![]() |
| গল্প পতিতা ৭+৮ |
পতিতা
পর্ব- ৭+৮
সেই রাতে শুধু আমার সম্মানই বাঁচান নি আমাকে দিয়েছেন নতুন একটা জীবন।
.
টুনি- সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন আমাকে এই বাড়িতে৷ এই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গেলাম। সেদিনের পর থেকে আজ ৮ বছর ধরে মার বুকে যাই না৷ কতশত রাত কাটলো আমার মাকে ছাড়া। মায়ের বুক ছাড়া। মায়ের কোল ছাড়া। আমার জীবনের ৮ টা বছর মাকে ছাড়াই কাটলো। মার কোন ছবিও নেই আমার কাছে তবু আজো মার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাই আমি। সেদিন যখন প্রথম আপনাকে দেখলাম আমি ৮ বছর পর আমার মাকে দেখলাম সেটা স্বপ্নে নয় বাস্তবতায় আপনার মাঝে। এই হলো আমার মায়ের গল্প।
.
আমি মুগ্ধ হয়ে টুনির কথা শুনছিলাম। টুনির প্রতিটা কষ্টের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। আজ নিজের কষ্টগুলোর বাহিরে কারো কষ্টগুলোকে এতোটা কাছ থেকে অনুভব করলাম।
.
এখন মেয়েটা অনেকটাই শান্ত হয়েছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে টুনি একটা হাসি দিলো একটা প্রশান্তির হাসি। মনে হয় এতো দিনের সব জমানো কথা গুলো বলতে পেরে মেয়েটা নিজেকে হালকা অনুভব করছে। কথায় কথায় যে কখন এতোটা সময় পার হয়ে গেছে দুজনের একজনও খেয়াল করি নি৷ টুনি উঠে যেতে নিলেই আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম।
.
রেনু- টুনি...
.
টুনি পিছন ফিরে তাকালো।
.
টুনি- জ্বি।
.
রেনু- মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না???
.
টুনি দ্রুত গতিতে ঠিক একদম আমার কাছে এসে বসে বলল।
.
টুনি- খুব করে।
.
কি মায়া মেয়েটার কথায়।
.
রেনু- যাবে মায়ের কাছে???
.
টুনি- আমার মায়ের কাছে????
.
রেনু- হুম। যাবে???
.
টুনি- মার কাছে যাবো???
.
রেনু- হ্যাঁ, আমি নিয়ে যাবো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে যাবে তুমি???
.
টুনি আর কথা বলতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউমাউ করে কান্না করতে থাকলো। আমি ওকে বাঁধা দিলাম না কারণ আমি জানি যখন বুকের ভেতরের কষ্টটা বেশি থাকে তখন একমাত্র কান্নাই মানুষকে হালকা করতে পারে। আর এই মেয়েটা তো ৮ টা বছর বুকের ভিতরে কষ্টগুলোকে লালন করেছে। বেশ কিছুটা সময় পর টুনি নিজেই থামলো।
.
টুনি- অনেক সময় হয়ে গেছে আপনি ঘুমিয়ে পরেন আমি যাই।
.
আমি টুনিকে বাঁধা দিয়ে বললা।
.
রেনু- অনেকদিন তো মার সাথে ঘুমাও না। আজ না হয় এই মায়ের সাথে ঘুমাও।
.
টুনি অবাক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেনো অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না৷
.
টুনি ঘুমিয়ে আছে। আমার আজ আর ঘুম আসবে না। হয়ত টুনির কষ্ট গুলো আবার আমাকে নাড়া দিয়েছে৷ আজকে নিজের জন্য নয় ঐ মেয়েটার জন্য বুকটা হা হা কার করছে আমার। ঐ টুকু একটা মেয়ে কিভাবে থাকলো মাকে ছাড়া৷ আমি তো এখনো মাকে ছাড়া এক বেলা থাকার কথা ভাবতে পারি না। আর এই টুকু মেয়ে জীবনের সব চাইতে প্রয়োজনীয় সময়ে মাকে পায় নি।
.
টুনি ঘুমিয়ে পরার পরেই উঠে বারান্দায় এসে দাড়াই আমি। মনে মনে মানুষটার জন্য অন্যরকম এক অজানা অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম। জানি না কিসের অনুভূতি তবে খুব করে অনুভব করছি। সেদিন রাতে টুনি কে বাঁচানো। ঐরাতে আমাকে অন্য কারো কাছে যেতে না দেয়া। কি যেনো টানছে আমাকে তার দিকে। তবু কিছু প্রশ্ন খুব তাড়া করছে আমাকে। ঐ পাষোন্ড লোকটার মাঝেও একজন ভালো মানুষ বিরাজ করে। তাহলে সে কেনো কখনো টুনিকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যায় নি। এমন নানারকম প্রশ্ন মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে কিন্তু কোন জবাব খুজে পাচ্ছি না। অনেকগুলো কথা ভাবতে ভাবতেই রাত পার করে ফেললাম। আজ আবার ভোর হওয়া দেখলাম। আমার শখের ভোর হওয়া। রাত থেকে হুট করেই যখন চারিদিকে আলো ছড়ায় তা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আজ আবার ভোর দেখলাম।
.
বাসায় যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। প্রশ্নগুলোও তাড়া করছে তাই থাকতে না পেরে টুনিকেই আবার জিজ্ঞেস করে বসলাম।
.
রেনু- একটা কথা বলি???
.
টুনি- একটা কেনো হাজারটা বলেন।
.
রেনু- তোমার স্যার তোমাকে কখনো নিয়ে যেতে চায় নি তোমার মায়ের কাছে।
.
টুনি আমার কথা শুনে হেসে দিলো।
.
রেনু- হাসছো যে???
.
টুনি- কত বার বলেছে। তবে আমার সাহস হয় নি সব বলতে। তাই কখনো বলাও হয় নি আর মায়ের কাছে যাও হয় নি।
.
রেনু- আমি আজ আসি তাহলে।
.
টুনি- বলছি কি স্যার নেই এ সময় যাওয়া টা কি ঠিক হবে??? যাদি জানতে পেরে রাগ করেন??
.
রেনু- তাকে বলো আমি তার সাথে কথা বলবো।
.
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে এলাম। সকালে আমাকে দেখলেই মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠে। আজ এসে বাবাকে জাগ্রত পেলাম। অনেকদিন পর বাবার পাশে বসে সকালের চা খেলাম। জানি না হয়ত দিনের শুরু টা ভালো হলো।
.
রেনু- মা আমি একটু শুয়ে পরলাম। ক্লান্ত লাগছে আমার।
.
মা- সারারাত জেগেছিস ক্লান্ততো তো লাগবেই৷ তুই ঘুমিয়ে নে।
.
আমি বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাই না। তাই কাথ হয়েই কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরলাম। চোখটা লেগে আসছে তখনি ফোন টা বেজে উঠল। আমার একদম ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলাম। তবে চোখ খুলি নি। তাই নাম্বারটাও দেখি নি। কন্ঠ শুনলেই বুঝতে পারবো কে।
.
রেনু- হ্যালো
.
- রেনু, আমি অয়ন, অয়ন চৌধুরী বলছি।
.
রেনু- আপনি????
.
আমার চোখ গুলো খুলে গেলো। নিমিষেই আমার চোখের ঘুম কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। আমি ফোনটা দেখলাম একটা বিদেশী নাম্বার। আর উনিও বিজনেসের কাজে দেশের বাহিরে আছেন।
.
অয়ন- হ্যালো রেনু শুনছো??
.
আমি চুপ করে রইলাম।
.
অয়ন- রেনু
.
উনি এমন ভাবে রেনু বলে ডাকলেন যেনো কত চেনা সে ডাক। কত প্রিয় তার ডাকের সুর। তার রেনু ডাকটা খুব ভালো লাগছে শুনতে। ইচ্ছে করছে আমি চুপ করেই থাকি সে রেনু রেনু বলে ডাকতেই থাকুক আর আমি শুনতেই থাকি।
.
অয়ন- রেনু কথা বলবে না৷
.
রেনু- জ্বি
.
অয়ন- কেমন আছো??
.
রেনু- ভালো। আপনি কেমন আছেন???
.
এই প্রথম আমি তাকে কোন প্রশ্ন করলাম। তার সাথে কথা বললাম। তার সাথে তো সেভাবে কথা বলার কোন প্রয়োজন হয় নি আমার।
.
অয়ন- আমিও ভালো আছি৷
.
রেনু- হুম
.
অয়ন- রেনু
.
রেনু- জ্বি
.
অয়ন- টুনি বলল তুমি কিছু বলতে চাও। কোন সমস্যা হয়েছে কি??
.
রেনু- টুনির সাথে কখন কথা হয়েছে???
.
অয়ন- মাত্রই শুধু বলল তুমি কিছু বলতে চাও৷
.
রেনু- আমি কিছু বলতে চাই শুনেই সাথে সাথে ফোন দিয়ে দিলেন???
.
অয়ন- হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাছাড়া তো রেনু কথা বলে না৷
.
আমার কথা না বলাটাও সে লক্ষ করেছে। এতোটা কাছ থেকে লক্ষ করেছে লোকটা আমাকে অথচ আমি বলতেও পারি না। আমি কিছু বলবো শুনেই ব্যাকুল হয়ে গেছেন। তার কন্ঠে আমি স্পষ্ট ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারছি। কেনো এই ব্যাকুলতা তার???
.
অয়ন- বলো না কি বলবে।
.
রেনু- আমি টুনিকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাই৷ তাই আপনার অনুমতি চাই। টুনিকে ওর মার বুক ফিরিয়ে দিতে চাই৷
.
অয়ন- কবে যাবে???
.
রেনু- কালই।
.
অয়ন- আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷ আর কিছু??
.
রেনু- নাহ
.
দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলাম। তারপর সেই বলল।
.
অয়ন- রেনু
.
রেনু- জ্বি
.
অয়ন- যদি সম্ভব হয় টুনির মাকে সাথে করে নিয়ে এসো। টুনিকে ছাড়া আমার বাড়িটা মরুভূমি হয়ে যাবে।
.
রেনু- নিয়ে আসবো।
.
অয়ন- রাখছি তাহলে।
.
রেনু- জ্বি রাখুন।
.
অয়ন- রেনু
.
রেনু- জ্বি
.
অয়ন- সত্যি ভালো আছো???
.
রেনু- হুম সত্যি ভালো আছি।
.
অয়ন- রাখছি।
.
এবার আর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ফোনটা রেখে দিলো। আমি কিছুক্ষণ নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাম্বারটা একটা অদ্ভুত নামে সেভ করে ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে পরলাম আবার৷ অদ্ভুত নাম রহস্য কারণ মানুষটা আমার কাছে একটা রহস্য আমি তাকে বুঝেই উঠতে পারছি না।
.
চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পেলাম। "রেনু আমি অয়ন, অয়ন চৌধুরী বলছি।"
" সত্যি ভালো আছো"
"রেনু"
"রেনু"
বারবার আমি তার ঐ রেনু ডাকটায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। তার প্রতিটা ডাক প্রতিটা কথা যেনো বলছিলো সে আমার কতো দিনের চেনা। কত আপন মানুষ। যেনো মানুষটা আমার আত্মার সাথে জড়িয়ে আছে।
.
.
.
চলবে........
#পতিতা
পর্ব-৮
.
.
.
কত আপন মানুষ। যেনো মানুষটা আমার আত্মার সাথে জড়িয়ে আছে।
.
ঘুম থেকে উঠেই ছাদে পায়চারি করতে লাগলাম। তাকে তো বলে দিলাম আমি টুনিকে নিয়ে কালই যাবো কিন্তু মাকে কি বলবো??? টুনিকে নিয়ে যাওয়া মানে কম হলেও একদিনের ব্যাপার। রাত হলে কিছু বলা লাগতো না। কিন্তু দিনের কথা কি বলবো???
.
পরে গেলাম মহা চিন্তায়৷ আমি যখন খুব বেশি চিন্তায় থাকি তখন এভাবে পায়চারি করি এটা বাসার সবাই জানে। তাই ভয়ও লাগছে কেউ দেখে ফেললও বুঝে যাবে আমি কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছি।
.
অনু- আপু
.
হঠ্যাৎ করে অনুর ডাকেও চমকে উঠলাম আমি। কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ৷ আমার এখন হয়েছে সেই অবস্থা।
.
রেনু- হ্যাঁ অনু তুই।
.
অনু- আপু তুমি কি কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত??
.
রেনু- না কই না তো।
.
অনু- না বললেই তো হলো না। তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা তো হয়েছে।
.
রেনু- আরে না কিছু না।
.
অনু- না হলেই ভালো। আচ্ছা যে জন্য এসেছিলাম তোমার ফোন বাজছিলো উঠিয়ে দেখি তমা আপু কিন্তু রিসিভ করার আগেই কলটা কেটে গেলো।
.
অনু আমাকে ফোনটা দিয়ে চলে গেলো। আমার মুখে রাজ্যের হাসি ফুটে উঠল। তমা আমার বেষ্টফ্রেন্ড। আমার ছোট বেলার সাথী৷ আমার সব বিপদের সঙ্গী। আমার সব ভালো-মন্দের পরামর্শ দাতা। ঠিক আমি বিপদে আছি তাই ও বুঝে গেছে। ওর কথা ভাবতে ভাবতেই আবার ফোনটা বেঝে উঠল।
.
রেন- হ্যাল....
.
তমা- তোর হ্যালো ট্যালো রাখ তো আগে সত্যি করে বলতো তুই কেমন আছিস??
.
রেনু- আমি?? কেন আমি তো ভালো আছি।
.
তমা- তোর এই হেয়ালি পনার উত্তর চাই নি৷ সত্যি টা বল।
.
রেনু- আরে বাবা সত্যি বলছি। আমি ভালে আছি।
.
তমা- সত্যি তো??
.
রেনু- সত্যি সত্যি সত্যি এবার হলো?
.
তমা- না হলো না তাও মেনে নিলাম।
.
রেনু- কেমন আছিস তুই??
.
তমা- ভাল না একদম ভালো না।
.
রেনু- কেনো কি হয়েছে???
.
তমা- পরপর দু দিন তোকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখলাম এর পর কিভাবে ভালো থাকি বল।
.
আমি ওর কথা শুনে হেসে দিলাম।
.
তমা- দেখ তুই একদম হাসবি না তের হাসি দেখলে আমার গা ঝালা করে।
.
আমি আরো জোরে হেসে দিলাম। এবার তমাও আমার হাসি শুনে হেসে দিলো। দুজন অনেকদিন পর মন খুলে হাসলাম।
.
তমা- ছোট বাবা কেমন আছে রে???
.
রেনু- বাবা এখন অনেকটাই ভালো আছে।
.
তমা- উঠতে পারে???
.
আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম।
.
রেনু- নারে।
.
তমা- ডাক্তাররা কি বলে।
.
রেনু- নতুন কিছু বলে নি আর।
.
তমার বাবা ছোট বেলায় মারা যায়। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা একসাথে পরি। ওর বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। তমা ছোট বেলা থেকেই আমার বাবাকে ছোট বাবা বলে ডাকতো। এক বছর আগেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। তমার বরটাও অনেক ভালো। সিলেটে থাকে ওরা৷
.
তমা- তুই কি আমাকে কিছু বলবি??
.
রেনু- তুই কিভাবে বুঝলি???
.
তমা- এতো বুঝা বুঝি রেখে কি বলবি সেটা বল।
.
রেনু- না মানে একটা হেল্প লাগবে।
.
তমা- কি হয়েছে বল। টাকা পয়সা লাগবে???
.
রেনু- না তা না।
.
তমা- তাহলে???
.
আমি তমাকে টুনির কথা বললাম। টুনির মায়ের কথাও বললাম। সব কিছুই ভালো ভাবে বললাম ওকে।
.
তমা- সেটা তো বুঝালাম এখন কি করতে চাস তুই??
.
রেনু- আমি টুনিকে টুনির মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।
.
তমা- সেটা তো ভালো কথা। নিয়ে যা সমস্যা কোথায়??
.
রেনু- সমস্যা হলো বাসায় কি বলবো??? মাকে বললে মা এতো দূর যাওয়ার অনুমতি দিবে না তা আমি জানি।
.
তমা- তাহলে কি বলতে চাস???
.
রেনু- সেটাই তো বুঝতে পারছি না কি বলবো।
.
তমা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল।
.
তমা- বল আমার কাছে আসবি। আর আমি তমালকেও বলে দিবো ও কাউকে বলবে না এটা আমাদের তিনজনের মাঝেই থাকবে।
.
রেনু- সত্যি তোর কথা বলবো.??
.
তমা- হ্যা আমার কথা বল। আমার কথা বললে তোকে অনুমতিও দিবে।
.
রেনু- তা দিবে জানি।
.
তমা- তাহলে এতো না ভেবে বলে ফেল।
.
রেনু- ঠিক আছে।
.
তমা- আমি জানি তুই কখনো ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিবি না এই টুকু বিশ্বাস তোর উপর আমার আছে। আর এটা তো অনেক ভালো একটা কাজ। মেয়েকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবি।
.
রেনু- আমি জানতাম আর কেউ না বুঝলেও তুই ঠিকি বুঝবি।
.
তমা- আর তুই এটা নিয়েই চিন্তায় ছিলি তাই না???
.
রেনু- হ্যাঁ, আর তুই সেটাও বুঝে গেলি।
.
তমা- না বুঝে কি উপায় আছে বল। তোর সাথে তো আমার আত্মার সম্পর্ক। আমার কিছু হলে যেমন তুই টের পেয়ে যাস সেভাবেই তোর কিছু হলে আমিও বুঝে যাই। তবে একটা কথা।
.
রেনু- কি কথা বল।
.
তমা- টুনির সাথে তোর পরিচয় কিভাবে হলো।
.
মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি। তমা যদি জানতে চায় আমি টুনি কে কিভাবে চিনি তাহলে কি বলবো। আর মিথ্যাও তো বলতে পারব না। মিথ্যা বললেই তমা ধরে ফেলবে। ও আমাকে খুব ভালো করেই চিনে।
.
তমা- কিরে বল।
.
রেনু- কাজের মাধ্যমে।
.
তমা- তোর কলিগ???
.
রেনু- কলিগ না ঠিক।
.
তমা- তাহলে???
.
রেনু- আমার বসের হাউজ এসিস্ট্যান্ট। আমার বসই সেরাতে টুনিকে বাঁচায়৷ ওকে আশ্রয় দেয়। ওর লালন পালন করে। এমনকি মেয়েটাকে খুব যত্নে আদরেই রেখেছে।
.
তমা- দেখছিস এমন ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো আছে। সে নিঃসন্দেহে অনেক ভালো একজন মানুষ। প্রতিটা মানুষ যদি তার মতো হতো পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো। নাহলে যে টুনি টা সেরাতে এই আলোকিত দুনিয়ার অন্ধকার রূপটার সাথে পরিচিত হয়ে যেতো। অন্ধকার জগৎতে একজন টুনির সংখ্যা বেরে যেতো।
.
রেনু- হ্যা রে।
.
মনে মনে তমার মুখে ঐ মানুষটার প্রসংশা শুনে ভালোই লাগছে। শুধু তো টুনি কে নয় আমাকেও বাঁচিয়েছে মানুষটা। আমার জীবনের অন্ধকার দিকটা তো কেবল তাকে ঘিরে। সে তো আমাকে অন্য কোন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে দেয় নি। আর তমাকেও মিথ্যা বলতে হলো না। তার সাথে তো আমার কাজের সম্পর্কই। হয়ত শুধু ডিটেইলস টা ভিন্ন। থাক না কিছু কথা সবার কাছে অজানা হয়ে৷ সবাই না হয় অন্ধকারের আলোকিত দিকটা দেখলো আর আমি অন্ধকার দিকটা দেখলাম।
.
সেই থেকে বাবার পাশে বসে আছি। প্রতিদিনের তুলনায় আজ কথা একটু কম বলছি।
.
বাবা- রেনু মা।
.
রেনু- জ্বি বাবা বলো।
.
বাবা- তুই কি কিছু বলবি??
.
রেনু- কেনো বাবা??? না মানে...
.
বাবা- এতো সংকোচ কেন মা বল না কি বলবি।
.
তনুও আমাদের সাথে ছিলো।
.
রেনু- তনু যা তো মাকে পাঠিয়ে তুই অনুর কাছে যা।
.
তনু গিয়ে মাকে পাঠিয়ে দিলো।
.
মা- কিরে ডাকছিস কিছু বলবি???
.
রেনু- এখানে আসো বসো।
.
মা- কি হয়েছে???
.
বলেই মা বাবার দিকে তাকালো।
.
রেনু- বলছি কি। আমার তমার সাথে কথা হয়েছে। আমি ২/৩ দিনের জন্য ওর কাছে যেতে চাই। যদি তোমরা অনুমতি দাও তো।
.
বাবা- তমার কাছে যাবি ভালো কথা যা। এটা বলতে এতো সংকোচ কেন??
.
রেনু- না মানে এসময় যাওয়াটা ঠিক হবে কি না তাই ভাবছিলাম আর কি।
.
বাবা- আমাদের জন্য তো কম করিস না একটু নিজের কথাও ভাবতে হয় মা। যা তমার কাছে কয়টা দিন বেরিয়ে আয় তোর ভালো লাগবে। তোর উপর দিয়ে তো কম ধকল যায় নি। একটু বিশ্রাম আর রিফ্রেসম্যান্ট দরকার তোর। যা ঘুরে আয়।
.
বাবার অনুমতি পেয়ে আমি মার দিকে তাকালাম। কারণ আমার দুজনেরই অনুমতি প্রয়োজন।
.
রেনু- মা
.
মা- তোর বাবা কোন কিছুর অনুমতি দিলে আমি কি কখনো সেটাতে না করেছি?? তবে আমি ভাবছিলাম কি
.
রেনু- কি মা??
.
মা- নতুন চাকরী কোন সমস্যা হবে না তো???
.
রেন- না মা সমস্যা হবে না। প্রয়োজনে যে কয়দিন থাকবো সে কয়দিন অফ ডে তে কাজ করে পুষিয়ে দিবো তাহলেই হবে।
.
মা- তাহলে তো হয়েই গেলো। যা মা ঘুরে আয়। কবে যাবি???
.
রেনু- রাতের গাড়িতে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু অফিসেও তো লিভ এপ্লিকেশন দেয়া লাগবে তাই কাল সকালেই রওনা দিবো ভাবছি। তবে আমি একেবারেই বের হবো সকালে আর আসবো না। অফিস থেকেই রওনা দিবো।
.
মা- বেশি ক্লান্তি হয়ে যাবে না???
.
রেনু- সমস্যা নেই মা বাসায় এসে গেলে আবার দেরি হয়ে যাবে।
.
মা- আচ্ছা যা ভালো মনে করিস।
.
আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ৪/৫ সেট ড্রেস আর কিছু যাবতীয় জিনিস নিয়ে নিলাম নাহলে আবার মা সন্দেহ করবে। আমি বাবা মাকে বলে বিদায় নিয়ে নিলাম। বের হওয়ার আগে বাবা আমার কপালে চুমু একে দিলেন। তমাকেও আমি সব জানিয়েছি৷ বাবা মা কেউই তমাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে না জানি। আমার পন্থাটা হয়ত ভুল হতে পারে তবে আমি জানি আমি খারাপ কিছু করছি না। টুনিকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
.
গলির মোড়ে আসতেই দেখি কালো গাড়িটা দাড়িয়ে আছে। যে আমাকে প্রতিদিন দিয়ে যায় নিয়ে যায় তার নাম রতন। তেমন কোন কথা হয় নি এই কয়দিনে রতন ভাইয়ের সাথে আমার।
.
রতন- ম্যাডাম কাল কখন যাবেন??? বলে দিলে আমি সেই হিসেবে সব ব্যবস্থা করে নিতাম।
.
রেনু- আপনাকে কে বলল???
.
রতন- স্যার ফোন দিয়ে ছিলো।
.
রেনু- রতন ভাই
.
রতন- জ্বি ম্যাডাম
.
রেনু- আমরা কি আজ রাতে যেতে পারি না???
.
রতন- রাতে যাওয়া যায় তবে টিকিট কাটা হয় নি যে। আর এখন পাবো কি না তাও ঠিন নেই।
.
রেনু- একটু চেষ্টা করে দেখবেন???
.
রতন- ঠিক আছে ম্যাডাম আমি আপনাকে বাসায় পৌছে দিয়ে দেখছি কিছু করা যায় কি না।
.
আমাকে দেখেই টুনি আমার কাছে ছুটে এলো। আমি হাসি মুখে বললাম।
.
রেনু- তৈরি হয়ে নাও টুনি আমরা তোমার মায়ের কাছে যাবো।
.
টুনি কিছু বলল না। তবে আমি টুনির চোখে স্পষ্ট হাসি দেখতে পারলাম। মানুষ যখন মন থেকে খুশি হয় তখন তার চোখ গুলো হাসে ঠিক যেমন এখন টুনির চোখ গুলো হাসছে।
.
হয়ত আমি সত্যি ভালো কিছু করছি তাই তো টিকিটের ব্যবস্থাও হয়ে গেলো। আমি, টুনি আর রতন ভাই কে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম রহমত গঞ্জের উদ্দেশ্যে। টুনির গ্রামের নাম রহমত গঞ্জ।
.
৮ বছর পর আবার সেই পথে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে তবে আজ পথের দিক ভিন্ন। আজ কোনো মেয়ে তার মায়ের থেকে আলাদা হবে না। আজ হারিয়ে যাওয়া মেয়ে তার মায়ের বুকে ফিরে যাবে। তাই আজ এই নিশ্চুপ রাতে লঞ্চের হুইসেল টাও শুনতে ভালো লাগছে। আমি পাতলা একটা শাল গায়ে দিয়ে কেবিনের বাহিরের বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের নদী দেখছি। নদীটা শান্ত। একদম শান্ত। পানির এক ফোঁটা শব্দও নেই। পানির সাথে তাল দিয়ে প্রকৃতিও শান্ত হয়ে আছে। যেনো একে অপরের সাথে অভিমান করে চুপ করে আছে কথা বলছে না। তবে তাদের মান ভাংগাতে বাতাস হই হই করে কথা বলছে। বাতাসের প্রতিটা স্পর্শ আমাকে ছুয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে সেই দিঘন্তের দিকে।
.
ভোর হতেই লঞ্চ ঘাটে ভিড়ে। টুনি ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত টুনিকে দেখতে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কেউ বলতেই পারবে না এই ছোট্ট মেয়েটা এতো গুলো বছর নিজের জীবনটাকে একাই গুছিয়ে রেখেছে।
.
আমি টুনির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ঘুমের মাঝেই টুনির মুখে একটা আলতো হাসি ফুটে উঠল৷ টুনি ঘুমের মাঝেই বলে উঠলো " মা "। আমিও ঠোঁটের কোণেও হেসে ফুটে উঠল। টুনির মুখে মা ডাকটা শুনতে খুব ভালো লাগছে। টুনিকে ডাক দিলাম।
.
রেনু- টুনি মায়ের কাছে যাবে না???
.
মায়ের কথা শুনে টুনি ধরপরিয়ে উঠল।
.
টুনি- মা মা কোথায়???
.
রেনু- লঞ্চ ঘাটে ভিরে গেছে।
.
টুনি- মায়ের কাছে চলে এসেছি??
.
রেনু- আর একটু পথ বাকি।
.
আমরা লঞ্চ থেকে নামলা। নামতেই টুনি থমকে গেলো।
.
রেনু- কি হলো???
.
টুনি আমাকে দেখিয়ে বলল।
.
টুনি- এখান থেকেই আমি আমার মায়ের থেকে দূরে চলে গিয়ে ছিলাম ৮ বছর আগে। আজ আবার সেখানেই দাড়িয়ে আছি।
.
রেনু- আজ আবার মায়ের কাছে ফিরে যাবে।
.
রতম ভাই একটা ভ্যান ভাড়া করলেন ঘাট থেকে টুনিদের গ্রাম রহমত গঞ্জ প্রায় ঘন্টা দুইয়ের পথ। গ্রামের আঁকা বাকা পথ দিয়ে আমরা যাচ্ছি। গ্রামের কাদামাটির একটা মিষ্টি গন্ধ এসে আমার নাকে লাগছে। নানারকম পাখির ডাক শুনতে পারছি।
.
ভ্যানে উঠার পর থেকেই টুনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। আমি বুঝতে পারছি টুনির কেমন অনুভূতি হচ্ছে তাই পরম যত্নে আমি ওর হাতের উপর আমার আরেকটা হাত দিয়ে ধরে রাখলাম। সমস্ত পথ ও আমার হাত ছাড়ে নি। টুনির চোখে মুখে উদ্দীপনা।
.
ভ্যান টা একটা মোড়ে এসে বামে যেতে নিলেই টুনি চেচিয়ে উঠে।
.
টুনি- ডানে যান ভাই।
.
আমি বুঝতে পারলাম আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি।
.
এই মেঠো পথটার শেষ মাথায় এসে ভ্যানটা থামলো। সামনে একটা বাড়ি। টুনি ফ্যাল ফ্যাল করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না আমরা টুনির মায়ের কাছে চলে এসেছি।
.
ভ্যান থেকে নামতেই টুনির যেনো আর পা চলছে না। টুনি সেখানেই দাড়িয়ে আছে। সামনে যাচ্ছে না হয়ত যেতে পারছে না। আমি টুনির কাঁধে হাত রাখতেই টুনি আমার দিকে তাকায়।
.
রেনু- যাও টুনি মা অপেক্ষা করছে যে।
.
আমার কথা শুনে টুনি এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না।
.
টুনি- মাআআ গো আমি আইছি মাআআ.... তুমি কই মাআআআ মাআআআআ
.
মা বলে চিৎকার করে মাকে ডাকতে ডাকতেই টুনি বাড়ির ভিতরে দৌড়ে গেলো। মা মেয়ের পুর্ণ মিলনের দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে না পেরে আমিও টুনির পিছনে দৌড়ে গেলাম।
.
টুনি- মা গো আমি আইছি মাআআআ..... মাআআআআ......
.
.
.
চলবে........

0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।