সম্পর্কের টান । পর্ব-৪৯+৫০


সম্পর্কের টান

 পর্ব-৪৯+৫০

-"হ্যালো?"
-"হ্যাপি ম্যারিজ এনিভার্সেরি, তৃষ্ণা।"
তৃষ্ণার কানে কথা টি পৌঁছতেই তার বুক কেঁপে উঠলো। নিমেষেই মুছে গেল ঠোঁটের সেই হাসি। তার পরিবর্তে সেখানে এসে ভর করলো একরাশ বিস্ময়।
-"তৃষ্ণা? শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো?"
তাড়াহুড়ো করে তৃষ্ণা কান থেকে ফোন নামিয়ে কল ডিসকানেক্ট করে দিল। তারপর মুহিবের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-"চলুন,, বিয়ে বোধহয় শুরু হয়ে গেছে।"
-"কে কল করেছিল?"
-"রঙ নাম্বার.. চলুন। না হলে দেখা যাবে বউ তার মন্ডপ ছেড়ে আমাদের খুঁজতে বেড়িয়েছে।"
তৃষ্ণার কথায় মনখুলে হাসলো মুহিব। বললো,
-"চলো।"

অর্থি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মন্ডপের দিকে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীর বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর বিয়েই আগে দেখে নি সে। তাদের রীতিনীতি নিয়মকানুন সম্পর্কে একদম অজ্ঞ। স্কুল লাইফে থাকতে একটি হিন্দু কিছু ক্লাসমেট থাকলেও তাদের সাথে তেমন একটা সখ্যতা গোরে উঠেনি। তাই আজ যখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বিয়ে নিজ চোখে দেখতে পারছে, তাদের আচারনিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে পারছে তখন একদন্ডও নজর এদিক থেকে ওদিক দিতে ইচ্ছে করছে না। বর আসা, গেট ধরা, কনে পক্ষরা মিলে বর কে বরণ করা, বাড়ির বয়স্কদের দিয়ে আশীর্বাদ সব একদম খুটে খুটে দেখলো অর্থি। একপর্যায়ে বর এসে মন্ডপে বসতেই পাশে থাকা তৌহিদকে অর্থি বললো,
-"বর টা কিন্তু বেশ সুন্দর হয়েছে... না?"
-"হু।"
-"আমি জানতাম বউ সুন্দর হলে বর নাকি সুন্দর হয় না। কিন্তু দেখো, আজ আমার প্রমাণ হলো আমার জানাটা ভুল।"
-"ভুল নয়... তবে ঠিকও নয়। পারসেন্টেজ হিসেবে দেখলে ঠিক আছে।"
ভ্রু কুঁচকে অর্থি বললো,
-"যেমন?"
-"এই ধরো,, আমি আর তুমি। তুমি সুন্দর আর আমি.....! থাক আর না বলি। আমাদের দেশের ৭০% সুন্দর মেয়ের বর অসুন্দর হয়। আর বাদবাকি ৩০% এর কপালে জয়দের মত বর জোটে। সেক্ষেত্রে তুমি ভুল বা ঠিক কোনোটাই নও।"
কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে বলে প্রসঙ্গ পালটালো অর্থি। বললো,
-"বর কে বরণ করবার পর ভেতরের দিকটায় নিয়ে গেল কেনো? ভেতরেও কি আবার আচারনুষ্ঠান আছে নাকি?"
-"ভালো করে লক্ষ করো বরের দিকে। কিছু চেইঞ্জ দেখতে পাচ্ছো?"
তৌহিদের কথায় অর্থি ভালোভাবে লক্ষ করলো... তবে তেমন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললো,
-"উহু... ধরতে পারছি না।"
-"বর যে পোশাক পড়ে এসেছিল... সেই পোশাকে নেই। কনেপক্ষের দেয়া পাঞ্জাবি আর ধুতি পড়েই বিয়ে করতে হয় এদের। আর... "
তৌহিদ কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই চারপাশ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শঙ্খ বাজানো শুরু হয়ে গেল। সঞ্চিতাকে নিয়ে আসা হচ্ছে মন্ডপে। অর্থি নিজেও তৌহিদের দিক থেকে নজর সড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সাত পাকে ঘোরা...

সঞ্চিতার সীঁথিতে জয়ের নামের সিঁদুরে রাঙতেই ভিড়ের মাঝ থেকে তনয়কে নিয়ে বেড়িয়ে এল তৃষ্ণা। কোনোদিকে নজর না দিয়ে চুপচাপ উঠে এল বাড়ির ছাদে। এতোটা সময় খুব কষ্টে নিজেকে সবার সামনে ঠিকঠাক ভাবে উপস্থাপন করলেও আর পেরে উঠছে না সে নিজেকে সামলাতে। কল আসবার পর থেকেই বুকের ভেতর উথালপাতাল চলছে, কষ্ট গুলো বারবার চোখ উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হ্যাঁ... বহু প্রতিক্ষিত কল টি আজ এসেছিল তার ফোনে। মাহসান কল করেছিল। কেন কল করলো মাহসান এতো দিন পর? অহ হ্যাঁ.. আজ তো তাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হলো।  ভুলেই গিয়েছিল সে.. হয়তো মাহসান আজ কল না করলে মনেও পড়তো না। এত সহজে কিভাবে ভুল গেল সে তার জীবনের সব চেয়ে সুখের দিনটির কথা? কিভাবে পারলো সে! সঞ্চিতার বিয়ের ঝৈঝামেলার জন্য? নাকি মুহিবের জন্য? মুহিব তার এই জীবনে আসার পর থেকেই অতীতের প্রায় অনেক কিছুই ভুলতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু কেনো? না চাইতেও সে কি তার মনের কোনো এক কোণায় জায়গা দিয়ে দিয়েছে মুহিবকে? না... তেমন কিছু নয়। তাহলে কেন সে ভুলে গেল আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী! একবছর আগে এই দিনটিতেই সে মাহসানের হাত ধরে প্রবশ করেছিল এক নতুন জগতে.... চোখ জোড়া বন্ধ করলো তৃষ্ণা। একবছর আগের সেই রাতটির কথা মনে হতেই নিজের অজান্তেই হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে। তবে হাসিটির স্থায়িত্বকাল বেশিক্ষণ হলো না। পরমুহূর্তেই তার চোখজোড়া জলে ভরে উঠলো। একেএকে চোখের কোণা বেয়ে উপচে পড়তে লাগলো নোনা পানির ঢেউ।
"কবে বাচ্চা নেব আমরা?" এই দেখো আমাদের ছেলে... আমাদের তনয়। তুমি চেয়েছিলে আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী তে আমাদের সাথে আমাদের বাচ্চাটাও থাকুক। আছে তো,, এই যে তনয় আছে। কিন্তু তুমি কই, মাহসান? তুমি কেনো নেই আমাদের দুজনের সাথে? কেন তুমি বাজে কাজটা করলে মাহসান? কেন তুমি আমাকে একটাবার আটকালে না ও বাড়ি ছেড়ে আসার সময়? কেন তুমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে ছাড়তে পারলে না মেয়েটাকে? কেন তুমি আমাকে ঠকালে, মাহসান? ভালোবেসেছিলাম না? বেসেছিলাম তো। তাহলে কেন আমার ভালোবাসা, বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে তুমি? কেন করলে আমার সাথে এমন? আমার জীবনটা তো এমন হবার কথা ছিল না.....

একটার পর একটা সিগারেট টেনেও কোনোভাবেই অস্থিরতা কমছে না মাহসানের। কল রিসিভ করে মাহসানের কন্ঠ শোনার পর ওপাশ থেকে কোনো কথা বলে নি তৃষ্ণা। সাথেসাথেই কল কেটে দিয়েছে। তৃষ্ণার কাছে এগুলোর প্রত্যাশা কি তার ছিল না? ছিল... কিন্তু তাই বলে আজকের দিনে একটু কথা তো বলতে পারতো! কিন্তু বললো না। বলবেই বা কেন! আর আজকের দিনই বা কিসের স্পেশাল তৃষ্ণার কাছে? অন্য সাধারণ আর কয়টা দিনের চেয়ে আজকের দিনটা হয়তো তৃষ্ণার কাছে একটু বেশিই খারাপ... সেদিন কাগজের টুকরো তে তৃষ্ণার নাম উঠার পর থেকেই তার অস্থিরতা কোনোভাবেই কমছে না। পথ চলতে বারবার মনে পড়ছে তৃষ্ণাকে, তনয়কে। তনয়ের নাম নিয়েই সে কাগজের টুকরো টি খুলেছিল,,, যার ফলাফল তৃষ্ণা। তাহলে কি তনয় চায় তার বাবামা কে একসাথে দেখতে? আর উপরওয়ালা? উনি কি চান? উনিও কি চান তার এবং তৃষ্ণার মিলন?? আর কিছু ভাবতে পারলো না মাহসান। ফোন হাতে নিয়ে আবারো কল করলো তৃষ্ণার নাম্বারে। একেরপর এক কল দিতে শুরু করতেই পঞ্চমবারে ওপাশ থেকে মাহসানের কলের সাড়া দিল তৃষ্ণা।
-"প্লিজ... ফোন কাটবে না, তৃষ্ণা। প্লিজ।"
ওপাশ থেকে তৃষ্ণাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মাহসান বললো,
-"কেমন আছো তুমি?"
এবারো নিশ্চুপ তৃষ্ণা।
-"একটা বার কথা বলো। শুধু একটাবার... তৃষ্ণা।"
এতক্ষণ তৃষ্ণা ছাদের ফ্লোরে বসে নির্বিকারভাবে কেঁদে যাচ্ছিল তনয়কে বুকে চেপে। ঠিক সেসময়ই আবারো মাহসানের কল আসায় নিজেকে এমন অবস্থায় ধাতস্থ করতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল। তবে মাহসানের কলের গতি তাকে থামিয়ে দিল। নিজের বুকে পাথর বসিয়ে সে আবারো রিসিভ করেছিল মাহসানের কল। মাহসানের বলা একেকটা শব্দ একদম বুকের মাঝখান টায় গিয়ে বিঁধছিল তৃষ্ণার। তবে না... সে গলে যাবে না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করলো তৃষ্ণা। একসময় কিছুটা ভারী গলায় বললো,
-"হ্যাঁ.. ভালো আছি।"
-"অহ... ভালো থাকলেই ভালো।"
-"হ্যাঁ।"
-"ফ্রি আছো? একটু কথা বলতে পারবে? এই কয়েকটা মিনিট?"
-"না।"
-"কেনো, তৃষ্ণা? আমি কি এতোটাই খারাপ যে আমার সাথে দুটো মিনিট কথা বলা যায় না?"
-"তুমি খারাপ হবে কেন? খারাপ তো আমি। যে তার হাজবেন্ড কে বিছানায় সুখ দিতে পারে না বলে হাজবেন্ড অন্যমেয়েদের নিয়ে বিছানায় যায়। যার ফিগারের তুলনা হাজবেন্ড বাইরের মেয়ের সাথে দেয়। যার বেড পারফরমেন্স নিয়ে...."
-"স্টপ ইট,, তৃষ্ণা।"
মাহসানের কথায় হেসে উঠলো তৃষ্ণা। তাচ্ছিল্যের সেই হাসি ঠোঁটে নিয়েই বললো,
-"কেন থামবো? সেদিন যেহেতু তোমার বলতে বাধে নি তাহলে আজ শুনতে বাধছে কেনো? এত অমূল পরিবর্তন!! কিভাবে সম্ভব? তোমার বেড পার্টনারের বদৌলতে?"
-"তৃষ্ণা,, আমি ওসব আলোচনা করতে কল করি নি। আপাতত ওসব কথা থাক।"
-"হুম... থাক। আমিও ওসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। ওসব কথা মনে করতেও আমার রুচিতে বাধে। আমার চিন্তাভাবনা এখনো ওতো নিচু পর্যায়ে যায় নি যে এসব নিয়ে ভেবে যাবো। তো কি জন্য কল করেছো? যা বলার তাড়াতাড়ি বলবে। এক মিনিট সময় দিচ্ছি।"
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর মাহসান বললো,
-"দেখা করে বলবো।"
দেখা করবার কথা আসতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তৃষ্ণা। কাঁপাকাঁপা স্বরে জবাব দিল,
-"অসম্ভব।"
-"প্লিজ, তৃষ্ণা। একটাবার।"
-"উহু। রাখছি আমি।"
-"না,, রাখবে না। তৃষ্ণা প্লিজ,, একটাবার। আমাকে আমার কথাগুলো তোমার সামনে উপস্থাপন করবার একটা সুযোগ দাও। আজ আমাদের ম্যারিজ এনিভার্সেরি, তৃষ্ণা। প্লিজ,, আজ অন্তত এতোটা কঠোর..."
মাহসানের কথা শেষ করবার আগেই তৃষ্ণা বলতে শুরু করলো,
-"আজ আমাদের ম্যারিজ এনিভার্সেরি? সত্যিই? তোমার মনে আছে? যার বউ এর জন্মদিনের কথা মনে থাকে না, আর তা নিয়ে যা নয় তাই বলে গালাগাল করে তার আজ কিভাবে সেই বউ এর সাথে বিয়ের দিনটা মনে রইলো? কিভাবে? বাহ!! সত্যিই প্রশংসার বিষয়।"
মাহসান চুপ। কি বলবে সে! তার এখানে জবাব দেবার মত কোনো মুখ আছে? না... নেই। সে যেসব কাজ তৃষ্ণার সাথে করেছে তাতে তৃষ্ণার সাথে কথা বলবার মতই তো মুখ নেই তার... কিছু বলতে গিয়েও বললো না মাহসান। তার কানে পিচ্চি বাচ্চার আধোআধো মুখের বুলি ভেসে আসছে। তনয়ের? তার ছেলে তনয়ের স্বর? তনয় কি এখন তৃষ্ণার সাথেই আছে? তনয়ের হালকা গলার স্বর কানে আসতেই তার সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তার মন।
-"তৃষ্ণা.. তোমার সাথে তনয় আছে? ফোনটা একটা বার ওর মুখের কাছে নাও। আমি ওর গলার স্বর শুনতে চাই। আমার বাচ্চাটার একটা নিশ্বাস শুনতে চাই।"
-"নেই।"
-"মিথ্যে বলো না, তৃষ্ণা। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। প্লিজ, তৃষ্ণা। একটাবার ভালোভাবে শুনতে দাও।"
-"বললাম তো নেই।"
অসহায়া গলায় বললো,
-"দেখ তৃষ্ণা, আমি তনয়কে তোমার কাছ থেকে কেড়ে তো নিচ্ছি না। শুধু একটু ওর গলার স্বর, ওর নিশ্বাস শুনতে চাচ্ছি। না করো না প্লিজ। তুমি আমাকে একটাবার শুনতে দাও। আচ্ছা,, যাও। আমার সাথে দেখা করতে হবে না তোমার। তুমি তার পরিবর্তেই আমাকে একটাবার আমার বাচ্চাটার.... তৃষ্ণা, আমি তনয়কে দেখলে বা তনয়কে অনুভব করলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। দুনিয়াটাই আমার উলটে যায়। আমি জানি, আমি খারাপ একজন মানুষ। কিন্তু আমি খারাপ বাবা নই। আমি ভালোবাসি আমার ছেলেকে... একটাবার শুধু একটাবার শুনবো।"
কোনো সাড়াশব্দ পেল না মাহসান ওপাশ থেকে। ফোন নামিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখলো, ওপাশ থেকে তৃষ্ণা কল কেটে দিয়েছে। তবুও থামলো না মাহসান। একেরপর এক কল দিয়ে যেতে লাগলো তৃষ্ণার নাম্বারে। তবে ওপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগলো এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর। ফোনটাই অফ করে দিলে তৃষ্ণা?
মাহসানের হাত পা অনবরত কাঁপছে, বুকের মাঝে চলছে উথালপাতাল, অস্থিরতা কোনোভাবেই কাটছে না। দু চোখের জ্বালায় তাকিয়ে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। এতোদিনের একাকীত্বও তাকে এতোটা কষ্ট দেয় নি, যতোটা আজ পাচ্ছে সে। একটাবার কি বাবা হিসেবে ছেলেকে কাছে পাবে না সে! তার বুকের এই হাহাকার সে কি তনয়কে বুকে নিয়ে কখনোই মিটাতে পারবে না!

    (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৫০

-"হঠাৎ তুমি এখনে? তাও এত রাতে? আগে তো পায়ে ধরেও তোমাকে এ বাড়িতে আনতে পারতাম না।"
-"আসতে বাধ্য হলাম। তুমি আমার কল রিসিভ করছো না কেনো?"
দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে অতৈন্দ্রিলা কে ভেতরে আসার ইশারা করলো মাহসান। ড্রইংরুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"মন মেজাজ ভালো না..."
-"কেন? কি হয়েছে?"
-"যা হবার হয়েছে। তোমাকে এখন সব খুলে বলতে হবে?"
সোফার মাঝখান টাই বসতে বসতে অতৈন্দ্রলা জবাব দিল,
-"উহু... বলতে হবে না। বাই দ্যা ওয়ে,, বাসাটা দারুণভাবে সাজিয়েছো তো।"
-"অর্থির কাজ এসব। তৃষ্ণার জন্মদিনের দিন সাজিয়েছিল। এখনো সেভাবেই আছে সব।"
-"অহ.. আচ্ছা। তা আজ অফিসে এলে না কেন?"
-"ইচ্ছে করলো না যেতে।"
-"শরীর খারাপ?"
-"না।"
-"আমার কিন্তু তেমনটা মনে হচ্ছে না। তোমার শরীর খারাপ প্লাস আমি যদি ভুল না করি তাহলে তুমি কাঁদছিলেও। ঠিক না?"
অতৈন্দ্রিলার কথার জবাব দিল না মাহসান। টেবিলে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে মুখে দিল সে। একটি টান দিয়ে ধুয়ো নাক মুখ দিয়ে বের করে বললো,
-"তুমি এখন যেতে পারো।"
মাহসানের কথায় হিংস্র চোখে তার দিকে তাকালো অতৈন্দ্রিলা। মাহসান কি তাকে খুব ভদ্র ভাষায় বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে বলছে?
-"থাকার জন্য আসে নি... তা আমাদের বিয়ে নিয়ে কি ভাবলে?"
-"আপাতত কিছু ভাবছি না।"
মাহসানের কথায় পুরো শরীর রাগে জ্বল্ব যাচ্ছে অতৈন্দ্রিলার। সময় ভালো না বলে হারামজাদা টাকে জব্দও করতে পারছে না। তবে যাই হোক, এক মাঘে শীত যায় না। তারও আবার দিন আসবে। তখন এসব এটিটিউড কে পায়ের নিচে পিষে না ফেললে তার নামও অতৈন্দ্রিলা নয়... ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো অতৈন্দ্রিলা। মাহসানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের মনোবাসনা কে দাবিয়ে রেখে বললো,
-"যাচ্ছি আমি।"

তৃষ্ণাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টার উপরে বেজে গেল। সারা দিনে ঝৈঝামেলা ক্লান্তি শেষে রাতে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম এসে যাবার কথা... তবে আজ তা এল না তৃষ্ণার। তার মন টা এখনো পড়ে আছে মাহসানের আসা ফোন কলেতে। কি বলতে চায় মাহসান তাকে? আর কেনই বা দেখা করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে চায়? মাহসানের বলা কথার ভঙ্গিও অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে তার কথাবার্তায় ছিল ভিন্নভাব, সবসময় একধরনের ভিন্ন আমেজ নিয়ে কথা বলতো সে। অথচ আজ তার কথা বলার ভঙ্গি ছিল আগের সেই ভঙ্গির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল আজ তার কথার মাঝে। তাহলে কি মাহসান অনুতপ্ত? সে কি তার কাছে ক্ষমা চাইবে? আবার ফিরিয়ে নিতে চাইবে? না.. এসব কখনওই হবার না। মাহসান কে যতটুকু তৃষ্ণা চেনে জানে, তাতে মাহসান নিজের ইগোকে কখনওই একপাশে রেখে এসব নিয়ে ভাববে না। আর ভাববেই বা কেন? সে ছোট হয়ে যাবে না!! সে নিজেই হয়তো বড্ড বেশি ভেবে ফেলছে। তবে যাই হোক, আজ সে যা করেছে ঠিক করে নি। একটাবার মাহসানকে তনয়ের গলার স্বর শুনতে দিলে কি এমন হতো? মাহসানের করুণ আহাজারিই বলে দিচ্ছিল সে কতোটা ব্যাকুল তনয়ের জন্য, একটাবার তনয়ের স্বর, নিশ্বাস শুনতে সে কতোটা মরিয়া সে! ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অপর পাশ ফিরলো তৃষ্ণা। তনয় হবার পর যা নয় তাই বলেছিল তনয়কে নিয়ে মাহসান। এমনকি প্রশ্নও তুলেছিল তৃষ্ণার চরিত্র নিয়ে। যেগুলো মনে পড়লে এখনো গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তৃষ্ণার। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে মাহসান নামক মানুষটাকে। কিন্তু মাহসান যেমনই হোক, তনয়ের জন্মদাতা পিতা সে। আর সবার উর্ধ্বে তৃষ্ণা নিজে একজন মানুষ। অমানুষের মত ব্যবহার করা তার দ্বারা সম্ভব নয়.... কাল সকালেই একবার মাহসান কে কল করে তনয়ের গলার স্বর শুনিয়ে দেবে সে। কাওকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করার মত মানুষ এখনো হয়ে উঠে নি সে....

অর্থি সকালের নাস্তার জন্য খাবার টেবিলে গুছিয়ে ডাকতে গেল মুহিবকে। মুহিবও এই ডাকের অপেক্ষাতেই ছিল। তাই অর্থির একবার খেতে আসতে বলার সাথেসাথেই তাড়াহুড়ো করে মুহিব চলে এল টেবিলে। প্লেটে একটা পরোটা উঠিয়ে অর্থির দিকে প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
-"যা দেবার তাড়াতাড়ি দাও। রাতে বিয়ে বাড়িতে ঠিকঠাক ভাবে খেতে পারি নি। যার ফলাফল এখন আমার পেটে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি।"
মুহিবের কথায় হেসে অর্থি বললো,
-"হায় আল্লাহ! তো আপনি বাসায় এসে বলবেন না! খাবার তো ছিলই।"
পাশ থেকে তৌহিদা বেগমও অর্থির কথায় সায় দিয়ে বললেন,
-"হ্যাঁ,, বাবা। আমাদের জন্য তো অর্থি রান্না করেই রেখে গিয়েছিল। তারপর আবার বিয়ে বাড়ি থেকেও খাবার দিয়ে দিয়েছে।"
ঠিক সেই মুহূর্তেই আগমন ঘটলো তৃষ্ণার। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
-"কি নিয়ে কথা হচ্ছে?"
-"খাদক মুহিবকে নিয়ে।"
বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো মুহিব। তৃষ্ণা তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-"হাসি থামান তো। সঞ্চি কল করেছিল?"
তৃষ্ণার কথায় চুপ করে গেল মুহিব। খাবারে মন দিয়ে বললো,
-"হ্যাঁ।"
-"আজ ওকে জয়দাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। কি কি আনুষ্ঠানিকতা যেন আছে। সব কম্পিট করে বেরোতে বেরোতে বিকেলের মত হবে। দুপুরের আগেই ও যেতে বলেছে। তবে আমি যাচ্ছি না। পিচ্চি পাচকে নিয়ে কোথাও গিয়ে শান্তি নেই।"
-"আমিও যাচ্ছি না। কাল সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আমার পা, কোমর প্রচণ্ড ব্যথা।"
-"ওকে জানিয়েছেন?"
-"হু... রাগ করেছে বোধহয়।"
-"করলেও সমস্যা নেই। ওর রাগের স্থায়িত্বকাল খুবই অল্প।"
দুজনের কথার মাঝে অর্থি বলে উঠলো,
-"ভাবি,, তনয়কে আমার কাছে রেখেই তো যেতে পারো। তুমি আর মুহিব ভাই গিয়ে ঘুরে আসো। সঞ্চিতা আপুরো ভালো লাগ..."
অর্থির কথা শেষ না হতেই পাশে বসা তৌহিদা বেগম ফুঁসে উঠলেন,
-"আর কত ভাবে তোমাকে বুঝালে তুমি বুঝবে? তৃষ্ণাকে ভাবি ডাকতে নিষেধ করি নি? বলো... নিষেধ করি নি তোমায়?"
শাশুড়ির ধমকে থতমত খেয়ে অর্থি জবাব দিল,
-"হ.. হ্যাঁ।"
-"তাহলে ডাকছো কেন? উপরে উপরে ভালোবাসা দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে সব উজাড় করার তাল থাকলে ছেড়ে দাও।"
তৌহিদা বেগমের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল অর্থি। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মুহিবের জন্য। করুন দৃষ্টিতে তাকালো তৃষ্ণার দিকে। তবে তৃষ্ণার ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন দেখতে পেল না অর্থি। চুপচাপ প্লেটের দিকে তাকিয়ে খেয়েই যাচ্ছে তৃষ্ণা। যেন এই মুহূর্তে তেমন কিছুই ঘটে নি। তৌহিদা বেগমের এতবড় কথা শোনাবার পরেও তৃষ্ণা কিছু বললো না তার মাকে। এমনকি একবার থামতেও বললো না। সে নিজে ভাই কে একা ফেলে ভাবির পক্ষ নিয়েছিল কি এসব পাবার আশায়? তাহলে কি তৃষ্ণাও চায় না অর্থি তাকে ভাবি বলে সম্বোধন করুক, মাহসানের সাথে সম্পর্ককে নতুন ভাবে আরেকটা নাম দেবার?

  (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ