সম্পর্কের টান । পর্ব-৩১+৩২


সম্পর্কের টান

 পর্ব-৩১+৩২

প্রায় বেশকদিন হলো অতৈন্দ্রিলার সাথে ঠিকঠাক ভাবে কথা হয় না মাহসানের। অফিসে প্রায় দিনই অনুপস্থিত থাকে। এ ব্যাপার নিয়ে মাহসান কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না.. একটাই ভয়, ছেড়ে যাবে না তো? ইদানীং অতৈন্দ্রিলার রাগটাও বেশি হয়েছে। কথায় কথায় রেগে উঠে। আগে তো এমন অদ্ভুত আচারণ করতো না। সবসময় এমন একটা ভাব নিয়ে চলতো যেন মাহসান ছাড়া সে অচল, মাহসানই তার পৃথিবী। অথচ আজ কাল এই পৃথিবী টাকেই তেমন একটা মনে পড়ে না তার... এর পেছনে কি বড় কোনো কারণ আছে? নাকি মাহসান নিজেই বেশি ভাবছে??

-"হ্যালো,, অতৈ?"
-"হ্যাঁ,, বলো।"
-"সেই সকাল থেকে কল দিয়ে যাচ্ছি... রিসিভ করছিলে না কেনো?"
-"ফোন সাইলেন্ট ছিল.. বুঝতে পারি নি।"
-"এটা কি যৌক্তিক কিছু বললে? এখন বাজে রাত ১০ টার উপরে। অথচ তুমি সারাদিনে একটা বারও কি ফোন হাতে নাও নি?"
বিরক্ত গলায় অতৈন্দ্রিলা বললো,
-"যৌক্তিক অযৌক্তিকের কি আছে! আমি আমার মতো এক্সপ্লেইন করেছি। এখন বিশ্বাস করাটা তোমার ব্যাপার। করলে করো না করলে নাই।"
-"ওকে,, করলাম বিশ্বাস। কোথায় আছো তুমি এখন?"
-"বাসায়।"
-"আসবো আমি? অনেকদিন হলো আমাদের ঠিকঠাক ভাবে দেখা হচ্ছে না,, নিজেদের তেমন একটা সময় দিতে পারছি না আমরা।"
-"তোমাকে তো বারবার বলেছি, আমার বাড়িওয়ালা বাসায় কোনো ছেলেকে আনতে মানা করে দিয়েছে।"
-"ছেড়ে দাও ওই বাড়ি.."
-"দেবো... কিছুদিন যাক।"
-"তুমি কিন্তু আমার বাসায় এসেও উঠতে পারো... আমি তো একাই থাকি। আসবে?"
-"শুধু শুধু তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠবো কেন!"
মাহসান বুঝতে পারছে অতৈন্দ্রিলা প্রচণ্ড রেগে যাচ্ছে। অথচ সে তো রেগে যাবার মত কোনো কথা বলেনি.. তাহলে অযথা রেগে যাচ্ছে কেন এভাবে! কথা বাড়ালো না মাহসান... কল কেটে দিল। দরকার নেই অতৈন্দ্রিলার মেজাজ খারাপ করে দেবার... বিছানায় গিয়ে নিজের শরীর এলিয়ে দিল মাহসান। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মাঝ সমুদ্রের মাঝে এসে ধীরেধীরে ডুবে যাচ্ছে সে। কোনোভাবেই তীরে উঠতে পারছে না। না ফেলে আসা তীরে, না যে তীরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল সে তীরে!! পাশ ফিরলো মাহসান। তার ছেলের মুখটা বারবার তার সামনে ভেসে উঠছে। খুব ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কাছ থেকে একটাবার দেখতে, নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখতে, বুকে চেপে ধরতে.... কিন্তু এর একটাও করতে পারবে না সে। কেন সে তৃষ্ণাকে ছেড়ে দিল এভাবে! আজ যদি তৃষ্ণা এ বাড়িতে তার সাথে থাকতো,, তাহলে তার ছেলেটাও তার পাশে থাকতো। নিজের ইচ্ছেমত ছেলেকে আদর করতে পারতো, ভালোবাসতে পারতো। কিন্তু এখন সেগুলোর একটিও পারছে না... ভাবতেই একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল মাহসানের বুক চিরে। আচ্ছা!! তার ছেলেটা কত বড় হয়েছে? এই দুই মাসে হয়তো অনেক বড়ই হয়ে গিয়েছে। দুই মাস আগে শেষ দেখেছিল সে তার ছেলেকে। ঐতিহ্যদের ফ্লাটে, তৃষ্ণা নিজের বুকের মাঝে অসম্ভব শক্ত করে চেপে রেখেছিল তার বাচ্চাটাকে। সে কি কখনওই তার বাচ্চাকে ওভাবে বুকে আঁকড়ে ধরতে পারবে না? একফোঁটা জল বেয়ে পড়লো তার চোখের কোণা বেয়ে। বুকটা প্রচণ্ড ফাঁকাফাঁকা লাগছে... বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অবশ্য এই ব্যাথাটা প্রায় রাতেই শুয়ে পড়বার পর অনুভব করে সে। বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছে সে... তা প্রায় রাতেই ভাবে সে। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। কিন্তু এসব ভেবেই বা এখন কি লাভ! এসব ভেবে শুধু কিছু দীর্ঘশ্বাসই বেড়িয়ে আসে বুকচিরে...

তনয় ঘুমিয়ে পড়েছে.. ছেলেটা এতোই দুষ্ট হয়েছে যে সারাদিন রাত মিলে দশ ঘন্টাই ঠিকঠাক ভাবে ঘুমোই না। তার কাজ একটাই,, সারাদিন হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করা, আর মিষ্টি হাসি দেওয়া। সেই হাসি যেন ভুবন ভোলানো হাসি। মানুষ এতো মিষ্টি করে হাসতে পারে?? ভাবতেই ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসলো তৃষ্ণা। রাত ১২ টার উপরে বেজে গেছে। অথচ তার চোখে এখনো ঘুম নেই। সমস্ত টেনশন কালকের দিনকে ঘিরে... কাল ঢাকায় যেতে হবে তাকে। একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে ইন্টার্ভিউ এর জন্য ডাক পড়েছে তার। কিন্তু সমস্যা একটাই। যদি কোনোভাবে সে সিলেক্ট হয়ে যায় তাহলে তনয়কে ফেলে রেখে প্রতিদিন এভাবে ঢাকায় যাওয়া আসা করতে হবে। সে চেয়েছিল নারায়নগঞ্জের মাঝেই কোথাও একটা ছোটখাটো জব নেবার জন্য। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মাঝে যেগুতে কথা বলে এপ্লিকেশন করে রেখেছিল, সেগুলো থেকে ডাক এখনো পড়ে নি। তার আগেই ইন্সুরেন্স কোম্পানির জন্য ডাক পড়ে গেল। অবশ্য তনয়কে নিয়ে এতোটা না ভাবলেও হবে। দিন রাতের বেশিরভাগ সময়ই কাটায় সে অর্থির সাথে। অর্থি বলতে যে তনয় পাগল, সেটা তার কিছু কার্যকর্মেই বোঝা যায়। এই যেমন তৃষ্ণা কোলে নিয়ে রয়েছে তাকে, ঠিক সেসময়ই বাইরে কোথাও থেকে অর্থির গলার শব্দ কানে এল তার। ব্যস! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না অর্থি এসে কোলে নেবে ততক্ষণ তার কান্না থামানোর সাধ্যি কারো নেই। তাই অর্থির ভরসায় তনয়কে রেখে যাওয়াই যায়... বাদবাকি থাকে খাবার ব্যাপার টা। সেটাতেও সমস্যা নেই। তনয়ের ডক্টর কৌটোর দুধ লেখার পর থেকে মাঝেমধ্যেই কৌটোর দুধ খাওয়ানো হয় তাকে। তাই দিনটা কৌটোর দুধ বা গরুর দুধ খাইয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে তনয়... তবে হ্যাঁ,, তার এতোটা জলদিও কাজে লেগে পড়ার দরকার ছিল না। মাত্র দুমাস হলো এখানে এসেছে সে। ভাইও যথেষ্ট হেল্পফুল। টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তারপরও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। চুপচাপ শুয়ে বসে খেয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না। আর তার ভাইয়ের ছায়াই বা সে কদিন থাকবে? হাজবেন্ড ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে চলে গেছে, আর সে ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছেদাচ্ছে আরামসে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। এটা বাড়ির সবাই সহজ স্বাভাবিক ভাবে নিলেও সে নিজে তা নিতে পারছে না। আর কেনই বা নেবে! সে তো অশিক্ষিত কোনো মেয়ে না, বিয়ের কারণে মাস্টার্স টা করতে না পারলেও অনার্সটা তো শেষ করেছে সে। তাহলে কেন ভাইয়ের করুণায় চলবে সে! নিজের চেষ্টায় কিছু করবে সে, নিজের চেষ্টায় তার ছেলেকে বড় করবে। মাহসানকে সে বলেছিল তার একার ছেলে তনয়। তাই সে নিজে একাই মানুষের মত মানুষ করে দেখিয়ে দেবে মাহসানকে। ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস তৃষ্ণা। ঘুমানো দরকার তার। কাল সকাল সকাল আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। তার ভাই তৌহিদ প্রথমে এই ইন্টার্ভিউ এর জন্য রাজি না হলেও অর্থি এবং মায়ের বোঝানো তে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত একটাই,, ইন্টার্ভিউ টা দিয়ে আসতেই পারে। কিন্তু সিলেক্ট হলেও জবটা করতে পারবে না তৃষ্ণা। তৃষ্ণা নিজেও ভাইয়ের কথায় রাজি হয়েছে। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে সে সিলেক্টই হবে না। সেখানে জব পাওয়া তো দুরের কথা। আচ্ছা!! ধীরেধীরে কি নিজের উপর থেকে আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে তার??

বেশ কিছু সময় হলো চুপচাপ চেয়ারে বসে রয়েছে তৃষ্ণা। তার সামনে শরীফ আহমেদ, এই ইন্সুরেন্স কোম্পানির পরিচালক বসে তার ফাইল ঘাটাঘাটি করছে। সাথে কিছুক্ষণ পরপর আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। দৃষ্টি তৃষ্ণার বুকের দিকে। 
-"আপনি ম্যারিড?"
-"জ্বি.."
-"কি করে আপনার হাজবেন্ড?"
-"ওর বাবার প্রাইভেট কোম্পানি...."
তৃষ্ণার কথা শেষ হবার আগেই শরীফ আহমেদ বলে উঠলেন,
-"আচ্ছা,, তো বড় লোক বাড়ির বউ হয়ে আবার নিজে জব করতে চাইছেন যে! তাও আমাদের মতো ছোটমোটো ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে?"
কিছুটা নড়েচড়ে বসে তৃষ্ণা বললো,
-"আমরা আর একসাথে থাকি না।"
-"ডিভোর্স?"
-"এখনো হয় নি... তবে কাজ চলছে। কিছুদিনের মাঝেই হয়ে যাবে।"
-"অহ! দ্যাটস গুড..."
-"জ্বি।"
-"ছেলেমেয়ে আছে?"
এসি চলছে ফুল স্প্রিডে। তবুও ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা। গলাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিললো তৃষ্ণা। কখনো জবের জন্য ইন্টার্ভিউ দেয় নি সে। এইটাই প্রথম... এখনতো মনে হচ্ছে শেষ। এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছে কেন বারবার!!
-"জ্বি,, একটা ছেলে।"
-"বয়স?"
-"তিন মাস।"
তিন মাস বলতেই আবারো শরীফ আহমেদ তাকালেন তৃষ্ণার বুকের দিকে। লোভাতুর দৃষ্টিতে একনজরে সে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার বুকের দিকে। তৃষ্ণা ওড়না টেনে ঠিকঠাক করতেই দৃষ্টিভঙ্গ হলো শরীফ আহমেদের। সে তৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
-"আপনাকে আমার ভালো লেগেছে,, মানে আপনি আমাদের এই পোস্টের জন্য যোগ্য। অনেক গুলো পোস্টই খালি ছিল,, তবে আপনাকে আমি আমার পারসোনাল এসিস্টেন্ট হিসেবে এপোয়েন্ট করলাম।"
বলেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলেন শরীফ আহমেদ। লান্সের টাইম প্রায় হয়ে এসেছে। উঠতে হবে এখন তাকে... তৃষ্ণাকে কোনো জবাব না দিয়ে উঠে চলে যেতে দেখে শরীফ আহমেদ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
-"কি ব্যাপার! উঠছেন যে!"
থমকে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। আমতাআমতা করে জবাব দিল,
-"না.. মানে বাইরে অপেক্ষা করি।"
-"আপনার অপেক্ষা করতে হবে না। চলুন আমার সাথে।"
হতবাক হয়ে বললো,
-"কোথায়?"
-"লান্সের টাইম হয়ে এসেছে... আপনাকে দেখেও মনে হচ্ছে আপনি ক্ষুধার্ত। পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। আমি সেখান থেকেই ডেইলি খাবার আনিয়ে লান্স টা সেরে ফেলি। আজ যেহেতু আপনি সাথে আছেন,, তাই ভাবলাম রেস্টুরেন্টে বসেই লান্সটা কমপ্লিট করি। কোনো সমস্যা নেই তো?"
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না তৃষ্ণা। তার আগেই শরীফ আহমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-"চলুন তাহলে,, এর মাঝে কাজটাও বুঝিয়ে দেব আপনাকে।"

মাহসান প্রায় আধাঘণ্টা হলো লক্ষ করছে একটি মেয়েকে। প্রথমে কিছুক্ষণ যাবৎ মেয়েটাকে তৃষ্ণা ভাবলেও এখন সে নিশ্চিত এই মেয়েটিই তৃষ্ণা। কিন্তু তৃষ্ণা এই ভর দুপুরে এখানে কি করছে! আর ওর পাশের লোকটাই বা কে! লোকটাকে দেখে একদম সুবিধার লাগছে না। বারবার তার দৃষ্টি গিয়ে আটকাচ্ছে তৃষ্ণার বুকের দিকে। সাথেসাথেই ঠোঁটে ফুটে তুলছে সে পিশাচসুলভ হাসি। তৃষ্ণা এই বাজে লোকটার সাথে করছেটা কি! একবার কি গিয়ে দেখবে ব্যাপারটা? না,, থাক। যার যা ইচ্ছে করুক। তাতে তার কি!! সে এই পথ ধরেই যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো পাশে ভালো একটা রেস্টুরেন্ট যেহেতু আছে, সেহেতু সেখান থেকেই না হয় লান্সটা করে যাই। ব্যস! এসে ঢুকতেই তার দৃষ্টি আটকে গেল তৃষ্ণাতে। প্রথমে চোখের ভুল মনে হচ্ছিল। কারণ এতোটা সুন্দর তো তৃষ্ণা নয়। কিন্তু কিছু সময় কেটে যাবার পর নিজের ভুল বুঝতে পারলো মাহসান। তৃষ্ণা দেখতে আসলেই এতোটা সুন্দর হয়েছে নাকি তার দেখার নজর পরিবর্তন হয়েছে?? খাবার প্রায় শেষের দিক মাহসানের। ওপাশে তৃষ্ণাদের খাবার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন বসে দুজন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। লোকটার নানান প্রশ্নে তৃষ্ণা হয়তো শুধু হু হা উত্তর করে যাচ্ছে। তবে এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে তৃষ্ণা প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে লোকটির মুখোমুখি.... প্লেটে আর কোনো খাবার নেই। যা ছিল সবই এখন ঢুকে পড়েছে মাহসানের পেটে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সে বসে বসে লক্ষ করে যাচ্ছে তৃষ্ণাদের। তবে আর করা যাচ্ছে না, দেরি হয়ে আসছে। উঠতে হবে এখন তার। ঠিক সেই মুহূর্তেই মাহসান লক্ষ করলো লোকটি কথার ফাঁকেফাঁকে হাত তুলে দিচ্ছে তৃষ্ণা কাঁধে। তৃষ্ণা অস্বস্তি নিয়ে কাঁধের দিকে চাইতেই হাত নামিয়ে নিয়ে সরি জাতীয় কিছু হয়তো বলছে। কিছুক্ষণ বাদে আবারো সেই একই কাজ করে যাচ্ছে লোকটি। না,, এভাবে চুপ করে বসে থাকবার কোনো মানে হয় না। কিছু একটা করা উচিৎ তার। উঠে পড়লো মাহসান। দ্রুত পদে এগুলো তৃষ্ণার টেবিলের দিকে।

-"বসতে পারি?"
মাহসানের গলার আওয়াজে শরীফ আহমেদ  ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
-"আপনি?"
-"আমি তৃষ্ণার হাজবেন্ড। মাহসান চৌধুরী অর্ক।"
বলেই হাত টা এগিয়ে দিল শরীফ আহমেদের দিকে। হ্যান্ডশেক করে বসে পড়লো তৃষ্ণার পাশে।
-"আপনিই তাহলে সেই হতভাগা! তা ডিভোর্স টা কবে হচ্ছে আপনাদের?"
শরীফ আহমেদের কথায় নড়েচড়ে বসলো মাহসান। এই লোক টার সাথে কি সম্পর্ক তৃষ্ণার? যে ডিভোর্স নিয়েও আলোচনা করেছে!!
-"হবে কিছুদিনের মাঝে... আসলে আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। আপনি কি তৃষ্ণাদের কোনো রিলেটিভ?"
শরীফ আহমেদ তার মানিব্যাগ থেকে একটি কার্ড বের করে এগিয়ে ধরলো মাহসানের দিকে। নিজেকে ইন্সুরেন্স কোম্পানির পরিচালক এবং তৃষ্ণাকে তার পিএ হিসেবে পরিচয় দিল.... সব শুনে মাহসান তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
-"তোমার জব করতে হবে কেন? ঘরে ছেলে ফেলে বাইরে এসে নষ্টিফষ্টি না করলে চলতো না? তোমার ভাই এত বড় বড় কথা বলে তোমাকে নিয়ে চলে গেল। আর এখন সেই তোমাকে আর টানতে পারছে না?"
এ পর্যায়ে মুখ খুললো তৃষ্ণা। এতোক্ষণ তার মাঝে একটা ঘোর কাজ করছিল। হঠাৎ এতোদিন পর যে মাহসানের সাথে দেখা হবে সেটা মোটেও ভাবতে পারছে না সে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। তবে তা নিজের ভেতর চেপে রাখলো তৃষ্ণা। ভারি গলায় উত্তর দিল,
-"সেটার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নয়।"
-"অবশ্যই বাধ্য। তুমি আমার ছেলেকে ফেলে রেখে আসবে আর আমার কাছে কৈফিয়ত দেবে না?"
-"না,, দেবো না। তনয় তোমার ছেলে না.. ও আমার একার ছেলে।"
-"একাও বুঝি সন্তান জন্ম দেয়া যায়?"
মাহসানের এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেল তৃষ্ণা। সামনেই বসে আছে শরীফ আহমেদ। তার সামনে এই ধরনের কথা কিভাবে বলতে পারলো মাহসান! অবশ্য ওকে দিয়ে সবই সম্ভব... লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললো তৃষ্ণা। ঠিক সেসময় শরীফ আহমেদ মাহসানের উদ্দেশ্যে বললেন,
-"আমার মনে হচ্ছে তৃষ্ণা আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। তাছাড়া আমি ওকে অফিসের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। কিছু মনে না করলে...."
মাহসান শরীফ আহমেদকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-"আপনি যে কি কাজ বুঝাচ্ছিলেন সেটা তো নিজ চোখেই দেখলাম... স্টাফের বুকের দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকানো, স্টাফের শরীরে নানা বাহানায় টাচ করাই আপনার কাজ বোঝানোর নমুনা?"
মাহসানের কথায় হালকা নড়েচড়ে বসলো শরীফ আহমেদ। গলা কিছুটা পরিষ্কার করে বললো,
-"আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।"
চেঁচিয়ে উঠে মাহসান বললো,
-"জাস্ট শাট আপ... বস হয়েছিস, বসের মত থাক। একজন বস আর স্টাফের মাঝে ঠিক যতটা ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলা উচিৎ সেভাবেই চলবি। না হলে যে চোখ দিয়ে বাজে নজরে তাকিয়েছিস তৃষ্ণার দিকে, সেই চোখই গেলে দেব।"
মাহসানের কথায় ঢোক গিললো শরীফ আহমেদ। কিছু করা উচিৎ তার। কিন্তু করবে টা কি?? ঠিক সেই মুহূর্তেই তৃষ্ণা বলে উঠলো,
-"আমার বস আমার সাথে যাই করুক সেটা আমার আর তার ব্যাপার। আমার যেহেতু এতে কোনো সমস্যা নেই, সেখানে তুমি এভাবে সিনক্রিয়েট করছো কেন! আর কি বললে তুমি? বস আর স্টাফের মাঝের রিলেশন কেমন হওয়া উচিৎ সেটাই উনাকে শেখালে তো?... নিজে কি করেছিলে? তখন কি তোমার একবারো মনে হয় নি ডিসটেন্স মেনে চলার কথা?"
বলেই উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। শরীফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"উনি আমার সাথে আর যাই করুক কখনো তোমার মত নীচু পর্যায়ে যাবে না। আর গেলেও সেটা আমি বুঝবো... চলুন,, স্যার।"

তৃষ্ণার গমন পথের দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাহসান। 

    (চলবে)

সম্পর্কের_টান
 
 পর্ব-৩২

বেলা ৪ টার বেশি বেজে গেছে। অথচ এখনো দুপুরের খাবারটা খেতে পারে নি অর্থি। রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে বাড়ি পরিষ্কার করা, কাপড় চোপড় ধোয়া সব কিছুই এখন এক হাতে সামলাতে হয় তাকে। আগে তার শাশুড়ি তৌহিদা বেগমই সব করতো। শুধু মাঝেমাঝে গিয়ে সামান্য সাহায্য করতো অর্থি। তবে এখন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ উলটে গেছে। এখন এক হাতে সব করতে হয় অর্থিকে, শুধু মাঝেমধ্যে এসে তদারকি করে যান তৌহিদা বেগম। কাজ গুলো করতে অর্থির প্রচণ্ড কষ্ট হলেও কিছু বলতে পারে না সে। কি আর বলবে সে! এখন তো সংসার টা তার। সেক্ষেত্রে তাকেই সামলাতে হবে একা এই সংসার। তবে এতো জলদি! মাত্রই ৭/৮ মাস হলো বিয়ে হয়ে এই সংসারে এসেছে সে। অপরদিকে বিয়ের আগে এসব রান্নাবান্না, বাড়ির টুকিটাকি কাজ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তার। কিছুই জানতো না সে। যা শিখেছে এ বাড়িতে এসে তার শাশুড়ির কাছ থেকেই শিখেছে। তবুও এখনো পুরোপুরি রপ্ত হয়ে উঠতে পারে নি সে। অনেকটা অজ্ঞই রয়ে গেছে সে। আর এর মাঝেই এত বড় একটা ঝামেলা ঘাড়ে তুলে দিল তার শাশুড়ি...... অবশ্য এ নিয়ে তৌহিদ বলেছিল তার মা এবং বাবাকে। কিন্তু তারা তেমন একটা পাত্তা দেয় নি সে কথায়। তাদের ভাষ্যমতে, একদিন না একদিন তো সামলাতেই হবে। তাহলে আজ থেকে সামলালেই সমস্যা কোথায়??
-"অর্থি? এই অর্থি?"
শাশুড়ি তৌহিদা বেগমের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়লো অর্থির। মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে মাথাটা মুছে ব্যালকনিতে টাওয়েল মেলতে গিয়েছিল সে। হঠাৎ ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই পাশে থাকা নারিকেল গাছের দিকে দৃষ্টি চলে গিয়েছিল তার। সেখানটায় দুটো পাখি বসে কিচিরমিচির আওয়াজ করে একে অপরের সাথে কথা বলছিল। কি বলছিল তারা? নিশ্চয় সুখ দুঃখের আলাপ করছিল......
-"জ্বি,, মা। আসছি।"
তৌহিদা বেগমের ডাকে তড়িঘড়ি করে টাওয়েল টা মেলে ঘরে ঢুকলো অর্থি। তৌহিদা বেগমকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মন মেজাজ প্রচণ্ড রকমের খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু কি কারণে? তার কি কিছু করতে ভূল হয়েছে?
-"মাত্র গোছল করলে তুমি? কি করছিলে এতোক্ষণ?"
কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না অর্থি। সকালে উঠার পর থেকেই বলতে গেলে একটার পর একটা কাজ করতেই হয় তার। সে তো আর একটা কাজ করেনি, হাজারটা কাজ করেছে। এখন কি একে একে সব গুলোর হিসেব দিতে হবে তার?
-"তুমি কি একাই সংসার করো? আর করে না কেউ? নিচের ফ্লাটের হাশেম সাহেবের ছেলের বউ কে দেখেছো? মাত্র কয়েক দিন হলো বিয়ে করে এসেছে। আর এখনি কি সুন্দর নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সবার সাথে! শাশুড়িকে কিছুই বলতে হয় না। সব কাজ কত সুন্দর ভাবেই না গুছিয়ে করে। কই! সে তো তোমার মত বিকেল ৫ টায় গোছল করতে যায় না। আমি নিজেও তো এতোবছর এই সংসার টাই সামলেছি। এতো বড় সংসার ও না আর এর কাজও এত বেশি না যে, সব কাজ সামলে তোমার বিকেলে গোছল সারতে হবে। বিকেলে গোছল করাটা একটা বদভ্যাস। আর যেটা আমি একদম পছন্দ করি না।"
-"আর করবো না, মা।"
তৌহিদা বেগমের আরো কিছু কঠিন কথা শোনানোর ইচ্ছা থাকলেও আর কিছু বললেন না। বেড়িয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। তবে তার পরমুহূর্তেই আবার ফিরে এল সে। অর্থিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-"বিকেলে গোছল করে করে ঠাণ্ডা টা লাগিয়েছো। সারাদিন খুক খুক করে কাশো। তৌহিদ কে বলবে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে। আর শোনো, তনয় তোমার শ্বশুরের কাছে আছে। গিয়ে নিয়ে আসো ওকে। এনে দুধ টা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। মা নেই আজ তার ঘুমও নেই। বাচ্চাটার অনিয়ম হচ্ছে খাওয়া ঘুম সবকিছুর। যার ভরসায় রেখে গেছে তার কাজই শেষ হয় না,, এসব খোঁজ নেবে কখন...."
বলতে বলতেই আবারো ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন তৌহিদা বেগম। অর্থি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর বিছানায় গিয়ে বসলো। তার পুরো মাথাটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। আগে যে মহিলা মা সম্বোধন না করে অর্থিকে ডাকতোই না,, আজকাল সে সারাদিন তাকে শাষনের উপরে রাখে। পাঁন থেকে চুন খসলেই কথা শুনাতে শুনাতে কান টা ঝালাপালা করে দেয়। এই যেমন কাজ নিয়ে, তনয়কে নিয়ে এখন কথা শুনিয়ে গেল। কাজের কথা তাও মানা যায়। সে নিজেও জানে সে ঠিকঠাক ভাবে কাজগুলো করতে পারছে না। কিন্তু তনয়! তনয়কে নিয়ে এই কথাগুলো কিভাবে বললো! তার নিজের ভাইয়ের ছেলে তনয়। রক্তের সম্পর্ক আছে তার তনয়ের সাথে। কতোটা বেশি ভালোবাসে সে তনয়কে এটা কারো অজানা নয়। তাহলে মা কিভাবে বললো তনয়ের জন্য তার সময় নেই!! অপরদিকে তনয়ও তৃষ্ণার চেয়ে তার কাছেই বেশিরভাগ সময় থাকে। কাজ ছাড়া বাকিটা সময় নিজের বুকের ভেতর আগলে রাখে সে তনয়কে। ছোটখাটো কোনো কাজ হলে সে তনয়কে কোলে নিয়েই কাজ গুলো করে। এমনকি তনয়ের জম্মের পর থেকে এই তিনটা মাস সে নিজেই তনয়ের কাথা সহ জামা কাপড় ধুয়ে আসছে। যদি তনয়কে সে ভালো নাই বাসতো, কেয়ার নাই করতো তাহলে এগুলো সে কি কখনো করতো?? ওঘর থেকে তনয়ের কান্নার আওয়াজে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অর্থি। এগুলো সেদিকে। 
অর্থির দেখা পেয়েই কান্না থেমে গেল তনয়ের। ঠোঁটে এসে ভর করলো হাসি। অর্থি তনয়কে কোলে নিয়ে আবারো নিজের ঘরে ফিরলো। বিছানার মাঝে তনয়কে রেখে সে বসলো দুধ বানাতে। তবে তার মন এখনও পড়ে আছে শাশুড়ির ব্যবহারের উপর। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কি কারণ হতে পারে? লাস্ট দুমাস হলো এই পরিবর্তন টা হয়েছে। হ্যাঁ,, ঢাকা থেকে তৃষ্ণাকে এ বাড়িতে আনার পর থেকেই তৌহিদা বেগমের এই পরিবর্তন টা হয়েছে। প্রথম দিকে অর্থি ওভাবে খেয়াল না করলেও এখন বুঝতে আর বেগ পেতে হচ্ছে না। তাহলে কি তৌহিদা বেগমের এমন খারাপ আচারণের পেছনে তৃষ্ণা আছে? কথাটি ভাবতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো অর্থি। সে কি উলটাপালটা ভাবছে এগুলো! তৃষ্ণা ওমন মেয়েই না। তাহলে কি কারণ থাকতে পারে? পরমুহূর্তেই উত্তর পেয়ে গেল অর্থি। সে মাহসানের বোন,, এটাই কি দোষ তার?

তৃষ্ণা নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে বাসে উঠে বসেই আগে জোরে কিছু নিশ্বাস ফেললো। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার। এই ভাবে হঠাৎ মাহসানের দেখা হওয়া, কথা হওয়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষ্ণা। আসলেই কি মাহসানের সাথে দেখা হয়েছিল তার? ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বাসের জানালার সাথে মাথা ঠেকালো তৃষ্ণা। মনে মনে আওড়াতে লাগলো মাহসানের বলা কথাগুলো....
"বসতে পারি?" "আমি তৃষ্ণার হাজবেন্ড। মাহসান চৌধুরী অর্ক।" "তোমার জব করতে হবে কেন? ঘরে ছেলে ফেলে বাইরে এসে নষ্টিফষ্টি না করলে চলতো না? তোমার ভাই এত বড় বড় কথা বলে তোমাকে নিয়ে চলে গেল। আর এখন সেই তোমাকে আর টানতে পারছে না?" "অবশ্যই বাধ্য। তুমি আমার ছেলেকে ফেলে রেখে আসবে আর আমার কাছে কৈফিয়ত দেবে না?" "একাও বুঝি সন্তান জন্ম দেয়া যায়?" "আপনি যে কি কাজ বুঝাচ্ছিলেন সেটা তো নিজ চোখেই দেখলাম... স্টাফের বুকের দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকানো, স্টাফের শরীরে নানা বাহানায় টাচ করাই আপনার কাজ বোঝানোর নমুনা?" "জাস্ট শাট আপ... বস হয়েছিস, বসের মত থাক। একজন বস আর স্টাফের মাঝে ঠিক যতটা ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলা উচিৎ সেভাবেই চলবি। না হলে যে চোখ দিয়ে বাজে নজরে তাকিয়েছিস তৃষ্ণার দিকে, সেই চোখই গেলে দেব।"

আচ্ছা... মাহসানের কি এখনো মনে পড়ে ওকে? তনয়কে? না... যদি মনে পড়তোই তাহলে একবার হলেও খোঁজ করতো ওদের। একবার হলেও দেখা করতে আসতো তনয়ের সাথে। কিন্তু আসে নি। দুইমাস হলো ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এসেছে সে তনয়কে নিয়ে। এর মাঝে একটাবারও তো কখনো খোঁজখবর নেয় নি মাহসান তাদের। মাহসান ভুলে গেছে তাদের। সে তার নিজের দুনিয়ায় অতৈন্দ্রিলা কে নিয়ে সুখে আছে.... তাহলে আজ কেন এতটা কেয়ার দেখালো মাহসান তৃষ্ণার প্রতি?? আর কিছু ভাবতে পারলো না তৃষ্ণা। কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে মাহসানকে দেখার পর থেকেই। এতোক্ষন শরীফ আহমেদের সামনে থাকার কারণে নিজেকে সামলে রেখেছিল। তবে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না তৃষ্ণা। দুই চোখ দিয়ে অঝর ধারায় কষ্টগুলো ঝরতে লাগলো অনবরত। অতীতের সব কিছু ভুলে নতুন পথ ধরে চলতেই আজ ঢাকায় এসেছিল সে। অথচ সেই নতুন পথেও অতীতের আগমন হয়েই গেল। কি করতে চায় সৃষ্টাকর্তা তার জীবন টা নিয়ে? আর কত কষ্ট, আর কত পরীক্ষা দেবার পর সে একটু সুখের সন্ধান পাবে? যে সুখ তার অতীতের সুখের মত ক্ষণস্থায়ী নয়। যার স্থায়িত্বকাল হবে চিরকাল......

বাসায় ঢুকে জুতো জোড়া খুলতেই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো তৌহিদের। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই মুখের ভঙ্গির পরিবর্তন হলো তৌহিদের। 
-"হ্যালো দোস্ত?"
-"আরে রাখ তোর দোস্ত ফোস্ত! তোর সাথে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে?"
ঘরে ঢুকেই হাতে থাকা কোট বিছানায় রাখলো তৌহিদ। তারপর ধীরেসুস্থে বসে জোড় গলায় হাসতে হাসতে বললো,
-"এতো ক্ষেপছিস কেন? কি হইছে রে?"
-"চুপ... একদম চুপ। ব্যাটা বিয়ে করে মনে হয় আকাশের চাঁদ হাতে পাইছে। অন্য কোনোদিকে তার কোনো নজর নাই।"
-"তোর বিয়ের পর এ নিয়ে কথা হবে। আপাতত এই বিষয়টা সাইডে থাক।"
-"আমি বিয়ে করলে তো! আজীবন চিরকুমার থাকার পণ করছি কি বিয়ে করে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বউ নিয়ে ঘোরার জন্য!"
-"ওমন পণ কতোজনই তো করে..."
-"তুই আমার আর অন্যদের এক করে ফেলছিস!"
তৌহিদ কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
-"বাদ দে। কোথায় আছিস? কেমন আছিস? কি খবর তোর?"
-"আর খবর!! আচ্ছা শোন, যার জন্য কল করছিলাম। একটা কেসের জন্য আমাকে নারায়ণগঞ্জ যেতে হচ্ছে কাল। কেস টাও একটা ড্যাম কেস। শালার বউ এর বান্ধুবি নিয়ে নষ্টিফষ্টি। তারপর খুন।"
-"পরকিয়ার ব্যাপার দেখছি। তা কে খুন হলো তিনজনের মাঝে?"
-"কে আবার হবে? এই ক্ষেত্রে বলির পাঠা বউ রাই হয়। মেয়েটা আমাদের রাজশাহীর, শ্বশুর বাড়িও এখানেই। তবে ওর লাশটা পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু কথা হচ্ছে জল টা অনেক দূরে গড়িয়েছে। মেয়ের বাবা মন্ত্রী টন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ আছে। প্রথমে কেস টা ছোট ভেবে ফাইলেই বন্দি রাখতে চাইলেও পরবর্তী তে আর তা হয়ে উঠলো না। উপর থেকে ওর্ডার আসছে। ওই শালারে জেলের ভাত খায়িয়েই ছাড়বে মেয়ের বাপ।"
সব শুনে তৌহিদ কিছুটা নড়ে চড়ে বসলো। ইশারায় অর্থিকে ফ্যানটা ছাড়তে বললো। তারপর বললো,
-"আর এর কারণেই তুই নিজেই আসছিস কেস টা হ্যান্ডেল করতে... আমাদের এসপি সাহেব। তা কখন আসছিস?"
-"কাল সকালেই রওনা হব। তোকে ইনফর্ম করবো,, সমস্যা নাই। তবে কথা হচ্ছে দুপুরে তোর বাড়িতে খাবো। ভাবির হাতের রান্না... আহ! ভাবতেই এখনি জিহ্বায় পানি এসে যাচ্ছে।"
সামান্য হাসলো তৌহিদ। বললো,
-"সেটা আবার বলতে হবে! আর শুধু দুপুর কেন! যে কয়দিন নারায়ণগঞ্জ আছিস আমার বাসায়ই থাকবি খাবি। বিয়েতে দাওয়াত করলেও আসতে তো পারিস নি। তার আগেই হুটহাট বিয়েটা হয়ে গেল। পরে তোদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর কথা অর্থি অনেকবার বলেছে। তবে আমিই সময় পাচ্ছিলাম না।"
-"হয়েছে হয়েছে। আর চাঁপা পেটা বন্ধ কর। অহ,, আরেকটা কথা। আমার সাথে রায়ানও আসছে। অনার্স ফাইনাল দিয়ে বসেই আছে। ভাবলাম সাথে নিয়ে গিয়ে ইনভেস্টিগেশনের কিছু শিখিয়ে আনি।"
-"এটাও আবার বলতে হবে!! তোর......"

অর্থি তনয়কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা শুনছিল তৌহিদের। সেই কখন থেকে ফোনে কথা বলছে অথচ শেষই হচ্ছে না। কার সাথে কথা বলছে? তুইতুকারি যেহেতু করছে সেহেতু কোনো ফ্রেন্ড। কিন্তু এতো কিসের কথা ফ্রেন্ডের সাথে! 
তৌহিদ ফোন রেখেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে ইশারায় অর্থিকে এগিয়ে আসতে বললো নিজের দিকে। অর্থি কপাল কুঁচকে তৌহিদের পাশে বসতেই তৌহিদ এক হাতে নিজের দিকে টেনে আনলো অর্থিকে। চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে বললো,
-"কপাল কুঁচকানো কেনো? কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম না। ছেলের সাথেই বলছিলাম।"
-"কার সাথে?"
-"মুহিব। তোমাকে বলেছি তো ওর কথা। আমার আবার বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই। তবে যা আছে তার মাঝে মুহিব খুব কাছের।"
কপালটা স্বাভাবিক করে অর্থি বললো,
-"অহ... কি বললেন উনি?"
-"কাল আসবে নারায়ণগঞ্জ। তাই জানিয়ে দিল।"
-"এখানে? মানে এ বাসায়?"
-"হুম... কেনো কোনো সমস্যা? ঘর তো খালিই পড়ে আছে। আসলে তো সমস্যা হবার কথা নয়।"
অর্থি তৌহিদের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
-"উফফ! আমি কি বলেছি আমার কোনো সমস্যা? শুধু জানতেই তো চাইলাম।"
তৌহিদ অর্থিকে ছেড়ে এবার হাত বাড়ালো তনয়ের দিকে। তনয় দিন শেষে মামার দেখা পেয়ে সেই কখন থেকেই হাত পা নাড়িয়ে আকারে ইংগিতে বোঝানোর তালে রয়েছিল সে এখন তার মামার কাছে যেতে চায়। তবে অর্থি তার চাওয়ায় সাড়া না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
-"ঘাম মাখা শরীর নিয়েই ওকে ধরবে না। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।"
তৌহিদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"তোমার মন মেজাজ খারাপ নাকি? সকালে তো ঠিকঠাকই ছিল। তা হঠাৎ কি হলো?"
-"কিছুই হয় নি। তুমি যাও শাওয়ার নেবে না কি করবে করো।"
তৌহিদ পরণে থাকা শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
-"গোছল করবো। তৃষ্ণা এসেছে ইন্টার্ভিউ দিয়ে?"
-"না। কল করেছিলাম বললো কাছাকাছি।"
বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল অর্থি। নিজের মন টা কোনোভাবেই ঠিক করতে পারছে না সে। শাশুড়ির উপর রাগ করে থেকে তৌহিদের সাথে খারাপ করে কথা বলার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তার নিজেরই বা কি করার আছে! কিছুই ভালো লাগছে না আজ তার.... অর্থি রান্নাঘরে এসে খাবার গরমের জন্য চুলো জ্বালাতেই রান্নাঘরে ঢুকলো তৌহিদা বেগম। ধমকের সুরেই বললো,
-"ওকে এভাবে কোলে নিয়েছো কেনো! কচি হাত... যদি ভেঙে যায়! আর ওকে কোলে নিয়েই চুলো জ্বালাচ্ছিলে কেনো! আগুন লাগলে!!"
শাশুড়ির কথায় তার দিকে ফিরে তাকালো অর্থি। তারপর খুব ঠান্ডা গলায় জবাব দিল,
-"আমি ঠিকঠাক ভাবেই কোলে নিয়েছি ওকে... আপনি আমার সাথে কিছুদিন হলো এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করছেন, মা? যা ভুল করেছে আমার ভাই করেছে। আমি তো কিছু করেনি।"

     (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ