সম্পর্কের টান। পর্ব-৬৫+৬৬


সম্পর্কের টান
 পর্ব-৬৫+৬৬

মাহসান অনেকটা সময় নিয়ে তৃষ্ণার ঠোঁটে চুমু খাবার পর নেমে এল গলায়। একের পর এক ঠোঁটের স্পর্শ একে দিতে লাগলো সে তৃষ্ণার পুরো শরীরজুড়ে। এতে তৃষ্ণার শরীরের ছটফটানি কিছুটা কমে এলেও শান্ত হলো না মনের ভেতরটা। লম্বা কিছু নিঃশ্বাস ফেলে তৃষ্ণা দু হাত দিয়ে চেপে ধরলো মাহসানের ঠোঁটজোড়া। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলতে লাগলো,
-"তুমি এভাবেই অতৈন্দ্রিলাকে আদর করেছো... না? নাকি ওকে আদর করার ভিন্ন কোনো স্টাইল ছিল? আর... তোমার এই ঠোঁটজোড়া? এগুলো দিয়েই তুমি অতৈন্দ্রিলা কে চুমু খেয়েছো একসময়! তোমার এই দুই হাত, আজ আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে পায়চারী করছে। অথচ দু দিন আগেই এই হাত জোড়া কোথায় পায়চারী করতো? অতৈন্দ্রিলার শরীরজুড়ে.. না?"
তৃষ্ণার মুখে অতৈন্দ্রিলার নাম শুনতেই মাহসান তৃষ্ণার হাত দুটো সরিয়ে উঠে পড়লো তার শরীরের উপর থেকে। লম্বা কিছু দম ফেলে নিজেকে প্রথমে স্বাভাবিক করলো সে। তারপর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। আর আমি সেটা মানছিও। তুমি বারবার আমাকে কেনো এক অজুহাত দিয়ে নিজের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছো? আমি যে অনুতপ্ত এটা কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না?"
শোয়া থেকে উঠে পড়লো তৃষ্ণা। মাহসানের পাশে খানিকটা দুরত্ব রেখে বসে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
-"তুমি সত্যিই অনুতপ্ত? সত্যিই তুমি অনুতপ্ত?"
ফাঁকা দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা ঝাকালো মাহসান। তৃষ্ণা সেদিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বললো,
-"যদি সত্যিই অনুতপ্ত হও, তাহলে আবারো আফসানার সাথে তুমি কিসের সম্পর্ক শুরু করেছো? অতৈন্দ্রিলা কে ছেড়ে আবারো আফসানার সাথে সম্পর্ক গড়ার নামই কি অনুতপ্ত?"
তৃষ্ণার কথায় বিস্তারিত চোখে মাহসান তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আফসানা কে?"
-"ওরে বাবা! এখন তুমি আফসানাকেই চিনছো না?"
-"না.. কে আফসানা? আর ওর সাথেই বা আমার কিসের সম্পর্ক!"
গলা কিছুটা কঠিন হয়ে এল তৃষ্ণার। সে একনাগাড়ে বলতে লাগলো,
-"একদম মিথ্যা বলবা না। মিথ্যা বলতে বলতে তো তুমি অভ্যস্ত। অতৈন্দ্রিলার কাছ এসব শোনার পরও আমি তোমাকে এ নিয়ে কিছু বলি নি। কারণ, তোমার লাইফ.. তুমি যেভাবে খুশি চলবা। এতে নাক গলানোর মত আমি আর কেউ নই তোমার লাইফে। তবে তোমার আজ করা কাজকর্মে, কথায় আমি এটা বাধ্য হলাম। আর কি বললে? তুমি আফসানা কে চেনোই না! তাহলে ওর সাথে তোমার ছবি কি করে এল? তাও কতটা খোলামেলা অবস্থায়!"
-"আমি সত্যিই আফসানা কে চিনি না। আর অতৈন্দ্রিলা তোমাকে মিথ্যে বলেছে। ও আমাকে..."
মাহসানকে থামিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"চুপ.. একদম চুপ। মিথ্যা অতৈন্দ্রিলা না, তুমি বলছো। আর এই মিথ্যা তুমি অতৈন্দ্রিলার বেলাতেও বলেছে। কি... বলো নি? মিথ্যা বলেও যখন তোমার কাজ ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছিল না তখন তুমি আমার শরীর নিয়ে, বেড পারফরমেন্স নিয়ে কথা তুলেছিলে। নিজেকে কি মনে করো তুমি? হ্যাঁ? কোনো পর্ণস্টার তুমি? পর্ণস্টারদের মত বেড পারফরমেন্স আমার কাছ থেকে যখন পাচ্ছিলে না, তখন গিয়েছিলে অতৈন্দ্রিলার কাছে। এখন যখন অতৈন্দ্রিলা তোমার মত পর্ণস্টারের চাওয়া পাওয়া আর পূরণ করতে পারছে না, তখন তুমি আফসানা কে ধরেছো। তোমার মত মিন মাইন্ডের কোনো ছেলে কখনোই অনুতপ্ত হতে পারবে না। সব তোমার নাটক। কি মনে করেছো? তৃষ্ণা তো আলাভোলা! এসন বুঝতেই পারবে না.. তাই না?"
-"আচ্ছা। তোমার সব কথাই ঠিক আছে। আমি যদি অনুতপ্ত নাই হই বা আফসানা নামক কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েই পড়ি.. তাহলে তোমার পিছুপিছু কেন ঘুরছি আমি? কেন আমি নিজের ইগো, আত্মসম্মান কে একপাশে ফেলে তোমার পা পর্যন্ত ধরেছি? তোমার সাথে নতুন করে সংসার সাজিয়ে আমার কি লাভ, তৃষ্ণা?"
-"এগুলো আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজেকে করো। তুমি নিজে খুব ভালো করেই জানো এতে তোমার লাভ টা কোথায়!"
তৃষ্ণার এক হাত আঁকড়ে ধরে মাহসান অসহায় গলায় বললো,
-"এতে আমার কোনো লাভ নেই। আমি ভালোবাসি তোমাকে.."
মাহসানের হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তৃষ্ণা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-"লাভ নেই তো আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে আমার মত করে থাকতে দাও।"
-"বোঝার চেষ্টা করো, তৃষ্ণা। তুমি সময় থাকতে একবার ডিভোর্স টা উইথড্র করে নাও। আমার উপর একটাবার আস্থা রাখো।"
-"উইথড্র করবো! অসম্ভব! তোমার সাথে আমি থাকবো কি করে? যেখানে তুমি আমাকে স্পর্শ করলেই আমার ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করো। এই যে তুমি আমাকে ঠোঁটে চুমু দিয়েছো.. আমি যদি এখন পারতাম নিজের ঠোঁটজোড়া কেটে ফেলতাম। তুমি কি বুঝতে পারছো, ঠিক কতোটা হেট করি আমি তোমায়? তোমার এই চেহারাটাও আমার আর দেখতে ইচ্ছে করে না। হাপিয়ে উঠেছি আমি মানুষরূপি জানোয়ার দেখতে দেখতে।"
অশ্রুসজল চোখে তৃষ্ণার দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মাহসান। বেড সাইড টেবিল থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে তনয়ের পাশে বসে পড়লো সে। ঝাপসা চোখে ছেলের নিষ্পাপ মুখটি ঠিকঠাক নজরে আসছে না তার। তাই চোখজোড়া মুছে সে আবারো তাকালো ছেলের দিকে। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
-"তৃষ্ণা, আমার এই মুখ আর কখনোই দেখতে হবে না তোমায়। ভালো থেকো.."

খানিকটা সময় কেটে যাবার পর তৃষ্ণা উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। পা বাড়ালো ড্রইং রুমের দিকে। ড্রইংরুমের একপাশে ঘুমিয়ে রয়েছে কলি, অপরপাশের সদর দরজা খোলা... মাহসান কি সত্যিই চলে গেছে? না.. যায় নি। সেদিনের মতই আবারো ফিরে আসবে সে। পেছন থেকে তাকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নিয়ে মাহসান নীচু গলায় বলবে, তৃষ্ণা.. সরি।
পুরো রাত মাহসানের অপেক্ষাতেই নির্ঘুমে কাটালো তৃষ্ণা। বিশ্বাস হচ্ছে না তার... সত্যিই কি মাহসান চলে গেলো? গেলে গেছে.. এতে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেনো? নিজেই তো যেতে বলেছিল মাহসানকে। নাহ! আর ভাববে না সে মাহসানকে নিয়ে। যার যাবার সে গেছে। তার জীবনে আর মাহসানের কোনো জায়গা নেই। নিজের মনকে নানান জিনিস বলে বুঝ দিলেও কোনোভাবেই মনকে শান্ত করতে পারলো না তৃষ্ণা। সকালে তনয় উঠার পর থেকেই তার ছটফটানি বলে দিচ্ছিল, সে তার বাবাকেই খুঁজছে। পুরো বাড়ি খুঁজে যখন কোথাও দেখা পেল না তনয় তার বাবার তখন মায়ের পায়ের কাছে এসে অনবরত 'বা বা বা' করে যেতে লাগলো। তনয়ের মুখ থেকে এই ডাক শোনার পর থেকেই তৃষ্ণার এই অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। কে শিখিয়েছে তনয়কে এই ডাক? তনয়ের অসহায় মুখ থেকে ডাক গুলো শুনতেই বুক টা ফেটে যাচ্ছে তার। আবারো সেই আত্মসম্মান, মর্যাদার কথা ভাবতে গিয়ে সে তার ছেলেকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ছেলের কাছ থেকে আবারো সে কেড়ে নিয়েছে তার বাবাকে। এতটা স্বার্থপর কেনো সে? নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে সে বারবার কেন ভুলে যায় সে একজন মা?
অপরদিকে দুপুর বারোটার দিকে নিহালের বরিশালের খালা এসে উপস্থিত হলো নিহালদের বাড়িতে। অর্থাৎ আজ থেকে তৃষ্ণার ছুটি। এই কয়েকটি দিন এবাড়িতে কখনোই একা ছাড়ে নি মাহসান তাকে। সারাদিন পিছু লেগেই থেকেছে, এটা ওটা নানান জিনিস বলে বিরক্ত করার উপরই থেকেছে। আর আজ যখন মাহসান নেই, কেউ বিরক্ত করছে না তাকে, পাশ ফিরে মাহসানকে খুঁজে পাচ্ছে না... তখন কেন যেন চোখ উপচে পানি বেড়িয়ে আসতে চাইছে তার। আর একমুহূর্তও তার থাকতে ইচ্ছে করছে না তৃষ্ণার এ বাড়িতে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কালকের রাত টি কেনো এল তার জীবনে?

-"নিহাল ভাই, আমি আজই বাড়িতে যাব।"
তৃষ্ণার কথায় খাতার দিক থেকে নজর সরিয়ে নিহাল বললো,
-"আর কিছুদিন থাকুন।"
-"না। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।"
চিন্তিত হয়ে নিহাল বললো,
-"আচ্ছা,, আজ তো আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে। কাল সকালে আপনাকে গিয়ে রেখে আসলে কোনো সমস্যা হবে কি?"
-"না।"
নিহালের কাছে না জবাব দিলেও তৃষ্ণা আজ বিকেলে যাবার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। দুপুরের খাবার খেয়ে নিহাল বেড়িয়ে যাবার পর তৃষ্ণাও ঐতিহ্যদের বলে, তাদের বাধা উপেক্ষা করেই বেড়িয়ে পড়লো নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে।

বাসায় ঢুকতেই মুহিবকে দেখে থমকে গেল তৃষ্ণা। পরবর্তীতে মুহিবের মা শাহানা বেগমকে দেখে তার বিস্ময় পৌঁছে গেল তুঙ্গে। এরা এখানে কেনো? ভাইয়াকে দেখতে এসেছে কি? তবে রাতের খাবারের সময়ই তাদের আসার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল তৃষ্ণার কাছে। মুহিবের সঙ্গে তৃষ্ণার বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতেই এসেছেন তারা। এবং এ নিয়ে দুপুরে এক দফা আলোচনা হয়েও গেছে। তৌহিদের দিক থেকে কোনো রেসপন্স না পেলেও তৌহিদা বেগম হ্যাঁ বলে দিয়েছে।

রাগে দুঃখে নিজের চুলগুলো একনাগাড়ে টেনেটুনে ছিড়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা। চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও কান্না চেপে রাখতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কি কপাল নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিল সে? যখন যার যেভাবে খুশি সেভাবেই তাকে ইউস করে ছুড়ে ফেলছে, একেকজনের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছে তার উপরে। প্রথমে বাবার চাপাচাপিতে মাহসানকে বিয়ে করতে বাধ্য হলো সে, তারপর মাহসান তাকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেললো। ভাইয়ের চাপাচাপিতে ছেড়ে এল নিজের ঘর সংসার, এমনকি ভাইয়ের কতামত ডিভোর্স দিতেও সে রাজী হলো মাহসানকে। তারপর আবারো তার জীবনে ফিরে এল মাহসান, মায়ার বাঁধনে তাকে জড়িয়ে আবারো ফেলে চলে গেল। সব ভুলে যখন নতুনভাবে জীবনের সূচনা করার কথা ভাবছিল সে, ঠিক তখনই আবার মুহিব! এবার কি বাবা মা ভাইয়ের কথামত তাকে আবারো বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে? নিজের মতামত বলতে কি কিছু নেই তার? সে কি মানুষ না? এত কষ্ট এত পরীক্ষা শুধুমাত্র তার ভাগ্যে কেনো? একজন সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ের মত জীবন কি সে কখনোই কাটাতে পারবে না!
-"তৃষ্ণা?"
কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় একদম নেতিয়ে পড়েছিল তৃষ্ণা। মাথার যন্ত্রণায় পুরো কপাল সহ মাথা গরম হয়ে পড়েছে তার.. কান দিয়ে অনবরত গরম বাতাস বের হচ্ছে। চোখজোড়াও লাল টকটকে হয়ে ফুলে গিয়েছে। পারছেনা সে আর এসব নিতে। মানুসিক ভাবে ধীরেধীরে ভেঙে পড়ছে সে। এই অবস্থায় আত্মহত্যা ছাড়া কিছু মাথায়ও আসছে না তার। তবে পরমুহূর্তেই তনয়ের কথা মনে হতেই নিজেকে শান্ত করছে সে। ঠিক সেসময় হঠাৎ দরজার বাইরে মুহিবের আওয়াজ শুনতেই জমে থাকা কষ্টগুলো আবারো উথালপাতাল শুরু করে দিল তৃষ্ণার বুকের ভেতরটায়। আগুনের ফুলকি চোখে ফুটিয়ে সে বিছানা থেকেই উঁচু গলায় বললো,
-"যান তো আপনি এখান থেকে। বিরক্ত করবেন না।"
-"কি করছো তুমি? আসার পর একটা বার কথাও হলো না তোমার সাথে। অনেক কথা ছিল তোমার সাথে আমার।"
-"ভদ্র ভাবে কথা বললে বোঝেন না আপনি? বলছি না একবার.. আপনি এখান থেকে যান? তারপরও ছ্যাঁচরামি করছেন কেনো? আর একবার বিরক্ত করলে কিন্তু আমি সম্পর্ক দেখবো না। ঠাটিয়ে গালে দুইটা চড় মেরে দিতে কিন্তু আমার বাঁধবে না।"
আচমকা তৃষ্ণার মুখ থেকে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল মুহিব। খানিকটা সময় দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে পা বাড়ালো গেস্ট রুমের দিকে।

অর্থিকে ঘরের আলো নেভাতে দেখে তৌহিদ বললো,
-"তনয়কে রেখে আসবে না?"
-"না, ওর মা বললো আজ আমার কাছে রাখতে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি?"
-"হ্যাঁ।"
অর্থি বিছানায় উঠতে উঠতে বললো,
-"মুহিব ভাইয়ের পেটে পেটে যে এসব ছিল.. তা মনের ভুলেও কখনো ভাবি নি আমি। পারেও এরা!"
তৌহিদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"সমস্যা কি? সারাজীবন তো আর এভাবে চলবে না তৃষ্ণার। একজন না একজনের সাথে তো নতুন করে জীবন শুরু করতেই হবে। আর সেই একজন টাই যদি মুহিব হয়,, তাহলে ক্ষতি কি?"
-"কোনো ক্ষতি নেই। ক্ষতি থাকবেই বা কেনো? তাই বলে ডিভোর্স না হবার আগেই বিয়ের প্রস্তাব?"
-"আর তো বেশি একটা সময়ও নেই। একমাসের মত আছে.. হয়ে যাবে।"
বুক থেকে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অর্থি বললো,
-"হ্যাঁ.. তাইতো। যা যাবে তনয়ের যাবে। আমার তোমার বা তৃষ্ণা মাহসানের তো আর যাবে না! তৃষ্ণাও বিয়ে করলে নতুন বর পাবে, মাহসানও নতুন বউ পাবে। শুধু হারাবে তনয়.. "

      (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৬৬

গরম বিছানার উত্তাপ ছেড়ে আলসেমি কাটিয়ে উঠে পড়লো তৃষ্ণা। কোনোরকম মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে একটি চাদর গায়ে চাপিয়ে সে বেড়িয়ে পড়লো ছাদের উদ্দেশ্যে। শীতের শিশিরভেজা ভোরের প্রকৃতি, কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল প্রকৃতিকে যেনো এক অপূর্ব মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। কনকনে এই ঠান্ডা বাতাসে আলসেমি পেয়ে বসেছে শহুরের এই ব্যস্ত জীবনে। চারিদিকটায় বিরাজ করেছে নিরবচ্ছিন্নতা... শীতের এই সকালটা সত্যিই অসাধারণ! যার সৌন্দর্য্য কিছু সময়ের জন্য হলেও অনেকেরই মনের কোণে জমে থাকা হাজারো কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
-"শুভ সকাল।"
হঠাৎ মুহিবের গলার স্বর শুনে তার দিকে ফিরে তাকালো তৃষ্ণা। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-"শুভ সকাল।"
-"কি করছিলে এখানে একা একা?"
-"দেখছিলাম.."
মুহিব ভ্রুজোড়া কুঁচকে বললো,
-"অহ! তা কাল রাতে কি হয়েছিল তোমার?"
মুহিবের প্রশ্নে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে তৃষ্ণা বললো,
-"আই অ্যাম সরি, মুহিব ভাই। আসলে কাল রাতে আমার শরীর ঠিক ছিল না, মাথার যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছিল। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না।"
-"শরীর ঠিক না থাকলেই কি একজনের সাথে ওভাবে কথা বলা উচিৎ? যেখানে আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়!"
-"সরি।"
-"নো.. নো। ইটস নট ওকে। ব্যাপার টা আমাকে খুব হার্ট করেছে। কাল রাতে তুমি আমাকে খুব বাজে ভাবে ইনসাল্ট করেছো.."
-"আমি তো ব্যাপারটার জন্য সরি বললাম!"
-"সরিই সব নয়, তৃষ্ণা। আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি মন থেকে সরি ফিল করছো না।"
-"আপনি কিভাবে জানলেন, আমি মন থেকে সরি ফিল করছি না?"
-"তোমার কথা বলার ভঙ্গিই সব টা বলে দিচ্ছে, তৃষ্ণা। আচ্ছা, আমার একটা কথার ঠিকঠাক ভাবে উত্তর দাও তো.. তুমি তোমার ফোন বন্ধ করে রেখেছো কেনো? তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছো?"
তৃষ্ণা মুহিবের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ছাদের রেলিং ঘেষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলো। এখনো লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা শুরু হয় নি। আচ্ছা.. শীতের সকাল এতটা দেরি করে কেনো শুরু হয়? হঠাৎ মুহিবের এক ঝটকায় প্রকৃতির দিক থেকে নজর সরিয়ে আবারো মুহিবের দিকে দিতে হলো তৃষ্ণার।
-"কি হলো? জবাব দাও।"
স্বাভাবিকভাবে তৃষ্ণা জবাব দিল,
-"হ্যাঁ.. এড়িয়ে যেতে চাইছি।"
-"এড়িয়ে যদি যাবারই ছিল.. তাহলে কেনো ফোনে কথা বলা শুরু করলে তুমি? এমন তো না যে তুমি কিছুই জানতে না! তুমি সবই জানতে.. আমি আমার মনে জমে থাকা সব কথাই তোমায় জানিয়ে দিয়েছিলাম।"
-"হ্যাঁ, আর এই কারণেই আপনি আপনার মা কে নিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে চলে এসেছেন।"
জবাবে মুহিব বললো,
-"তো আমি কি করবো? আমার কি কিছু করার ছিল? তুমি তো ফোন বন্ধ করে বসেছিলে। কখনো বা কল রিসিভ করলেও কথা বলছিলে না!"
-"এই কার্যকলাপ গুলো দেখে কি আপনার মনে হয় নি, আমি আপনাকে এড়িয়ে চলছি? হয়েছে তো.. না? তারপরও আপনি কেনো আপনার মা কে নিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসলেন?"
খানিকটা সময় নিল মুহিব। তারপর বললো,
-"আমাকে বিয়ে করতে তোমার কোনো অসুবিধে আছে? কথা ঘোরাবে না। হ্যাঁ বা না তে উত্তর দেবে।"
সময় নিল না তৃষ্ণা। জবাবে বললো,
-"হ্যাঁ।"
তৃষ্ণার মুখ থেকে হ্যাঁ শুনতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল মুহিবের। এমন টা তো হবার ছিল না। তৃষ্ণা শুধুমাত্রই তার.. তৃষ্ণার কপালে শুধু তার নামই লেখা আছে। যার কারণে বারবার ঘুরেফিরে তার কাছেই ফিরে আসছে তৃষ্ণা। আর এই একটা কারণেই মাহসানের সাথে তৃষ্ণার সংসার টেকে নি। অল্পদিনের এই সংসারে তাদের মাঝে কোনো ভালোবাসা টাও ছিল না। এগুলো উপরওয়ালার খেলা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে? উপরওয়ালা যেখানে চাচ্ছে, সেখানে তৃষ্ণা চাইছে না কেনো? এতসব ঘটে যাওয়া ঘটনা কি তাদের মিলনের সংকেত নয়? নিজেকে সামলে নিল মুহিব। তৃষ্ণার দু হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
-"কি অসুবিধে? আমাকে তুমি বলো.. আমার সাথে তুমি একবার শেয়ার করো। আমি তোমাকে একটা না একটা সলিউশন বের করে দেব।"
মুহিবের হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"আমাকে প্লিজ একটু একা থাকতে দিন।"
-"আগে জবাব দাও।"
-"আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।"
-"এছাড়া আর কোনো অসুবিধে আছে?"
এতক্ষন নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে কথা বলছিল তৃষ্ণা। এই সাতসকালে এসব নিয়ে কথা বলে মন মেজাজ কোনোটাই খারাপ করার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু মুহিব যেমন প্রশ্নের উপর প্রশ্ন শুরু করেছে তাতে কড়া কিছু কথা না শোনালে চলবে না। লম্বা একটা দম নিয়ে তৃষ্ণা বলতে শুরু করলো,
-"শুধু এই অসুবিধে না, আরো অনেক অসুবিধে আছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না.. চাই না মানে চাই না।"
হঠাৎ তৃষ্ণাকে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখে মুহিবের স্তব্ধতার সীমা রইলো না। এই মেয়ে তো আস্ত একটা পাগল! পাগলকে পাগলের ট্রিটমেন্ট না দিলে চলবে না। তাই সে নিজেও কঠিন গলায় তৃষ্ণার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
-"তাহলে রাতের পর রাত ফোনে কথা বলেছো কেনো?"
-"আপনি বলতে বলেছিলেন বলেই বলেছি।"
-"আমি তোমাকে জাস্ট আস্ক করেছিলাম। তোমাকে ধরে বেঁধে কথা বলাতে আমি বাধ্য করি নি। তুমি নিজের ইচ্ছেতেই আমার সাথে কথা বলেছো।"
-"তো? ফোনে কথা বললেই বিয়ে করতে হবে? আপনিই বলুন.. আপনি কি তেমন কোনো ডিল করেছিলেন আমার সাথে? আমরা কি একে অপরের সাথে কোনো রিলেশনশিপে ছিলাম? না কি কোনো কমিটমেন্ট ছিল আমাদের মাঝে?"
কথা গুলো বুঝতে খানিকটা সময় নিল মুহিব। তারপর বললো,
-"অহ.. আচ্ছা! তাইলে তুমি বলতে চাচ্ছো আমরা রাতের পর রাত শুধুশুধু কথা বলেছি?"
-"শুধুশুধু কখন বললাম? আপনি যেমন আমাকে ইমপ্রেসড করার জন্য, আমার মনে আপনার একটা জায়গা তৈরি করার জন্য কথা বলেছিলেন.. আমিও তেমনি আমার অতীত ভোলার জন্য আপনার সাথে কথা বলেছিলাম। আপনার সাথে যতক্ষণ কথা বলতাম, ততক্ষণ আমি ভালো থাকতাম।"
-"এখন থাকো না?"
মুহিবের সে কথার জবাব না দিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"আপনি আপনার প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন.. আর আমিও হয়েছি। আমি না করবো না এটা। আপনি খুব ভালো করেই জানতেন আমার হাজবেন্ডের কাছ থেকে এতটা কষ্ট, অবহেলা পাবার পর আমার কোন জিনিসটার খুব বেশি দরকার ছিল! আর আপনি সে অনুযায়ী এগিয়েছেনও।"
-"তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, এসব আমি প্লান করে করেছি? সবই আমার অভিনয় ছিল?"
-"হ্যাঁ,, ছিল।"
তৃষ্ণার কথায় ম্লান হেসে মুহিব বললো,
-"ওকে! দেন আমি এই অভিনয় করেই না হয় তোমাকে আমার করে নেব। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব, তৃষ্ণা... খুব! যেদিন তোমার বিয়ের খবর টা পেয়েছিলাম। তবে আজ তার থেকেও বেশি কষ্ট আমায় দিলে তুমি, তৃষ্ণা। তোমার নিজের মত নিয়ে, তোমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম আমি। আর সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল! যেটা খুব শিঘ্রই আমি শুধরে নেব।"
বলেই মুহিব পা বাড়ালো সিঁড়ি ঘরের দিকে। তৃষ্ণা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবারো চারপাশের প্রকৃতিতে চোখ ডোবালো। চারপাশের পরিবেশ টা কোলাহলে ভরে উঠেছে। যাক! অবশেষে সবাই জাগলো!

দুপুর তিনটের উপরে বেঁজে গেছে অথচ এখনো বাসায় ফেরেনি নিহাল। কল করলেও রিসিভ করছে না। আজ এক্সট্রা কোনো ক্লাস আছে নাকি? থাকলে তো বলেই যেত আর না বলে গেলে একটা টেক্সট করে তো জানিয়ে দিত! এসব নানান চিন্তাভাবনায় মশগুল ছিল ঐতিহ্য। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেঁজে উঠায় চিন্তাররাজ্য ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হলো তাকে। ফোনের স্ক্রিনে চোখ না বুলিয়েই রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেল তৃষ্ণার গলা।
-"কি অবস্থা তোমার? নিহন কেমন আছে?"
-"ভালোই.. তুমি কেমন আছো, ভাবি?"
-"ভালো। আচ্ছা,, মাহসান কি আর এসেছিল তোমাদের ওখানে?"
তৃষ্ণার কথায় চিন্তিত গলায় ঐতিহ্য জবাব দিল,
-"না.. তোমার সাথে কি ভাইয়ার আবার খুব বড় কোনো ভেজাল টেজাল লেগেছে নাকি?"
-"যে ভেজাল লেগে আছে তার চেয়ে বড় কোনো ভেজাল আছে বলে তোমার মনে হয় কি?"
-"না.. আসলে ভাইয়া কাল থেকে একটাবারো বাসায় আসে নি। ফোন টাও বন্ধ। নিহালকে আজ ভোরে আব্বার বাসায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানেও ভাইয়া নেই।"
ঐতিহ্যর কথা শুনতেই আবারো অস্থিরতা বেড়ে গেল তৃষ্ণার। সে নিজেও দুপুর থেকে কল করে ছিল মাহসানকে। সেই যে পরশু রাতে ওভাবে বেড়িয়ে গেল! তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কোথায় গেল, কেমন আছে কে জানে! বারবার শুধু মাহসানের বলা শেষ কথাটিই কানে বাজছে তৃষ্ণার। 'আমার এই মুখ আর কখনোই দেখতে হবে না তোমায়!' কি বুঝিয়েছে এই কথাটি দ্বারা মাহসান? উলটা পালটা কিছু আবার করে ফেলেনি তো? ঢোক গিলে তৃষ্ণা ঐতিহ্যর উদ্দেশ্যে বললো,
-"খোঁজ নাও ওর। বন্ধুবান্ধব.. যাদের সাথে ও মেশে তাদের কল করো। থানায় একটা মিসিং কমপ্লেইনও করে রাখতে বলো নিহাল ভাই কে।"
তৃষ্ণার কথায় ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেললো ঐতিহ্য। বললো,
-"কি হয়েছে? খুলে বলো তো আমাকে..."


   (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ