সম্পর্কের টান
পর্ব-৪৭+৪৮
-"আপনাকে দিয়ে আর যাই হোক প্রেম ভালোবাসা হবে না, মুহিব ভাই। এত ভয় পেলে চলে! তাও তৃষ্ণাকে! আপনি কিভাবে চোর বাটপার দের সায়েস্তা করেন তা ভগবানই জানে!"
-"উহু,, সঞ্চিতা। এটা ভয় নয়... যাকগে তুমি বুঝবে না।"
কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে সঞ্চিতা মুহিবের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে বললো,
-"আমার বুঝতে হবেও না, মুহিব ভাই। আপনি বুঝুন... আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে নিতে পারছেন না। অবশ্যই পারবেন কিভাবে! চেষ্টাই তো করছেন না।"
-"তেমন কিছু না, সঞ্চিতা। আমি তৃষ্ণাকে শুধুই সময় দিচ্ছি। আসলে ও এখন যে পরিস্থিতির মাঝে আছে, তাতে এসব এখন ও নিতে পারবে না। প্লাস একটা বিশ্বাসের ব্যাপারও রয়েছে। বারবার ঠকতে কে চায়.. বলো?"
মুহিবের কথা শুনে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো সঞ্চিতা। তনয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-"তনয়কে আমার কাছে দিন। আপনি বরং যান রাতের খাবার টা খেয়ে নিন।"
তনয়কে সঞ্চিতার কোলে দিয়ে ম্লান হাসলো মুহিব। বললো,
-"তুমি খেয়েছো?"
-"আমি পরে খাবো। আপনি যান তৃষ্ণাকে নিয়ে খেয়ে নিন। বেশি রাত হলে এদিকে গাড়িঘোড়া তেমন একটা পাওয়া যায় না।"
-"আচ্ছা।"
বলেই পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল মুহিব। সঞ্চিতার উদ্দেশ্যে বললো,
-"সব কিছুর জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ, সঞ্চিতা।"
হালকা হাসির রেখা ঠোঁটে ফুটিয়ে সঞ্চিতা বললো,
-"হুম... তবে মুহিব ভাই, তৃষ্ণাকে দেয়া সময় টা যেন আবার আপনার কাল না হয়ে দাঁড়ায়... একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমার শুধু এটাই চাওয়া, আপনার আগের বারের করা ভুলটা যেন আবারো রিপিট না হয়। তেমন কিছু হলে কিন্তু কেঁদেকেটেও ফিরে পাবেন না তৃষ্ণাকে। ভগবান আপনাকে একবার ভুল শোধরানোর সুযোগ দিয়েছে বলে বারবার দেবে এমন তো নয়। তাই বলবো, সুযোগের সঠিক ব্যবহার করুন।"
রান্নাঘরে মুহিবকে দেখেই সঞ্চিতার মা সুহাসিনী মুখার্জি বললেন,
-"আজ কিন্তু থেকে গেলেও পারতে।"
-"সমস্যা নেই খালাম্মা। কাল সকাল সকাল চলে আসবো।"
-"তা এসো। তবে এই ঠান্ডার মাঝে এত রাত করে তনয়কে নিয়ে রাস্তায় বেরুনোই তো ঠিক না। পিচ্চি বাচ্চা, ঠান্ডা একবার বসে গেলে সহজে সারবে না।"
-"জ্যাঠা দেখলাম একটা সিএনজি আনতে পাঠালো। সমস্যা হবে না। গাড়িতে উঠলেই দশ মিনিটের মাঝেই পৌছে যাব।"
এপর্যায়ে সুহাসিনী বেগম প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন,
-"আচ্ছা। যেহেতু থাকবেই না তাহলে জলদি খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়ো। রাত গভীর হলে ঠান্ডা বাড়বে। তৃষ্ণা কই?"
-"সঞ্চিতার ঘরে বোধহয়।"
-"ওর খাবার টাও তাহলে বেড়ে দেই। নিয়ে যাও ওর টাও। আসলে মানুষজন বেশি হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়ি... বুঝতেই পারছো। কিছু মনে না করে হাতেহাতেই খেয়ে নাও। ডাইনিং এ আবার এই পারার বড়দার কিছু বন্ধিবান্ধব দের খেতে দেয়া হয়েছে।"
-"কি যে বলে বলেন, খালাম্মা! এটাতে কিছু মনে করার কি আছে! আমরা আমরাই তো!"
অর্থিকে বিছানায় ব্লানকেট মুড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে দুষ্টু বুদ্ধি খেললো তৌহিদের মাথায়। ঘরের দরজা হালকা চাপিয়েই সে তাড়াহুড়ো করে বিছানায় উঠে এল। নিজের শরীরও ঢেকে ফেললো ব্লানকেটের আবরণে। তারপর খুব ধীরগতি তে এগুতে লাগলো অর্থির দিকে।
তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব চলে এসেছিল অর্থির। তবে হঠাৎ পেটে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই তার তন্দ্রাভাব টা কেটে গেল। চোখজোড়া খুলে সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-"উফফফ!! ঠান্ডা..."
অর্থির কথা শুনে কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হাসলো তৌহিদ। তারপর আদুরে গলায় বললো,
-"কি ঠান্ডা?"
-"অহ.. তুমি! এই ছেলে হাত ছড়াও বলছি। এতোক্ষণ টিভি দেখে দেখে ঠান্ডা হাত পা বানিয়ে এখন এসেছে আমার কাছে! সরো এখান থেকে।"
ছাড়বার বদলে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো তৌহিদ অর্থিকে। ঠোঁট অর্থির কানের পাশে নিয়ে একটি চুমু দিয়ে বললো,
-"এখন তুমি গরম আমি ঠান্ডা... এই দুটো একসাথে মিলে কি হয়.. জানো?"
উত্তরে অর্থি বললো,
-"বিস্ফোরণ হয়।"
-"মোটেও না। দেখো আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলি। এই ধরো..."
-"কোনো ধরাধরি না। সরো এখান থেকে। এখান কেন এসেছো! যাও তুমি খবর দেখ গিয়ে! কি সুন্দর ঠান্ডা একটা ওয়েদার! আর এর মাঝে উনি বউ কে সময় না দিয়ে সময় দিচ্ছিলেন টিভিকে। তাও খবর দেখে! কি আছে এই খবরের মাঝে! আমি যদি পারতাম দেশ থেকে খবরই উঠিয়ে দিতাম। প্রতি ঘন্টার খবর... মাই ফুট!"
অর্থির কথায় কপাল কুঁচকে তৌহিদ বললো,
-"খবর আবার কি দোষ করলো! এর মাধ্যমে আমরা দেশ সহ দেশের বাহিরের কত খবরাখবর পাচ্ছি।"
-"কি হবে সেসব খবরাখবর দিয়ে? পাড়াপড়শি ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে আগে নজর দাও।"
-"আমার প্রোফেশনের জন্য আমার এসব রাখতে হয়।"
তৌহিদ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালো না অর্থি। চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে রইলো। অপরদিকে তৌহিদ কিছু সময় অর্থির উত্তরের অপেক্ষা করার পর নিজে থেকেই বললো,
-"আমি কি সত্যিই তোমাকে সময় দিতে পারি না?"
-"তোমার কি মনে হয়?"
-"আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি। তুমিই না হয় জবাব টা দাও।"
তৌহিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো অর্থি। খানিকটা সময় নিয়ে তৌহিদের ডেইলি রুটিন মনে মনে আওড়ালো সে। তারপর পাশে শুয়ে থাকা তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"সকালে গোছল সেরে বের হয়ে যাও কোর্টের উদ্দেশ্যে। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকাল বা সন্ধ্যাই হয়ে যায়। এসে খাওয়াদাওয়া সেরেই আবার লেগে পড় কেস স্টাডিতে। সেসব শেষ হলেই খবর দেখতে টিভির সামনে চলে যাও। টিভি দেখার কারবার চুকলেই রাতের খাবার সেড়ে রুমে চলে আসো। অপেক্ষায় থাকো আমার.... তাহলে এখান থেকে আমি কি বুঝবো? তুমিই বলো কি বুঝবো? হ্যাঁ,, তুমি যথেষ্ট কেয়ারিং একজন হাজবেন্ড। আর তোমাকে আমার লাইফে পেয়ে আমি ধন্য। তবে ইদানীং আমার কেন যেন মনে হচ্ছে,, আমার এক্সপেকটেশন, আমার চাওয়াপাওয়া টা তোমার কাছে আরো বেশি। আমি আরো কিছু সময় চাই। আমাদের একসাথে আরো বেশি সময় কাটানো দরকার। আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের মাঝে সামান্য ফাঁকও থাকুক। কারণ ওই সামান্য ফাঁকফোকর দিয়েই কিন্তু সম্পর্কে তিক্ততা প্রবেশ করে। যার ফল স্বরূপ ভাইয়া আর ভাবির জীবন। আমি মোটেও এমন একটা জীবন চাই না যেখানে তুমিই নেই। মোটকথা আমি আমাকে তুমিহীন কখনো আমার কল্পনাতেও আনতে চাই না।"
অর্থির কথা চুপচাপ শুনলো তৌহিদ। হ্যাঁ,, অর্থির কথা ঠিক আছে। তবে সবার জীবনেই ব্যস্ততা থাকবে, এবং সেটা মেনে নিয়েই সংসার করতে হবে। আর এমন টা শুধু অর্থির সাথে একা নয়, ঘরেঘরে প্রত্যেকটা মেয়ের সাথেই এসব ঘটে আসছে। তাদের এসব মেনে নিয়েই সুন্দরভাবে সংসার চালানোর মত একটি গুণ আল্লাহ তাদের মাঝে দান করেছেন। এখানে তিক্ততা বা ফাঁকফোকরের ব্যাপার আসবে কেনো! আর অর্থি সব কথার শেষে যে কথাটা তাকে বুঝিয়ে দিল, সেটা হলো তৌহিদ শুধু তাকে রাতের জন্য ভালোবাসে? শুধু রাতেই তৌহিদের দরকার পরে অর্থিকে? শুধুমাত্র তৌহিদের নিজের শারীরিক চাহিদা পুরণের জন্যই বিয়ে করে ঘরে বউ এনেছে তৌহিদ? এগুলোই কি বুঝালো অর্থি? নাকি সে নিজেই বেশি বুঝে ফেলছে! যাই হোক, অর্থিকে এ বিষয় নিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে। যেহেতু অর্থি খুবই ছোট.. সেক্ষেত্রে তার চাওয়াপাওয়া গুলো আলাদাই হবে। বয়সের পার্থক্যরও একটা ব্যাপার আছে। এক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনার সাথে অর্থির চিন্তাধারা মিল খুঁজতে চাওয়াটা ভুল হবে।
-"কিছু বলছো না যে! আমি ভুল কিছু বলেছি?"
অর্থির কথায় তৌহিদ হালকা মাথা ঝাকিয়ে বললো,
-"হয়তো না।"
অর্থি চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-"হয়তো কেন?"
-"সবার জীবনেই ব্যস্ততা থাকে অর্থি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের মাঝের..."
তৌহিদ কে থামিয়ে অর্থি বললো,
-"যুক্তিদিয়ে কথা তোমার কোর্টে শোনাবে.. আমাকে না। এসেছে উকিল আমার!!"
অর্থির কথায় হেসে উঠলো তৌহিদ। উঠে বসে প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকে। গালে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে দিতে বললো,
-"কাল থেকে সব বাদ। অফিস আদালত কিচ্ছু করবো না। শুধু তুমি আর আমি আর আমাদের ভালোবাসাবাসি। চলবে?"
-"ইশ! সময় দেয়া বলতে বুঝে উলটিয়েছেন উনি! দেখি ছাড়ো এখন। মা ডাকছে,, গেলাম আমি।"
অর্থি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৌহিদ। মেয়েটা যেমনই হোক, তাকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছে সে। অর্থির করা বাচ্চামি গুলো খুব করে টানে তাকে, ভুলিয়ে দেয় তাদের মাঝের মনমালিন্য গুলো কে। তবে ব্যস্ততার ব্যাপারটা সময় নিয়ে বোঝাতে হবে অর্থিকে।
মুহিব হাতে দুটো খাবার প্লেট নিয়ে ঢুকলো সঞ্চিতার ঘরে। তৃষ্ণার পাশে বসে নিজের প্লেটটি হাতে রেখেই তৃষ্ণার প্লেট টি রাখলো বিছানায় একপাশে। তারপর তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বললো,
-"তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। রাত বেশি হবার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে।"
মুহিবের কথায় তৃষ্ণা নিজের দুহাতের দিকে একবার নজর দিল। বেশিক্ষণ হয়নি হাতে মেহেদি পড়েছে সে। আর এখনি উঠাতে হবে! ভাবতেই মন টা অসম্ভব খারাপ হয়ে এল তৃষ্ণার। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ না করে ম্লান হেসে বললো,
-"আচ্ছা.. তনয় কোথায়?"
মুহিব খেতে খেতে জবাব দিল,
-"সঞ্চিতার কাছে।"
-"অহ..।"
আর কথা বাড়ালো না তৃষ্ণা। চুপচাপ উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। হঠাৎ তৃষ্ণাকে উঠে ঘরের বাইরের দিকে যেতে দেখে মুহিব ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"যাচ্ছো কোথায়?"
-"মেহেদি লাগিয়েছিলাম হাতে। হাত টা ধুতে..."
-"কোথাও যেতে হবে না তোমার। দেখি.. এদিকে এসে বসো। মেহেদি দিয়েছো, শুকাতে দাও। না হলে ভালো রঙ হবে কিভাবে! আমি একটা চামচ নিয়ে এসে তোমাকে খাইয়ে দেই। নাকি তোমার এতে সমস্যা হবে?"
-"আরে না। আপনার কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই খেতে পারবো।"
-"চুপ... তুমি বসো.. আমি আসছি দুই মিনিটের মাঝে।"
মুহিবের যাবার পথের দিকে কিছুক্ষণ স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তৃষ্ণা। বুঝতে পারে না সে এই লোকটাকে। কেন করছে মুহিব ভাই এগুলো? মুহিব ভাই কি বুঝতে পারছে না.. এসব এখন আর সম্ভব না!! তবে যাই হোক, মুহিব যাই করুক... মুহিবকে বুঝতে চাইও না সে। আবারো কাওকে বুঝতে গিয়ে তার মায়ায় নিজেকে জড়াতে চায় না তৃষ্ণা।
-"মা,, ডাকছিলেন?"
-"হ্যাঁ,, তৃষ্ণারা এসেছে?"
-"না এখনো আসে নি।"
-"কল দিতে বলো তৌহিদ কে। কতদুর এল খোঁজ নাও।"
-"আচ্ছা,, মা। আপনি শুয়ে পড়ুন। ভাবি এলে আমি আপনাকে জানিয়ে যাব।"
-"আচ্ছা,, যাও।"
অর্থি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই তৌহিদা বেগম আবারো ডাকলেন অর্থিকে। অর্থি আবারো ঘরে ফিরে আসার পর তৌহিদা বেগম গলা খানিকটা গম্ভীর করে বললেন,
-"তুমি আর তৃষ্ণাকে ভাবি বলে ডাকবে না। যে সম্পর্ক আর নেই, সেই সম্পর্কটা নিয়েই এখনো পড়ে আছো কেন তুমি?"
শাশুড়ির কথা টা শুনতেই মন টা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল অর্থির। চোখজোড়া ছলছলে হয়ে উঠলো। শাশুড়ির সামনে নিজেকে কিছুটা সামলে অর্থি ভারি গলায় বললো,
-"আচ্ছা,, আর বলবো না মা।"
(চলবে)
সম্পর্কের_টান
#পর্ব-৪৮
সকালে উঠতে না উঠতেই সঞ্চিতার নাম্বার থেকে কল দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেল তৃষ্ণার। এই মেয়ে পারেও বটে! তার নিজেরই তো কালকের ধকল সহ্য হচ্ছে না। পুরো শরীর ব্যথায় ঝিনঝিন করছে। অথচ সঞ্চি! যার বিয়ে তার এসবে সামান্য ভ্রুক্ষেপও নেই... ছোট্ট একটি নিশ্বাস ছেড়ে তৃষ্ণা উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। ফ্রেশ হয়ে, হালকা নাস্তা সেরে সে ঢুকলো মুহিবের ঘরে।
-"আপনি প্লিজ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সঞ্চিদের বাড়িতে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।"
মুহিব বিছানায় শুয়ে শুয়ে পেপার পড়ছিল। হঠাৎ তার ঘরে তৃষ্ণার আওয়াজ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। বিস্মিত গলায় বললো,
-"কেনো? কিছু হয়েছে?"
-"কি আর হবে! সঞ্চি বারবার কল করে করে পাগল করে দিচ্ছে। আপনাকে কল করে নি এখনো!"
-"আমার ফোন তো অফ করে চার্জে দিয়েছি। হয়তো দিয়েছিল।"
-"খুব ভালো একটা কাজ করেছেন। আমারো এটাই করা উচিৎ ছিল। যাই হোক, আপনি কখন বেরুবেন সঞ্চিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে?"
-"তোমাদের সাথেই বেরুবো।"
-"না,, আমাদের সাথে আপনার যেতে হবে না। আমাদের বেরুতে বেরুতে তে বিকাল হয়ে যাবে। ভাইয়া কোর্ট থেকে এলে তারপর আমরা একসাথে বেরুবো। আপনি বরং আগেই যান। না হলে ওর খারাপ লাগবে।"
-"সেটা তো তুমি না গেলেও তো লাগবে।"
-"লাগবে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি। আসলে তনয় কে নিয়ে সারাদিন বিয়ে বাড়ির জঞ্জালের মাঝে থাকা খুব কঠিন। পিচ্চি বাচ্চা, এত লোকজনের মাঝে থাকতে চায় না। দেখলেন না,, কাল কেমন বিরক্ত করলো! আজ তো আরো বেশি লোকজন থাকবে। তাই আমি একদম অর্থি আর ভাইয়া কে সাথে নিয়ে বিয়ের আগেই চলে আসবো। আপনি বরং এখন যান, হলুদ টলুদ কি হয় না হয় তাতে এটেন্ড করুন।"
তৃষ্ণার কথায় হতাশার একটি নিশ্বাস বেড়িয়ে এল মুহিবের বুকচিরে। কোনোমতে ধীর গলায় বললো,
-"আচ্ছা।"
দুপুরের খাবার খেয়ে সব কাজ কাজ সেরে ঘরে এল অর্থি। কিছুক্ষণ শুয়ে রেস্ট নেবার পর উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। আজ সঞ্চিতার বিয়েতে যাচ্ছে তারা। এই বাড়িতে আসার পর তৌহিদের সাথে এই প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে সে। অবশ্য সাথে তৃষ্ণা এবং তনয় থাকবে। থাকুক,, তবুও সে তো তৌহিদের সাথে তার বউ হিসেবে কারো বাড়িতে যাচ্ছে। এই বা মন্দ কি? ভাবতেই মনটা অসম্ভব ভালো হয়ে গেল অর্থির। চটপট করে আলমারি খুলে কয়েকটি শাড়ি বের করলো সে। একটা নিজের পড়বার জন্য অপরটি তৃষ্ণার পড়বার জন্য সিলেক্ট করবে। তারপর শাড়ি দুটো নিয়ে সে খুশিমনে এগুলো তৃষ্ণার ঘরের দিকে।
-"কি করছো?"
-"কিছু করছি না। এসো ভেতরে এসো। হাতে দেখছি আবার শাড়ি! আজ পড়বে নাকি?"
অর্থি হাসি মুখে এগিয়ে এল তৃষ্ণার দিকে। বিছানায় শাড়িগুলো ছড়িয়ে রেখে বললো,
-"হ্যাঁ। পছন্দ করো আমার জন্য একটা তোমার জন্য একটা।"
-"আমার জন্য করতে হবে না। দাঁড়াও। আমার টা তোমায় দেখাচ্ছি।"
তৃষ্ণার কথায় কপাল কুঁচকে ফেললো অর্থি। তার জানামতে, শাড়ি কেন একটা সুতোও নিয়ে আসে নি তৃষ্ণা তাদের বাড়ি থেকে। তাহলে আজ শাড়ি পেল কোথাও? কিনেছে নাকি এর মাঝে? কিনতেও পারে.. এর মাঝে একদিন সঞ্চিতার সাথে তো শপিং এ গিয়েছিল। হয়তো সেদিনই কিনেছে শাড়িটা।
তৃষ্ণা অর্থির সামনে মুহিবের দেয়া শাড়ি রাখতেই অর্থি মুগ্ধ গলায় বললো,
-"ওয়াও! তোমাকে খুব মানাবে এই শাড়িতে।"
-"আগেই কিভাবে জানলে! আগে পড়ি, তারপর না হয় দেখা যাবে। যাকগে, চলো এবাত তোমার শাড়ি সিলেক্ট করি। কি কালার পড়তে চাচ্ছো?"
-"তোমার ইচ্ছেমত একটা সিলেক্ট করো।"
-"ওকে!! উম্ম... ভাইয়া ফেভারিট কালার হলো যেহেতু হোয়াইট। তাহলে এটাই পড়ো।"
-"এটা? সাদা পড়বো? সঞ্চিতা আপুরা যদি কিছু মনে করে? বা আমায় বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই না দেয় সাদা পড়বার জন্য... তাহলে?"
অর্থির কথায় খিলখিলিয়ে খানিকটা সময় হাসলো তৃষ্ণা। একপর্যায়ে হাসি থামিয়ে বললো,
-"পাগলের মত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভাইয়াকে কল করো। দেখো কতদুর.."
তৃষ্ণার নাম্বার থেকে কল আসতেই রিসিভ করলো তৌহিদ।
-"আসছি আমি। এই আর দশমিনিট লাগবে।"
-"এতো তাড়াহুড়োর দরকার নেই। ধীরেসুস্থেই এসো। আর শোনো আসবার সময় ফুলের দোকানে গিয়ে সাদা আর লাল কিছু অর্কিড ফুল আনবে। সাথে একটা গাঁজড়া। মনে থাকবে?"
-"আচ্ছা.. আনবো।"
তৌহিদ শার্ট ইংক করতে করতে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে অর্থির দিকে। সাদা শাড়িজমিনের উপর সোনালি রঙের সুতোর কাজের একটি শাড়ি পড়েছে অর্থি। সোজা কোমরসমান চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রেখেছে পিঠময়। সাথে কানের একপাশটায় লাল এবং সাদা অর্কিড ফুল গুঁজে দিয়েছে। ঠোঁট ভর্তি করে দিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে এঁকেছে গাঁঢ় কাজলের রেখা...
-"আমি তোমার নিজের বউ না?"
হঠাৎ অর্থির এমন প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তৌহিদ। অবাক দৃষ্টিতে সে অর্থির দিকে তাকিয়ে বললো,
-"হ্যাঁ.. হ্যাঁ। অবশ্যই।"
-"তাহলে চোরের মত আমার দিকে তাকাচ্ছো কেন? যেন আমি অন্যের বউ। আমার দিকে তাকানো তোমার মানা।"
-"না.. মানে। তোমাকে সুন্দর লাগছে।"
-"শুধু সুন্দর?"
-"উহু... খুব সুন্দর। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্যের সাদা পরী টা নেমে এসেছে এই পৃথিবীতে।"
তৌহিদের কথায় মনটা আনন্দে ভরে উঠলেও তা বাইরে প্রকাশ করলো না অর্থি। মুখ বাঁকিয়ে তৌহিদকে বললো,
-"ইশ! এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না।"
তৌহিদের শার্ট ইংক করা শেষ হতেই সে এগিয়ে এল অর্থির কাছে ড্রেসিং টেবিলের দিকে। পেছন থেকে অর্থিকে জাপটে ধরে অর্থির ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে নিল তৌহিদ। তারপর ঠোঁট জোড়া বসালো অর্থির ঘাড়ে। অর্থি নিজেও দুই চোখজোড়া বন্ধ করে পরম আনন্দে উপভোগ করতে লাগলো তৌহিদের আদর।
মুহিবের আনা লাল কাতান শাড়িটিই পড়েছে তৃষ্ণা। মুখে হালকা মেকআপের সাথে চুল খোঁপা করে তাতে লাগিয়েছে গাঁজরা। সাথে তো ঠোঁটে লেগেই আছে তার সেই মিষ্টি হাসি... তৃষ্ণা এ বাড়িতে আসবার পর থেকেই দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে মুগ্ধ চোখে দেখেই যাচ্ছে মুহিব। বেশি সুন্দর নাকি মানুষের চোখে সহ্য হয় না... কই? তার তো এমনটা হচ্ছে না। চোখ ঝলসে যাবার মতোই একজন সুন্দরীর দিকে চোখের পলক না ফেলিয়ে সেই কখন থেকে তাকিয়ে রয়েছে সে। পলক ফেলে তৃষ্ণার এই অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখার কাজে সামান্য সময়ও নষ্ট করতে চায় না সে।
অপরদিকে বিয়ে বাড়িতে আসার পর থেকেই কেন যেন তৃষ্ণার দু চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে মুহিবকে। কোথায় সে? তার আনা শাড়িটা যে তৃষ্ণা পড়েছে সেটা কি দেখেছে মুহিব ভাই? আর দেখলেও কিছু এসে বলছে না কেনো তাকে? তাহলে কি তৃষ্ণা কে দেখতেই বাজে লাগছে? উঠানে সাজানো মন্ডপের কাছ থেকে সরে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো তৃষ্ণা। মন মানছে না কোনোভাবেই। একবার গিয়ে আয়নাতে নিজেকে না দেখা পর্যন্ত মনের ভেতরে চলা এই অস্থিরতা কোনোভাবেই কমবে না তার.... এদিকওদিক ঘোরাফেরার পর তৃষ্ণা ঢুকে পড়লো সঞ্চিতার ঘরে। সঞ্চিতাকে সাঁজানো হচ্ছে এ ঘরটায়। পার্লার থেকে লোক আনা হয়েছে সাজানোর এই কাজের জন্য। তৃষ্ণা কিছুক্ষণ সেদিকে লক্ষ করবার পর সঞ্চিতার উদ্দেশ্যে বললো,
-"সঞ্চি, একবার আমার দিকে তাকা তো।"
-"কেন? কিছু হয়েছে?"
-"না,, তুই তাকা না একবার।"
তৃষ্ণার অসহায় গলা শুনে ঘুরে তৃষ্ণার দিকে তাকালো সঞ্চিতা। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"কি হয়েছে?"
-"আমাকে ঠিকঠাক লাগছে? মানে কেমন লাগছে আমাকে?"
-"হ্যাঁ,, ঠিকঠাক। একদম পারফেক্ট।"
-"সত্যি করে বল, প্লিজ। মিথ্যা বলিস না।"
-"তোকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ! দেখি কাছে আয় তো। ভালো করে দেখে বলি।"
তৃষ্ণা সঞ্চিতার কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরলো সঞ্চিতা। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরগলায় বললো,
-"মুহিব ভাই এই শাড়িটাই এনেছে... না?"
সঞ্চিতার কথা হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। সঞ্চি কিভাবে জানলো এটা? ইশ! কি না কি ভাবছে! ভারী লজ্জায় পড়ে গেলাম! সঞ্চিতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে তৃষ্ণা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল ওঘর ছেড়ে। আশেপাশে তাকিয়ে একবার দেখে নিল চারপাশ টা। না,, মুহিব এদিকটায়ও নেই। কোথায় গেল এই লোকটা? আচ্ছা... সে মুহিব কে কেনো খুঁজছে? তার এই সাজগোজ মুহিবকে দেখানোর জন্য? মুহিবকে এসব দেখিয়ে মুগ্ধ করবার জন্য? আর সে নিজে এত সেজেছেই বা কেন? তার এই সাজের কারণটা কি মুহিব? কিন্তু কেন? সে কি মুহিবকে নিজের মনে নিজের অজান্তেই জায়গা দিয়ে দিয়েছে? সে কি মুহিবের উপর সে দুর্বল হয়ে পড়ছে? না... সবগুলোর উত্তরই না। এত সহজেই কাওকে মনে জায়গা দিয়ে দেয়া যায় না। এসব তার ভুল ধারণা। মুহিব কেউ না... মুহিব তার জন্য পছন্দ করে শাড়িটা এনেছে বলেই সে শাড়ি পড়ে মুহিবকে দেখাতে চাচ্ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু না... না। এভাবেই কিছুক্ষণ তৃষ্ণার মনের সাথে বিবেকের তর্কাতর্কি চলার পর নিজের মন এবং বিবেককে নিজের আয়ত্বে আনলো সে। হাতের মুঠ চেপে সে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। সে মুহিব কে নিয়ে কেনো ভাবছে? এসবই কি সে চেয়ে এসেছিল সে তার জীবনে? এভাবে আর কয়দিন? তার এই জীবনে কি সুখের কখনওই দেখা পাবে না সে? এই রাতের অন্ধকার আকাশের মতই কি তার পুরো জীবনটাও অন্ধকারে ভরে থাকবে?
-"কাওকে খুঁজছিলে?"
মুহিবের কন্ঠ কানে আসাতেও সে তাকালো না মুহিবের দিকে। আগের মতই স্থবির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে।
-"তৃষ্ণা? মন খারাপ?"
-"উহু।"
-"আচ্ছা। তা আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো? তারা গুনছো?"
-"হু।"
-"একাএকা গুনে তো শেষ করতে পারবে না। এসো এক সাথে গুনি। তুমি ডান পাশের গুলো গুনতে থাকো আর আমি বাম পাশের গুলো।"
-"মুহিব ভাই, আপনি প্লিজ এখান থেকে যান। আমাকে কিছু সময় একা থাকতে দিন।"
-"আচ্ছা.. যাবো। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই আমি চলে যাবো।"
এপর্যায়ে মুহিবের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। বললো,
-"কি প্রশ্ন?"
-"ইংলিশে E এর পরের অক্ষর কোনটি?"
সময় নিল না তৃষ্ণা। বললো,
-"F.."
-"উহু,, পারলে না। তারমানে আপাতত আমি যাচ্ছি না এখান থেকে।"
মুহিবের কথা ভ্রু কুঁচকে তৃষ্ণা বললো,
-"কিভাবে পারলাম না? E এর পরের অক্ষর তো F ই।"
-"উহু... E এর পরের অক্ষর N। আমি কি বলেছিলাম? ইংলিশে..."
মুহিবের কথা শেষ হবার আগেই হেসে উঠলো তৃষ্ণা। হাসতে হাসতেই সে বলতে লাগলো,
-"আরে হ্যাঁ... ইংলিশ। E N G L I S H.. হায় আল্লাহ! আমি কিভাবে পারলাম না! আমার বোঝা উচিৎ ছিল, এত ইজি কোয়েশ্চেন অবশ্যই আপনি করবেন না।"
কিছু বললো না মুহিব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো তৃষ্ণার ঠোঁটের এই হাসি। যাক! মেয়েটার মন খারাপ টা কাটিয়ে তাকে হাসাতে তো পেরেছে। এতেই শান্তি...
অপরদিকে তৃষ্ণার হাসি যেনো ফুরোচ্ছেই না। নিজের বোকামিতে নিজে কখনো এত হাসে? হাসি থামাতে চেয়েও সে পারছে না অথবা তার ইচ্ছেই করছে না এই হাসিটি থামাবার....... ঠিক সেই মুহূর্তেই তৃষ্ণার ফোন বেজে উঠলো। একপলক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আননোন নাম্বার দেখে নিল তৃষ্ণা। তারপর হাসতে হাসতেই কল রিসিভ করলো সে।
-"হ্যালো?"
-"হ্যাপি ম্যারিজ এনিভার্সেরি, তৃষ্ণা।"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।