সম্পর্কের টান । পর্ব-২৯+৩০


সম্পর্কের টান 
পর্ব-২৯+৩০

ফোন রেখে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলো তৃষ্ণা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মাহসান এমন ধরণের কথা বলতে পারলো!!
-"ভাবি,, শুনতে খারাপ লাগলেও এটা বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি যে, তোমার ভেতর লজ্জার ল টাও নেই। একটা মানুষ এতোটা আত্মসম্মানহীন কিভাবে হতে পারে! বারবার নিজেকে কেন ছোট করতে যাও? কেন নিজেকে বারবার মেরুদণ্ডহীন হিসেবে প্রমাণ করতে চাও তুমি?"
অর্থির এ কথার কোনো জবাব দিল না তৃষ্ণা। হ্যাঁ, অর্থি ঠিক বলছে.. তার আত্মসম্মানবোধ দিনে দিনে এতোটাই লোপ পাচ্ছে যে, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবাও দায় হয়ে পড়েছে। সে কি আসলেই রক্তেমাংসে গড়া কোনো মানুষ? না... মানুষের চামড়া এতোটাও মোটা না যে, এত অপমান সহ্য করবার পরেও আবার নিজে থেকে অপমানিত হতে যাবে।
-"তোমার উচিৎ ভাইয়াকে লাত্থি মেরে তার নিজের যোগ্যস্থান দেখিয়ে দেয়া। তা না করে তুমি নিজেই বারবার ভাইয়ার পায়ের নিচে যাচ্ছো লাত্থিগুড়ি খেতে! এতো শখ কেন তোমার! এভাবে অপমানিত হতে খুব ভালো লাগে তোমার? শরীরে গণ্ডারের চামড়া থাকলেও মানুষ এত অপমান কখনওই সহ্য করবে না। তোমার জায়গায় আমি থাকলে কবেই এমন হাজবেন্ডের কপালে পাঁচ লাত্থি বসিয়ে চলে আসতাম। দেশে কি ছেলের অভাব পড়ছে? নাকি তোমার মাঝেই কমতি আছে?"
এ পর্যায়ে মুখ খুললো তৃষ্ণা। ভারি গলায় বললো,
-"এগুলো বলা যতটা সহজ,, করা ঠিক ততটাই কঠিন। মাহসান আমার..."
তৃষ্ণাকে থামিয়ে অর্থি বললো,
-"প্লিজ,, এখন আর এ কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করো না যে মাহসান তোমার হাজবেন্ড.... মাহসান তোমার কেউ না। আপাতত মাথায় এটা ঢুকিয়ে নাও। আর বলা যতটা সহজ,, করাটা তত সহজ না হলেও কঠিন কিছু নয়। ইম্পসিবল বলতে কোনো ওয়ার্ড মানুষের জীবনে নেই। ইম্পসিবলের আরেক নাম কিন্তু আই অ্যাম পসিবল। ব্যাপার টা মজার হলেও সত্য..."
বলেই থামলো অর্থি। নিজের প্রতি আজ তার প্রচণ্ড গর্ভ হচ্ছে। এতো সুন্দর, সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারা, সময়ের সাথে সব কিছু বুঝে নিজে কে মানিয়ে নেওয়া, কোন পরিবেশে কিভাবে চলা... এসব কিছুই তাকে শিখিয়েছে তৌহিদ। তৌহিদ তার জীবনে না এলে হয়তো তৃষ্ণার সামনে বসে আজ এত বড় বড় কথাও বলতে পারতো না। আবার হয়তো অন্যকোনো তৃষ্ণা হয়েই পড়ে থাকতে হতো কারো না কারো পায়ের নিচে....

-"নিজেকে শক্ত করো, ভাবি। এভাবে অল্পতে হেরে যাওয়া মেয়েদের তালিকায় নিজেকে ফেলো না। প্রত্যেক নারীর জীবনেই যে পুরুষ থাকতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। পুরুষ ছাড়াও নারীরা যে দিব্যি চলা ফেরা করে খুব সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সেটাই দেখিয়ে দাও সবাইকে। বারবার কেন মাহসান নামক পশুর কাছে অপমানিত হতে যাও?"
ঐতিহ্যর কথার সাথে তাল মিলিয়ে অর্থি বললো,
-"হুম,, ভাবি। শক্ত করো নিজেকে। নিজের বাবুর জন্য হলেও নিজেকে শক্ত করো। এভাবে মিথ্যে আবেগের পিছুপিছু ছুটলে তো হবে না। তাও আবার এমন হাজবেন্ডের জন্য যে কিনা নিজের সন্তানকেই পাপ বলছে। আমার তো ভাবতেই ঘৃণা লাগে মাহসান আমার ভাই।"
সব শুনে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। হুম, ঠিক বলছে ওরা... এখন সময় শুধু তার সন্তানকে নিয়ে ভাবার। যাকে নিজের জন্মদাতা পিতাও অস্বীকার করলো। অবশ্য লাগবেও না তার বাবুর কোনো বাবার পরিচয়। নিজের পরিচয়েই বড় করবে সে তার বাবুকে। দরকার নেই পাশে এমন কোনো সঙ্গীর, যার কাছে মেয়েদের শরীরই সব। তার কাছে নেই কোনো ভালোবাসার মূল্য। এমন মানুষের ছোঁয়ায় নিজের সন্তানকে রাখাও পাপ.... সে কিভাবে পারলো এতটা নিচে নামতে? তাও মাহসানের মত পশুর কাছে! নিজের মান অপমান বোধ সব ভুলে সে কিভাবে পারলো ওই জানোয়ারের কাছে নিজেকে বারবার অপমান করাতে!! মাহসানের বলা কথাগুলো একেএকে মনে করতে লাগলো তৃষ্ণা। কম অপমানজনক কথা শুনায়নি মাহসান তাকে, কম অবহেলা করে নি, কম কষ্ট দেয় নি। তবে আর না,, আজকের পর থেকে অপমান করার একটা সুযোগও দেবে না তৃষ্ণা তাকে। ভালোবাসা ভালোবাসা জায়গায় আর ঘৃণা ঘৃণার জায়গায়। দুটোকে একসাথে এনে আর গুলিয়ে ফেলতে চায় না সে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও সে শক্ত হবে... নতুন ভাবে বাঁচবে। যেখানে মাহসান নামক কারোর কখনওই কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

আজ পনেরো দিনের উপরে হলো তনয়কে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। তনয়, তৃষ্ণার ছেলে.. নামটা অবশ্য অর্থির দেয়া। তৌহিদের নামটা তেমন পছন্দ না হলেও এ নিয়ে কিছুই বলে নি। দরকার কি! নাম একটা হলেই হলো.... তনয় কে দেখে বের হবার সময় পেছন থেকে ডাক পড়লো তৌহিদের। ঘুড়ে পেছনে তাকাতেই সে দেখতে পেল, মরিয়ম নামের মেয়েটি তাকে ডাকছে। সে এখানকার একজন নার্স। বয়স ২০/২২ এর কাছাকাছি হবে। শ্যামলা গায়ের রঙ, মায়াবী দুটি চোখ। সব মিলিয়ে মেয়েটার মধ্যে একটি দুঃখী দুঃখী ভাব আছে। তনয়কে প্রায়ই দেখতে আসার কারণে এর সাথে ভালই একটা খাতির হয়েছে তৌহিদের। অবশ্য খাতির হবার মতোই মেয়ে মরিয়ম। অত্যন্ত চঞ্চল এবং মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। হালকা হেসে তৌহিদ এগুলো মরিয়মের দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-"কি অবস্থা তোমার? ভালো আছো?"
-"জ্বি,, ভাইয়া.. ভালো। আপনাকে কিছু বলার ছিল.. কিন্তু প্রায় বেশ কদিন হলো আমার নাইট ডিউটি পড়ছে। যার কারণে আর আপনার সাথে দেখাই হচ্ছিল না।"
-"হুম,, বলো।"
-"আপনার ভাগনে কে দেখতে প্রায়ই রাত ৯ টার দিকে এক ভদ্র লোক এসে উপস্থিত হয়। প্রথম কিছুদিন আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে চললেও এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এড়িয়ে চলার মতো নয়। তাই রেজিস্টার খাতায় গিয়ে নাম চেক করলাম। উনার নাম মাহসান চৌধুরী। তবে সম্পর্কের জায়গাটায় কিছু লেখা ছিল না। চেনেন কি আপনি তাকে? কোনো রিলেটিভ হয় আপনাদের? তবে লোকটি যতোক্ষণ থাকে একনজরে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আপনার ভাগনের দিকে।"
মরিয়মের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল তৌহিদ। মাহসান প্রতিদিন দেখতে আসে তনয়কে? কিন্তু কেন? আর যাই হোক ভালোবাসা, মমতা থেকে তো নয়। নিশ্চিত খারাপ কোনো উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। কিন্ত সেটাই বা কি? আর এখন কিই বা করা উচিৎ তার?
-"অপরিচিত কেউ হলে বলুন,, আজ আসলে আমি নিজে ব্যাপারটা দেখবো। কারণ এসব জায়গায় আননোন পারসন এলাও না। তবে বোঝেনই তো! আজকাল টাকার কাছে কি না হয়! সব জায়গাতেই দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে।"
চিন্তিত গলায় তৌহিদ বললো,
-"হুম,, আননোন। চিনি না ওকে আমরা কেউ। প্লিজ,, তাকে আর এখানে এলাও করবেন না। কোনো বাজে মতলবে হয়তো আছে।"
-"টেনশন করবেন না, ভাইয়া। আমি দেখবো ব্যাপারটা। এর জন্যই আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।"
তৌহিদ মরিয়মের কথার জবাবে হা হু বলে বেড়িয়ে এল হসপিটাল ছেড়ে। টেনশন হচ্ছে,, তবে মরিয়মের উপরে আস্থা রাখাই যায়। অসম্ভব ভালো মেয়েটি.....

একদম সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাদের মত লাগছে তার বাচ্চাকে। কিছুদিন আগেও যার চোখ ফুটেছিল না, একদম পিচ্চি ছিল, হাতপার নখ উঠেছিল না,, আজ সেই বাচ্চা সব দিক দিয়েই পরিপূর্ণ হয়েছে। লম্বায় এতোটাই বেড়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে ধীরেধীরে বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে। নিজের আনমনেই কিছুক্ষণ হাসলো মাহসান। আজ প্রায় ২০ দিনের উপরে হলো এখানে প্রায় প্রতিদিন আসে সে। মাঝখানে ঢোকা নিয়ে সমস্যা হলেও হসপিটালের মালিকের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে নিয়েছে সে। তবুও একটি নার্স প্রচণ্ড বিরক্ত করতো তাকে। ইদানীং তাকেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আগ্রহ নিয়ে খোঁজ নিতেই মাহসান জানতে পারলো টায়ফয়েডে বেচারি বিছানায় পড়ে গেছে। তাই ছুটি চলছে তার। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। অনেকটা সময় নিজের মত করেই সে দেখতে পায় তার ছেলেকে। তবে কাল থেকে এই দেখাটাও হয়তো হবে না। কালই রিলিজ করে দেয়া হবে তার বাচ্চাটাকে। ইনকিউবেটরে রাখার একমাস সময় পার হয়ে এসেছে.... কাল থেকে কি করবে সে! কিভাবে দেখতে পাবে তার বাচাটাকে?? প্রথম প্রথম এই বাচ্চাকে নিয়ে তার না ছিল কোনো উল্লাস, না ছিল দেখার ইচ্ছা। তবে অতৈন্দ্রিলা কে নিয়ে কক্সবাজার যাবার পর সেখানে উঠা কিছু ছবি ফেসবুকে আপলোড করার সময় তার চোখ আটকে যায় নিহালের আপলোড করা এক বাচ্চার ছবিতে। অবিকল ছোট্ট মাহসান,, ছোট বেলার নিজের অনেক ছবি তার ফোনে ছিল। দু টো ছবি একসাথে করে দেখতেই হতভম্ব হয়ে গেল সে। তৃষ্ণা ঠিকই বলেছিল। যে কেউ একনজরে দেখেই বলে দেবে এটা তারই ছেলে। ছেলের ছবি দেখার পর থেকেই একটা মায়া কাজ করছিল বাচ্চাটার উপর। কোনোভাবেই মন টিকাতে পারছিল না সে কক্সবাজারে। বারবার মনে হচ্ছিল এখনি ছুটে গিয়ে একটাবার সামনাসামনি চোখের দেখা দেখে আসতে। ব্যস! সেদিনই চলে এল সে ঢাকায়। হসপিটালে এসে বাচ্চাকে দেখতেই তার মাঝে পিতৃত্ববোধ জেগে উঠলো, চোখ জোড়া খুশিতে ঝাপসা হয়ে আসলো। হুম,, সে তো এমন একটা বাচ্চাই চেয়েছিল তৃষ্ণার কাছ থেকে.. তারপর থেকেই প্রায় প্রত্যেক রাতেই সে এখানে আসে। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার ছেলের দিকে। এক অসম্ভব ভালোবাসা কাজ করে তার ছেলের জন্য তার হৃদয়ে.... হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠায় চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেড়িয়ে এল মাহসান। অতৈন্দ্রিলা কল করেছে। দিনে দিনে তার আবদার বেড়েই যাচ্ছে। আজ ডায়মন্ডের নেকলেস তো কাল অন্যকিছু। না জানি আজ কি চেয়ে বসবে!
-"হ্যালো? তুমি কোথায়?"
মাহসান হালকা কেশে বললো,
-"হসপিটালে এসেছিলাম।"
-"তোমার ছেলেকে দেখতে?"
-"হু।"
-"উফ! ইটস টু মাচ! অলওয়েজ হসপিটাল! প্রচণ্ড বিরক্তি হয়ে যাচ্ছি তোমার উপর আমি।"
-"আর হবে না। কালই ওকে রিলিজ করে দেবে। কালই ওকে নিয়ে চলে যাবে তৃষ্ণারা।"
-"ওয়াও! হোয়াট আ গুড.."
কথা শেষ করবার আগেই মাহসান বললো,
-"ঠিক ভাবে কথা বলো, অতৈ।"
-"ঠিক ভাবেই বলছি। তোমার এই প্রতিদিনের ন্যাকামো দেখতে দেখতে আমি টায়ার্ড। চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে এমন এক বাচ্চার মাঝে তুমি কি খুঁজে পাও যে ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে কাটাও!"
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মাহসান বললো,
-"অনেক কিছু পাই, তুমি বুঝবে না।"
-"আমি বুঝতেও চাই না। এসব লেইম কাজ তুমি নিজেই বোঝো।"
বলেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে অতৈন্দ্রিলা। মাহসান সেদিকে নজর না দিয়ে আবারো গাড়ি ঘুড়িয়ে হসপিটালের দিকে এগুলো। আজ পুরো রাতটাই ছেলের পাশে বসে কাটালে মন্দ হয় না।

সব ঝৈ-ঝামেলা মিটিয়ে তনয়কে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হতে হতে দুপুর ১২ টার উপরে বেজে গেলো। তনয়কে নিতে হসপিটালে এসেছে তৌহিদ, নিহাল এবং অর্থি। বাড়িতে তৃষ্ণার সাথে আছে ঐতিহ্য। তৃষ্ণা আসার জন্য বায়না করলেও তৌহিদ নিয়ে আসে নি তাকে। আজ বিকেলেই তারা রওনা হবে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্যে। তখন লম্বা একটা জার্নি করতে হবে। আবার এখনো তাদের সাথে বের হলে শরীরের অবস্থা নাজুক হয়ে যেতে পারে। একটি ট্যাক্সি ডেকে পেছনে তনয়কে কোলে চেপে উঠে পড়লো অর্থি তার পাশে তৌহিদ। আর নিহাল গিয়ে বসলো ড্রাইভারের পাশের সিটে। ঐতিহ্যদের বাড়ির সামনে এসে ট্যাক্সি থামতেই ধীরেসুস্থে তনয়কে কোলে নিয়ে নামলো অর্থি... ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি বিদায় দিতেই তাদের সকলের চোখ গেল কিছুদুরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহসানের দিকে। ধীরেধীরে সে এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই। হঠাৎ এভাবে মাহসানকে দেখেই হাসিখুশি থাকা মন টা ক্রমেই খারাপ হয়ে যেতে লাগলো সবার।
-"কিছু কথা ছিল।"
মাহসানের কথায় তৌহিদ তার দিকে তেড়ে যেতে নিতেই থামালো নিহাল। সে তৌহিদের কাধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো তাকে। তারপর মাহসানের উদ্দেশ্যে বললো,
-"যা বলার ভেতরে গিয়ে বসে বলবেন। রাস্তায় কোনো সিনক্রিয়েট চাচ্ছি না আমি।"

তৃষ্ণার অপেক্ষার প্রহর যেনো কোনোমতেই শেষ হচ্ছে না। সেই সকাল থেকেই তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে সে। অথচ এখন দুপুর একটা বেজে গেছে। কিন্তু আসার কোনো নামগন্ধ নেই তাদের। কখন যে আসবে! ভাবতে ভাবতে ড্রইং রুমে পাইচারী করতে লাগলো তৃষ্ণা। ঠিক সেই মুহূর্তেই কলিংবেল বেজে উঠলো। সাথে তার মনে খেলে উঠলো খুশির জোয়ার। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই ভুত দেখার মত চমকে গেল সে। তৌহিদদের সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাহসান। কিন্তু সে কেনো??

সোফায় বসেই নিজের বক্তব্য পেশ করলো মাহসান সবার সামনে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে বললো,
-"আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে যেতে এসেছি।"
এ কথা শুনে যেনো বাজ পড়লো পুরো ঘর জুড়ে। সবাই মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো মাহসানের দিকে। ঠিক সেসময় অর্থি বিস্ময় কাটিয়ে বলে উঠলো,
-"আর ভাবি?"
সে কথার জবাব না দিয়ে মাহসান বললো,
-"আমি ওকে আমার নিজের কাছে রাখতে চাই।"
তৌহিদ কিছু বলার আগেই মাহসানের সামনে বসা তৃষ্ণা বলে উঠলো,
-"কাকে চাও তুমি? আমার বাচ্চাকে?"
মাহসানের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তৃষ্ণা উঠে দাঁড়ালো। এখনো সে তার বাচ্চাকে ছুঁয়েও দেখে নি। কিন্তু এপর্যায়ে অর্থির কোল থেকে খুব ধীরেসুস্থে নিজের বাহুডোরে বন্দি করলো তনয়কে। তারপর আবারো তার বসার জায়গায় ফিরে এসে বললো,
-"অন্যের বাচ্চাকে কোন সাহসে তুমি নিয়ে যেতে চাও?"
হতবাক হয়ে মাহসান বললো,
-"অন্যের বাচ্চাকে নেবো কেনো! ও আমার ছেলে।"
-"কোনো প্রমাণ আছে ও তোমার ছেলে?"
-"এখানে প্রমাণের কি আছে!"
-"অবশ্যয় প্রমাণের দরকার এখানে। আমি কার না কার সাথে শুয়ে পেট বাধিয়ে ওকে জন্ম দিয়েছি। তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সেখানে তুমি কিভাবে এতো নিশ্চিত ভাবে বলছো ও তোমার ছেলে?"
তৃষ্ণার কথায় অপারাধী বেশে মেঝের দিকে তাকালো মাহসান। এই কথাটি সে নিজেই কিছুদিন আগে বলেছিল তৃষ্ণাকে...
-"আমার নিজের একার ছেলে তনয়। ওর কোনো বাবা নেই। নিজে একা ছয় মাস পেটে নিয়ে থেকেছি ওকে। নানান অবহেলা, মানুষিক অত্যাচার সহ্য করবার পরেও মুখ বুঝে চুপচাপ সব সহ্য করেছি। বাথরুমে পড়ে গিয়ে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরিয়েছি। অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে আল্লাহ কে ডেকেছি আমার বাচ্চাকে ঠিক রাখার জন্য। পেট কাটার জ্বালাপোড়া সহ্য করেছি এই একটা মাস। আর তুমি... তুমি কি করেছো?"
মাহসান চুপ। তৃষ্ণা জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারো বললো,
-"একবার আমার ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখো। হাত কেটে কুচিকুচি না করে দিয়েছি তো আমার নাম তৃষ্ণা না। আগের ভোলাভালা তৃষ্ণা ভেবে সুড়সুড় করে চলে এসেছো তনয়কে নিয়ে যেতে... না? তৃষ্ণা তো মাহসান বলতে পাগল। একবার গিয়ে বললেই সুড়সুড় করে তৃষ্ণা দিয়ে দেবে তার বাচ্চা কে.... না? তাহলে বলবো মায়ের মমতা জিনিশটা কি সেটা সম্পর্কে সামান্য ধারণা ও নেই তোমার। ভদ্রভাবে বলছি এখান থেকে উঠে বের হয়ে যাও। না হলে পরবর্তী তে কোনো মারামারি কাটাকাটি হোক সেটা অবশ্যই তুমি চাইবে না।"
তৃষ্ণার কথা শেষ হতেই তৌহিদ বললো,
-"শুনিস নি তৃষ্ণার কথা? তাইলে এখন উঠ। কত্তবড় বুকেরপাটা ওর! আমার সামনে এসেছে আমার ভাগনে কে চাইতে! বের হহ বলছি,, এখনি বের হ।"

ঐতিহ্যর ফ্লাট থেকে বের হয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট মাহসান। আজ প্রথম নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে তার। তৃষ্ণার মত মেয়ের কাছ থেকে আজ অপমান হতে হলো তাকে। আর কিছুই বলতে পারলো না। চুপচাপ শুনে গেল। কেন বাচ্চাটা সামনে থাকলে পুরো জগৎ থেকে আলাদা হয়ে যায় সে! কাকে কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বাচ্চাদের প্রতি তার একধরনের দুর্বলতা আগে থেকেই ছিল। তাই বিয়ের রাতেই তৃষ্ণাকে বাচ্চা নেবার কথা বলেছিল। অথচ অতৈন্দ্রিলা তার জীবনে আসার পর থেকেই তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেনো? এ প্রশ্নের উত্তর না পেলেও আশার আলো খুঁজে পেল মাহসান। পকেট থেকে ফোন বের করে অতৈন্দ্রিলার নাম্বারে ডায়েল করলো সে। অপাশে অতৈন্দ্রিলা কল রিসিভ করতেই মাহসান বললো,
-"আমাদের উচিৎ এখন বিয়েটা করে ফেলা।"
-"হোয়াট!"
-"হু,, আই নিড আ বেবি।"
-"কেনো! একটা দিয়ে চলছিল না, যে এখন বাচ্চার দোকান খুলে বসবে! আর বাচ্চা দরকার হলে এতিমখানায় যাও। অনেক পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চা পাবে সেখানে।"
-"প্লিজ,, বাজে বোকো না। আমার নিজের বেবি চাই আমার।"
মাহসানের কথায় কিছুক্ষণ জোর গলায় হাসলো অতৈন্দ্রিলা। তারপর বললো,
-"নিজের বাচ্চাদের নিয়ে দোকান খুলে বসবে নাকি!"
বিরক্ত গলায় মাহসান বললো,
-"আমি ফান করছি না।"
-"আমিও ফান করছি না। তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বিজনেস শুরু করবে, আর আমি বছরে বছরে একটা একটা করে পয়দা করবো!"
হতাশ গলায় মাহসান বললো,
-"বিজনেসের কথা এখানে আসছে কেনো! আমি তোমাকে নিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করতে চাই। যেখানে আমি তুমি আর আমাদের বাচ্চা থাকবে।"
-"লল! কি বলছো এগুলো তুমি! তোমার সাথে আমার তেমন কোনো কথা ছিল না।"
-"এটা আবার মুখে বলতে হবে নাকি! বয়ফ্রেন্ড গার্ল্ফ্রেন্ড একসময় একসাথে থাকবে, সংসার করবে। এটাই তো নিয়ম।"
-"নিয়ম তো হাজবেন্ড ওয়াইফেরও একসাথে সংসার করা। করেছো তুমি?"
-"তৃষ্ণার কথা এখানে টানছো কেন!"
-"টানবো নাই বা কেন! তৃষ্ণা তোমাকে যে সুখ দিতে পারে নি, আমি তোমায় সে সুখ দিয়েছি..."
অতৈন্দ্রিলার এমন উস্কানি মূলক কথা শুনে মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল মাহসানের। তীক্ষ্ণ গলায় সে বললো,
-"তৃষ্ণার নাম যখন টানছো,, তখন তোমার আর তৃষ্ণার মাঝের তফাৎ টাও জেনে নাও। তৃষ্ণাকে একবার বাচ্চার কথা বলার সাথেসাথেই তার উত্তর ছিল আমার ইচ্ছে। অথচ তুমি!"
-"অথচ এই আমির কাছেই তৃষ্ণাকে ফেলে তুই চলে এসেছিলি শরীরের ঝাঁঝ মেটাতে। তৃষ্ণার সাথে আমার তুলনা করছিস তুই! আমার? তোর পোষাকবিহীন তৃষ্ণাকে দেখেও যে ফিলিং কাজ করতো না, যা আমাকে দেখার সাথেসাথেই তোর......"
অতৈন্দ্রিলার কথা শেষ করবার আগেই মাহসান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-"ঠিকঠাক ভাবে কথা বলো।"
-"তোর মতো মাগীবাজ লোকের সাথে আবার কিসের ঠিকঠাক ভাবে কথা! প্রেগন্যান্ট বউ রে ফালাইয়া আমার সাথে রাতের পর রাত কাটাইছিস তুই। যা কোনো ভদ্রলোক করতে পারে না। তোর চোখ দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম তুই কোন ধরনের লোক। আর সেই তুই দিচ্ছিস আমার সাথে তোর বউ এর তুলনা!"
-"আর একবার বলছি ভদ্রভাবে কথা বলো।"
-"বলবো না। তোর সাথে ভদ্র ভাষায় কথা আমি বলবো না।"
ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল মাহসানের। অতৈন্দ্রিলার মত মেয়ে তাকে অপমান করছে! যার কিনা নিজের বাপ মায়েরই কোনো ঠিক নেই। রাগে পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করলো মাহসানের। সে কঠিন গলায় বললো,
-"তুই নিজেই তো একটা প্রোস্টিটিউট। না হলে পরিচয়ের দুই দিন পরেই আমার সাথে বেডে যাইতি না। সাধারণ কোনো মেয়েরে দেখে কোনো ছেলের সেক্স উইঠা পড়েনা,, যা তোরে দেখে সবার উইঠা যায়। তোর চেহারাতেই বেশ্যা বেশ্যা ভাব। সাথে জামাকাপড় গুলোও পড়িস বেশ্যাদের মত। শালার বেশ্যা হারামজাদী একটা।"
বলেই কল ডিসকানেক্ট করে ফোন পাশের সিটে ছুড়ে রাখলো মাহসান।

অর্থি তনয়কে পাশে নিয়ে শুয়ে শুয়ে আজকের দিনের কথা ভাবছিল। কিছুক্ষণ পরেই দুপুরের খাবারদাবার খেয়ে রওনা দেবে তারা নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ঠিক সেসময় ঘরে ঢুকলো তৌহিদ। অর্থিকে ডেকে বললো,
-"ঘুমিয়েছো?"
-"না।"
বলেই উঠে বসলো অর্থি। তৌহিদ দরজার আটকাতে আটকাতে বললো,
-"তৃষ্ণা কোথায়? তনয়কে তোমার কাছে দেখছি যে!"
-"গোছলে গিয়েছে। তুমি এই ভর দুপুরে দরজা আটকাচ্ছো কেন!"
তৌহিদ তার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"আজ আমি খুব খুশি। খুব মানে খুবই। আজ তৃষ্ণার এই নতুন রূপটা দেখে আমি সত্যিই নির্বাক হতে গিয়েছিলাম।"
ভ্রু কুচকে অর্থি বললো,
-"তো এর সাথে দরজা আটকানোর কি সম্পর্ক?
অর্থির দিকে এগুতে এগুতে তৌহিদ বললো,
-"এই একটা মাস নানান ঝামেলার মাঝ দিয়ে কাটিয়েছি আমরা। রোমান্স তো দুরের কথা ভালো করে কিছু সময় মন ভরে দেখিও নি তোমাকে। তাই ভাবলাম, আজ এই খুশিতে সব পুষিয়ে ফেলি।"
বলেই অর্থিকে ঠেলে বিছানায় শুয়িয়ে দিল তৌহিদ। নিজেও তার ভর অর্থির উপর ছেড়ে দিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো,
-"আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছে মনে হচ্ছে।"
-"তো? আর দেখি, সরো। তনয় আছে না!"
-"থাকুক না! ও তো আছে ওর মতো।"
-"ছি! মামা হয়ে ভাগনে কে এখন থেকেই এসব শিখাচ্ছো!"
-"শুধু মামা শিখাবে না,, সাথে ফুফুও শেখাবে।"
বলেই অর্থির ঠোঁট জোড়ায় ঠোঁট ডুবালো তৌহিদ। খানিকটা সময় নিয়ে ঠোঁটের স্বাদ নেবার পর ঠোঁট ছেড়ে অর্থির বুকে মাথা রাখলো সে।
-"নতুন একটা ফ্লাট দেখেছি। বড়সড়, খোলামেলা। আজ নারায়ণগঞ্জ গিয়ে কালই ফ্লাট টা কেনার সব ব্যবস্থা করে ফেলবো। আশা করছি ৩/৪ দিনের মাঝে আমরা আমাদের নিজের ফ্লাটে উঠতে পারবো।"
অর্থি সে কথা এড়িয়ে গিয়ে আহ্লাদী গলায় বললো,
-"আমারও তনয়ের মতো একটা বেবি চাই।"
-"একটা বেবির আরেকটা বেবি চাই?"
-"আমি মোটেও বেবি টেবি না। শোনো না,, প্লিজ।"
-"জ্বি,, বলুন।"
-"আমরা বাচ্চা নেব কবে?"
-"দেরি আছে... আগে আপনার ইন্টার তারপর বাচ্চা।"
মুখ সামান্য বাকিয়ে অর্থি বললো,
-"এতো দেরি!!"
-"জ্বি,, এতোই দেরি।"
-"ওকে... দেন প্রমিজ করো? ইন্টার এক্সাম শেষ হবার দিন থেকেই আমরা বাচ্চা নেবার প্লান শুরু করে দেব।"
-"এহ! বললেই হলো! আগে পাশ তারপর বাচ্চা।"
হাতপা ছিটাতে ছিটাতে অর্থি বললো,
-"না,, না। হবে না, হবে না। তোমার সাথে আমার কি কথা ছিল? রেজাল্ট নিয়ে কোনো ধরনের কথা তুমি বলতে পারবা না। তাহলে এখন কেন পাসের কথা আসছে! হবে না,, হবে না। রেসাল্ট নিয়ে কোনো কথা হবে না।"
অর্থির বলা এ কথাগুলো শুনে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো তৌহিদ।

     (চলবে)

সম্পর্কের_টান

 #পর্ব-৩০

চারিদিকে ধীরেধীরে অন্ধকার নেমে আসছে... সাথে চারপাশ থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে মাহসানের কানে। এই সময়টায় বাসায় এসে বড্ড বড় ভূল করে ফেলেছে সে। খুব বেশি নিঃস্বঙ্গ লাগছে নিজেকে। কি দরকার ছিল ছোট একটা বিষয় নিয়ে অতৈন্দ্রিলার সাথে এতো বাজে ব্যবহার করার? অতৈন্দ্রিলা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত নয়। আর তাকে সাধারণ মেয়ে ভেবে সেভাবে তাকে ট্রিট করাটাও ঠিক নয়। যেখানে সে এখন বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভাবছে না,, সেখানে তার নিজেরও উচিৎ হয় নি এইসব ব্যাপারে অতৈন্দ্রিলাকে চাপ দেয়া। থাকুক না সে তার নিজের মত... তবে হ্যাঁ, তার ছেলেটা এখন তার মাথায় চেপে বসেছে। কোনোভাবেই নামাতে পারছে না সে তাকে। অবশ্য নামাতে সে চায় ও না। কি দরকার নামানোর? বাচ্চাটা ও থাকুক তার নিজের মত... ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহসান। তার এই নিঃস্বঙ্গ জীবনে অতৈন্দ্রিলা ছাড়া সে অচল। এই একটা মাত্র অবলম্বন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায় সে। যারা ছিল, তাদের নিজের ইচ্ছেতেই সবাইকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে মাহসান। এখন আবার অতৈন্দ্রিলাকেও দুরে সরিয়ে দিচ্ছে। একাএকা এ জীবনে চলতে পারবে তো সে?? সব চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে অতৈন্দ্রিলা কে কল করে ক্ষমা চাইবার সিদ্ধান্ত নিল মাহসান। নিঃস্বঙ্গ জীবন কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব। আর সে নিঃস্বঙ্গ জীবন কাটাবেই বা কেন? যার কারণে বাবামা, বোন, স্ত্রী, সন্তান সবাইকে দুরে সরিয়ে দিল নিজের কাছ থেকে, তাকে ছাড়া জীবন কাটানোর কোনো প্রশ্নই উঠে না...

-"বলো? এত বারবার কল দিচ্ছো কেন?"
অসহায় গলায় মাহসান বললো,
-"সরি, অতৈ। আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ, আমাকে মাফ করে দাও। আসলে দুপুরে আমার মন মেজাজ ঠিক ছিল না। এমনিতেই  আমার ছেলেটা...."
মাহসানকে থামিয়ে অতৈন্দ্রিলা বললো,
-"হুম,, ঠিক আছে। আমারো ভুল ছিল। আমারো ওভাবে অভার রিয়াক্ট করা উচিৎ হয় নি।"
-"সত্যিই মাফ করে দিয়েছো তো আমায়?"
মৃদু গলায় অতৈন্দ্রিলা জবাব দিল,
-"হুম।"
ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মাহসান বললো,
-"থ্যাংকইউ... তুমি রেডি হও। আমি ২০ মিনিটের মাঝে তোমার ওখানে আসছি। আজ আমরা একসাথে বাইরে ডিনার করবো।"
-"না,, আজ না। আজ আমার শরীর টা ভালো না।"
-"কি হয়েছে?"
-"তেমন কিছু না.. এই একটু টায়ার্ড লাগছে।"
-"প্লিজ, অতৈ। না করো না। আমার সাথে বের হলেই ভালো লাগবে।"
কঠিন গলায় অতৈন্দ্রিলা বললো,
-"এক কথা একবার বললে তুমি বোঝো না? এর জন্যই এখন অসম্ভব বিরক্ত লাগে তোমায়।"
-"ওকে, ওকে। আজ বের হলাম না। প্লান ক্যান্সেল। তুমি রেস্ট নাও।"
-"থ্যাংকইউ.. এখন রাখছি।"
-"আর একটু কথা বলি.. খুব বেশি একাএকা লাগছে।"
মাহসানের এ কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে অতৈন্দ্রিলা বললো,
-"কিছু টাকা পাঠাতে পারবে?"
-"কত?"
-"বেশি না,, বিশ হাজার।"
-"পাঠাচ্ছি এখনই... কি করবে টাকা টা দিয়ে?"
-"এতো কৈফিয়ত দিতে আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। পাঠাতে হবে না তোমার টাকা।"
মাহসান আদুরে গলায় বললো,
-"আরে,, আমার জানটা এতো কথায় কথায় রাগ করে কেন! তোমার কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি এখনই পাঠাচ্ছি।"
-"থ্যাংকইউ... এন্ড আই লাভ ইউ।"
-"লাভ ইউ টু..."
বলতেই ওপাশ থেকে কল কেটে দিল অতৈন্দ্রিলা। মাহসান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বিকাশ করে টাকাটা পাঠিয়ে দিল অতৈন্দ্রিলাকে। তার এই নিঃস্বঙ্গ জীবনে অতৈন্দ্রিলা খুব বেশিই প্রয়োজন তার......

অতৈন্দ্রিলা শোবার ঘরে ঢুকতেই আজিজ সাহেব বললো,
-"কি ব্যাপার? এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে?"
-"বসের সাথে..."
-"উফ!! কাজকর্ম, স্ত্রী বাচ্চাদের ফেলে আসি তোমার কাছে। আর তুমি ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকো।"
অতৈন্দ্রিলা এগিয়ে গিয়ে আজিজ সাহেবের পাশে বসতে বসতে বললো,
-"খুব জরুরী একটা কাজ ছিল,, বোঝোই তো অন্যের আন্ডারে কাজ করতে কতো কিছুই না ফেস করতে হয়.."
-"তোমাকে বারবার বলি আমার অফিসে জয়েন করো..."
অতৈন্দ্রিলা নিজের পরণের জামাটা খুলে ফেলতে ফেলতে বললো,
-"হুট করে তো এক অফিস ছেড়ে অন্য অফিসে জয়েন করা যায় না.. সময় লাগবে কিছুদিন।"
আজিজ সাহেব আপাততর জন্য এই প্রসঙ্গ বাদ দিলেন। সে অতৈন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,
-"ওটা আবার পড়ে রেখেছো কেন? তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে সব উন্মুক্ত করে দাও তো।"

ঐতিহ্য সেই বিকাল থেকে মন মরা হয়ে আছে। অবশ্য মন খারাপ হবারই কথা। কি করা উচিৎ নিহালের, যাতে মনটা সামান্য হলেও ভালো হয় ঐতিহ্যর??
-"ঘুমিয়েছো?"
ঐতিহ্য জাগাই ছিল। কিন্তু নিহালের কথার জবাব দিল না সে। এখন কারো সাথেই কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। একটু সময় নিজের মত করে একা কাটাতে ইচ্ছে করছে....
-"আচ্ছা!! ঘুমিয়ে পড়েছে তাহলে ঐতিহ্য। এই অর্থি,, তোমার বোন ঘুমিয়ে পড়েছে.."
নিহালের কথায় ধুপ করে বিছানায় উঠে বসলো ঐতিহ্য। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-"ঘুমাইনি আমি।"
নিহাল ফোন এগিয়ে দিল ঐতিহ্যর দিকে। ওপাশে ভিডিও কলে রয়েছে অর্থি। দু বোন কথা বলুক কিছুসময়,, তাও যদি মনটা ভালো হয় ঐতিহ্যর.... নিহাল ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই ঐতিহ্য ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিজের বোনকে আগে দেখে নিল। কান্না পেয়ে যাচ্ছে তার। খুবই কান্না পাচ্ছে। সে কান্না নিজের মাঝে চেপে ভারি গলায় বললো,
-"কেমন আছিস? ডিনার কমপ্লিট?"
-"হু,, তোমাদের?"
-"উহু,, ভালো লাগছে না রে। কেন চলে গেলি তোরা। সারাটা জীবন এভাবে একসাথে সবাই মিলে কাটালে কি হতো?"
অর্থি মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
-"অনেক কিছু হতো.. এই যেমন তুমি আর নিহাল ভাই রোমান্স করতে পারতে না। দুই জন আলাদা আলাদা রুমে থাকতা। বিরহে দিন কাটতো তোমাদের।"
-"ছি! এসব আজেবাজে কথা বলছিস কেন!"
ঐতিহ্যর কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো অর্থি। বললো,
-"আজেবাজে কি বললাম? ঠিক কথাই তো বললাম। বেচারা নিহাল ভাই কতোটা কষ্টে ছিল এই একটা মাস, সে নিয়ে তোমার কোনো আইডিয়া আছে?"
-"চুপ কর তো। তনয় কোথায়? কেমন আছে ও? আর ভাবির কি অবস্থা?"
-"সবাই ভালো আছে.. শুধু আমার ভাগ্নি টা ছাড়া। বেচারী হয়তো ক্ষুধায় মায়ের পেটে লাফালাফি করছে.. যাও, যাও। কিছু খেয়ে আমার ভাগ্নি টাকে উদ্ধার করো।"
-"খাবো,, তুই এখনি আমার বাচ্চাটাকে মেয়ে বানিয়ে দিলি? যদি ছেলে হয়?"
-"হবে না,, বাজি লাগবে?"
-"না,, না। ওসব লাগতে যাবো কেন!"
-"তাহলে যাও এখন খেতে যাও। আমিও যাই,, আমার পতিদেব আমার জন্য অপেক্ষা করছে।"
মুচকি হাসি দিয়ে ঐতিহ্য বললো,
-"যা, ভাবির আর তনয়ের দিকে খেয়াল রাখিস। আর শোন, বিকেলে যেতে কোনো সমস্যা হয় নি তো তোদের?"
-"না, হয় নি। তবে অসম্ভব টায়ার্ড লাগছে। রাখি কেমন?"
-"হুম,, রাখ।"
কল ডিসকানেক্ট করে ঐতিহ্য বিছানা ছেড়ে নেমে এগুলো নিহালের দিকে। নিহাল ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিল। ঐতিহ্য কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে বললো,
-"কথা হলো?"
-"হু, তবে তোমার মেয়ে ক্ষুধায় আমার পেটে প্রচণ্ড লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।"
নিহাল সোফা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-"আমার মেয়ের মা, খাবার টেবিলে গিয়ে বসে পড়ুন। আমি খাবার আনছি।"

খুব সকাল সকাল অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলো মাহসান। এখনো তেমন কোনো স্টাফ আসে নি। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো ধীরেধীরে সকলে আসতে শুরু করবে। অতৈন্দ্রিলা ও হয়তো। আচ্ছা,, হঠাৎ অতৈন্দ্রিলার বাসায় গিয়ে তাকে চমকিয়ে দিলে ব্যাপারটা কেমন হয়? মন্দ না... কাল তাদের মাঝে যা হয়েছে, তাতে দুজনের সামনাসামনি বসে কিছু সময় কাটানোর প্রয়োজন।

অতৈন্দ্রিলা আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিল। ৯ টা ২০ বাজে। দশটার মাঝে অফিসে যাবার কথা থাকলেও আজ সে অফিসে যাবে না। আজ সারাদিন সে কাটাবে আজিজ নামের এই লোকটার সাথে... পাশ ফিরে আজিজের পিঠে হাত রাখলো অতৈন্দ্রিলা। লোকটার বয়স ৪০ এর মত হবে। তবে শারীরিক দিক দিয়ে যে প্রচণ্ড একটিভ সেটা মানতেই হবে। দেখেও বোঝার উপায় নেই এই লোকের বড় মেয়ের ঘরে একটি নাতনি আছে তার... হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে বিছানা ছেড়ে নামলো অতৈন্দ্রিলা। গায়ে নাইটির উপরের পার্ট পড়ে সে এগুলো দরজার দিকে। এই সকাল সকাল আবার কে এল??
-"গুড মর্নিং.. মাই লেডি"
বলেই মাহসান অতৈন্দ্রলার হাতে চাপিয়ে দিল রজনীগন্ধার স্টিক। মাহসানকে এই সময় দেখে হতবাক হয়ে গেল অতৈন্দ্রিলা। আতংকে তার পুরো মুখ নীল হয়ে এল, গলাটাও শুকিয়ে এল। সে ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,
-"তুমি কেন এসময়?"
-"কেন? আসতে পারবো না?"
-"অবশ্যই পারবে। কিন্তু কোনো কল না দিয়ে চলে এলে যে!"
-"সারপ্রাইজ,, সাথে কালকের ব্যবহারের জন্যও সরি ফিল করছিলাম। তাই চলে এলাম।"
-"অহ।"
-"এভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভেতরে ঢুকতে দেবে?"
মাহসানের কথায় দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো অতৈন্দ্রলা। কি রেখে এখন কি করবে সে! শোবার ঘরে আছে আজিজ। এখন এই অবস্থায় মাহসান আজিজকে বা আজিজই মাহসানকে দেখে ফেললে কি রিয়াক্ট করবে ভাবতেই মাথা ঘুরতে লাগলো অতৈন্দ্রিলার। কোনোমতে সোফায় বসে পড়লো সে। আজ কি তাহলে সত্যিই ধরা পড়ে যাবে সে? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল তার। মাহসানের হাতে হাত রেখে বললো,
-"চলো,, আজ ব্রেকফাস্ট টা তোমার সাথে বাইরে কোথাও বসে করি।"
-"হু,, যাওয়া যায়।"
-"তুমি এখানেই বসো। আমি দুই মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি।"
অতৈন্দ্রিলা উঠতেই তার হাত চেপে ধরলো মাহসান। টেনে নিজের কোলের মাঝে চেপে ধরে বললো,
-"ব্রেকফাস্টের আগে একটা চুমু চাই।"
বলেই অতৈন্দ্রিলার গলায় ঠোঁট ডুবালো মাহসান। অতৈন্দ্রিলার অবশ্য এদিকে কোনো তাল নেই। সে বারবার তাকাচ্ছে শোবার ঘরে দরজার দিকে। আজিজ একবার যদি বের হয়ে এসে তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলে তাহলে খুব বড় ঝামেলায় পড়ে যাবে সে। কি করা উচিৎ এখন তার?? মাহসান অতৈন্দ্রিলার ঠোঁট ছেড়ে নাইটির দিকে হাত বাড়াতেই অতৈন্দ্রিলা বলে উঠলো,
-"কি করছো তুমি? এখন কি এই সোফায় বসেই শুরু করে দেবে?"
-"তাহলে রুমে চলো।"
-"এখন না,, আগে ব্রেকফাস্ট টা করে আসি। অসম্ভব হাংরি আমি।"
অতৈন্দ্রিলা কে ছেড়ে দিল মাহসান। বললো,
-"ওকে,, যাও। রেডি হয়ে এসো।"

দুই মিনিটও লাগলো না অতৈন্দ্রিলার তৈরি হতে। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে শুধু পরণের জামাটা বদলে নিল সে। ড্রইং রুমে এসে মাহসানের উদ্দেশ্যে বললো,
-"চলো..."
-"ওরে বাপ্স! এতো জলদি! মেকআপ ছাড়াই আজ বের হচ্ছো!"
বিরক্ত মুখে সে তাকালো মাহসানের দিকে। বড্ড বাজে বকছে এই হারামজাদা টা। আমার চেহারা আমি যেভাবে ইচ্ছে বের হবো। তাতে তোর বাপের কি রে!
-"হু,, বললাম না প্রচণ্ড হাংরি আমি! চলো এখন.."

গাড়িতে মাহসানের পাশে বসেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো অতৈন্দ্রিলা। আজ ধরা পড়তে গিয়েও অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে। খুব বুঝেশুঝে তাকে এখন থেকে চলতে হবে। কোনোভাবেই ধরা পড়া যাবে না। আপাতত তার হাতে এই দুজনই আছে। আর দুজনই বলতে গেলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তবে এর মাঝে আরেকজন পেয়ে গেলে মাহসান নামের এই হারামজাদা টাকে ছেড়ে দেবে। বড্ড বেশি জ্বালিয়ে মারছে। অপরদিকে মাহসানের সাথে রিলেশনশিপেরও পাঁচ মাসের বেশি হয়ে এসেছে। আর বেশিদিন চালানো ঠিক হবে না। ভেবেই ছোট একটি নিশ্বাস ফেললো অতৈন্দ্রিলা। মাহসানের দিকে তাকিয়ে একটি মিষ্টি হাসি দিল সে। অবশ্য হাসিটি লোকদেখানো মিথ্যে হাসি। যার অর্থ, তোমার সাথে এখন বেড়িয়ে আমি খুব বেশিই খুশি। কিন্তু সত্যি বলতে চরম বিরক্ত লাগছে এখন তার। খাবার পর কোনোমতে বুঝিয়ে শুঝিয়ে এই আপদ টাকে বিদায় করতে হবে.... ফোন হাতে নিয়ে আজিজের নাম্বারে একটি ম্যাসেজ পাঠালো অতৈন্দ্রিলা,
I came out urgent work.. Come back within 1 hour😘
     -Atoyndrila

দুপুরের খাবার শেষে সব কিছু ধুয়েমুছে গুছিয়ে ঠিকঠাক করে অর্থি ঢুকলো তৃষ্ণার ঘরে। তনয়কে পাশে রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে তৃষ্ণা। তনয় মায়ের পাশে শুয়ে পা ছোড়াছুঁড়ি করে যাচ্ছে। যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ এভাবেই নড়াচড়ার উপরে থাকে তনয়...
-"ভাবি,, আমি তনয়কে আমার রুমে নিয়ে যাই?"
তৃষ্ণা চোখ খুলে হাসি মুখে বললো,
-"যাও.."
অর্থি তনয়কে নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই তৌহিদা বেগম ঢুকলেন তৃষ্ণার ঘরে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"ঘুমাবি নাকি? তনয়কে দিয়ে দিলি যে!"
-"হুম,, ঘুমাবো।"
-"অহ,, জানিস তৌহিদ বড়সড়, খোলামেলা দেখে একটা ফ্লাট কিনছে? ভালোই কিন্তু হবে, এই ছোট্ট একটা কুটিরে থেকে কি লাভ! টাকাকড়ি সব আছে,, অথচ তোর বাবার জন্য আমার ছেলেটা শখ করে কিছুই করতে পারে না। তবে এবার আর তোর বাবার কথা কানে তুলে নি তৌহিদ। সবকিছুতে এভাবে কিপ্টেমি করলে চলে? এত টাকাপয়সা জমিয়ে করবে টা কি সে! দুদিন বাদে মরে গেলে কি সব কবরে নিয়ে যাবে?"
মায়ের কথার জবাব দিল না তৃষ্ণা। আদুরে গলায় সে তার মাকে বললো,
-"মা,, একটু বিছানায় এসে বসো তো। তোমার কোলে মাথা রাখবো।"
তৌহিদা বেগম হঠাৎ মেয়ের এমন কথায় মোটেও চমকালেন না.. তৃষ্ণা বিয়ের আগে প্রায়ই তাকে এভাবে এ কথা বলতো, প্রায়ই তার পাশে এসে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তো। খানিক সময় পর বলতো, মা.. তোমাকে জড়িয়ে ধরি? তারপর গায়ে হাত উঠিয়ে দিয়ে বুকের কাছে মাথা রেখে ছোট শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়তো.... দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৌহিদা বেগম বিছানায় উঠে বসলেন। তৃষ্ণা মাথা তার কোলে রাখতেই সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-"তোর বাবাকে কতো বলেছি, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে জেনে শুনে তারপর মেয়ের বিয়ে দাও। বিয়েশাদী কোনো খেলা না.. সময় নিয়ে দেখো। কিন্তু তোর বাবা আমার কথা কিছু শুনলে তো! ছেলের বাপের সম্পত্তি আর ছেলের রূপ দেখেই তোর বাবা পাগল হয়ে গেল। রাজি হয়ে গেলো বিয়েতে। কি হলো এখন এসব সম্পত্তি আর রূপ দিয়ে? কোনোটাই কি তার মেয়ের কাজে এলো? এখন অবশ্য হারেহারে সব কিছু টের পাচ্ছে সে। বুঝুক,, দরকার আছে তার বোঝার। বেশি বেড়ে গিয়েছিল না! এখন বুঝতেছে ঠ্যালা কি আর কত প্রকার! চরিত্রহীন একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দেবার শাস্তি এবার পাচ্ছে সে।"
মায়ের মুখ থেকে বিয়ের প্রসঙ্গে কথা উঠতেই মুখটা ছোট করে ফেললো তৃষ্ণা। মাহসানের সাথে বিয়ের ৯ মাস চলছে। এখনো আইনত ভাবে দুজন আলাদা না হলেও মন থেকে একজন অপরজনের থেকে অনেক দুরে সরে গেছে। কেন নিয়তি তাদের এক করেছিল আর কেনই বা আলাদা করছে এভাবে? হ্যাঁ, এখনো সে মাহসানকে নিজের স্বামী হিসেবে মানে, নিজের বাচ্চার বাবা হিসেবে মানে, এমনকি তার হৃদয়ের দরজা খুললে শুধু সেখানে এই মাহসানের জন্য ভালোবাসাতেই ভরপুর। কিন্তু এসব শুধু তার নিজের মনের ভেতরের লুকানো কথা। বাইরের জগতে মাহসান নামক মানুষটাকে খুব বেশি ঘৃণা করে সে। হুম, সে শক্ত হয়েছে। তনয়ের জন্য শক্ত হয়েছে বা প্রকৃতি নিজেই তাকে শক্ত বানিয়ে দিয়েছে... আর এতোটাই শক্ত বানিয়ে দিয়েছে যে, কাল মাহসানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কঠিন কিছু সত্য তাকে শুনিয়েছে তৃষ্ণা। কথাগুলো বলার সময় একদলা কষ্ট এসে তার গলা চেপে ধরলেও সে থামে নি.. বুকের মাঝে অসহ্য এক যন্ত্রণাও তাকে দামাতে পারে নি। নিজের ছেলেকে বুকের মাঝে চেপে সে শক্তি, সাহস পেয়েছে। কিন্তু,, এগুলো সব তো বাইরের কথা। বাইরে তাকে এভাবে শক্ত হতে দেখে খুশি হয়েছে সবাই, বাহবা দিয়েছে। অথচ ভেতরের কষ্ট টা দেখার কেউ একটা বারও চেষ্টা করে নি। অবশ্য সে নিজেও দেখাবার চেষ্টা করে নি। মাহসান চলে যাবার সাথেসাথেই সে গোছলের নাম করে বাথরুমে ঢুকে নিজের কষ্ট গুলোকে পানির সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। যা শরীর বেড়ে পড়ে একসময় ময়লা আবর্জনার সাথে মিশে গিয়েছে। আচ্ছা,, তার ভালোবাসা টাও কি এই পানির মতোই হবে? যার শেষ স্থান হবে ময়লা আবর্জনায়??
-"কিরে? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?"
চোখ মুছলো তৃষ্ণা। মাহসানের কথা মনে পড়তেই তার চোখের পানি কিছুতেই বাধ মানতে চায় না.. এতটা বেহায়া কেন তার এই চোখের পানি?
-"ঘুমাই নি... মা?"
-"হু।"
-"আমি কিছু করতে চাই...."
-"করতে চাইলে করবি। তবে কিছুদিন সময় নিয়ে আগে নিজেকে সুস্থ কর।"
তৃষ্ণা আর মায়ের সাথে কথা বাড়ালো না। মায়ের কোমড় চেপে ধরে পরম যত্নে মায়ের কোলে চোখ বুজলো সে।

তৌহিদ রাত ৮ টার দিকে বাড়ি ফিরলো হাসিহাসি মুখ নিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফ্লাটটা কিনে ফেলেছে সে। যার কারণে সে আজ খুশির সীমানা খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের টাকায় পরিবারের জন্য ছোট ছোট জিনিশ কিনতেই অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে। সেখানে তৌহিদ আজ বড় একটা জিনিশ কিনেছে তার পরিবারের জন্য। অর্থাৎ তার এই খুশি অযৌক্তিক নয়... অর্থি তৌহিদ কে তাদের শোবার ঘরে ঢুকতে দেখেই তার পিছুপিছু ঘরে ঢুকলো। তৌহিদ হাতে থাকা কোট বিছানায় রাখতেই পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো অর্থি। তৌহিদের ঘামে ভেজা শার্টে নাক ডুবিয়ে বললো,
-"তনয় বলেছে,, তার ফুফু নাকি তার মামাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।"
-"আচ্ছা!! আর কি বলেছে?"
-"আর বলেছে মামা বাড়ি ফেরার সাথেসাথেই ফুফুকে যেনো একটু আদর করে দেয়।"
-"একটু?"
-"বেশি করলেও সমস্যা নেই..."
তৌহিদ চিন্তিত চেহারায় বললো,
-"কিন্তু তনয় তো একটু করতে বলেছে... তাহলে এখন কি করা যায়?"
তৌহিদের এ কথায় তৌহিদকে ছেড়ে পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো অর্থি। তৌহিদের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
-"অনেক কিছুই করা যায়..."
-"আজ হঠাৎ এত রোমান্টিক মুডে যে! ব্যাপার টা কি?"
অর্থি বললো,
-"আজ তনয়ের ফুফুর বুক উজাড় করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তনয়ের মামাকে। তবে প্লিজ, এর কোনো কারণ জানতে চাইবে না... কারণ, এর কারণটা তার নিজেরও অজানা।"
-"আচ্ছা,, চাইবো না। তবে কয়েকদফা ভালোবাসাবাসির আগে গোছল দরকার। তারপর সামান্য খাওয়াদাওয়ার ও দরকার আছে। শক্তির ব্যাপার আছে না একটা!! আবার ক্ষুধায়ও পেট থেকে চোঁচোঁ শব্দ বেরুচ্ছে..... তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই... আজ রাতে বুক উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে তোমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো।"
অর্থি লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বললো,
-"খাবার দিচ্ছি,, তুমি গোছল সেরে আসো।"
তারপর খুব দ্রুপদে বের হয়ে এল ঘর ছেড়ে।

   (চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।