সম্পর্কের টান
পর্ব-৯+১০
রাতের খাবার খাওয়া শেষের দিকে সবার। ঠিক সেই মুহূর্তে মহসিন চৌধুরী হালকা কেশে সবার দৃষ্টি তার দিকে আকর্ষণ করলেন।
-"বৌমা?"
তৃষ্ণাকে ডাকতেই সে বলে উঠলো,
-"জ্বি, বাবা।"
-"এই সময় টায় খুব কেয়ারফুলি চলবে। তোমার শাশুড়ি যখন যা খেতে বলবে, যখন যেভাবে চলতে বলবে সেভাবে চলার চেষ্টা করবে।"
বলেই থামলেন মহসিন চৌধুরী। তৃষ্ণা তার দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধন সম্মতি জানিয়ে আবার প্লেটের দিকে তাকালো। মাহসান কে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না মহসিন চৌধুরী। পরে একসময় বলা যাবে! আপাতত যে কথা বলা টা জরুরী সেটা বলা দরকার। ভেবে ঐতিহ্যর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
-"পরীক্ষা তো শেষ,, না?"
খেতে খেতেই উত্তর দিল ঐতিহ্য।
-"হু।"
-"কেমন হলো?"
-"ভালোই হয়েছে।"
ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললেন মহসিন চৌধুরী। কি দিয়ে সে শুরু করবে কথা টা? পেঁচিয়ে কথা বলে লাভ নেই। ঐতিহ্যর বুঝতে সময় লাগবে। তাই আর না পেঁচিয়ে আসল কথা বলে ফেললেন মহসিন চৌধুরী।
-"আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি তৃষ্ণার ভাই তৌহিদের সাথে। তোর এখানে কোনো কথা আছে?"
মহসিন চৌধুরীর কথায় যেন বাজ পড়লো পুরো খাবার টেবিলজুড়ে। সবাই স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ঐতিহ্যর বিষ্ময় তো কোনো ভাবেই কমছে না! সাথে আবার হাত পা ও কাঁপাতে শুরু করে দিয়েছে। কি জবাব দেবে সে এখন তার বাবা কে??
ঐতিহ্যর কিছু বলার আগেই পাশের চেয়ার থেকে অর্থি বলে উঠলো,
-"ইম্পসিবল! তুমি কি উলটাপালটা বলছো এসব, বাবা! তৌহিদ ভাইকে তুমি দেখছো? কোন দিক দিয়ে সে যায় আপুর সাথে? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে! আর স্মার্টনেসের তো স ও মনে হয় জানে না সে। আর তাদের বাসা দেখেছো! মনে হয় মুরগীর খোঁপ! আপু এডজাস্ট করবে ওখানে কিভাবে!"
মহসিন চৌধুরীর চোখ রাঙানো দামাতে পারলো না অর্থিকে। সে বলতেই থাকলো,
-"আর আপুর মাঝে তো কোনো খুঁতও নেই। শুধু গায়ের রঙ শ্যামলা। এই তো! এর জন্যই কি আপুকে তুমি তৌহিদ ভাইয়ার মতো কারো গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাচ্ছো? তাহলে বলবো, তোমার আজকালকার দুনিয়া সম্পর্কে কোনো আইডিয়াই নেই! আপুর চুল দেখছো তুমি! আপুর এই চুল দেখেই যে কতো ছেলে ফিট হয়ে পড়ে থাকে এটা জানো? আর তুমি কিনা....."
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল অর্থি। তার আগেই মহসিন চৌধুরী থামিয়ে দিল অর্থিকে।
-"ছোট, ছোট দের মত থাক। যা বলেছিস অনেক বলেছিস! এবার আমার সামনে থেকে বিদায় হ।"
অর্থি খাবার ছেড়ে ক্ষোভ দেখিয়ে উঠে পড়লো টেবিল ছেড়ে। হনহন পায়ে সে এগুলো তার ঘরের দিকে। মহসিন চৌধুরী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঐতিহ্যর উদ্দেশ্যে বললেন,
-"এখন বলতে হবে না তোর কিছু। তুই চিন্তা ভাবনা কর। তারপর জানা। তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি এগুতে চাই। তাই কাল সকালের মাঝে আমাকে জানালে আমার জন্য সুবিধা হয়। মাহসানের বিয়েটা মনের মত করে না দিতে পারলেও তোর টা দেবো। এখন হাতের অবস্থাও খুব ভালো। তাই চাচ্ছিলাম হাত খারাপ হবার আগেই বিয়ের কাজ টা সেরে ফেলতে।"
বলেই টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন মহসিন চোধুরী।।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তৃষ্ণা ড্রেসিং টেবিলে সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি দিতেই বিছানা থেকে মাহসান বলে উঠলো,
-"বাবার সিদ্ধান্তে কিছু বলার আছে তোমার?"
-"না।"
শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে মাহসান বললো,
-"বাবা আজ একটু বেশিই করে ফেললো। দিনেদিনে বয়স বাড়ার সাথেসাথে বাবার বুদ্ধিটা ধীরেধীরে কমছে।"
ওপাশ থেকে তৃষ্ণার কোনো সারা না পেয়ে আবারো বললো মাহসান,
-"এসব আলোচনা করার আগে বাবা একবার আমার সাথে কথা বলতে পারতো। তৌহিদ আর ঐতিহ্য! কোনোভাবে যায়! ইটস টু মাচ!!"
এ পর্যায়ে বুক উথলে বেরিয়ে আসা কান্নাটা আর আটকে রাখতে পারলো না তৃষ্ণা। মাহসানের দিকে না তাকিয়েই নাক টেনে টেনে সে বলতে লাগলো,
-"এখন এসব বলছো কেন! অর্থির মতো টেবিলে তোমার বাবার সামনে বললেই পারতে। আমাকে এসব কেন শোনাচ্ছো তুমি! আমার ভাই কিসে কম? শুধু হাটাতে একটু সমস্যা। আর এর জন্যই এতো কথা শুনতে হবে তাকে? তোমার মতো আমার ভাই বাপের টাকায় চলে না, প্রতিষ্ঠিত কোনো বাপ ছিল না তার সমাজে। নিজের যোগ্যতায় আজ সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তার টাকায় এখন আমার বাবামাও চলে। আমার ভাইকে নিয়ে তোমরা ভাই বোনের কথা বলার আগে, নিজেদের যোগ্যতা গুলো দেখে নেবে।"
বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল তৃষ্ণা।
অর্থি শুয়ে শুয়ে রায়ানের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করছিল। হঠাৎ তার ঘরে মা শান্তি বেগম প্রবেশ করতেই উঠে বসলো সে। বললো,
-"কিছু বলবে?"
মেয়ের পাশে এসে স্থিরভাবে বসলেন শান্তি বেগম। শান্ত গলায় বললেন,
-"তুই যে আজ টেবিলে বসে কথা গুলো বলেছিস, ওগুলো কি বলা উচিৎ ছিল তোর?"
-"অবশ্যই ছিল! বাবা এমন লো মাইন্ডের কাজ করবে, আর আমি কিছু বলতে পারবো না!!"
-"না,, তুই ছোট, অর্থি।"
-"হেল!! ছোট ছোট করবে না একদম!"
-"কথায় কথায় এমন মাথা গরম করিস কেন? মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বোঝা এবং বলার চেষ্টা করবি। কথা গুলো বলার সময় কি একবারো খেয়াল করেছিলি তোর ভাবিও আমাদের সাথে বসেছিল খেতে!! ওর ভাই, ওর ফ্যামিলি নিয়ে তুই আজেবাজে কথা শুনালি। ওর কেমন লেগেছে এটা কি একবার ভেবেছিস? তোর সামনে তোর ভাইবোন দের নিয়ে কেউ এধরনের কথা বললে তোর কেমন লাগতো?"
মায়ের কথায় হুশ হলো অর্থির। জিহ্বা কামড়ে বললো,
-"শিট! ভাবি ওখানে ছিল এটা একদম মাথায় ছিল না আমার!"
-"তা থাকবেই বা কি করে! কথা বলার সময় কোনোদিক খেয়াল রাখিস তুই! শুধু কথা বললেই মানুষ বড় হয়ে যায় না। ধীরেধীরে বড় হচ্ছিস। এগুলো মাথায় রাখতে শেখ। এই যে আমি কালো! তোর বাবা এ নিয়ে কখনো কিছু বলেছে আমায়? কখনওই বলে নি। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই কিছুনা কিছু খুঁত থাকে। কোনোমানুষই কিন্তু ত্রুটিহীন নয়! তোর মাঝেও কিছু না কিছু খুঁত আছে। বল, নেই?"
মায়ের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে নিরব দৃষ্টিতে অর্থি তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে।
নিহালের নাম্বার ফোনের স্ক্রিনে আসতেই কল রিসিভ করলো ঐতিহ্য। ধীরগলায় বললো,
-"হ্যালো!"
-"কি করছে আমার ছাত্রীটা?"
-"কিছু না।"
-"খাওয়াদাওয়া হয়েছে তার?"
-"হুম!"
-"তার কি কোনো কারণে মন খারাপ?"
ঐতিহ্য কি এখন নিহাল কে বলে দেবে সব? কিন্তু কিভাবেই বা বলবে! নিহাল তো এখনো তেমন ভাবে কিছুই বলে না তাকে! হুম, নিহালের কার্যকলাপের মাধ্যমে বোঝা যায় নিহাল অনেক বেশিই পছন্দ করে তাকে! কিন্তু মুখফুটে বলে না কেন তাকে কিছু!!
-"কিছু হয়েছে, ঐতিহ্য?"
-"উহু।"
-"আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে খুলে বলো তো।"
-"বলছি তো কিছু না!"
-"ওকে! দেন চলো কাল বিকেলে ঘুরতে বের হই!"
-"আচ্ছা।"
-"ভার্সিটিতে আসবে কাল?"
-"দেখি! আচ্ছা, রাখছি। আম্মা ডাকছে।"
হঠাৎ দরজার নক করার শব্দ পেয়ে ফোন রেখে দিল ঐতিহ্য। এগুলো দরজার দিকে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শান্তি বেগম বললেন,
-"ঘুমিয়ে গিয়েছিলি?"
-"উহু, বসো।"
বিছানায় এক কোণায় বসলেন শান্তি বেগম। বললেন,
-"তুইও বয়। কথা বলি একটু।"
মায়ের পাশে বসলো ঐতিহ্য। শান্তি বেগম মেয়ের গায়ে আদরমাখা হাত রেখে বললো,
-"কারো মাঝের কোনো প্রতিবন্ধকতা কিন্তু তার স্বভাব চরিত্র প্রকাশ করে না, ঐতিহ্য।"
মাকে কাছে পেয়ে স্বস্তির সহিত ঐতিহ্য বললো,
-"আম্মা, আমি সেসব দিক ভাবিও না। তবে আমি বিবিএ টা কমপ্লিট করে তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবতে চাই।"
-"ওদের ফ্যামিলি যথেষ্ট শিক্ষিত। তোর পড়াশোনার ব্যাপারে ওদের কোনোরকম সমস্যা নেই।"
-"তবুও!!"
-"তুই কি তৌহিদকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না?"
খানিকটা সময় নিরব থাকার পর মায়ের দুহাত চেপে ধরলো ঐতিহ্য। ধীরগলায় বললো,
-"না।"
(চলবে)
"""সম্পর্কের_টান"""
পর্ব-১০
বেশ কদিন হলো ফজরের নামায কাজা হয়ে যাচ্ছে মহসিন চৌধুরীর। একদিকে বয়স ধীরেধীরে বাড়ছে তার। সেই সাথে অপরদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা রকম অসুখ বিশুখের সংখ্যাও! তার জের ধরেই তাকে নিতে হচ্ছে নানানপ্রকারের ঔষধ। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘুম!
বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে অযু করে এসে ৪ রাকাত কাজা নামায আদায় করে নিল মহসিন চৌধুরী। জায়নামাযে বসে কিছুক্ষণ আল্লাহর নাম জপে উঠে পড়লো সে।
-"টেবিলে খাবার দিয়েছি!"
শান্তি বেগমের কথায় তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলে মহসিন চৌধুরী। তারপর ধীরেধীরে এগুলেন ডাইনিং এর দিকে।
-"ওরা কেউ উঠেছে?"
-"না। এখনো উঠে নি।"
-"ঐতিহ্যর সাথে কথা বলতাম। কিন্তু আজ আবার একটু বাইরে কাজ ছিল। তাড়াতাড়ি বেরুবো। ডেকে উঠাও ওকে।"
-"থাক, এখন ঘুমাচ্ছে,, ঘুমোক। তুমি না হয় রাতে এসে কথা বলো।"
-"হুম,, ওটাই ভালো হবে। এখন এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
খাবার শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মহসিন চৌধুরী। স্ত্রী শান্তি বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-"আমি বেরুচ্ছি,, মাহসান উঠলে আমাকে একটা কল দিতে বলো।"
ঘুম ভেঙে রায়ানের ম্যাসেজ পেয়েই মন টা ফুরফুরে হয়ে গেল অর্থির। তার সকাল টা শুরু হলো এক নতুন আমেজে!
Riyad Ahmed Rayan - শুভ সকাল💜
Orthy Chowdhury - gd mrng!
ম্যাসেজ সেন্ড হবার সাথেসাথেই ওপাশ থেকে উত্তর এল,
Riyad Ahmed Rayan - ঘুম কেমন হলো?
Orthy Chowdhury - জানি না!! আমাদের কি দেখা হবে না?😣
Riyad Ahmed Rayan - হবে।
Orthy Chowdhury - কবে! কেয়ামতের দিন?🙄
Riyad Ahmed Rayan - তোমার এটা খুবই বাজে অভ্যাস! কেয়ামত নিয়ে কেউ মজা করে?
Orthy chowdhury - আমি সিরিয়াসলি বলছি। কোনদিক দিয়ে মনে হলো এটা মজা করে বলছি!😠
Riyad Ahmed Rayan - ওকে! ওকে! কুল ডাউন😶
Orthy chowdhury - 😂😂
তুমি ঢাকায় আসবা কবে?🤕
Riyad Ahmed Rayan - এর আগের মাসেই তো গিয়েছিলাম। তখন তোমাকে এতবার কল দিলাম, ম্যাসেজ করলাম অথচ তুমি কোনো রিপ্লাই করলা না। এখন আবার এই মাসে ঢাকায় যাওয়া কি সম্ভব নাকি! প্রতিমাসে মাসে রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাওয়া ইজি না!
Orthy chowdhury - আজব! ইজি না হবার কি আছে! তুমি কি পায়ে হেটে আসবা নাকি! গাড়িতে আসবা, গাড়িতে যাবা। আর তখন কেন তোমার কলের রেসপন্স করি নি সেটা ভালো করেই জানো তুমি!😡
Riyad Ahmed Rayan - না,, জানি না। এখন একটু দয়া করে বলবেন!🤔
Orthy chowdhury - ফাজলামো কম করো! তুমি দুনিয়ার মেয়েদের পিকে লাভ রিয়াক্ট দিয়ে দিয়ে বেড়াবা! আর আমি তোমার ম্যাসেজ, কলের রেসপন্স করবো!!🤧
Riyad Ahmed Rayan - গুলশানে নাকি কিভাবে আগুন লাগছে! তার পোড়া পোড়া গন্ধ কিন্তু আমরা রাজশাহী বাসি রাও পাচ্ছি!🤣
Orthy chowdhury - 🙄
Riyad Ahmed Rayan - অর্থি বাবু, জেলাস!!😆
Orthy chowdhury - জ্বি না🤐
Riyad Ahmed Rayan - জ্বি,, হ্যাঁ।😘 আপনার জেলাস লুকটা দেখার জন্য আমার মন টা আনচান করছে!😍 ভিডিও কল দিচ্ছি।"
Orthy chowdhury - এই না!! মোটেও না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। গেলাম আমি! বাই😏
ফোন বিছানায় রেখে গাল দুলিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিল অর্থি। তারপর পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে।
আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করেছে। একটার পর একটা মেঘ ছুটে ছুটে খেলা করছে পুরো আকাশ জুড়ে! তুমুল বৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছে ভেসে বেড়ানো মেঘের এই দল গুলো। শ্রাবণ মেঘের এই দিনে, হাতে হাত রেখে পাশে বসে আছে প্রিয়তমা!! ভাবতেই ভালো লাগার এক জোয়ার বয়ে গেল নিহালের হৃদয় জুড়ে। এতোদিনের না বলা কথা গুলো কি আজ খুলে বলবে সে তার প্রিয়তমা কে? এতোদিন বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারে নি নিহাল ঐতিহ্য কে। বারবার শিক্ষকছাত্রীর সম্পর্কর কথা ভেবে সংকোচ করে কিছুই বলা হয়নি! শিক্ষক ছাত্রীর মাঝে সম্পর্ক হওয়া উচিৎ সম্মানের, শ্রদ্ধার, স্নেহের সাথে ভালোবাসারও। হুম.. তার আর ঐতিহ্যর সম্পর্ক বাদবাকি আর দশটা শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্কের মত নয়। তবে এতে কিন্তু কোনো দিক থেকে সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহের কমতি নেই। শিক্ষক ছাত্রী হিসেবে নয়,, একজন ছেলে হিসেবে একজন মেয়েকে নিজের করে পেতে চায় নিহাল ঐতিহ্যকে। ভালোবেসে ফেলেছে সে ঐতিহ্য কে। ঐতিহ্যর লাজুক ভঙ্গিতে কথা বলা, নিরবতা, ঠোঁট টিপে হাসা সবই মুগ্ধ করে ফেলেছে তাকে। তিন মাস আগে যেটা শুধু ভালোলাগায় সীমাবদ্ধ ছিল,, সেটা এখন আর ভালোলাগাতে সীমাবদ্ধ নেই। তিনটা মাস নিহালের কাছে ছিল ঐতিহ্য কে জানার আর বোঝার জন্য যথেষ্ট! হুম,, নিহাল তার জীবনের লক্ষ স্থির করে ফেলেছে। ঐতিহ্যর সাথেই জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দিতে চায় সে।।
ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল নিহাল। বিকেল ৫.৪৫ বাজে! এখনো এসে উপস্থিত হয় নি ঐতিহ্য। এমনকি আসার কোনো লক্ষণ ও দেখা যাচ্ছে না। কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে ঐতিহ্যর। কিন্তু কি! আর সে নিজেই কি আজ সব খুলে বলতে পারবে ঐতিহ্য কে!
সন্ধ্যা হবার একটু আগে ঐতিহ্য এসে পৌঁছালো ধানমন্ডি লেকে। আশেপাশে তাকিয়ে নিহালকে খুঁজতেই পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠলো নিহাল।
-"এতো দেরি হলো যে! আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না। চলো, ওদিকটায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।"
হাটতে হাটতে দুজনে এগুতে লাগলো সমান তালে।
-"বৃষ্টি কেমন লাগে তোমার? আমাদের দেশে কিন্তু বৃষ্টিপ্রেমীর সংখ্যা অগণিত! শতকরায় হয়তো ২/৩ ভাগ লোক বৃষ্টিপ্রেমী নয়! তুমি কোন ভাগে আছো?"
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ঐতিহ্য বললো,
-"প্রেমীর দলে।"
খানিকটা সময় এটাসেটা নিয়ে কথোপকথন চালানোর পর নিহাল খেয়াল করলো আজ ঐতিহ্য নিহালের কোনো কথাই তেমন মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। শুধু হা হু করে যাচ্ছে। অন্যদিন গুলোতে নিহালের প্রায় সব কথাই খুন মনোযোগ দিয়ে শুনে নিজের মনে গেঁথে নেয় ঐতিহ্য। তাহলে আজ কি এমন হলো.....
-"ঐতিহ্য?"
-"হু।"
-"কি হয়েছে তোমার? আজ হঠাৎ এমন উদাসীন লাগছে তোমায়!"
ঐতিহ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"মনে হচ্ছে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হবে!"
-"আমার দিকে তাকাও! কি হয়েছে তোমার? কথা এভাবে ঘুরাচ্ছো কেন?"
-"আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না, স্যার... ফোনে কথা বলা, প্রায় বিকেলেই ঘুরতে বের হওয়া এগুলো কেন করছি আমরা?"
-"তোমার কি আমার সাথে ফোনে কথা বলতে বা ঘুরতে ভালোলাগছে না আর?"
-"সেটা কি একবারো বলেছি!"
-"তাহলে?"
এ পর্যায়ে নিহালের দিকে ফিরলো ঐতিহ্য। চোখ বুজে কাঁপাকাঁপা স্বরে বললো,
-"আমার বিয়ে ঠিক করেছে আমার বাবা।"
ঐতিহ্যর কথায় বুকটা কেঁপে উঠলো নিহালের। বামপাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো সে। অদ্ভুত এক ধরণের কষ্ট এসে গলা চেপে ধরলো তাকে। কিছু বলতে গিয়েও বলার মত শক্তি নিজের শরীর থেকে পেল না সে। আজ নিজের শরীরটাই প্রতারণা করছে তার সাথে..
-"এখন শুধু আমার মতের অপেক্ষা!"
কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় নিহাল বললো,
-"অহ!! কনগ্রাটস। এটাতো ভালো খবর!"
নিহালের এ ধরণের প্রতিক্রিয়ায় বুকের মাঝে উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল ঐতিহ্যর। তার মানে তনিই ঠিক বলেছিল! স্যার ওকে ভালোবাসে না। ওর নিজের স্যারের প্রতি দূর্বলতা দেখে সেই সুযোগ নিয়েছিল নিহাল! ব্যবহার করেছে নিহাল তাকে! অবশ্য ওর মতো মেয়েকে নিহালের মত ছেলে ভালোবাসবেই বা কেনো? কি আছে ওর মাঝে! না আছে রূপ, না গুণ! তাহলে কিভাবে নিহালের মতো কোনো ছেলের মনে জায়গা করতে পারবে সে! তার জন্য তৌহিদই উপযুক্ত!
আর এক মিনিট ও নিহালের পাশে বসে থাকার মতো কোনো কারণ খুঁজে পেল না ঐতিহ্য। উঠে দাঁড়িয়ে ধীরপায়ে এগুতে লাগলো সে। আকাশের বুক চিরে টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। সেই সাথে ব্যস্ত শহরের ফুটপাত ধরে হেটে চলছে ঐতিহ্য। খোলা লম্বা চুল গুলো ভিজে, তা দিয়ে টপাটপ বেয়ে পড়ছে পানির ধারা। সাথে ঐতিহ্যর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম ধারায় পানি। সব পানি মিশে একাকার হয়ে এক স্রোতধারায় গড়িয়ে যাচ্ছে। এতো জল জমা ছিল পৃথিবীর বুকে!!
রাতে মহসিন চৌধুরী বাসায় ফিরেই ঢুকলো ঐতিহ্যর ঘরে। আলো জ্বালিয়ে মেয়ের মাথার পাশে বসে হাত রাখলো তার মাথায়। আদরমাখা গলায় বললো,
-"এখন এভাবে অন্ধকারে শুয়ে আছিস যে! শরীর খারাপ নাকি!"
বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে উঠে বসলো ঐতিহ্য। ধীর গলায় বললো,
-"উহু.. বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম বাসায় ফেরার সময়। অনেকদিন পর মাথায় বৃষ্টির পানি পড়াতে মাথা ভার হয়ে আছে। সাথে নাকটাও বন্ধ হয়ে আসছে।"
-"বৃষ্টিতে ভিজতে গেলি কেন আবার!"
-"ওসব বাদ দাও। কিছু বলবে?"
-"হ্যাঁ,, তৌহিদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলি? শোন, আমি তোর বাবা। আমি চাই তুই ভালো থাক। আমি তোর মাঝের কোনো ত্রুটি বা তৌহিদের মাঝের কোনো ত্রুটির জন্য বিয়ের কথা টা উঠাই নি। আমি তৌহিদকে দেখেছি, বুঝেছি, ওদের ফ্যামিলি কে চিনেছি,, তারপরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তৌহিদের মা অনেক ভালো একজন মহিলা। সাথে ওর বাবাও। তারা তৌহিদ বল আর তৃষ্ণা বল, দুজনকেই অনেক ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে। তৌহিদ অনেক ভালো ছেলে। বড়দের প্রতি ওর সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার প্রশংসা না করে পারছি না। ও তোকে অনেক ভালো রাখবে, তুই সুখী হবি ওর সাথে, মা।"
ঐতিহ্য খুব কষ্টে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"আমি জানি, বাবা। তোমার খুশিমতো তুমি আগাও। আমার কোনো কথা নেই এতে!"
মেয়ের কথায় মন টা ভরে গেল মহসিন চৌধুরীর। এই একটা মেয়ে, যে কোনোদিন তার কথার বাইরে যায় নি। কোনো কাজে অবাধ্য হয় নি। মায়ের মত হয়েছে একদম। মেয়ের মাথায় আবারো হাত রেখে আশীর্বাদী চোখে তাকিয়ে মহসিন চৌধুরী বললো,
-"আমি জানতাম! আমার কথার অবাধ্য একদম হবি না তুই। তাই সব কিছু আগের থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম। আচ্ছা, আমি যাই ফ্রেশ হই। আবার বেয়াই কে ফোন দিয়ে ডেট ঠিক করতে হবে। তুই শুয়ে থাক। আমি তোর মা কে ঔষধ দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
মনে একরাশ স্বস্তি নিয়ে মহসিন চৌধুরী পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
ডিনার করতে বসেও কিছু খেতে পারলো না নিহাল। গলা দিয়ে কিছুই নামছে না তার। এক অসহ্য যন্ত্রণার শুধু ছটফট করে যাচ্ছে। কি করবে এখন সে? হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠায় তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো নিহাল। হয়তো ঐতিহ্য কল করেছে! ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই সাজিদের নাম্বার ভেসে উঠতেই মন টা আবারো খারাপ হয়ে গেল নিহালের। হতাশা নিয়ে ফোন রিসিভ করলো সে।
-"কিরে দোস্ত! কি খবর? কেমন আছিস? আর দেখাই মেলে না তোর! আমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেলি নাকি!"
-"এইতো আছি। তোর কি খবর? ছেলেমেয়ে দুটো কেমন আছে?"
-"আমি তো জব্বর! সাথে তিতাস আর স্বাতীও। হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায় দুটো! একদিন কি হয়ছিল জানিস! স্বাতী হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ির পাশে চলে গিয়েছিল! আর একটু হলেই আমার মেয়েটা একদম যেতো!"
-"দরজা খোলা রেখেছিলি কেনো?"
-"আরে ভাই, কখন কে বাইরে যায় আর না যায়! দরজা খুলে রেখেই বেড়িয়ে পড়ে।"
-"এখন থেকে সাবধান হ!"
-"হু,, তা তোর কি খবর? আসবি কবে বাড়িতে? কাল গেছিলাম তোদের ওইদিক। দেখা করে আসলাম চাচা চাচির সাথে।"
-"অহ! যাবো কিছুদিন পর।"
-"কিছু হইছে নাকি? মন টন খারাপ মনে হচ্ছে?"
-"না, এমনি। ভাবি কেমন আছে?"
-"এমনি অবশ্যই না! কারণ তো একটা আছেই। দেখি বল তো কি হইছে?"
সাজিদ এবং নিহাল বাল্যকালের বন্ধু। রাজশাহীতে থাকাকালীন একসাথেই বেড়ে উঠেছে দুইজন। কিন্তু পরবর্তীতে এইচএসসি দেবার পর নিহাল চলে আসলো ঢাকায়, নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অপরদিকে রাজশাহীতেই ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লো সাজিদ। তারপর থেকে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও নিহাল বাড়িতে যাবার পর দেখা হতো দুই বন্ধুর। আড্ডা, ঘোরাফেরা চলতো আগের মত। বছর দুইয়ের বেশি হলো সাজিদ বিয়েশাদী ও করে ফেলেছে। অথচ এখনো কুমারই রয়ে গেছে নিহাল!
সাজিদের জোরাজুরিতে সব খুলে বললো নিহাল তাকে। সব শুনে সাজিদ বললো,
-"তুই তো একটা রাম ছাগল! এই তিনটা মাস ফোনে কথা বলে, ঘুরে নষ্ট না করে কাজের কাজ করে ফেললেই তো পারতি!"
অবাক হয়ে নিহাল বললো,
-"কিসব বলিস! আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি।"
-"তো আমি সেটা না করেছি নাকি! তোর স্টুডেন্ট কে ভালোলাগছে,, ভালো কথা। তোর বাবামা কে দিয়ে সরাসরি ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাইলেই পারতি তিন মাস আগে। তাইলে আর আজ এই দিন দেখতে হত না!"
সাজিদের কথা অন্যভাবে নেয়ায় কিছুটা লজ্জিত বোধ করলো নিহাল। বললো,
-"আমি আসলে তখনো সিউর ছিলাম না। কিন্তু এই তিনটা মাস ওকে জানার পর, বোঝার পর এখন আমি সিউর। এখন ওকেই লাগবে আমার.."
-"বুঝলাম সব। কিন্তু ওখানেই তোর ভুল! যাকগে, যা হবার হয়েছে। এখনো চাইলে সব ঠিকঠাক করা সম্ভব। তুই চাচা চাচিকে সব খুলে বল। তাদের পাঠা ঐতিহ্যর বাবামায়ের কাছে।"
-"কিন্তু এখন কিভাবে! ওর তো বিয়ে ঠিক..."
নিহালকে থামিয়ে সাজিদ বললো,
-"বিয়ের কথা চললেই বিয়ে ঠিকঠাক হয় না। মেয়েদের এমন অনেক বিয়েই যায় আসে। আর তুই নিজেও এখন ভালো একটা পজিশনে আছিস। ঐতিহ্য ও তোকে পছন্দ করে। সব শুনে আমার মনে হয় না ঐতিহ্যর বাবা অমত করবে। তুই পারলে কালই চাচা চাচিকে রাজশাহী থেকে রওনা হতে বল।"
সাজিদের কথায় ভরসা খুঁজে পেল নিহাল। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো। বললো,
-"থ্যাংকইউ সো মাচ, দোস্ত! আমার মাথা একদম কাজ করছিল না।"
-"ব্যাপার না!"
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ফোন কেটে দিল নিহাল। ডায়েল করলো ঐতিহ্যর নাম্বারে। ওপাশ থেকে ভেসে এল এক কর্কশ কণ্ঠী সুর 'আপনার ডায়েলকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে একটু পর.........
মহসিন চৌধুরী কল কেটে শান্তি বেগমের দিকে ফিরে মুখে একরাশ হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"সব ঠিকঠাক। আসছে শুক্রবার বিয়ের ডেট ফিক্সড করলাম।"
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।