সম্পর্কের টান । পর্ব-৭+৮


সম্পর্কের টান
 গল্প পড়ি
 পর্ব-৭+৮

ভোর ৭ টার দিকে তৃষ্ণার ঘুম ভাঙতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো বন্দি অবস্থায়। মোটা দড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তাকে। সামান্য নড়াচড়া করার মতো শক্তি বা সুযোগ কোনোটাই পাচ্ছে না সে। কিন্তু সে এ অবস্থায় কিভাবে এল? সে তো মাহসানের সাথে ছিল রাতে!! ভাবতেই চোখ মেলে তাকিয়ে চারপাশটায় চোখ বুলালো সে। সাথেসাথে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে।

তৃষ্ণাকে পেছন থেকে প্রগাঢ়ভাবে জাপটে ধরে ঘুমে তলিয়ে আছে মাহসান। সাথে এক পা তুলে দিয়েছে তৃষ্ণার গায়ে। যার কারণে হটাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠার পর নিজেকে বন্দিদশায় আবিষ্কার করেছিল তৃষ্ণা। মাহসানের হাত ধীরেধীরে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো তৃষ্ণা। তারপর মাহসানের ঘুমন্ত নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"আহ!! কি শান্তির ঘুম আপনার! অবশ্য বউ যখন কোলবালিশ তখন ঘুম তো শান্তির হবেই। না? নিন,, এবার পা টা সরিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন!"

মাহসানের যখন ঘুম ভাঙল তখন বাজে বেলা ১০ টা। তাড়াহুড়ো করে উঠে ফ্রেশ হয়ে কোনোরকম নাস্তাটা সেরে বিছানায় এসে আবারো শরীর মেলে দিল সে। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটির পর সে ডাকলো তৃষ্ণাকে।

-"কিছু লাগবে?"
-"হু।"
-"কী লাগবে।"
-"তোমাকে।"
বলেই চোখ টিপলো মাহসান। মাহসানের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেল তৃষ্ণা। মেঝের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে সে বললো,
-"মা কে কাজে হেল্প করছিলাম।"
-"মা একাই করতে পারবে। তুমি আমার সেবায় আপাতত নিজেকে নিবেদিত করো।"
-"বলেছে আপনাকে!"
-"হু,, বলেছেই তো।"
বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহসান। তৃষ্ণার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"কাল রাতে শাশুড়ি মা এসে বলে গিয়েছে সারাটা দিন তার মেয়ের সাথে কাটাতে।"
-"কচু বলেছে! সব সময় এত রোমান্স করার ধান্ধায় কেন থাকেন আপনি?"
তৃষ্ণা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল মাহসানের সাথে। মাহসান তাই তৃষ্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করলো আগে। তারপর টেনে তৃষ্ণাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল এক কোণায়। নিজে পাশে বসে বললো,
-"এখনি তো সময় রোমান্স করার। এখন না করলে আর কখন!!"
-"আপনার এই সময়ের চক্কোরে পড়ে আমার বারোটা বেজে যাচ্ছে!! আমার মত চিকণ ফিকণ একজন মেয়ের উপর কিভাবে আপনার মত হাতির এক পা তুলে দিলেন! আমার তো দম টম বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল!"
তৃষ্ণার কথায় হোহো করে হেসে উঠলো মাহসান। তৃষ্ণা খানিকটা সময় তাকিয়ে দেখলো মাহসানের সেই ভূবন ভুলানো হাসি। তারপর বললো,
-"এভাবে হাসবেন না। অসহ্য লাগে হাসি টা।"
মাহসান চুপ। হঠাৎ মাহসান হাসি বন্ধ করায় চোখের কোণা বেয়ে একদু ফোটা করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো তৃষ্ণার। কাঁদোকাঁদো স্বরেই সে বলে উঠলো,
-"থামালেন কেন হাসি? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন? কিন্তু আমি তো মন থেকে বলিনি। মিথ্যা বলেছি। আপনার এই হাসিটাই কিন্তু একজন মেয়েকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। সেখানে আমিতো এই দুইদিনে রক্তাক্ত হয়ে আছি।"

তৌহিদের কোর্ট থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল ৫ টার মতো বেজে গেল। বাড়িতে এসেই আগে গোছল সেরে নিল সে। তারপর ধীরেধীরে এগুলো মায়ের খোঁজে রান্নাঘরের দিকে।
-"মা? কী করছো?"
তৌহিদা বেগম ছেলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,
-"পিঠে বানাচ্ছি।"
-"কী পিঠে?"
-"তাল বড়া আর কাঠালের রসের বড়া।"
-"উম্মম্ম!! আমি বাসায় ঢোকবার সময়ই টের পেয়ে গিয়েছিলাম। পুরো বাড়ি তো ঘ্রাণে একদম ম ম করছে!"
তৌহিদা বেগম চুলোয় কড়াই তুলে দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"কখন এসেছিস? গোছল হয়েছে?"
-"হু,, সব শেষ। কিন্তু আজ যা গরম পড়েছে। তার ভেতর এসব ঝামেলা করতে গেলে কেন! দেখো তো নিজের দিকে তাকিয়ে! ঘেমে কি অবস্থা!"
-"কিচ্ছু হবে না। বাড়িতে নতুন জামাই! সন্ধায় কিছু সামনে দিতে হবে না তার?"
-"তো বাইরে থেকে কিছু আনালেই তো হতো!"
-"তোর যে বাপ! সে টাকা খরচ করে জিনিশ আনবে, আর সেই জিনিশ তোরা খাবি! তবেই হয়েছে!!"
-"আমাকে একটা কল দিয়ে বললেই হতো।"
-"উফফ! বিরক্ত করিস না তো। যা এখন এই গরমের ভেতর থেকে।"
তৌহিদ রান্নাঘর ছেড়ে বেরুবার পরিবর্তে ভেতরে ঢুকে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,
-"এই আটা গোলাতে হবে? কি দিয়ে গোলাবো? পানি নাকি তালের রস?"
তৌহিদা বেগম ছেলের এমন আচারণের সাথে পরিচিত। খুব বেশি ভালোবাসে তোহিদ তার মাকে। কখনো মায়ের কষ্ট হবে এমন কিছু করে না। বরং সবসময় এই চেষ্টাতে থাকে কি করে মাকে সুখে শান্তিতে রাখা যায়।
তৌহিদা বেগম দেখিয়ে দেবার পর ধীরেধীরে আটা গোলাতে লাগলো তৌহিদ। অপরদিকে তৌহিদা বেগম তেল ঢালতে লাগলো কড়াই এ।
-"তুষ কোথায়? দেখছিনা যে ওকে!"
তৌহিদা বেগম ঠোঁটে হাসি এনে উত্তর দিল,
-"তাকে কী এখন আর পাবি নাকি!! সেই সকাল থেকে ঘরের মধ্যে গুজুরগুজুর ফুসুরফাসুর করছে দুজনে। দুপুরবেলা খাবার সময় বের হয়েছিল। আবারো.."
-"যাক! তুমি খেয়াল করেছো কিনা! ও যতক্ষণ মাহসানের সাথে থাকে ততক্ষন ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে থাকে। ও সুখী আছে, মা। মাহসান ছেলেটাও অসাধারণ। আল্লাহ ওদের কে এভাবেই সবসময় সুখী রাখুক।"
-"হু,,"
বলেই ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো তৌহিদা বেগম। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে আদরমাখা গলায় বললো,
-"ঐতিহ্য কে তোর কেমন লাগে, বাবা?"
-"ঐতিহ্য টা কে?"
-"আরে তৃষ্ণার ননদ। বড়টা। হ্যাংলা পাতলা করে।"
-"ওহ!! ঐতিহ্য! ভালো তো। কথাবার্তায় যথেষ্ট নম্রতা আছে।"
-"হ্যাঁ,, নম্রভদ্র মেয়েটা। দারুণ মায়াবী একটা চেহারা। শ্যাম বর্ণের হলেও ভারি মিষ্টি কিন্তু মেয়েটা!"
তৌহিদ ধীরগলায় বললো,
-"হু।"
-"তুই তো জানিস আমার পেটের ভেতর কথা থাকে না একদম। তাই তোকেও বলে দিলাম। ঐতিহ্যর সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। বেয়াই নিজেই প্রোপোজাল টা দিয়েছে তোর বাবাকে। তবে এখনি কাওকে কিছু বলিস না। বেয়াই বলেছে ধীরেসুস্থে এগোতে। তুই ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে নে,, তারপর না হয় দিন দেখে আগানো যাবে। তোর জন্য কিন্তু ভালোই হলো। ঐতিহ্যকে জানার, বোঝার সময় পাবি তুই।"

রাতের খাবার শেষে ঘরে এসে ঐতিহ্য ফোন হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো, আজও কি সে কল দেবে নিহাল স্যার কে! কাল যেভাবে হটাৎ করে কল দিয়ে বসেছিল, আজও তেমন টা করলে কিন্তু মন্দ হয় না! কিন্তু এভাবে প্রতিদিন কল দিয়ে বিরক্ত করাটা কি ঠিক হবে! ভাবতে ভাবতেই নিহালের নাম্বার থেকে কল এল ঐতিহ্যর ফোনে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই খুশিতে দিশেহারা হয়ে গেল ঐতিহ্য। বিছানায় দাঁড়িয়ে লাফাতে শুরু করে দিল সে। একপর্যায়ে লাফানো থামিয়ে ফোন রিসিভ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-"হ্যালো!! হ্যালো!! হ্যালো!!"
-"জ্বি!! আসসালামু আলাইকুম, ম্যাম!"
নিহালের কথায় লজ্জা পেয়ে গেল ঐতিহ্য। বললো,
-"ওয়ালাইকুম সালাম, স্যার!"
-"নাইট ওয়াক করছিলে নাকি! এতো হাঁপাচ্ছো যে!"
-"না,, মানে হ্যাঁ,, ডিনার কমপ্লিট?"
-"হু,, মাত্রই হলো। কাল তো ফ্রাইডে! ছুটির দিন!"
-"হ্যাঁ.."
-"ফ্রি আছো? থাকলে চলো বিকেলে ঘুরতে যাই কোথাও!"

   (চলবে)

""সম্পর্কের_টান""

 #পর্ব-৮

নারায়ণগঞ্জে দিন দুয়েক কাটানোর পর শুক্রবার বিকেলে মাহসান এবং তৃষ্ণা রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। একদম আসতে ইচ্ছা করছিল না তৃষ্ণার বাবার বাড়ি ছেড়ে। দুদিন বাবার বাড়িতে থাকলেও বাবামা ভাইয়ের সাথে তেমন একটা সময় কাটাতে পারে নি তৃষ্ণা। মাহসান নামক নতুন এক অভ্যাস এমন ভাবে জেকে ধরে বসেছে তাকে! যা কোনোভাবেই ডিঙিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। কি আছে এই মাহসানের মাঝে? যে,, শুধু তাকে ঘিরেই কাটাতে ইচ্ছে করে প্রতিটি মুহূর্ত! তার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে সারাটা সময়! তার একটি ছোঁয়া পাবার জন্য মনটা আনচান করতে থাকে! মাহসান,, মাহসান!! চৌম্বকের মত সর্বসময় আকর্ষণ করেই যাচ্ছে তাকে। যেন এক ভয়ংকর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তৃষ্ণা। ধীরেধীরে এই নেশার মায়াজালের মাঝে ডুবে বাইরের জগতের সব ভুলতে বসেছে সে। তারই এক উদাহরণ বাবামা কে সময় না দেয়া। আর এখন,, বাবামা কে ফেলে চলে আসার সময়, সেটা খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে তৃষ্ণা। কিন্তু এখন এসব বুঝে হবে টাই বা কী! সেই তো বাবামা, পরিবার সব কিছু ফেলে চলে এসেছে সে! আবার কবে দেখা হবে কে জানে! তবে সেবার আর সময়ের অপব্যবহার করবে না তৃষ্ণা। ভেবে নিজের মনকে শান্তনা দিতে লাগলো সে।
-"মন খারাপ লাগছে?"
চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে এল তৃষ্ণা। মাহসানের কাঁধে মাথা রেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"উহু।"
মাহসান পরম ভালোবাসায় এক হাতে জাপটে ধরে নিজের বাহুর সাথে মিশে ফেলতে চাইলো তৃষ্ণাকে। একদম কষ্ট পেতে দেবে না সে তৃষ্ণা নামের এই মায়াবতী কে। যার মায়ার জালে নিজেকে ধীরেধীরে ডুবিয়ে ফেলছে সে।

গুলশান- ২ এর ৭০ নং সড়কের চারতলা বাসা থেকে বেরিয়ে ধীরেধীরে সামনে এগুতে লাগলো ঐতিহ্য। পরণে তার কমলা রঙের সিল্কের শাড়ি, চোখে গাঁঢ় কাজল, কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ, ঠোঁটে হালকা কমলা রঙের লিপস্টিক। সাজ বলতে এটুকুই। গতকালের মতো আজ রোদের তাপ বেশি একটা নেই। মাঝেমাঝে আবার ঝাপটা বাতাসও বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসের সাথেই কিছুসময় পরপর খেলায় মেতে উঠছে ঐতিহ্যর খোলা চুলগুলো।

প্রায় আধাঘণ্টার মতো গুলশান রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছে নিহাল ঐতিহ্যর জন্য। পরণে কালো শার্ট, নীল জিন্স, সোজা সিল্কি চুলগুলো জেল দিয়ে পেরে রেখেছে একদিকে, সাথে চেহারায় নার্ভাসনেস।। এভাবে রেস্টুরেন্টে দেখা করাটা ঠিক হলো কি! কোনো স্টুডেন্টের চোখে পড়লে আবার কি না কি ছড়াবে ভার্সিটিতে! এমনিতেই ভার্সিটিতে জাতীয় দুলাভাইয়ের খেতাব পেয়ে বসে আছে সে!! এসব চিন্তা ভাবনার মাঝে হটাৎ নিহাল লক্ষ করলো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে ঐতিহ্য। সাথেসাথেই তার সব অস্বস্তি, ভয় এক নিমিষেই কেটে গেল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে দেখতে লাগলো ধীরেধীরে ঐতিহ্য এগিয়ে আসছে তার দিকে।

ঐতিহ্য নেহালের সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এখনও কি তার সালাম দিতে হবে স্যার কে! ভাবতেই একরাশ অস্বস্তি এসে চেপে ধরলো তাকে।
-"বসো, দাঁড়িয়ে আছো কেন!"
-"হুম।"
হালকা হেসে নিহালের মুখোমুখি বসলো ঐতিহ্য।
-"শাড়িতে আসবে কল্পনাতেও ভাবি নি!"
-"না,, মানে একটি বিয়েতে গিয়েছিলাম তো। ওখান থেকে সরাসরি আসলাম। শাড়ি বদলানোর সময় পাই নি।"
বলেই ঢোক গিললো ঐতিহ্য।
-"আচ্ছা! ভালোই হলো। শাড়িতেও তোমাকে দেখা হয়ে গেল।"
-"হুম।"
মেনুকার্ড ঐতিহ্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিহাল বললো,
-"অর্ডার দাও।"
-"আপনি দিন। আমি কিছু নেব না।"
-"এটা কোনো কথা হলো! প্লিজ বি নরমাল! এখানে আমাকে স্যার ভাবার দরকার নেই।"
অপর পাশ থেকে ঐতিহ্যর কোনো উত্তর না পেয়ে আবারো নিহাল বললো,
-"বলো, কী নেবে?"
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর ঐতিহ্য বললো,
-"কোল্ড কফি।"
-"শুধু?"
-"হু।"
-"আরো কিছু নাও! এত কম খেলে চলবে! বেশি বেশি খাবে, তবেই না মোটা হবে!"
-"হু।"
আর কথা না বারিয়ে ওয়েটারকে ডেকে দুটি কোল্ড কফির অর্ডার দিল নিহাল। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ঐতিহ্যর কার্যকলাপ লক্ষ করলো সে। ওপাশ থেকে ঐতিহ্যর কোনো আন্তরিকতা দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে নিহাল বললো,
-"ফ্রি হতে পারছো না কেন আমার সাথে! এখানে তো শুধু আমরা দুজনেই আছি। না আছে কোনো স্টুডেন্ট অথবা পরিচিত কেউ! তাহলে সমস্যা কোথায়? প্লিজ কিছু বলো, চুপচাপ থেকে বোর ফিল হবার আগেই কথা বলো।"
নিহালের বিরক্তি নজর এড়ালো না ঐতিহ্যর। কিন্তু আকাশপাতাল ভেবেও সে কথা বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। তাই উপায় না দেখে উদ্বিগ্ন গলায় নিহালকে বললো,
-"আর মাত্র ১০ দিন আছে আমার পরীক্ষার। প্রস্তুতি খারাপ না। তবে... আচ্ছা? বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত থেকে প্রশ্ন করাটা কি খুব জরুরী?"
ঐতিহ্যর মুখ থেকে এমন কথা শোনায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো নিহাল। মেয়েটা প্রচণ্ড রকমের ভীতু। অবশ্য এই ভীতচিত্তে তাকে দেখতে কিন্তু অসম্ভব রূপবতী লাগছে!

রেস্টুরেন্টে কিছু সময় কাটানোর পর নিহাল ঐতিহ্য কে নিয়ে বেরিয়ে এল। রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে নিহাল বললো,
-"আমাদের কি এখন থেকে রোজ রাতে ফোনে কথা হবে?"
নিহালের কথায় চোখজোড়া ছলছলে হয়ে উঠলো ঐতিহ্যর। তার মনের কথা গুলো কি তাহলে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছে! নিহালের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"হ্যাঁ..."
হালকা হেসে রিকশা ডাকতে লাগলো নিহাল। রিকশা ঠিক করে ঐতিহ্যর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় বললো,
-"আমার সাথে এক রিকশায় উঠতে সমস্যা হবে না তো?"
রিকশায় একপাশে উঠে বসে, নিহালের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উত্তর দিল ঐতিহ্য।
-"না।"

রাত ১ টার দিকে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল অর্থির। অনেকভাবে চেষ্টার পরেও পুনরায় ঘুমের দেখা মিললো না। ইনসোমনিয়া রোগে দীর্ঘ ১বছর হলো ভুক্তভোগী অর্থি। তবে ইদানীং আরো বেশির দিকে যাচ্ছে। গতকাল তো পুরো রাত একভাবে জেগেই পার করে দিয়েছে সে। এক অসহ্য যন্ত্রণায় ভেতর দিয়ে সময় পার করছে অর্থি। হাজার খুঁজেও তার ইনসোমনিয়া হবার কোনো কারণ পাচ্ছে না সে। তার জীবনে তো কোনো দুঃখ কষ্ট নেই, না আছে কোনো হতাশা, দুশ্চিন্তা। তাহলে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে সারাটা রাত তাকে নির্ঘুমে কাটাতে হয় কেনো!!
বিছানা ছেড়ে উঠে কিছুক্ষণ মেঝেতে পায়চারী করলো অর্থি। অস্থিরতা কমেছে অনেকটা! বিছানায় আবারো এসে শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে এটা সেটা ভাবতেই হটাৎ ফেসবুকের রায়ান নামের ছেলেটির কথা মনে হল তার। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে উঠিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করলো সে। রায়ানের নামের পাশে জ্বলছে সবুজ বাতি। সত্যিই কি ছেলেটি এসেছে অনলাইনে? চোখজোড়া ঠিকভাবে মুছে সে আবারো তাকালো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। হ্যাঁ, অনলাইন। কোনো কিছু না ভেবেই ম্যাসেজ দিয়ে দিল অর্থি।

Orthi Chowdhury - kmn acn?
মুহূর্তের মাঝেই উত্তর এল। যেন ওপাশে রায়ান নামের ছেলেটিও অপেক্ষায় ছিল অর্থির একটি ম্যাসেজের।
Riyad Ahmed Rayan - জ্বি, ভালো। আপনি?
Orthy Chowdhury - amio valo😊
Riyad Ahmed Rayan - 👍
কিছু একটা প্রশ্ন করা উচিৎ। কিন্তু কি প্রশ্ন! অর্থি এসব ভাবতেই ওপাশ থেকে পুনরায় ম্যাসেজ এল রায়ানের।
Riyad Ahmed Rayan - তা এত রাতে এফবিতে!
Orthy Chowdhury - hmm.. ghumabo. apni ki ekhn theke regular online a asben?
Riyad Ahmed Rayan - জানি না। কেনো?
Orthy Chowdhury - emni.. sediner omn rude behave er jnno 'Sorry'🤐
Riyad Ahmed Rayan - ইটস ওকে😊
Orthy Chowdhury - thanks.. ki korcen?
Riyad Ahmed Rayan - এত রাতে আর কি করবো! শুয়ে আছি।😬
Orthy Chowdhury - oh! hae.. tai to🤣
Riyad Ahmed Rayan - 😑
Orthy Chowdhury - okay,, bye. Kal kotha hobe😄
লিখেই অর্থি বেরিয়ে এল ফেসবুক থেকে। কেমন যেন ঘুমঘুম পাচ্ছে তার। আরেকবার ঘুমানোর চেষ্টা চালিয়ে দেখা যাক!!

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তৃষ্ণা-মাহসান, ঐতিহ্য-নিহাল এবং অর্থি-রায়ানের দিন গুলো। নতুন বিয়ে, নতুন সংসার নিয়ে যখন তৃষ্ণা এবং মাহসান ব্যস্ত,, তখনি ঐতিহ্য এবং নিহাল স্যার-ছাত্রী মিলে ব্যস্ত রাত জেগে ফোনে কথা বলায়। দুজন দুজনায় এতোটাই মেতে উঠেছিল যে, কখন রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে যেতো বুঝেই আসতো না কারো। প্রথম প্রথম আড়ষ্টভাব নিয়ে কথা বললেও ধীরেধীরে নিহালের সাথে ফ্রি হয়ে যাচ্ছিল ঐতিহ্য। সব ঠিকঠাক ভাবে চললেও দুজনের কেউ কাওকে এ পর্যন্ত ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে জানানোর মত সাহস পাচ্ছিল না। অপরদিকে ভার্চুয়াল জগতে এক রঙিন স্বপ্নের সন্ধানে ঘুরছিল অর্থি। ঘণ্টারপর ঘন্টা রায়ানের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট, ম্যাসেঞ্জারের একটি টুং শব্দেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হওয়া, সারাটা দিন এটা সেটা নিয়ে রায়ানের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এখন কিন্তু আর ইনসোমনিয়ায় ভুক্তভোগী রোগী অর্থির, রাত জাগা কোনো যন্ত্রণা মনে হয় না। হবেই বা কেনো? পাশে রায়ান আছে না!!

তিন মাস পর....

-"বেরুচ্ছো?"
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি লাগাতে লাগাতে মাহসান বললো,
-"হুম। আজ বাবা একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে অফিসে।"
-"অনেকদিন হলো একটা কথা বলতে চাইছিলাম।"
-"বলো।"
-"তোমাকে তো বলেছিই, আমার পিরিয়ড এমনিতেই অনিয়মিত। কিন্তু তবুও ২/৩ মাস পর পর হতো। আমাদের বিয়ের তো ৩ মাসের বেশিই হলো।"
-"এখনো হয় নি?"
-"উহু।"
-"টেস্ট করাতে চাচ্ছো?"
-"হু,, আমার নিজেরও কিছু অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। টেস্ট করিয়ে সিউর হতে চাচ্ছিলাম।"
-"কতো বাজে এখন?"
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো,
-"৮ টা ১৩।"
-"ওকে!! রেডি হয়ে নাও।"

বিকেলে ফেরার পথে হসপিটাল থেকে রিপোর্ট নিয়েই বাসায় ঢুকলো  মাহসান। তৃষ্ণা অর্থির সাথে ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিল। মাহসান কে চুপচাপ বাসায় ঢুকতে দেখেই মনে উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল তৃষ্ণার। মাহসানের চেহারা দেখে তেমন একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। তাহলে কি নেগেটিভ এসেছে রেসাল্ট? নেগেটিভের কথা ভাবতেই বুকের ভেতর কষ্ট দলা পাকিয়ে চোখজোড়া ছলছলে হয়ে উঠলো তৃষ্ণার। মাথায় নানা প্রশ্ন আসলেও সেটাকে দাবিয়ে রেখে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে ঘরের দিকে এগুলো তৃষ্ণা। রুমে ঢুকে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললো,
-"তোমার ঠান্ডা পানি.."
শার্ট খুলে তৃষ্ণার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে পুরো পানি শেষ করলো মাহসান।
মাহসানকে কিছু বলবে না, বলবে না করেও তৃষ্ণা রিপোর্ট এর খবর জানতে চাইলো। মাহসান খানিকটা সময় তৃষ্ণার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে এক সময় জড়িয়ে ধরলো তাকে। কানের পাশে মুখ নিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো তৃষ্ণাকে। তারপর ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
-"কনগ্রাচুলেশন, উড বি মাদার অফ মাই চাইল্ড!!"

    (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ