সম্পর্কের টান । পর্ব-২১+২২


সম্পর্কের টান

 পর্ব-২১+২২

ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তৃষ্ণার। রাতে ঘুম হয় না, বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করেই কাটিয়ে দিতে হয় পুরো রাত। ঠিকঠাক মতো কিছু খেতেও পারে না। টুকটাক যাই খায়, পরমুহূর্তে সেটাই বমি করে ফেলে দেয়। তারপরও এসব দিক তার চেহারাই সামান্য আভাসও ফেলে নি। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে সে। চাপা গাল ভরাট হয়েছে, শরীরও আগের চেয়ে খানিকটা মোটা হয়েছে, চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়েছে, পেটটা সামনের দিকে সামান্য ফুলে ফেঁপে উঠেছে, সাথে চালচলনে এসেছে এক স্বাভাবিক মন্থরতা।
অপরদিকে মানুষিক প্রশান্তি... যা নেই বললেই চলে। থাকবেই বা কি করে! যে মেয়ের স্বামী বিয়ের ৪ মাসের মাথায় নতুন মেয়েকে নিয়ে পরকিয়ায় মেতে উঠে তার আর যাই থাকুক, মানুষিক প্রশান্তি থাকার কথাও নয়। সারা রাতদিন তৃষ্ণার কাটে নিঃসঙ্গতায়। সব নিজ চোখে দেখেশুনেও সে দীর্ঘশ্বাস এবং চোখের জল ছাড়া আর কিছু ফেলতে পারে না। মাঝেমাঝে তো মন বলে, দরকার কি এসব সহ্য করার! পেটে বাচ্চা ধরেছে বলে কেন এসব সহ্য করবে সে! কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার সব হিসেব গুলিয়ে যায়। লোকে কি বলবে! আর সে নিজেও তো ছেড়ে থাকতে পারবে না মাহসানকে.. এক মায়াজালে জড়িয়ে ফেলেছে মাহসান তাকে। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় রাতের পর রাত...

কোনো কাজে নিজের মন সায় না দিলে সে কাজ কখনওই করতে হয় না। আর করলেও তার ফল খারাপ হয়। যা নিজেকে দিয়েই প্রমাণিত সে। বারবার সে বাবাকে বলেছিল এখন বিয়ে করবে না। তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না এই বিয়েতে। অথচ বাবার যুক্তির কাছে হেরে বিয়েটা করতেই হলো তাকে। আর এখন যার ফল তার এই বর্ণহীন জীবন। কি পেল সে এই জীবনে! পাওয়াও তো ছিল অনেককিছু। কিন্তু সে পেল কি! সেইদিনই তার বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিল, যেদিন মাহসান সামান্য নাইটি নিয়ে কি বিশ্রী একটা নাটক করলো!! এই ছেলের চরিত্রে যে দোষ আছে, সেটা সেদিনই বোঝা উচিৎ ছিল তার। কিন্তু সে বুঝতে পারে নি। কেন পারলো না সে! বুঝলে কখনওই এত দূর আগাতো না। কিন্তু এখন এসব ভেবেই বা হবে টা কি! সে তো ভালোবেসে ফেলেছে মাহসানকে। কিভাবে পারলো সে চরিত্রহীন একটি লোককে ভালোবাসতে!! অবশ্য মাহসান তার স্বামী, তার অনাগত সন্তানের বাবা। এটাই কি ভালোবাসতে যথেষ্ট নয়? মন কে নানান কিছু বলে বুঝ দিলেও মন তো আজও কাঁদে মাহসানকে সম্পূর্ণ নিজের করে ফিরে পাবার জন্য। বরই অদ্ভুত মন তার। যেখানে মাহসানের জন্য ভালোবাসার কাছে তাকে করা ঘৃণার কোনো জায়গা নেই। এতোটা আবেগী হয়ে জন্মেছে কেন সে! বিধাতা তাকে আবেগহীন করে বানালে কি তেমন ক্ষতি হতো!!

-"তোমার আজ এপয়েন্টমেন্ট ছিল না ডক্টরের কাছে?"
মাহসানের কথায় চিন্তার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে এল তৃষ্ণা। মৃদু স্বরে বললো,
-"ছিল..."
-"তো রেডি হচ্ছো না কেন!"
-"হবো.."
-"তো হও! তোমার জন্য কি লেইট করবো আমি!"
-"তোমার সাথে যাবো সেটা কি একবারো বলেছি আমি!"
ভ্রু কুঁচকে মাহসান বললো,
-"তো কার সাথে যাবে?"
-"জানি না... তুমি যাও।"
-"ন্যাকামি টা কমাও। আর যাও, রেডি হয়ে নাও জলদি।"
মাহসানের কথায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। তারপর ধীরেধীরে মাহসানের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"প্লিজ,, সব ঠিক করে ফেলো। আগের মতো হয়ে যাও,, প্লিজ।"
-"কি ঠিক করে ফেলবো? আর আমি তো আমিই আছি। আগের আর পরের!! হোয়াট... ননসেন্স!!"
মাহসানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পেটে হাত রাখলো তৃষ্ণা। ভারি গলায় বললো,
-"ও তো কোন দোষ করে নি। বরং তুমিই চেয়েছিলে আমাদের বিয়ের একবছরের মাথায় আমাদের মাঝে নতুন কোনো সদস্য আসুক। তাহলে আজ ওর সাথে অন্যায় কেন করছো! ও তো তোমার নিজের রক্ত। আমার কথা না ভাবলে,, অন্ততপক্ষে ওর কথাটা ভাবো।"
-"এনাফ, তৃষ্ণা। তুমি এই কয়েকটা মাস হলো কি শুরু করেছো! হ্যাঁ! আজেবাজে কথা বলবে আর আমি সেগুলো মেনে নেব! আগেও বলেছি আর আজও বলছি, আমার সাথে অন্য কোনো মেয়ের কোনো রিলেশন নেই।"
চেঁচিয়ে উঠে তৃষ্ণা বললো,
-"তাহলে অতৈন্দ্রিলা কে?"
-"অফিস স্টাফ.. নাথিং এলস."
-"স্টাফের সাথে এতো কিসের মাখামাখি তোমার! আমাকে স্টাফ কি শিখাবে তুমি!"
-"তোমার মত চিপ মেন্টালিটির মেয়েকে কিছু শিখানোর ইচ্ছে আমার নেই।"
বলেই হাতে থাকা বডিস্প্রে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল মাহসান। তৃষ্ণা কিছুক্ষণ সেদিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর এগুলো শাশুড়ির ঘরের দিকে। ডাকছে বোধহয়। শান্তি বেগমের মৃদু কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসছে তার কানে।

-"বৌমা, বৌমা?"
-"জ্বি, আম্মা। বলেন..."
-"তোমার শ্বশুর কে আজ রাতেও দেখলাম। আমার পাশে শুয়ে বারবার বলতেছিল আমি বড় একা হয়ে গেছি...."
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শান্তি বেগম। তৃষ্ণা চুপচাপ এসে শাশুড়ির পাশে বললো,
-"আচ্ছা,, আর আপনি কি বললেন?"
-"বললাম, একা হবে কেন! তোমার পাশে আমি আছি। তিনটা ছেলেমেয়ে আছে। তখন উনি বললেন, না পাশে তিন ছেলেমেয়ে নেই। সবাই এখন যারযার মতো আলাদা হয়ে গেছে। একে অপরের চেয়ে অনেক দূরে চলে গেছে..."
-"অহ.."
-"পরে আমি বললাম, ওরা না থাকলো তোমার পাশে। আমি তো আছি। তখন তোমার শ্বশুর হেসে কি বললো জানো?"
-"কী বললেন?"
-"বললো, তুমিও আমার পাশে নেই..."
বেশকদিন হলো এমন অদ্ভুত আচরণ করছে শান্তি বেগম। তার কথার মূল বক্তব্য হলো, সে ইদানীং মহসিন চৌধুরী কে দেখতে পায়। তার পাশে এসে বসে, কথাবার্তা বলে, আবার  একদিন নাকি তাকে সাথে করে নারায়ণগঞ্জ ও নিয়ে গিয়েছিল। আর এসব উদ্ভট কথাবার্তা আবার চুপচাপ বসে শুনতে হয় তৃষ্ণার। কিই বা আর করবে সে! সারাদিন চুপচাপ একা বসে থাকার চেয়ে অসুস্থ শাশুড়ির পাশে বসে আজগুবি কথা শোনা ভালো। সময় তো অন্তত কাটে।

-"আম্মা, একটা কথা বলি?"
-"বলো, মা।"
-"আপনি সারাদিন বাবা আর মাহসান, অর্থিদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। যার ফলেই রাতে ঘুমালে এসব স্বপ্ন দেখেন।"
তৃষ্ণার কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো শান্তি বেগম। বিরক্তের দৃষ্টিতে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আমি বুঝি কোনটা সত্যি আর কোনটা স্বপ্ন।"
শাশুড়ির রাগমাখা মুখের দিকে তাকিয়েই মায়া হলো তৃষ্ণার। বাবা মারা যাবার পর কি হালটাই না হয়ে গেছে! চোয়াল ভেঙে নিচের দিকে নেমে এসেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। যেন কতো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে!
-"জ্বি, আম্মা।"
-"তোমার কত মাস যেনো চলছে?"
-"৬ মাস.."
-"তোমার শ্বশুর মারা গেছে কত মাস হলো?"
-"৪ মাস.."
-"অর্থি আর ঐতিহ্যর বিয়ের ও তাহলে ৪ মাস চলছে?"
-"হু..."
-"ওদের একটা বার ফোন করে আসতে বলবে? অসুস্থ মা কে একটাবার ওদের দেখতে মন চায় না?"
বলেই ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো শান্তি বেগম। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে সবাই স্বার্থপর। সবাই। নিজের জন্মদাতা পিতামাতা কে ভুলে যেতেও এরা সময় নেই না.....

তৌহিদ বিকেলে বাসায় ফিরে গোছল সেরে খেতে বসলো। আর সব দিনের মত আজ অর্থি তার পাশে নেই। দুপুরেই নাকি আজ খেয়ে নিয়েছে। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই করেছে। প্রতিদিন তৌহিদের জন্য অপেক্ষা করে একদম তৌহিদ ফিরলে একসাথে খায়। দুপুরের খাবার বিকেলে খাবার কোনো যৌক্তিক কারণ দিতে না পারলেও অর্থি প্রতিদিন এই কাজটা করে। তৌহিদ কি দুপুরে না খেয়ে থাকে নাকি! হালকা কিছু তো খেয়েই নেই। আর এতে একরকম অভ্যাসও হয়ে গেছে তৌহিদের। অথচ অর্থি এসব কিছু মানতে নারাজ। তার কথায় সে একদম অটল। অর্থির ভাষ্যমতে, ৩ টার খাবার দু ঘন্টা লেইট করে ৫ টায় খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

খাবার শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকলো তৌহিদ। ঘুমে কাঁদোকাঁদো হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে অর্থি। উপরের ফ্যান ঘুরছে ভনভনিয়ে। তবে গরম তেমন একটা কমাতে পারছে না। অর্থির নাক, ঠোঁটের উপর দিয়ে ফোটাফোটা ঘাম জমে রয়েছে। লোভাতুর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সেদিক তাকিয়ে থেকে তৌহিদ ঘরের দরজা বন্ধ করে এগুলো বিছানার দিকে। অর্থির পাশে শুয়ে দু হাতে নিজের দিকে টেনে আনলো তাকে। নিজের শরীরের সাথে পিশে ফেলে ঠোঁটে আলতো করে একটি চুমু দিতেই নড়েচড়ে উঠলো অর্থি। তৌহিদ কিছু সময় নিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো অর্থির দিকে। এই রূপবতী মেয়েটি কি সত্যিই তার পথ চলার সঙ্গী?

-"উফ! ছাড়ো। এই গরমের মধ্যে এভাবে ধরে রেখেছো কেন!"
ঘুমঘুম কণ্ঠে অর্থির এই কথা তৌহিদের কানে  পৌঁছতেই আরো গভীরভাবে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো তাকে।
-"ও আল্লাহ! মরে গেলাম। প্লিজ ছাড়ো আমারে!!"
শব্দ করে হেসে উঠলো তৌহিদ। বললো,
-"আজ আমার জন্য অপেক্ষা করলে না যে! খেতে বসে মিস করছিলাম তোমায়।"
-"আজ কাপড়চোপড় ধুয়ে খুব ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। তাই আর অপেক্ষা করিনি। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।"
-"তুমি ধুতে গেলে কেন! ময়নার মাকে দিয়ে ধোয়ালেই তো পারতে।"
-"উনি তো আজ আসেই নি।"
-"তো কাল আসলে কাল ধোয়াতে।"
-"সকাল সকালই তো কাপড় ভিজিয়ে দিয়েছিলাম ময়লা কাটার জন্য। ভেবেছিলাম ময়নার মা আসলে ধুয়ে দেবে। কিন্তু সে তো এলোই না। তাহলে ওই ভেজা কাপড়চোপড় কি দুই দিন ফেলে রাখতাম?"
-"আমি এসে ধুতাম।"
তৌহিদের কথায় ঠোঁটে হাসি ফুঠলো অর্থির। বললো,
-"থ্যাংকইউ সো মাচ। বাট আপনার হেল্প লাগবে না আমার। ছাড়ো এখন, ঘেমে একাকার হয়ে গেছি।"
হালকা ছাঁড় দিল তৌহিদ। বললো,
-"তৃষ্ণা কল করেছিল। তোমার সাথে কথা বলতে চাইলো। বারবার বলি একটা ফোন কিনে দেই, অথচ তুমি কানেই নাও না কথা। ফোন ছাড়া এ যুগে চলা যায় নাকি!"
-"যায়। আমি এমন ঠিক আছি। আর কিনতে হবে কেন নতুন ফোন। আমার তো ফোন আছেই। বাসায় গেলে নিয়ে আসবো। তো ভাবি কি বললো?"
-"যেতে বললো। তোমার মা নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা বলে। মাহসান ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ঔষধ দিয়েছে,, তবে অবস্থা তেমনই আছে।"
মন টা খারাপ হয়ে গেল অর্থির। সেই যে বাবা মারা যাবার সময় গিয়েছিল, সেটাই শেষ যাওয়া তার। মাঝেমাঝে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিলেও ওই বাড়িতে যাবার মতো কোনো ইচ্ছে হয় নি অর্থির। আর যাবেই বা কিভাবে! চারিদিকে শুধু বাবা, ভাইবোন দের নানান স্মৃতি ওই বাড়িতে। যার কেউই এখন আর তার জীবনে নেই। তাহলে শুধু ওই বাড়িতে যাবে কেন সে! ভাবতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের মুখ। বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে তার মাকে। বাবা মারা যাবার পর তাদের ভাই বোনের কি উচিৎ ছিল না তার মায়ের পাশে দাঁড়ানোর? কিন্তু তারা করেছে ঠিক তার উল্টোটা। তাকে বাবার স্মৃতিতে ভরপুর ওই বাড়িতে, ঘরে একা ফেলে রেখে এসে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে.....

-"কবে যাচ্ছি আমরা?"
-"তুমি যেতে চাও কবে?"
-"আজই যেতে চাই।"
তৌহিদ মুচকি হেসে বললো,
-"কোনো সমস্যা নেই। রেডি হয় নাও। সন্ধ্যার আগেই বেড়িয়ে পড়বো।"
-"থ্যাংকইউ। আচ্ছা, এবার আসার সময় আম্মাকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে আসতে পারি না? ভাবির ঘরটা তো খালিই পরে আছে।"
-"ভালো একটা কথা মনে করেছো। এখানে এসে কিছুদিন থাকলে হয়তো ভালো লাগবে তার।"
-"তাহলে নিয়ে আসবো আমরা?"
-"হু..."
-"আর তোমার বাবা?"
-"আমি ম্যানেজ করবো।"
তৌহিদের কথায় কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো অর্থি। বাবার উপর আজ সে কৃতজ্ঞ.. এমন একজন কে পথ চলার সঙ্গী করে দিয়ে যাবার জন্য। বাবার কথামত সেদিন বিয়েটা না করলে কখনওই তৌহিদের মত এমন একজন কে স্বামী হিসেবে পেত না সে। যে সব বিষয়েই শুরু থেকে সাপোর্ট দিয়ে আসছে তাকে। টাকাপয়সা আর শারীরিক দুর্বলতাই সব না। মনমানুষিকতা টাই সব চেয়ে বড়। সেটা এতদিন তৌহিদের সাথে থেকে, তার সংস্পর্শে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে অর্থি। আসলেই বাবা মা কখনওই সন্তানের খারাপ চায় না......
-"থ্যাংকইউ।"
-"তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে, ধন্যবাদ দেবার অভ্যাস টা বাদ দাও। না হয় তো সারাজীবন ধন্যবাদ দিতে দিতেই কেটে যাবে তোমার। কি? কথা মিলেছে তো?"
হাসলো অর্থি। বললো,
-"জ্বি,, মিলেছে।"
-"তাহলে উঠে পড় এখন, গোছগাছ করে নাও। তবে তার আগে একটা চুমু খাবো। বিশাল একটা চুমু। বিশেষ করো তোমার ঠোঁটের চারপাশের ফোটাফোটা ঘাম। আহ!! অনেকক্ষণ হলো ইচ্ছাটাকে মনের ভেতর পুষে রেখেছিলাম....."
বলেই অর্থির ঠোঁটে গাঢ় ভাবে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল তৌহিদ।

আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ঐতিহ্য। সব কিছু মেনে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা, উঠাবসা, খাওয়াদাওয়া করছে। ক্লাসেও যাচ্ছে নিয়মিত। তবে আগের চুপচাপ, লাজুক স্বভাবের ঐতিহ্যর সাথে কোনো মিল নেই বর্তমান ঐতিহ্যর। সাধারণ কোনো কথাতেই রেগে উঠা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেমন যেন একটা ক্যাটকেটে ভাব এসে গেছে তার চেহারায়। তবে যাই হোক,, আগের চেয়ে কিছুটা মোটা হয়েছে ঐতিহ্য। এখন আর শরীর ধরলে শুধু হাড্ডি খুঁজে পায় না নিহাল,, মাংসর কিছু অস্তিত্বও সেখানে মেলে। ভাবতেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো নিহালের। দিনে দিনে কি বড় বেশিই ক্যারেক্টারলেস হয়ে যাচ্ছে সে! অবশ্য হলেই বা কি! এসব চিন্তাভাবনা তো আর অন্যমেয়েকে নিয়ে না,, সবই তো তার নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে ঘিরে। এতে দোষের কিছু নেই.....

-"টেবিলে খাবার দিয়েছি। খেতে আসবে নাকি খাতা খেয়েই রাত পার করবে?"
ঐতিহ্যর উস্কানিমূলক কথায় হুশ ফিরলো নিহালের। বসে বসে খাতা দেখছিল নিহাল। হঠাৎ কিছু আবোলতাবোল ভাবনা মাথায় এসে ভর করেছিল। তারপর থেকেই খাতা দেখা বন্ধ করে রাজ্যের সব আজেবাজে জিনিশ নিয়ে চিন্তায় মেতে উঠেছিল। দিনে দিনে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে সে!!
-"আসছি,, দু মিনিট দাও। খাতাগুলো ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখে আসছি।"

খাবার টেবিলে এত পদের তরকারি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল নিহালের। ভাতের বদলে পোলাও দেখে তা রূপ নিল বিস্ময়ে। হঠাৎ রাতে এত কিছু রান্না করে ফেললো ঐতিহ্য? আজ কি কোনো স্পেশাল ডে??
-"বসো... দাঁড়িয়ে আছো কেন বলদের মতো?"
চেয়ারে বসতে বসতে নিহাল বললো,
-"হঠাৎ এসব কেন? মানে কোনো উপলক্ষে?"
-"কেন! মাঝেমাঝে ভালো কিছু খেতে উপলক্ষ লাগে নাকি!"
-"না,, সেটা বলছি না।"
-"হু,, কিছুই বলতে হবে না। চুপচাপ খেতে বসে যাও।"
খাবার মুখে দিয়েই মুগ্ধ কণ্ঠে নিহাল বললো,
-"দারুণ হয়েছে।"
-"ধন্যবাদ।"
-"হু,,তো কি ভাবলে তোমাদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে? তৃষ্ণা ভাবি এতবার করে বললো.."
-"যাচ্ছি না।"
-"এটা কিন্তু বাচ্চামি হয়ে যাচ্ছে, ঐতিহ্য। তোমার মা অসুস্থ। নিজে থেকে তো খোঁজখবর রাখোই না। আজ যখন ওরাই খবরটা দিল, তখন মেয়ে হিসেবে তোমার উচিৎ না একটাবার মা কে দেখে আসা?"
-"উচিৎ তো বাসা থেকে বেড়িয়ে আসাও ছিল না। কিন্তু এসেছি তো। তাই আপাতত উচিৎ অনুচিত নিয়ে ভাবি না।"
গলাটা উঁচু হয়ে এল নিহালের। বললো,
-"এতটা উদাসীন ভাব তোমার সাথে যায় না, ঐতিহ্য। যেহেতু মানুষ হয়ে জন্মেছো মানুষের মত ব্যবহার করো। কোনো পশুর সাথে নিজেকে গুলিয়ে ফেলো না।"
-"আমার ডিসিশন আমাকে নিতে দাও।"
আর কথা বাড়ালো না নিহাল। চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল। প্রচণ্ড রকমের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার ঐতিহ্যর উপর। একজন মানুষ কখনো এতটা আবেগহীন হতে পারে, যে কিনা একসময় আবেগে পরিপূর্ণ ছিল!!

-"আমি প্রেগন্যান্ট।"
হঠাৎ ঐতিহ্যর এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নিহাল। খাবার মুখে পুড়ে চুপচাপ বসে রইলো।
-"কি ব্যাপার? অতি খুশিতে পাথর হয়ে গেলে নাকি! তোমার চাওয়া তো পূর্ণ হয়ে গেল..."
ঢোক গিলে নিহাল বললো,
-"সত্যি? নাকি মজা করছো?"
-"এটা মজা করার মতো কোনো টপিক নাকি! আর শুধুশুধু মজাটাই বা কেনো করবো!"
-"হ্যাঁ,, তাইতো।"
-"হু.."
নিহাল কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। খুশিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবে? উঠে গিয়ে ঐতিহ্য কে জড়িয়ে ধরে মা হবার জন্য অভিনন্দন জানাবে? বাবামা, আত্মীয়স্বজন সবাইকে কল করে জানাবে? এসবের কিছুই করলো না নিহাল। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো খাবারে আবার মন দিল সে। যেন এটা তার কাছে বড় কোনো ব্যাপার না... সচরাচর এমন কিছু ঘটেই থাকে তার সাথে।

ঐতিহ্য কিছুসময় লক্ষ করলো নিহালকে। না, কোনো ভাবান্তর নেই। এতো বড় একটা খুশির খবর শোনার পর কিভাবে স্বাভাবিক আছে সে! নাকি ঐতিহ্যর মতোই সবটা মনের ভেতর রেখেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে নিহাল! কিন্তু,, না। এভাবে মোটেও ভালোলাগছে না নিহালকে। কিছু একটা করতে হবে যেন নিহাল খুশিটা নিজের মাঝে চেপে না রেখে বাইরে বের করে দেয়। কিন্তু কিভাবে? রাগিয়ে দেবে নিহালকে??

-"আবার ভেবো না, আমি প্রেগন্যান্ট বলে ডিভোর্স নিয়ে ভাববো না। বাচ্চা হবার দিন, বা পরেও তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে আমার বাধবে না।"
-"আচ্ছা,, যেও।"
বলে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো নিহাল। এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেল ওর? আর প্রতিদিনের মত তো আজ বললো না, যেতে দিলে তো! বরং বললো, আচ্ছা যেও। লেবু বেশি চিপলে যেমন তিতে হয়ে যায়। তেমন কিছু নিহালের বেলায় আবার হবে না তো! ডিভোর্সের কথাটা এখন তুলে হীতের বিপরীত হয়ে গেল নাকি! কি দরকার ছিল এখন এসব বলার! ভাবতেই নিজেকে আচ্ছামত গালাগাল করতে লাগলো ঐতিহ্য।

অর্থিকে দেখে আত্মায় পানি ফিরে এল শান্তি বেগমের। তার এই মেয়ে অসম্ভব রূপবতী। তবে এখন যেনো আরো বেশিই সুন্দর হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এই পৃথিবীর কেউ নয় সে। অন্য পৃথিবী থেকে এসেছে। এই পৃথিবীতে আছে নাকি তার ছোট মেয়ের মতো এত রূপবতী কোনো মেয়ে! মুগ্ধতা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার হৃদয় জুড়ে। ঠোঁটের হাসি যেন অর্থির এই সৌন্দর্য কে দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ হাসি কোনো লোকদেখানো হাসি নয়। বরং মনের অন্তস্থল থেকে বেড়িয়ে আসা হাসি... সুখে আছে তার মেয়ে। আর থাকবেই বা না কেন! ওর বাবা অনেক দেখেশুনে তৌহিদের হাতে তুলে দিয়েছিল ওকে। ওর বাবার নেয়া সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হয় না। এই যে মাহসানের জন্য শান্তশিষ্ট, ভদ্র একটা বৌ এনেছে। যে কখনওই বেয়াদবি করেনি তার সাথে। না হলে আজকালকার যুগের যা বৌ! কাজের চেয়ে মুখ বেশি চলে তাদের...

-"আম্মা? পায়েস খাবে?"
-"না।"
-"আমি নিজে বানাবো তুমি খেতে চাইলে।"
আগ্রহ নিয়ে শান্তি বেগম বললেন,
-"তুই আবার পায়েস রাঁধা শিখলি কবে?"
-"মা শিখিয়েছে। আর শুধু পায়েস না। আরো কিছু টুকিটাকি শিখিয়েছে। আম্মা, খাবে তুমি? করে দেই একটু?"
-"দে.. দেখি কেমন রান্না শিখলি।"
মায়ের উত্তরে বিছানা ছেড়ে উঠে অর্থি এগুলো রান্নাঘরের দিকে। সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন শান্তি বেগম। অনেক পালটে গেছে তার এই মেয়েটি। সংসারী হয়েছে, বুঝেশুঝে কথা বলতে শিখেছে। তবে সেই ঝটপটে রয়ে গেছে আগের মত। একজন মানুষ অপর একজন ভালো মানুষের সংস্পর্শে গেলে কতটাই না পরিবর্তন হয়! তার জীবন্ত উদাহরণ অর্থি এবং তৌহিদ। সারাজীবন এভাবেই সুখে থাকুক ওরা....

রাতের খাবার শেষে তার নিজের শোবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো অর্থি। এক সময় এই ঘরটাই তার সবকিছু ছিল। অতি সুখে চুপিচুপি হেসে উঠতো, কষ্টে বুক চেপে কাঁদতো এই ঘরে লুকিয়েই। আর এখন বড্ড অচেনা লাগছে ঘরটাকে। তবে এতোদিন পর নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় শরীর মেলে দিতে পেরে খারাপ লাগছে না। বরং খুব বেশিই ভালো লাগছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তৌহিদ অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
-"আম্মা খেয়েছে?"
-"হু,, ভাত খেতে চাচ্ছিল না। তাই পায়েস রেঁধে খাওয়ালাম। যতোটুকু দিয়েছিলাম পুরোটাই খেয়েছে।"
-"মেয়ের হাতের রান্না এই প্রথম খেলো তো তাই। খেয়ে কিছু বললো না?"
-"উহু,, তবে কাঁদছিল। আম্মাকে কিন্তু এবার সাথে করে কিন্তু নিয়ে যাব আমরা।"
-"হু,, যাবো তো। আচ্ছা,, তোমার ফোনটা বের করে রাখো। নিয়ে যাবে এবার। কোর্টে গিয়ে বাবার ফোনে কল করে তোমাকে চাইতে অস্বস্তি লাগে।"
হাসলো অর্থি। বললো,
-"ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ারেই আছে। বের করো।"
তৌহিদ ফোন বের করে দেখলো ফোন অফ হয়ে আছে। প্রায় চারমাসের মত এভাবে ড্রয়ারে পড়ে রয়েছে ফোনটা। অফ হয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই ফোন না খুলেই চার্জে দিয়ে বিছানায় আসলো তৌহিদ। চার্জ হোক, কাল সকালে অন করলেই হবে।
তৌহিদ বিছানায় আসতেই তৌহিদের বুকে মাথা রাখলো অর্থি। বললো,
-"তুমি আমাকে রেখে কবে চলে যাবে বাড়িতে?"
অর্থির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তৌহিদ বললো,
-"যাবো না। ডেইলি এখান থেকেই কোর্টে যাবো আসবো।"
-"ডেইলি এইভাবে জার্নি করবা!"
-"হু, করবো। সমস্যা তো নেই।"
ঠোঁট টিপে হেসে অর্থি বললো,
-"কেন! রাতে বউ ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না? কষ্ট হয়?"
-"হ্যাঁ,, হয় হয়তো... তবে বিয়ের পর আমি এখনো বউ ছাড়া রাত কাটাইনি। প্রতি রাতেই পাশ ফিরে বউ কে পাশে পেয়েছি। তাই বিয়ের পর বউহীন রাত ঠিক কতোটা বিরহের সেটা আপাতত উপলব্ধি করতে পারছি না।"

     (চলবে)

""সম্পর্কের_টান""

 পর্ব-২২

একা একা ঘরে বসে সময় কাটাতে একদম ভালো লাগছে না তৃষ্ণার। কিন্তু করারও তো তেমন কিছু নেই। চুপচাপ বসে টিভি দেখতেও বিরক্ত লাগে। গল্পের বই নিয়ে বসলেও মাথা ধরে যায়। একবার মার ঘরে যাবে কি! না, থাক। কিছুক্ষণ আগেই সেখান থেকে উঠে ঘরে এসেছে। সারাদিন এক কথা শুনাতে শুনাতে একদম মাথা ধরিয়ে দেয়। বাবা নাকি তাকে নিয়ে যাবে তার কাছে! এটা কি আদৌ বিশ্বাস যোগ্য কথা? এমন হাজারো কথা বলে সারাদিন। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই,, শুনতেও বিরক্ত লাগে। মার ঘরে গিয়ে মাথা ধরানোর চেয়ে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকা ভালো। কিন্তু এভাবে বসে থাকতেও তো ভালো লাগে না। একবার ফেসবুকে যাবে কি! যাওয়া যায়। লাস্ট কবে গিয়েছিল সেটাই মনে করতে পারছে না...

ফেসবুকে লগ ইন করতেই বিস্মৃত হয়ে গেল তৃষ্ণা। ফেসবুক ফ্রেন্ডদের উইশ দিয়ে ভরে আছে পুরো প্রোফাইল। আজ তার জন্মদিন! অথচ তার নিজেরই মনে নেই! অবশ্য মনে থাকবার কথাও নয়। মনে শান্তি থাকলে জন্মদিন কেন ছোটছোট অনেক ডেটও মনে থাকে। অপরদিকে কেউ মনে করিয়েও দেয় নি। না মাহসান, না তার ভাই। মাহসানের কাছে এসব কিছুর আশা না থাকলেও ভাইয়া তো একটাবার উইশ করতে পারতো! কিন্তু সেও তো করে নি। সবাই তাই এভাবে ভুলে যেতে পারলো দিনটার কথা? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো তৃষ্ণা। মন খারাপ করবে না সে। সে তো আর বাচ্চা নেই... অনেকটা বড় হয়েছে। তাহলে এখন আবার কিসের জন্মদিন!!!

শার্ট গায়ে পড়তে পড়তে তৌহিদ বললো,
-"বাইরের কাওকে কিছু বলার দরকার নেই। শুধু আমরা যারা যারা আছি তাদের নিয়েই ছোটখাটো একটা পার্টি হবে.."
-"আচ্ছা,, তবে তুমি কাল আমায় বললে আমরা সাথে করে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাবা আর মা কেও নিয়ে আসতে পারতাম। ভাবিরও ভালো লাগতো।"
-"আমার নিজেরই মনে ছিল না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর মনে হইছে। তখন একবার ভাবলাম যেয়ে উইশ টা করে আসি। কিন্তু তুমিই তো.."
তৌহিদকে থামিয়ে অর্থি বললো,
-"সারপ্রাইজের স ও জানো না তুমি! সব চিন্তাভাবনা আগের যুগের মতো! একদম সন্ধ্যায় যখন ভাবি এসব দেখবে তখন শুধু ভাবির রিয়াকশন টা দেখবা। বুঝতে পারবা সারপ্রাইজ জিনিশটা কি! এখন ঠিক যতটুকো মন খারাপ করে বসে আছে তখন এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খুশি হবে।"
-"অপেক্ষায় থাকলাম..."
-"ধন্যবাদ, এখন চলুন। অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে।"

বাসা থেকে বের হতেই তৃষ্ণার সামনাসামনি পড়লো অর্থি এবং তৌহিদ। তৃষ্ণা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। যেখানে যাচ্ছে যাক। কৈফিয়ত চাওয়াটা একদম বাজে দেখায়। আর মোটকথা ওরা দুজন স্বামী স্ত্রী,, কোনো গার্ল্ফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড নয়। পড়ন্ত বিকেলে সঙ্গীকে সাথে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়ে দুষ্টুমিষ্টি প্রেম করার অধিকার তাদের আছে। সব স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কই তো আর তার আর মাহসানের মত নয়.......

সন্ধ্যার আগে আগেই বাসায় ফিরে এল অর্থি এবং তৌহিদ। হাতে থাকা শপিং ব্যাগ গুলো তৌহিদের হাতে দিয়ে অর্থি বললো,
-"তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি দেখে আসি ভাবি কি করছে.."

এই ভরা সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে আছে তৃষ্ণা। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। যাক,, ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। এর মাঝে যা যা করার সব করে নিতে পারবে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে অর্থি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ঝটপট কাজে লেগে পড়লো।

অর্থি বাড়ি এসেছে অনেকদিন পর। ভাই হিসেবে বোনদের জন্য তেমন কিছু একটা করতে পারে নি মাহসান। তবে তাদের জন্য ভালোবাসা, আদর, স্নেহ কোনোদিক দিয়ে কমেনি। অর্থি নারায়ণগঞ্জ থাকার ফলে সেখানে গিয়ে খোঁজখবর না নিলেও ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ ঠিকই রাখে সে। অপরদিকে ঐতিহ্য ঢাকার মাঝেই থাকার কারণে প্রায়ই গিয়ে দেখে আসে তাকে মাহসান। ঐতিহ্য এই যাওয়া নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ না দেখালেও সে প্রায়ই হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয় তাদের ফ্লাটে। বোন রাগ দেখালেও ভাই হিসেবে তার উচিৎ রাগকে পাত্তা না দেয়া। অবশ্য এটা ঐতিহ্যর রাগও নয়,, অভিমান। আর সে এই অভিমান ভাঙিয়েই ছাড়বে.... অর্থিকে সময় দিতেই আজ সন্ধ্যার ভেতরই বাসায় চলে আসলো মাহসান। আড্ডা দেয়া হয় না অনেকদিন হলো। আজ জম্পেশ আড্ডা দেয়া যাবে!

বাসায় ঢুকতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো মাহসান। ড্রইং রুম সাজানো কেন! আর কেইবা সাজালো? ড্রইং রুমটা সাজানো হয়েছে হরেক রকমের আলো দিয়ে। এক রঙের আলো জ্বলছে তো আরেক রঙের আলো নিভছে। দেখতে দারুণ লাগছে। সবসময় এভাবে ড্রইংরুম টা সাজিয়ে রাখলে কিন্তু মন্দ হয় না!!

-"ভাইয়া? এত দেরি করে ফিরলে যে! আমি আরো ভাবছিলাম বিকেলে হয়তো ভাবিকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বা খেতে যাবে!"
পিছন ফিরে অর্থির দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো মাহসান। বললো,
-"হঠাৎ ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবার কি হলো!"
-"আরে!! হঠাৎ হবে কেন! আর দেখি ভাবির জন্য কি এনেছো? হাতে তো কিছুই দেখছি না.. নাকি আগেই দিয়ে দিয়েছো গিফট!"
-"গিফট কেন?"
-"তো গিফট দেবে না! স্পেশাল ডে তে স্পেশাল মানুষের কাছ থেকে গিফট পাবার মত আনন্দের আর কিছু আছে!"
অর্থির কথার আগামাথা গোড়া কিছুই মাথায় ঢুকছে না মাহসানের। মেয়েটা কি তৌহিদের সাথে থেকে থেকে পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি!
-"তুই ঠিক আছিস? আজেবাজে কি সব বকছিস! কিসের স্পেশাল ডে!"
মাহসানের কথায় হতবাক হয়ে অর্থি বললো,
-"আজ ভাবির বার্থডে, এটা জানো না তুমি!"
মাহসানের বিস্মিত গলায় বললো,
-"আজ তৃষ্ণার বার্থডে!!"
-"হু,, জানো না তুমি?"
-"না তো,, তৃষ্ণা তো আমাকে কিছু বলে নি।"
অর্থির আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু একটা সমস্যা হয়েছে মাহসান এবং তৃষ্ণার মাঝে। কিন্তু কি এমন সমস্যা, যে সবচেয়ে কাছের মানুষের প্রিয় কিছু মুহূর্তের কথাও অন্যজনের কাছে অজানা!! ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অর্থি বললো,
-"ভাবির জানাতে হবে কেন! একজন হাজবেন্ড হিসেবে কি তোমার উচিৎ ছিল না এসব বিষয়ে নিজে থেকে জানা?"
অর্থির প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে মাহসান বললো,
-"আচ্ছা থাক,, ফ্রেশ হয়ে আসি। সারাদিন যা প্যাড়ার মধ্যে ছিলাম!"
-"যাও। আর হ্যাঁ, জানি না কি হয়েছে তোমাদের মাঝে। তবে যাই হোক না কেন আমি শুধু এটাই বলবো, সবসময় চেষ্টা করবে বাবার মতো একজন হাসবেন্ড হতে। আম্মাকে কতোটা ভালোবাসতো বাবা সেটা তোমার বা আমার কারো অজানা নয়। তাই আমি এটুকুই আশা করবো, বাবার একমাত্র ছেলে যেন বাবার এই গুণ টি পায়। যাকগে তুমি ভাবিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সাথে এখানে নিয়ে এসো। আমি কেক ঠিক করছি।"

রুমে ঢুকেই কোর্ট খুলে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেললো মাহসান। রাগে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আজ তৃষ্ণার জন্মদিন সেটা তৃষ্ণার ওকে জানালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো! তাহলে হয়তো আজ এভাবে তারই ছোটবোন অর্থি তাকে এভাবে অপমান করতে পারতো না। বিছানায় একপাশে বসে নিজের রাগ কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো মাহসান। না, হচ্ছে না। ক্রমে যেনো আরো বেড়ে যাচ্ছে। ঘুমন্ত তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকটি নিশ্বাস ছাড়লো মাহসান। উহু,, হচ্ছে না কোনোভাবেই। কি করা উচিৎ এখন তার?? হঠাৎ হাত ধরে হেচকা টানে ঘুমন্ত তৃষ্ণাকে শোয়া থেকে উঠে বসালো মাহসান। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে জানতে চাইলো,
-"তোর আজ বার্থডে?"
হঠাৎ এভাবে গভীর ঘুম থেকে জাগা পেয়ে ঘুমন্ত অবাক দৃষ্টিতে তৃষ্ণা তাকিয়ে আছে মাহসানের দিকে। হৃদস্পন্দন ঘনঘন উঠা নামা করছে, ধীরেধীরে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, পেটের মাঝখানটায় হঠাৎ চাপ পরায় তীব্র ব্যাথা হচ্ছে, মাথাটার ভেতরটাও দপদপ করছে। অসহ্য এক যন্ত্রনায় হচ্ছে পুরো শরীর জুড়ে। আচ্ছা!! সে কি মারা যাচ্ছে??
-"কথা কানে যায় না?"
কিছু না বুঝেই ঢোক গিলে তৃষ্ণা বললো,
-"হু.."
-"তুই জানিস, তুই কি পরিমাণের একটা স্টুপিড! আমি তোর কি? হাজবেন্ড না? তোর বাচ্চার বাপ না?"
-"হু..."
-"তাইলে আজ যে তোর মতো স্টুপিড একটা মেয়ে এই দুনিয়ায় আসছে সেটা আমাকে জানাস নি কেন? আমাকে আমার বোনকে দিয়ে অপমান করানোর খুব ইচ্ছা.. না? খুব মজা পাস আমাকে অপমান করিয়ে?"
বলেই তৃষ্ণার গাল চেপে ধরলো মাহসান। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে ধরে কড়া গলায় বললো,
-"তুই জানতে চাইছিলি না, অতৈন্দ্রিলা কে? শোন তাইলে,, অতৈন্দ্রিলা আমার গার্ল্ফ্রেন্ড। শুধু গার্ল্ফ্রেন্ড না,, আমার বেড পার্টনার ও। দিনরাত মিলে হাজার বার বেডে যাই ওর সাথে। ও আমাকে যে সুখ দেয়, তার এক পার্সেন্ট সুখও তুই আমাকে কখনো বেডে দিতে পারোস নাই। তোর নিজের দিকে তাকাইয়া দেখ। বাঁশের চেয়ে কোনো অংশে কম না তুই। আর অতৈন্দ্রিলা,, ফিগার দেখলেই সেক্স উইঠা যায়। ড্রেসআপ দেখছোস? দেখ,, বইসা বইসা ওরে দেখ আর নিজের দিকে তাকা। বুঝতে পারবি আজকের যুগে তোর দাম কত..."
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল মাহসান। তৃষ্ণা ফোন হাতে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। সুন্দর বললে ভুল হবে,, খুব সুন্দর। মাহসানের পাশে অতৈন্দ্রিলার মতোই কাওকে মানায়,, ওর মতো কোনো মেয়েকে না। কিন্তু তাতে ওর নিজের এত খারাপ লাগছে কেন! বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে বাইরে। চোখ দুটিও ঝাপসা হয়ে এসেছে, ভেতরে প্রচণ্ড জ্বলছেও। গালটা বারবার ভিজে যাচ্ছে কেন! সে কি কাঁদছে!! এমন অস্থির লাগছে কেন! নিশ্বাস নিতেও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তীব্র এক যন্ত্রণা এসে বারবার গলা টিপে ধরছে...............

   (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ