্যাঁ।"
-"তুমি ওর সাথে কি করছো এই ছবিতে? আবার ক্যাপশন দিয়েছো সিস্টার্স বন্ডিং! ফ্যামিলি মেম্বারেও দেখলাম আফসানা এড আছে!"
-"হ্যাঁ.. আফসানা আমার বোন। কিন্তু ওর সাথে মাহসানের রিলোশন আছে। আমার সাথে রিলেশনশিপে থাকতেই ওর আর আফসানার মাঝে রিলেশন টা হয়। আমার নিজের বোনই আমাকে চিট করেছে, তৃষ্ণা।"
-"সত্যি?"
অতৈন্দ্রিলা ভারী গলায় জবাব দিল,
-"হ্যাঁ। আর এর কারণে আমি আফসানার সাথে পর্যন্ত সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছি। আমি তো রিয়েল লাভ করি মাহসানকে!"
অতৈন্দ্রিলার কথায় তৃষ্ণা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
-"তাই তো! সম্পর্ক না থাকলে তাতে কি! ডেইলি একসাথে হ্যাংআউট করে পিক আপলোড তো করাই যায়! তাই না?"
ঢোক গিলে অতৈন্দ্রিলা বলতে লাগলো,
-"তুমি কি বলতে চাচ্ছো? আমি মিথ্যে বলেছি? আমি যদি মিথ্যেই বলে থাকি.. তো পিকচার গুলো?"
-"কাকে দিয়ে ফটোশপ করিয়েছো?"
-"আশ্চর্য! ফটোশপ করাবো কেনো? তোমার হাজবেন্ড যে নাম্বার ওয়ান লুচ্চা সেটা কি ভুলে যাচ্ছো? তোমার হাজবেন্ডের লুচ্চামি প্রমাণ করতে আমার ফটোশপের সাহায্য নিতে হবে?"
-"হ্যাঁ.. নিতে হবে। আর তুমি নিয়েছোও।"
-"আচ্ছা! নিয়েছি। তাতে কি হয়েছে? তোমার বেড পারফরমেন্সে স্যাটিসফাইড না হয়ে তোমার হাজবেন্ড নিজে আমার কাছে এসেছিল।"
লম্বা একটা দম ফেলে তৃষ্ণা দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
-"আমি তো তোর মত পর্ণস্টার না। তাই তোর মত বেড পারফরমেন্স দিতেও পারি না। আমি নিজেও জানি.. আমার হাজবেন্ড খারাপ, কিন্তু তুই ওর চেয়েও বেশি খারাপ। আল্লাহ যেন তোর মত প্রোস্টিটিউটের উপর দুনিয়াতেই গজব ফেলে।"
-"মুখ সামলে কথা বলো, তৃষ্ণা।"
থামলো না তৃষ্ণা। বরং গলার স্বর আরো বাড়িয়ে চেচিয়ে বলতে লাগলো,
-"কিসের মুখ সামনে কথা বলবো? তুই কে রে? তুই একটা প্রোস্টিটিউট।"
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। আশেপাশে থাকা লোকদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
-"সবাই এই মেয়েকে দেখে নিন। ও একটা প্রোস্টিটিউট। না.. না, ওকে প্রোস্টিটিউট বললেও, প্রোস্টিটিউটদের অপমান হবে... এই মেয়ের কাজই অন্যের সাজানো গোছানো সংসার ভাঙা। পুরুষ তো পুরুষই! কিন্তু একজন নারী হয়ে অন্য নারীর জীবনটা শেষ করে দিতে একটা বারো বুক কাঁপে না এদের? কি মাটি দিয়ে আল্লাহ বানিয়েছে এদের?"
ঘড়িতে বাজে রাত ৮ টা। বিছানায় বসে চুপচাপ খেলনা নিয়ে খেলছে তনয়। অস্পষ্ট আওয়াজে খানিক বাদে বাদে বা বা করে যাচ্ছে। আচ্ছা.. এই ডাকটার অর্থ কি জানা আছে তনয়ের? এখন জানা না থাকলেও কিছুদিন পর হয়তো জানতে পারবে। বাবার মানেটা বুঝতে শিখবে তখন... ভাবতেই তৃষ্ণার বুকচিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। মন বারবার বলছে, মাহসানের চাওয়া শেষ সুযোগ নিয়ে আরেকটা বার ভাবতে। কিন্তু এখন আর ভেবেই বা কি হবে! মাহসানের নিজেরই তো কোনো খোঁজ নেই....
(চলবে)
#সম্পর্কের_টান
#পর্ব-৭০
-"কি রে? কি করছিস?"
এতক্ষণ যাবৎ মাহসানের চিন্তায় মগ্ন ছিল তৃষ্ণা। মাহসান নিখোঁজ হবার পর থেকে ধরতে গেলে সারাটা দিনই তৃষ্ণার কাটে মাহসানকে ভেবে। বিশেষ করে আফসানার ব্যাপারটা মিথ্যে প্রমাণ হবার পর থেকে মনে একটা প্রশ্নই বারেবারর উকি দেয়.. মাহসান কি একটা সুযোগের যোগ্য নয়? একটাবার কি মাহসানকে সুযোগ দেয়া যায় না? হ্যাঁ.. আগের মত বিশ্বাস, ভালোবাসা কিছুই নেই তাদের এই সম্পর্কের মাঝে। কিন্তু কোথাও যেন একটা টান রয়ে গেছে.... হঠাৎ তৌহিদের গলার স্বরে চিন্তার জগতে করা বিচলন থেমে গেল তৃষ্ণার। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-"কিছু না। ভেতরে এসো।"
তৌহিদ ধীরেধীরে এগুলো বিছানায় চুপচাপ বসে থাকা তৃষ্ণার দিকে। বিছানার এক কোণায় আরাম করে বসে বললো,
-"রাত তো অনেক হলো! ঘুমাবি না?"
-"হ্যাঁ.. ঘুমাবো।"
-"কাল কোর্টে যাব।"
তৌহিদের কোর্টে যাবার কথা আসতেই তৃষ্ণা বললো,
-"আর কিছুদিন রেস্ট নাও। এখনো তো পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হও নি। তাছাড়া... "
তৃষ্ণার কথার মাঝপথেই তৌহিদ বললো,
-"আর আমার সাথে তুইও যাবি।"
ভ্রু কুঁচকে গেল তৃষ্ণার। মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-"আমি কেনো?"
-"ডিভোর্স উইথড্র করার জন্য। দেখ, তৃষ্ণা.. আমি আজ তোকে কিছু কথা বলবো, আমার বলা কথাগুলোর ভুল কোনো অর্থ বের করিস না। মাহসানের তোর নামে লিখে দেয়া সম্পত্তির জন্য আমি কথাগুলো বলছি না। আমি অনেক ভাবনা চিন্তার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছি।"
বলেই থামলো তৌহিদ। তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো, তার মনের অবস্থা। মনের ভেতরটা পড়তে না পারলেও চোখ টা পড়ে নিল তৌহিদ। ছলছলে নয়নে তাকিয়ে থাকা তৃষ্ণার কাধে ভরসার দুই হাত চেপে বললো,
-"তোর সাথে মাহসান যা করেছে.. তাতে ওকে শাস্তি দেয়া, সুযোগ দেয়া সবই তোর ব্যাপার। আমি শুধু এখানে এটুকুই বলবো, ডিভোর্স টা উইথড্র করে রাখ। আমাদের সমাজে বিয়েটা আমরা যেমন ছেলেখেলা বানিয়ে রেখেছি.. তাতে ডিভোর্স আর বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের মাঝে সো কলড ব্রেকাপ একই হয়ে গেল না? এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এমন এক সময় আসবে, যখন আর এই বিয়েরও মূল্য থাকবে না। কিন্তু আমরা যেহেতু মুসলিম ফ্যামিলি বিলং করি... সেহেতু আমাদের উচিৎ বিষয়টা কে গভীরভাবে ভেবে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া। আজ ডিভোর্স দিলে কাল তুই আবার ইচ্ছে করলেও মাহসানের কাছে ফিরে যেতে পারবি না। অনেক বাঁধা আসবে তখন তোর আর মাহসানের সম্পর্কের মাঝে। তুই কি বুঝতে পারছিস আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি?"
হালকা মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের কথায় সায় জানালো তৃষ্ণা। তৌহিদ উত্তর পেয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,
-"আমি শুধু এটাই বলছি... তুই আরেকটাবার ভাব। আর আপাততর জন্য ডিভোর্স টা উইথড্র করে রাখ। মাহসানের খোঁজ চলছে... মাহসান ফিরুক। তুই ওর সাথে সামনাসামনি খোলাখুলি কথা বল। তোরা দুইজনই তনয়ের ব্যাপারটা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নে। অর্থি আমায় একটা কথা বলেছিল... যেটা খুব বেশি আমার মনে দাগ কেটেছিল। আজ তুই নতুন ভাবে জীবন শুরু করলে তুই তোর জীবনসঙ্গী পাবি.. মাহসানো পাবে। তবে যা হারাবে শুধুই তনয় হারাবে... আর আমি নিজেও এ বিষয়ে কথা বলবো মাহসানের সাথে। তবে সত্যি বলতে আমার মন বলছে, মাহসান অনুতপ্ত। তাকে আমরা সবাই মিলে গাইড করলে, নিজেদের মত ট্রিট করলে হয়তো তনয় পরিপূর্ণ একটি পরিবার পাবে.. বেড়ে উঠবে বাবা মা দুজনকেই পাশে পেয়ে। আমাদের দেশে কিন্তু এমনো হাজারো ছেলেমেয়ে রয়েছে... যারা ব্রোকেন ফ্যামিলির শিকার হয়ে বেছে নিয়েছে অসৎ পথ। আমরা তো পারবো না অতীত কে পরিবর্তন করতে, তবে সেই অতীতকে শুধরে সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ তো গড়তেই পারি... না?"
হাসি ফুটলো তৃষ্ণার চোখেমুখে। না.. এটি লোকদেখানো মিথ্যে হাসি নয়।
নিহনের প্রচন্ডরকমের ঠাণ্ডা লেগেছে। সর্দির উন্য মেয়েটা ঠিকভাবে নিঃশ্বাস টাও ফেলতে পারছে না। সেই সাথে কাশি তো আছেই। মেয়ের এই অসুস্থতা নিয়ে চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। একমাসের বাচ্চার উপর দিয়েই কেনো এত ঝড় তুফান আসতে হবে? তার উপর মাহসানের উধাও হয়া.. দুটি বিষয় নিয়ে পুরো পাগল হতে বসেছে সে। খাওয়াদাওয়া, ঘুম কিছুরই ঠিক ঠিকানা নেই। কবে যে আবারো ঠিকভাবে চোখের দুইপাতা এক করে আরামের ঘুম ঘুমাতে পারবে! ঘড়িতে রাত এগারোটার উপরে বাজে। অথচ এখনো ঘুম নেই ঐতিহ্যর চোখে। শুয়ে শুয়ে নানান বিষয় নিয়ে ভেবে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। এত রাতে আবার কে কল করলো? বিরক্তিমুখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভেসে উঠলো নিলয়ের নাম।
-"কি ব্যাপার নিলয়, ভাই? এত দিন পর? কেমন আছো?"
-"আমি তো সবসময়ই ঝাক্কাস! তা তোদের কি খবর? মাহসানের নাম্বার বন্ধ কেনো? কিছুদিন হলো ট্রায় করার উপরেই আছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।"
নিলয়ের কথায় ঐতিহ্যর বুকচিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। একেএকে সব খুলে বলতে লাগলো সে নিলয়কে। সব শুনে নিলয় হতাশ হয়ে বললো,
-"মাহসানকে আমি এত করে বুঝালাম! তারপরও ও এই ডিসিশন টা নিল কিভাবে! আর এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার মানে কি! তোর জীবন কি শুধু তৃষ্ণা তেই সীমাবদ্ধ! একটাবার তো নিজের দুই বোনের কথা ভাবা উচিৎ ছিল। কিভাবে করলো ও এসব!"
-"কি ভেবে এসব করলো ভাইয়া জানি না। প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেও তার বিভিন্ন ধরন ছিল। যাইহোক, এখন আমাদেরই বা আর কি করার আছে? যতটুকু সাধ্য হচ্ছে আমরা করছি। দেশের ভেতর কোথাও ভাইয়ার খোঁজ নেই.. না বাইরে। ভাইয়া নিখোঁজ হবার দিন থেকে এয়ারপোর্টে যতগুলো ফ্লাইট টেক ওভার করেছে, সবগুলোরই প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করা হয়েছে। কোথাও ভাইয়ার নাম নেই। বর্ডার চেকপোস্টেও খোঁজ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও থেকে খোঁজ পাবার মত কিছুই জানা যায় নি এখনো।"
খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে নিলয় বললো,
-"আমি যা সন্দেহ করছি.. তুই ও কি..."
নিলয়ের কথার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিল ঐতিহ্য। ভারী গলায় বললো,
-"না.. ভাইয়া স্ট্রং পারসোনালিটির একজন মানুষ। ভাইয়া এমন কিছুই করবে না।"
-"নিজে না করলেও! আল্লাহর খেল কিন্তু বোঝা মুশকিল!"
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঐতিহ্য বললো,
-"না.. ইনশাআল্লাহ ভাইয়া ফিরবে। বোনদের ভালোবাসার টানে হলেও ভাইয়া ফিরবে।"
-"জীবন জিনিসটা বড় অদ্ভুত.. না? যে জিনিসটি কখনোই তোমার হবার নয়, কখনোই তোমার নিজের জন্য তৈরি করা হয়নি... সেই জিনিসটির মায়াবী জালে ফেসে যাই আমরা!"
ফোন কানে নিতেই মুহিবের মুখ থেকে এ কথা শুনে তৃষ্ণা বললো,
-"সরি, মুহিব ভাই। ব্যাপারটা যে এভাবে ছড়িয়ে যাবে, আপনি হার্ট হবেন.. কোনোটাই আমি ভেবে দেখি নি। আমার ভালো লাগে আপনার সাথে সময় কাটাতে, আপনার মুখের বলা প্রতিটি কথা আমার ঠোঁটে হাসি ফোটায়... আর আপনি যা চাইছেন, তা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু.. আই অ্যাম সরি, মুহিব ভাই। আমি পারবো না.. তনয়ের বাবার জায়গাটা আমি আপনাকে দিতে পারবো না। আমি শুধু এটুকুই চাই, মাহসানকেই তনয় বাবা হিসেবে জানুক। মাহসানের পরিচয়েই বেড়ে উঠুক তনয়। বাবা নিয়ে বড় হয়ে আমার ছেলে কোনো কনফিউশনে পরুক আমি সেটা চাই না।"
ফোনের ওপাশ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুহিব বললো,
-"বাবা না হতে পারি.. মামা তো হওয়াই যাই। আরে না.. যাবে আবার কি! আমি তো ওর মামাই।"
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মুহিব। কিছুটা সময় নিয়ে নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রণ করে চোখজোড়া মুছলো সে। ইদানিং এই একটা সমস্যায় পড়েছে সে.. হঠাৎ করেই চোখের কোণায় জল এসে পড়ে। একবছর আগের সেই রোগটা আবারো কি চেপে ধরলো তাকে? না.. কোনোভাবেই ধরতে দেয়া যাবে না। ছেলে হয়ে কান্নাকাটি.. ছিঃ! কি অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার!
আজ তনয়ের জন্মদিন। পাঁচবছর আগে এই দিনটিতেই দুনিয়ার বুকে এসেছিল তনয়। দেখতে দেখতেই পাঁচটা বছর কত সহজেই না কেঁটে গেল.. ভাবতেই তৃষ্ণার বুকচিরে বেরিয়ে এল একটি নিঃশ্বাস। হাতে থাকা র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে ফেললো সে তনয়ের জন্য কেনা গিফটটি। তারপর তা জায়গা মত রেখে উঠে পড়লো সে। দরজার দিকে এগুতেই সামনে থেকে ঝাপিয়ে পড়লো তনয়। তৃষ্ণার দু পা চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-"আম্মু ও আম্মুই,, নিহনরা এসে পড়েছে।"
তৌহিদ তাথৈকে নিয়ে মেঝেতে বসে মন দিয়ে পেপার পড়ে যাচ্ছে। তাথৈ খানিকক্ষণ বাবার কোলে চুপচাপ বসে থাকার পর হামাগুড়ি দিয়ে নেমে পড়লো বাবার কোল ছেড়ে। এগুলো কিছুদূরে রাখা ময়লার ঝুড়ি দিকে। তাথৈ সরকার.. অর্থি এবং তৌহিদের একমাত্র মেয়ে। এ মাসের বাইশ তারিখ আসলে আট মাস ছেড়ে নয় পড়বে তার।
নিহন কে কোলে নিয়ে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকতেই চেচিয়ে উঠলো অর্থি।
-"এই! এই তৌহিদ.. ইশ মেয়ে আমার ময়লা খাচ্ছে! ছিঃ। দেখি নিহন মা,, নাম তো।"
বলেই নিহন কে কোল থেকে নামিয়ে অর্থি এগুলো তাথৈ এর দিকে। হাত ঝেড়ে মুখ মুছে তাথৈ কে কোলে উঠিয়ে নিয়ে অর্থি পা বাড়ালো তৌহিদের দিকে। ঝট করে নিউজ পেপার তৌহিদের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
-"তুমি এই নিউজ পেপার পেলে কোথায়? আমি বাসায় কোনো নিউজ পেপার আনতে নিষেধ করেছি না? দাঁড়াও! আজ এই পেপারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার না করলে আমার নাম অর্থি না!"
তৌহিদ মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-"আরে! এটা পলাশ ভাইয়ের বাসা থেকে এনেছি। কিছু করো না, অর্থি। অন্যের জিনিস। ফেরত দিতে হবে তো!"
-"চুপ.. একদম চুপ! মেয়ে বসে বসে ময়লা খাচ্ছে আর উনি পেপার গিলছেন!"
তৌহিদ অবাক হয়ে বললো,
-"বলো কি! দেখি? আম্মা, তুমি ময়লা খেয়েছো কেনো?"
-"হ্যাঁ,, উনি বললো, আর মেয়ে জবাব দিল! সাধারণ মেয়েকেও দেখে শুনে রাখতে পারো না তুমি!"
একবার অর্থির দিকে আরেকবার তৌহিদের দিকে তাকিয়ে তাদের ঝগড়া খুব মন দিয়ে শুনছে নিহন। কিন্তু আজ তো তনয় ভাইয়ার বার্থডে! তাহলে কেনো ঝগড়া করছে ওরা? বার্থডেতে ঝগড়া করলে কি চলে?
-"উফ!! স্টপ.. আজ তনয় ভাইয়ার বার্থডে না? বার্থডে তে ঝগড়া করছো কেনো তোমরা?"
নিহনের কথা শুনে একদন্ড থেমে গেল অর্থি। তবে পরমুহূর্তে আবারো তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
-"দেখো... শেখো কিছু আমার মার কাছ থেকে। বার্থডে তে কেউ ঝগড়া করে!"
হেসে ফেললো তৌহিদ। কানে দুই হাত চেপে বললো,
-"সরি নিহন মা.. সাথে তার খালামুনিকেউ।"
সন্ধ্যা না গড়াতেই কেক কাটার জন্য উঠে পড়ে লাগলো তনয় এবং নিহন। তাদের জেদের সাথে কেউ না পেরে শেষমেশ মাগরিবের আযানের আগেই কাটা হলো তনয়ের পঞ্চম জন্মদিন উপলক্ষে কেক। তারপর তনয়ের অভ্যাসমত সে একেএকে সবার পিছেপিছে ঘুরঘুর করতে লাগলো। এখন সবার গিফট দেবার পালা। এই দিনটায় প্রচুর গিফট পায় সে। তারপর মার সাথে একসাথে বসে গিফট গুলো খুলতে খুব বেশি ভালো লাগে তার... একেএকে সবার কাছ থেকেই গিফট পাবার পর সে এগুলো তার মায়ের দিকে।
টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল তৃষ্ণা। রাত বেশি একটাও হয় নি। তবে আজ তাড়াতাড়িই সবাই খেয়ে নেবে। সে নিজেও অবশ্য ক্ষুধার্ত। সারাদিন ধরে রান্নাবান্না করার পর এখন খুব বেশিই ক্লান্ত লাগছে..
-"আম্মুই... আমার গিফট?"
তৃষ্ণা তনয়ের দিকে না ফিরেই বললো,
-"রুমে যাও। আলমারিতে রেখেছি। সামনেই আছে... খুললেই পেয়ে যাবে।"
নড়লো না তনয়। সেভাবেই চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে বললো,
-"আমি আজ খেলনা চাই না, আম্মুই।"
-"বিরক্ত করো না তো, তনয়। তুমি যাও নিহনের সাথে খেলো। আমি পরে বের করে দিচ্ছি।"
-"না... আম্মুই। আমার এবার খেলনা গিফট চাই না তো।"
বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে ছেলের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। চোখ মুখ রাঙিয়ে বললো,
-"আবার কি বাইনা নিয়ে এসেছিস? খেলনা চাই না তো কি চাই?"
-"বাবা..."
তনয়ের মুখের কথাটি শুনেই বুকটা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণার। অজানা কষ্টে ছেয়ে গেল তার চোখমুখ..
-"তাথৈ এর মত আমিও তোমার আর বাবার মাঝে ঘুমাতে চাই। আমার বাবা কোথায় থাকে আম্মুই? তুমি কখনই আমাকে কেনো বলো না? নিহনেরও বাবা আছে, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শিপনেরও বাবা আছে। তাহলে আমার কেনো নেই বাবা?"
মায়ের মুখ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তনয় আবারো বলতে শুরু করলো,
-"তাথৈ যেমন দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেলে মামা ধরে ফেলে, মামার বুকে ঘুমায়... আমিও কি তেমনটাই করতাম, আম্মুই?"
তনয়ের কথায় তৃষ্ণার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিহন হবার সময়, ঐতিহ্যদের বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর কথা। আধো আধো বলে যখন তনয় ডাকতে শিখেছিল তার বাবাকে।
-"আমার বাবা কোথায় থাকে, আম্মুই? ছোট ফুপু সেদিন মামাকে বলছিল, বাবা নাকি মারা গেছে। সত্যিই কি আমার বাবা মারা গেছে?"
ছেলের কথায় বুকটা ফেটে গেল তৃষ্ণার। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল এক হাতে মুছে নিল সে। হাটু গেড়ে বসে ছেলের দুই কাঁধে হাত রেখে বললো,
-"না.. তোর বাবাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আত্ম অহংকার, নিজের জেদের বসে তোর বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। তবে ফিরে আসবে তোর বাবা। তোর মার উপর অভিমান করে চলে গেলেও তোর টানে তোর বাবা ফিরে আসবেই।"
তনয় মায়ের দিকে ছলছলে নয়নে তাকিয়ে বললো,
-"আম্মুই.. তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমারো কান্না পায়। আমি আর বাবাকে গিফট চাইবো না।"
-সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।