সম্পর্কের টান । পর্ব-৪৫+৪৬


সম্পর্কের টান
পর্ব-৪৫+৪৬

আজকাল ঐতিহ্যর শরীর বেশি একটা ভালো যাচ্ছে না। রাতে ঘুম হয় না, বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করেই কাটিয়ে দিতে হয় পুরো রাত। ঠিকঠাক মতো কিছু খেতেও পারে না। টুকটাক যাই খায়, পরমুহূর্তে সেটাই বমি হয়ে বেড়িয়ে যায়। তারপরও চাপা গাল ভরাট হয়েছে, শরীরও আগের চেয়ে খানিকটা মোটা হয়েছে, চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়েছে, পেটটা সামনের দিকে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, সাথে চালচলনে এসেছে এক অস্বাভাবিক মন্থরতা। তবে জিদ টা আগের তুলনায় আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। খ্যাটখ্যাটে মেজাজ, সারাদিন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে চিল্লাফাল্লা করা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব বিষয়কে নিজের মত করে সামাল দিচ্ছে নিহাল। কারণ, ঐতিহ্য কে দেখানো ডাক্তারের মতে,,, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন এর পাশাপাশি মানুষিক পরিবর্তনও হয়। মেজাজ খিটখিটে হওয়াটা এই অবস্থায় স্বাভাবিক। আর তাই প্রত্যেক স্বামীর উচিৎ এই সময় তার স্ত্রীর এই দিকটার উপর নজর না দেওয়া, তার এই ধরনের কথায় গুরুত্ব না দেয়া। কারণ এতে শুধু সংসারে বাড়ে অশান্তি সাথে বাড়ে মানুষিক চাপ। যা আপনাদের অনাগত সন্তানের জন্য ক্ষতিকর। এর পাশাপাশি আপনার স্ত্রী মানুষিক ভাবেও সুস্থ নয়। উনার বাবা মারা যাবার পর থেকে উনি নানান মানুষিক চাপেয় মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজেকে দোষী হিসেবে মেনে নিয়ে নানান রকমের শাস্তি দিচ্ছিলেন নিজেকে, আপনার কাছ থেকে আলাদা হতেও চেয়েছিলেন। মোট কথা উনি মানুষিক ভাবে অসুস্থ। এই অবস্থায়ই তার শরীরের মাঝে আর একটা নতুন প্রাণ ধীরেধীরে বাড়ছে। এটা কিন্তু আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। যাই হোক, এমন অনেক কম্পলিকেশনই আসবে  প্রেগনেন্সিতে। তবে এস এ ডক্টর আমি আপনাকে এটাই সাজেস্ট করবো, হাজবেন্ড হিসেবে সবসময় আপনার স্ত্রীর পাশে থাকবেন, সাপোর্ট দেবেন। যতোটা পারবেন কেয়ার নেবেন, চেঁচামেচি করলে সেটাতে রিয়াক্ট করবেন না। এবং অতি শীঘ্রই একজন সাইক্রাটিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন আপনার স্ত্রীকে।

-"এই,,, তোমার এফবি আইডির ফ্রেন্ড লিস্টে শরমি এল কি করে?"
ভার্সিটি থেকে ফিরে দুপুরের খাবার গরম করছিল নিহাল। হঠাৎ ঐতিহ্যর চিৎকার শুনে রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল সে। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"জানি না তো। আছে নাকি শরমি আমার ফ্রেন্ড লিস্টে?"
-"একদম হাবলা সাজবা না... তোমার ফ্রেন্ড লিস্টে শরমি আছে নাকি সেটাই তুমি জানো না? বোকা পাইছো আমারো? তোমার কি মনে হয় এখনো আমি ফিডার খাই?"
-"সত্যিই জানি না। দেখি কই আমাকে দেখাও।"
-"দেখবা মানে! আমার কথায় তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি মিথ্যে বলি?"
নিহাল খানিকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, সে আসলেই কি কখনো শরমিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল নাকি শরমির পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টই এক্সেপ্ট করেছিল? না.. তার যতটুকু মনে পড়ছে, তাতে সে কখনওই এ কাজ গুলো করে নি। তাহলে কি ভুলেই কখনো স্ক্রিনে টাচ লেগে এমন টা হয়েছে? হতেই পারে... অসম্ভব কিছু না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিহাল বললো,
-"হয়তো ভুলে কখনো স্ক্রিনে টাচ লেগে হয়ে গেছে।"
নিহালের কথায় আরো ফুঁসে উঠলো ঐতিহ্য। দাপুটে গলায় বললো,
-"ভুল আবার কি? হ্যাঁ? ভুল কি? আমার তো কখনো ভুল হয় না। তোমার কেন হবে? আর হবে তো হবেই শরমির আইডির সাথেই বা কেনো হবে? আর এই শরমিটাও কি লুচ্চি! তোমাকে আবার ম্যাসেজও পাঠিয়েছে। দেখো একবার ম্যাসেজের ছিঁড়িটা! এটা কোনো স্টুডেন্টের ম্যাসেজ? শালীর এত সাহস হয় কিভাবে? তুমি সাহস না দিলে ও কখনওই এতটা সাহস পাবে না। তুমি পাত্তা দিয়েছো বলেই ও এসব করার সাহস পাচ্ছে। আমি এটা বুঝতে পারছি না, দেশে কি আনম্যারিড ছেলের আকাল পড়েছে যে ও ম্যারিড একজনের পেছনে এভাবে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে লেগেছে!!"
কথাগুলো লাগাতার বলায় দম নিতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছিল ঐতিহ্যর। তাই কথা শেষ হবা মাত্রই সে সোফায় বসে পড়লো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হাতে থাকা নিহালের ফোন ফ্লোরে ফেলে জোরেজোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করে দিল সে। হঠাৎ ঐতিহ্যর অবস্থা এভাবে খারাপ হতে দেখে তার দিকে দৌড়ে এগুলো নিহাল। পাশে বসে ভয়ার্ত গলায় বলতে লাগলো,
-"ঐতি? কি হলো? ঠিক আছো তুমি?"
-"আমি ঠিক আছি। পানি খাবো।"
ঐতিহ্য পানি চাইতেই তাড়াহুড়ো করে পানি এনে ঐতিহ্য কে দিল নিহাল। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছে সে। কি রেখে এখন কি করা উচিৎ সেটা মোটেও মাথায় আসছে না তার। একবার কি ডক্টর কে কল করবে? নাকি ঐতিহ্য কেই সরাসরি চেম্বারে নিয়ে যাবে?
-"আমাকে ধরে রুমে দিয়ে আসো। কিছুক্ষণ শুয়ে রেস্ট নেব।"
ঐতিহ্যর কথার পিঠে কোনো কথা বললো না নিহাল। চুপচাপ ঐতিহ্য কে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেও বসলো ঐতিহ্যর মাথার পাশে। একাএকা আর এসব পেরে উঠছে না সে। আবার এই অবস্থায় ঐতিহ্য কে রাজশাহী তে বাবামার কাছেও পাঠানো যাচ্ছে না। আর না মা কেও ঢাকায় তাদের এখানে এনে কিছুদিন রাখা যাচ্ছে। ঐতিহ্যর এমন ব্যবহার সে সহ্য করলেও তার মা সহ্য করবেন না। প্রথমদিন কিছু না বললেও দ্বিতীয় দিন হয়তো কিছু বলবেন। অপরদিকে ঐতিহ্য ও চুপ থাকবে না। লেগে যাবে কুরুক্ষেত্র.... ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐতিহ্যর মাথায় হাত রাখলো নিহাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো, অর্থিকে নিয়ে এলে কেমন হয়? অর্থি তো আর বোনের এমন ব্যবহারের সাথে অপরিচিত নয়! তবে অর্থিও নিজের সংসার ফেলে রেখে এখানে এসে কয়দিন পড়ে থাকবে? মাত্র প্রেগন্যান্সিতে ছয় মাস চলছে ঐতিহ্যর...

প্রায় আধাঘণ্টার মত হলো মুহিব এসেছে তৌহিদদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য সঞ্চিতার বিয়ে। তবে আগের মত চঞ্চলতা টা আর তার মাঝে নেই। আসার পর থেকেই একাএকা চুপচাপ বসে রয়েছে ড্রইংরুমে। অর্থি তাকে সঙ্গ দেবার জন্যই ঢুকলো ড্রইং রুমে। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"কি ব্যাপার? এভাবে একা বসে আছেন যে?"
অর্থির কথায় নড়েচড়ে বসলো মুহিব। ম্লান হেসে বললো,
-"বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। আসবে কখন ও?"
-"রোজ তো পাঁচ টার মাঝেই চলে আসে। আজ যে কেন এত দেরি হচ্ছে। কল দিলাম তবে রিসিভ করলো না। কোনো কাজে আটকা পড়েছে হয়তো। আপনি ওর জন্য অপেক্ষা না করে আপনার রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।"
-"না,, থাক। ঠিক আছি আমি। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম।"
-"অবশ্যই... বলুন না!"
-"রায়ানের ব্যাপারটা তৌহিদকে জানিয়েছো?"
রায়ানের কথা আসতেই অর্থি গম্ভীর মুখে বললো,
-"বলেছি। তবে শুধু বিয়ের আগে ফেসবুকে টুকটাক চ্যাট হতো.... এতোটুকুই। আসলে আমি চাই না আপনার আর তৌহিদের মাঝের ফ্রেন্ডশিপ টা থার্ড পারসোনের একটা নোংরা কাজের ফলে নষ্ট হয়ে যাক।"
-"আমাদের ফ্রেন্ডশিপ টা এতোটাও দূর্বল নয়। আমার মনে হয় তোমার তৌহিদকে...."
কথা শেষ করবার আগেই তৃষ্ণার আগমন ঘটলো ড্রইংরুমে। হাসি মুখে অর্থির পাশে বসতে বসতে মুহিবের উদ্দেশ্যে বললো,
-"কেমন আছেন মুহিব ভাই?"
-"ভালো... তুমি? তনয়?"
-"আমরা মা ছেলেও বিন্দাস আছি। তা কখন এলেন?"
-"এই তো কিছুক্ষণ হলো।"
-"আচ্ছা.. তোমরা বসে গল্প করো। আমি চা নিয়ে আসি... কেমন?"
অর্থি চা আনতে ড্রইংরুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই মুহিব কিছুটা এগিয়ে এল তৃষ্ণার দিকে। আদুরে গলায় বললো,
-"আমার একটা কথা রাখবে, তৃষ্ণা?"
-"রাখার মত হলে অবশ্যই রাখবো।"
-"রাখার মতই হবে। আমি অবশ্যই এমন কিছু তোমাকে করতে বলবো না, যা রাখা তোমার পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না।"
মুহিবের কথায় নিজেকে কিছুটা ছোট মনে হলো তৃষ্ণার। ছোট হবার মতই কোনো কথা বলেছে কি মুহিব ভাই? না.. তাহলে এতোটা কষ্ট হচ্ছে কেন তার?
মুহিব ব্যাগ থেকে একটি শপিং ব্যাগ বের করে এনে আবারো বসলো সোফায়। শপিং ব্যাগটি তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মুহিব তৃষ্ণার দিকে।
অপরদিকে মুহিবের হাতের শপিং ব্যাগটি দেখেই বুকটা কেপে উঠলো তৃষ্ণার। মনে পড়ে গেল বিয়ের পরের দিনের কথা। মাহসান এমন একটি শপিং ব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। তাতে ছিল নাইটি... যা নিয়ে কত কাহিনীই না ঘটে গিয়েছিল এক রাতে!!
-"এতে লাল কাতান শাড়ি রয়েছে তৃষ্ণা। আমি চাই তুমি শাড়িটা সঞ্চিতার বিয়ের দিনে পড়ো। কি... পড়বে না?"
-"পড়বো..."
কথাটি বলতেই তৃষ্ণার চোখের কোণা বেয়ে বেড়িয়ে এল একফোঁটা জল।

   (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৪৬

পুরানো আমলের এক তলা বাড়ি, সামনে বিশাল আকৃতির এক উঠান। উঠানের মাঝবরাবর তুলসীমঞ্চ, যা ইট সিমেন্টে বাধানো। তুলসীমঞ্চ থেকে সোজাসুজিভাবে সামনে এগুতেই বেশ বড়সড় একটি মন্দির। তাতে রাখা নানান ধরনের দেবদেবী মূর্তি। মন্দিরের সামনেই অবাক চোখে দাঁড়িয়ে মুহিব দেখতে লাগলো মন্দিরের ভেতরটা। এতটা জায়গা জুড়ে মন্দির! তাও বাড়িতে? কারো বাড়িতে এত বড় মন্দির থাকতে পারে তা নিয়ে সামান্য ধারণাও ছিল না মুহিবের। অবশ্য তার তেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর লোকজনদের সাথে পরিচয়ও নেই। তাতে এসব না জানবারই কথা। তবে যাই হোক না কেন, সে হতভম্ব! সে মুগ্ধ! অনেককাল আগের পুরাতন এই বাড়ির সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ....
-"তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো বাবা? ভেতরে যাও,, ভেতরে সঞ্চিদের সাথে গিয়ে বসো।"
হঠাৎ মোটা পুরুষালী এক কন্ঠ মুহিবের কানে আসাতে পেছন ফিরে তাকাতেই মোটা বেঁটেখাটো ভূড়িওয়ালা এক লোককে দেখতে পেল সে। পরনে হালকা সবুজ রঙের ধুতি পাঞ্জাবি। বয়স বোধহয় ষাটের ঘর পেরিয়েছে বা ছুঁইছুঁই করছে। মাথায় আধকাচা আধপাকা চুল। তার দিকে তাকিয়েই ঠোঁটে কিছুটা হাসির রেখা এনে মুহিব বললো,
-"জ্বি,, যাচ্ছি...আমি যদি ভুল না করি তাহলে আপনি সঞ্চিতার জ্যাঠা শ্যামল মুখার্জি।"
-"তুমি ভূল করোনি।"
-"তা জ্যাঠামশাই.. শরীর ভালো আপনার?"
-"এউ বয়সে আর শরীর! ভগবানের আশীর্বাদে যে বেঁচে আছি এই কি কম নয়!"
-"জ্বি... সেটা তো অবশ্যই।"
-"আচ্ছা,, বাবা যাও। ভেতরে যাও। আমরা আবার যাচ্ছি জয়কে আশীর্বাদের জন্য। আসলে হাতে সময় খুবই স্বল্প। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই ভগবান সঞ্চির জন্য যা ভালো মনে করবেন সেসবই আমাদের দিয়ে করাবেন। তবে বেশি কিছু করতে পারছি না মেয়েটার জন্য। মেয়েটা ছোটকাল থেকেই আমার এখান থেকে মানুষ!"
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্দিরের ভেতর দিকটায় এগুলেন শ্যামল মুখার্জি। প্রতিমা দর্শন করে মাথা ঠেকিয়ে বের হয়ে এসে আবারো মুহিবের উদ্দেশ্যে বললেন,
-"অহ.. হ্যাঁ শোনো। সঞ্চিকে গিয়ে বলবে জ্যাঠা বলেদিয়েছে মেহেদী টেহেদী সহ যা কিছু করার আজকের রাতের ভেতরেই সেরে ফেলতে।"
-"জ্বি বলবো।"
আরো কিছু বলতে চেয়েও বললেন না শ্যামল মুখার্জি। আপাতত তার এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। কত কাজ পড়ে আছে তার। বিয়ে বাড়ির কি কাজের শেষ আছে! একদিনের মাঝে সব কাজ ঠিকঠাক ভাবে শেষ করতে হবে। এবং কাজ গুলো এতটাই নিখুঁত ভাবে করতে হবে যাতে ছেলেপক্ষের মুখ থেকে কোনো ধরনের কথা শুনতে না হয় তাদের।

বাড়ির ভেতরে পাঁ দিতেই তৃষ্ণাকে দেখতে পেল মুহিব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি মহিলার সাথে কথা বলছে। সাথে কোলে তনয়। মাঝেমাঝে পাশে থাকা মহিলাটির কথায় খিলখিল করে হেসে উঠছে। কি অপূর্ব এক দৃশ্য!

-"এই যে মিস তৃষ্ণা?"
মুহিবের ডাকে পিছন ফিরল তৃষ্ণা। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"কি হয়েছে?"
-"তনয়কে আমার কাছে দাও। আর তুমি সঞ্চিতার রুমে যাও। তোমাকে ডাকছে।"
-"সঞ্চি ডাকছে?"
-"হু..."
তনয়কে মুহিবের কোলে দিয়েই সঞ্চিতার ঘরের দিকে পা বাড়ালো তৃষ্ণা। তবে বেশি একটা দূরে যেতে পারলো না। পেছন থেকে বাধা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে সে বললো,
-"কি হচ্ছে মুহিব ভাই! হাত ছাড়ুন।"
হঠাৎ তৃষ্ণার হাত ধরায় নিজেই অবাক হয়ে গেল মুহিব। সে তো ধরতে চায় নি তৃষ্ণার হাত এভাবে,, হঠাৎ করে কি হয়ে গেল তার! চটপট হাত ছেড়ে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে মুহিব বলতে লাগলো,
-"সরি,, সরি। সরি তৃষ্ণা। আমি আসলে..."
-"ইটস ওকে। আপনি এই দিকটাতেই থাকবেন তনয়কে নিয়ে। ওইদিকটায় প্রচণ্ড গানবাজনা হচ্ছে। এমন বিট দিয়েছে বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওইদিকটায় তনয়কে নিয়ে যাবেন না। আমি কিছুক্ষণের মাঝেই আসছি।"

তনয় কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। থামাথামির কোনো নাম নেই। কি এমন হলো বাচ্চাটার? এভাবে তো কখনো কাঁদে না। আর মুহিবের কোলে থাকলে তো কাঁদেই না। তাহলে আজ আবার কি হলো? ওদিকে তৃষ্ণাও গেছে তো গেছে, আসবার কোনো নাম নেই। ফোনও ধরছে না। তনয়কে নিয়েই কি একবার যাবে তৃষ্ণার কাছে? না.. ওইদিকটায় নিয়ে যেতে নিষেধ করেছে তৃষ্ণা। তাহলে এখন উপায়? এদিকে তনয়ের কাঁদা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এটাসেটা নানা জিনিশ বলে, বুঝিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। হলো টা কি বাচ্চাটার? আর কোনো উপায় না দেখে তনয়কে নিয়েই মুহিব এগুলো তৃষ্ণার খোঁজে সঞ্চিতার ঘরের দিকে।

বোলে চুড়িয়া বোলে কাঙ্গনা,
হায়ে মেয় হো গায়ি তেরি সাজনা,,
তেরে বিন জিয়া নেইয়ো লাগদা,
মেয় তো মারগায়িয়া....
লে জা লে জা সোনিয়া লে জা লে জা,
দিল লে জা লে জা হো..।।
হায়ে হায়ে মেইন মার যাওভা যাওভা তেরে বিন,
আব তো মেরে রাতে কাটতে তারে গিন গিন।
বাস তুঝকো পুকারা কারে,
মেরে বিন্দিয়া ইশারা কারে...

সাউন্ড বক্সের গানের তালেতালে নেচে যাচ্ছে তৃষ্ণা, সঞ্চিতা সহ অনেকে। তবে অনেককে দেখার মত কোনো ইচ্ছে নেই মুহিবের। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণার নাচছে? তৃষ্ণা? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না মুহিবের একদম। তাই এ পর্যায়ে আঙুল দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে নিল সে। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলো সে তৃষ্ণার দিকে। গানের তালে তালে হাত পা নিখুঁত ভাবে নাড়িয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা। দেখতে কি কোনো অংশে অপ্সরীদের চেয়ে কম লাগছে? আজ এই বিয়েতে না আসলে হয়তো তৃষ্ণার এমন একটা রূপ কখনো দেখতেই পেত না সে। বিয়ে অবশ্য পরের কথা, এখন এই মুহূর্তে তনয় না কাঁদলে কি সে তৃষ্ণার খোঁজে এখানে আসতো! তনয়ের কথা মনে হতেই সে তৃষ্ণার দিক থেকে নজর সরিয়ে কোলে থাকা তনয়ের দিকে দিল। না.. আর কাঁদছে না। কাঁদবে কি! এই ছেলে তো মায়ের দিকে তাকিয়ে তার সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা দিচ্ছে....

-"আরে আপনি? এই সময় এখানে? আমাদের অফিসে!"
মাহসান শরীফ আহমেদের মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
-"কেন? আসতে পারি না?"
-"না.. সেটা বলি নি। আসলে এটা একটা অফিস। আর এখানে..."
শরীফ আহমেদকে থামিয়ে মাহসান বললো,
-"দরকারেই এসেছি। শুধুশুধু আসি নি।"
শরীফ আহমেদ অবাক হবার ভান করে বললেন,
-"আমার এই ছোট্টমোট্ট কোম্পানি তে আপনার কাজ! শুনে বরই অবাক হলাম।"
-"অবাক হওয়াটা আপনার ব্যাপার। তো কাজের কথায় আসি।"
-"জ্বি,, হ্যাঁ। বলুন।"
-"আপনাদের রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তৃষ্ণা আজ অফিসে আসে নি.."
-"জ্বি। তৃষ্ণা ছুটিতে আছে।"
কিছুটা নড়েচড়ে বসলো মাহসান। পুরো রুমে চোখ বুলাতে বুলতে বললো,
-"ছুটি টা কেনো নিয়েছে জানতে পারি?"
-"অবশ্যই... তৃষ্ণার এক ফ্রেন্ডের বিয়ে।"
-"অহ.. তা ছুটি শেষ হবে কবে?"
-"পরশু।"
-"তাহলে তার পরের দিন আসলে ওকে পাবো?"
-"জ্বি.. পাবেন।"
-"থ্যাংকইউ।"
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মাহসান। শরীফ আহমেদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
-"আমার তৃষ্ণার নাম্বার টা লাগবে।"
মাহসানের সাথে হাত মিলিয়ে ম্লান হেসে শরীফ আহমেদ বললেন,
-"সরি,, আমি আসলে তৃষ্ণার অনুমতি ছাড়া ওর ব্যক্তিগত নাম্বারটা আপনাকে দিতে পারছি না।"
-"আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, তৃষ্ণা আমার ওয়াইফ।"
মাহসানের কথার পিঠে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় শরীফ আহমেদ বললেন,
-"তাহলে তো আপনার ফোনেই আপনার ওয়াইফের নাম্বার থাকা উচিৎ। তা নয় কি?"
কথা বাড়ালো না মাহসান। চুপচাপ বেড়িয়ে এল দোতালা ভবনটি থেকে।

      (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ