পতিতা। পর্ব-৫+৬


পতিতা 
পর্ব-৫+৬

মনে হচ্ছে কেউ আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘুমের দেশে রাজ্যত্ব করতে। হয়ত সেটা অয়ন চৌধুরী ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
.
আজ অনেক দিন পর খুব সুন্দর একটা সকাল হলো। কোন দুশ্চিন্তা ছাড়াই আমার সকাল হলো। এটাকেই বলে প্রকৃত সকাল। আমি বারান্দায় দারিয়ে সকাল হওয়া দেখছিলাম। ঠিক তখনি টুনির আগমন ঘটে।
.
টুনি- ঘুম কেমন হলো??
.
রেনু- খুব সুন্দর।
.
টুনি- সুন্দর??
.
আমি সুন্দর বলায় টুনি অবাক হয়েছে তা টুনিকে দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।
.
রেনু- হ্যাঁ সুন্দর।
.
টুনি- ঘুম আবার সুন্দর হয় নাকি??? ঘুম হয়ত ভালো হয় নয়ত খারাপ হয়।
.
রেনু- হয় টুনিমণি ঘুমও সুন্দর হয়।
.
টুনি আমার কথা শুনে অবাক হচ্ছে। কিছু কিছু অনুভূতি চাইলেও কারো সাথে ভাগ করা যায় না তাই আমিও এই অনুভূতি টা টুনির সাথে শেয়ার করতে পারছি না। তবু আমার ভালো লাগছে। এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।
.
টুনি- আপনি চা শেষ করেন আমি আপনার নাস্তার ব্যবস্থা করি।
.
রেনু- প্রয়োজন নেই৷ আমি বাসায় গিয়ে মার সাথে খাবো। আমি না যাওয়া পর্যন্ত মা কিছু খায় না।
.
টুনি- কিন্তু স্যার তো...
.
রেনু- তোমার স্যারকে বলো আমি খেয়েছি।
.
টুনি- তাহলে আমি ড্রাইভারকে বলছি গাড়ি বের করতে। আপনি রেডি হয়ে নিন।
.
আমি আর টুনিকে বাধা দিলাম না। কারণ টুনিকে বললেও শুনবে না৷ আর ওর স্যারের নির্দেশ ও অমান্য করবেও না। তাই বাধ্য মেয়ের মতো টুনির কথা মতোই গাড়িতে করে ফিরলাম। তবে এর গন্ডি গলির মোড় পর্যন্তই৷ এর পরে যাওয়ার অনুমতি নেই৷
.
ইদানিং প্রতিদিনই সকালে নাস্তা নিয়েই বাসায় ফিরি। মা অনেক খুশি হয় যখন আমার হাতে কিছু দেখে।
.
মা- কিরে আজো তুই খাবার নিয়ে এসেছি??
.
রেনু- হ্যাঁ, অনু, তনু, তোমার আর বাবার জন্য।
.
মা- তোকে না নিষেধ করলাম।
.
রেনু- সব নিষেধ শুনতে হয় না মা। আজকে নাস্তার জন্য কি বানিয়েছো মা??
.
মা- কিছুই না তুই নাস্তার জন্য প্রতিদিনই তো কিছু না কিছু নিয়ে আসিস। তাই তো কিছু বানাই নি৷
.
রেনু- দেখলে তো??? তাহলে আজ যদি আমি খালি হাতে আসতাম তাহলে আমার অনু আর তনু কি খেয়ে যেতো???
.
মা- সে আমি কিছু একটা বানিয়ে দিতাম।
.
রেনু- তুমি তো রান্না করোই। এক বেলা না হয় না করলে।
.
মা- সেই তো ডাল ভাত ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারি না৷ কতদিন ধরে তোদের ভালোমন্দ কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারি৷
.
কথাটা বলতেই একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো মার। মার চোখগুলো ছলছল করছিলো। মার কষ্ট টা বুঝতে পারছিলাম। আমার সাধ্যের বাইরে তো আমিও কিছু করতে পারছিলাম না৷ আর একসাথে মাকে এতো টাকা দিলে যে মাও সন্দেহ করবে। না পারছি পরিবারের কষ্ট দেখতে না পারছি কিছু করতে। সংসারের মেয়ে গুলো এতো অসহায় হয় কেনো?? কেনো মেয়ে গুলোর ইচ্ছে থাকা সত্বেও তারা নিজের পরিবারের জন্য কিছু করতে পারে না??
.
গতরাতে খুব ভালো ঘুম হয়েছে তাই আজ আর ঘুমালাম না। মাকে ঘরের কাজে হেল্প করলাম। মা তো আমাকে কিছু করতেই দিবে না। তাই টুকটাক এটা ওটা করতে লাগলাম। ঘর গুছাতে গুছাতেই ফ্রিজটা খুললাম দেখি পরিষ্কার করা লাগবে কি না। ফ্রিজটা খুলতেই বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠল। আমি আমার এতোটা বয়সে কখনো দেখিনি আমদের ফ্রিজ খালি। আমার মার ফ্রিজ সব সময় ভরা থাকতো। এই খালি ফ্রিজটা দেখে আমার এতো কষ্ট হচ্ছে তাহলে আমার মার না জানি কতো কষ্ট হয়। ঘর গুছানো শেষ করেই কাপড় পাল্টে নিলাম। চুলগুলো মাথায় তুলে হাত খোপা করতে করতেই মাকে ডাকতে শুরু করলাম।
.
রেনু- মা ও মা মা কোথায় তুমি???
.
মা- কিরে চেচাচ্ছিস কেন???
.
রেনু- বাজারের ব্যাগটা দাও তো।
.
মা- বাজারের ব্যাগ দিয়ে তুই কি করবি???
.
রেনু- কি করব মানে??? বাজার করব। বাজারের ব্যাগ দিয়ে মানুষ কি করে??
.
মা- তুই করবি বাজার????
.
রেনু- হ্যাঁ, বাজার করব। দাও এখন বাজারের ব্যাগটা এনে দাও।
.
মাকে অবাক করে দিয়ে আমি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। জীবনে কোন দিন বাজার করি নি। আজ প্রথম বাজারে যাচ্ছি। আমি ছোট বেলা থেকেই দরদামে খুব পাঁকা। বাবার থেকেই শিখেছি।
.
ব্যাগ ভর্তি বাজার করে বাসায় ফিরলাম। আজ মনটাও ফুরফুরা লাগছে। বাজার করে অনু আর রেনুর জন্য টুকটাক কেনা কাটাও করলাম। ওদের জন্য কিনতে গিয়েই এক পাতা কালো টিপে চোখ পরল। দেখেই টুনির কথা মনে পরে গেলো আমার। টিপের পাতাটা টুনির জন্য কিনে ব্যাগে রেখে দিলাম।
.
ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার হাত ভর্তি বাজার দেখে মা তো তাক লেগে গেলো।
.
মা- সে কিরে তুই তো মনে হয় পুরো বাজারটাই তুলে এনেছি।
.
রেনু- কই আর বাজার তুলে আনলাম। অল্পকয়টা জিনিসই তো এনেছি।
.
মাকে এভাবে খুশি দেখে ভালো লাগছে সাথে কষ্টও হচ্ছে৷ আমার এখনো মনে পরে সেই তো সেদিনের কথা বাবা ব্যাগ বোঝাই করে বাজার নিয়ে আসতো। আর সেই বাজারের সামনে এই বাজার তো কিছুই নয়৷ তবু আমার মা আজ কতো খুশি৷ আজ অনেক গুলো দিন পর তার ফ্রিজটা পুরোপুরি না ভরলেও কিছুটা ভরবে। ভাবতেই আমার ভেতরটা জুরিয়ে যাচ্ছে৷ অনেকদিন পর মার মুখে হাসি দেখলাম।
.
সারাদিন অনু রেনু আর বাবার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।
.
অনেকদিন পর মনের মত একটা দিন গেলো আমার।
.
মা- কিরে সময়ের খেয়াল আছে তোদের??? রেনুকে ছাড় ওর অফিস যেতে হবে যে।
.
অনু- মা আরেকটু প্লিজ।
.
মা- সে কি কথা ৮ টা বাজে প্রায়৷
.
রেনু- আজ এখানেই থাক আবার কাল খেলবো।
.
বলেই আমি উঠে গেলাম। আমার নিজেরও আজ উঠতে মন চাইছিলো না। আজ না গেলেও সমস্যা নেই৷ মানুষটাতো নেই। তবে না গেলে মা যদি সন্দেহ করে। এর চাইতে চলে যাওয়াই ভালো হবে। টুনি টাও তো আমার অপেক্ষা করবে।
.
গলির মোড়ে আসতেই দেখি তার গাড়িটা দাড়িয়ে আছে। আমি চলে এলাম টুনির কাছে।
.
টুনি- এতোক্ষণে আসার সময় হলো?? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম।
.
রেনু- রাগ করলে??
.
টুনি- আপনার উপর কি রাগ করতে পারি??? আসুন।
.
টুনি আমার হাত ধরে টেনে আমাকে উপরে নিয়ে গেলো।
.
টুনি- খেয়ে আসেন নি তো???
.
রেনু- সন্ধ্যায় খেয়েছিলাম।
.
খেয়েছি শুনে টুনি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো।
.
রেনু- আর ঘন্টাখানিক গেলে আবার খেতে পারবো।
.
টুনি- ঠিক আছে। আর যেনো না শুনি খেয়ে এসেছেন।
.
আমি টুনির হাত ধরে ওকে পাশে বসিয়ে বললাম।
.
রেনু- কি করবো বলো মা যে না খেয়ে বের হতে দিতে চায় না।
.
টুনি- মা??
.
রেনু- হ্যাঁ মা
.
টুনি- ঠিক আছে তাহলে অল্প খেয়ে আসবেন। কিন্তু আমার সাথেও খেতে হবে।
.
রেনু- আচ্ছা খাবো।
.
মা শব্দটা শুনে টুনির মুখটা কেমন যেনো ফেকাসে হয়ে গেলো। দেখেই বুঝতে পারছি ওর ভিতরে কোন একটা ঝড় বইছে।
.
রেনু- টুনি
.
টুনি- জ্বি
.
রেনু- মাকে খুব ভালোবাসো তাই না???
.
মায়ের কথাটা বলার সাথে সাথেই টুনি আমাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরল। ওর জড়িয়ে ধরার মাঝে অনেক কষ্ট ছিলো যা আমি খুব করে অনুভব করতে পারছিলাম। এই মায়া ভরা হাসি মুখো মেয়েটার মাঝেও অনেকগুলো কষ্ট লুকিয়ে আছে। আর আজ আমি ওর ঐ কষ্ট গুলোতে নাড়া দিয়ে বসলাম।
.
বেশ অনেক্ষণ টুনি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। মেয়েটার কান্নাটাও ভারি ভিন্ন৷ এতো কাঁদলো তবে একটু শব্দও করল না। একটা গোঙ্গানিও দিলো না।
.
আমি টুনির জন্য পানি আনতে উঠতে নিলেই টুনি আমার হাতটা ধরে বলে।
.
টুনি- শুনবেন আমার মায়ের কথা???
.
আমি টুনির মাথায় হাত রেখে বললাম।
.
রেনু- হ্যাঁ, শুনবো। সব শুনবো।
.
বলেই টুনির হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে ওর জন্য পানি ঢেলে এনে দিলাম।
.
রেনু- আগে পানি টা খাও।
.
কষ্টে মেয়েটার মুখ দিয়ে পানিও যাচ্ছে না। এক ঢোক পানি খেয়ে টুনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। কি মায়া সেই চাহণিতে।
.
টুনি- জানেন আমার মা না দেখতে আপনার মতো ছিলো। আমি আপনার মাঝে আমার মাকে দেখতে পাই।
.
ও আমার মাঝে ওর মাকে দেখতে পায় কথাটা শুনে আমার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। টুনি টা আমার অনুর বয়সি তাই এখন টুনির মাঝে আমি আমার অনুকেই দেখতে পারছি। টুনি বলতে শুরু করল।
.
টুনি- আমার মার বাবা আমার মাকে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার মা না অনেক রূপবতী ছিলো না। তবে মায়াবতী ছিলো। আমার মায়ের গায়ের রং দুধে আলতা ছিলো না তবে একবার দেখলে আবার তাকাতো মায়ের দিকে। ঠিক অবিকল আপনার চোখের মতো ছিলো আমার মায়ের চোখগুলো। বিয়ের বছর পরেই মার কোল জুড়ে আসলাম আমি। খুব শখ করে মা আমার না দিয়ে ছিলো টুনি। বাবার সাথে মায়ের সম্পর্ক ভালোই ছিলো। কখনো কোন ঝগড়া দেখি নি। একদিন মাঝ রাতে মায়ের চিৎকারে আমার ঘুম ভেংগে গেলো। আমি দাদীর সাথে অন্য ঘরে ছিলাম। আমি মার চিৎকার শুনে উঠতে চাইলে দাদী আমাকে বাধা দেয়। তবু আমি দাদীর বাধা উপেক্ষা করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় চলে এলাম। এসেই দেখি অন্য পাশে মায়ের ঘরের দাওয়ায় মা বসে কাঁদছে। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে মায়ের আর্তনাদ শুনতে লাগলাম। মা বলছিলো।
.
টুনির মা- আপনে যাইয়েন না। আমার কথা হুনেন যাইয়েন না আপনে....
.
আমি ঐ টুকু মানুষ কিই বা বলতাম। পা টিপেটিপে মায়ের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
.
.#পতিতা
পর্ব-৬

.
.
.
আমি ঐ টুকু মানুষ কিই বা বলতাম। পা টিপেটিপে মায়ের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
.
টুনি- তারপর কয়েকদিন বাবাকে দেখিনি। কোথায় ছিলো জানি না৷ আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম "মা বাজান কই গেছে আহে না কেলেইগা??? আমার পরানডা বাজানের লেইগা কেমন কেমন করে মা।" মা আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে।
.
টুনির মা- জানি না রে মা তোর বাপে কই গেছে। আমার কপাল পুড়ছেরে মা আমার কপাল পুড়ছে।
.
টুনি- ঐ সময় বুঝিনি কপাল পুড়া জিনিসটা কি। তখন বুঝিনি আমার মার কপাল কিভাবে পুড়ল। আমি মার কাপলে তাকিয়ে দেখলাম মার কপালে তো কোন পোড়া দাগ নেই তাহলে মা কেনো বলল তার কপাল পুড়েছে। ঐ সময় ব্যাখ্যা চাওয়ার চাইতে আমার মায়ের চোখের পানি মুছে দেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিলো তাই আর মার কাছে জানতে চাই নি "মা মাগো কপাল পুড়া কি জিনিস।" তার কিছু দিন পর বাবা আসলো। বাবাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে৷ তখন এতো কিছু আমি বুঝি না। আমি তো আমার বাবাকে দেখেই খুশি হয়ে চিৎকার করে উঠলাম "মা বাজান আইছেএএএ" চিৎকার করতে করতেই বাবার কাছে দৌড়ে গেলাম। বাবা আমাকে কোলে তুলে চুমু খেলেন। মা কলপাড়ে পানি তুলছিলেন৷ কলস ফেলে মাও দৌড়ে এসে দাওয়ায় দাড়ায়। বাবা কাছাকাছি আসতেই বলে উঠলেন।
.
টুনি মা- আপনে আইছেন?? আহারে চোখ-মুখ খান হুগায় গেছে। আপনে কলপাড়ে জান আমি আপনের লাইগা গামছা লইয়া আহি৷ গোসল দিয়া গরম ভাত খাইবেন৷
.
টুনি- তারপরের কয়টা দিন বাবাকে মার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করতে দেখি নি৷ আর ঝগড়াও করতে দেখিনি৷
.
তার পর একদিন।
.
-মফিজ মিয়া বাড়ি আছো নি?? ওওও মফিজ মিয়া বাড়ি আছো নি???
.
টুনির বাবা- কেডারে ডাকে???
.
-আরে মিয়া আমি জব্বার আলী।
.
মফিজ- আরে জব্বার মিয়া যে। আহো মিয়া বাড়ির ভিত্তে আহো। ও টুনির মা কই গেলা। জব্বার মিয়ার লাইগা দানা পানির ব্যবস্থা করো।
.
জব্বার- না না দানা পানি অন্যদিন হইবো। আজকে একটা দরকারি কামে আইছি।
.
মফিজ- কি কাম কও মিয়া???
.
জব্বার আলী ফিসফিস করে বাবাকে বলল।
.
জব্বার- একদল বড় পার্টি আইছে।
.
টুনি- কথাটা বলেই তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করে। আমি পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম।
.
জব্বার- এদিক আহো...
.
টুনি- জব্বার কাকা বাবাকে সাইডে নিয়ে গিয়ে কি কি যেনো বলল৷ বাবা তাকে বিদায় করে দিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে গেলেন।
.
মফিজ- ও টুনির মা টুনির মা ট্যারাংকের চাবিডা দেও তো।
.
টুনি- বাবার যেনো তর সইছিলো না। মা রান্নায় ব্যস্ত ছিলো। বাবা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসে মার আঁচল থেকে চাবিটা নিয়ে আবার ঘরে যায়। শুধু ট্রাং খুলার খট করে শব্দ পেলাম৷ কি করলো কিছুই জানি না। মাকে চাবি টা দিয়ে একটু কাজ আছে বলে বাবা চলে গেলো। মা পিছন থেকে চিৎকার করতে লাগল।
.
টুনির মা- আপনে খাইবেন নাআআআআ...
.
মফিজ- রাইত্তে আইয়া খামুউউউউ
.
টুনি- সেদিন অনেক রাতে বাবা বাড়ি ফেরে। বাবার মুখ-চোখ কেমন যেনো লাগছে দেখতে৷ বাবাকে দেখেই মা আমাকে বলল।
.
টুনির মা- মা যাও দাদির লগে গিয়ে ঘুমায় পরো।
.
টুনি- আমি বের হতে হতে শুনলাম।
.
টুনির মা- আপনাকে হাত মুখ ধুইয়া আহেন। আমি ভাত বারি আপনের লাইগা।
.
মফিজ- না ভাত খামু না।
.
টুনির মা- কেন খাইয়বেন না??? কি হইছে আপনার।
.
মফিজ- খামু না কইছি খামুনা এতো প্রশ্ন করোছ কেন???
.
টুনি- আমি দাদির কাছে চলে এলাম। তাও আমার ঘুম আসছিলো না৷ পরে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম জানি না। আবার মাঝ রাতে মার আর্তনাদে আমার ঘুম ভেংগে গেলো। মা চিৎকার করে কাঁদছে।
.
টুনির মা- ঐডা নিয়েন না ঐডা টুনির লাইগা বানাইছি। আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে ঐডা নিয়েন না।
.
টুনি- তখনো বুঝিনি বাবা কি নিয়ে যাচ্ছে আর মা কেন বাঁধা দিচ্ছে। মা সারারাত কান্না করল। পরেরদিন দুপুরের দিকে বাবা বাড়ি ফিরল। মা চুপ করে বসে ছিলো।
.
মফিজ- ঐ ভাত দে। খিদা লাগছে।
.
টুনি- মা বাবার কথার কোন জবাব দিলো না।
.
মফিজ- কিরে কথা কানে যায় না ভাত দিতে কইলাম না।
.
টুনি- ও মা বাজান ভাত চায় বাজানরে ভাত দাও।
.
টুনির মা- ভাত নাই।
.
মফিজ- ভাত নাই কেন। আমি কি খামু।
.
টুনি- মা রাগ চোখে বাবার দিকে তাকায়৷
.
টুনির মা- আমার জিনিস ফিরায় দেন নাইলে আপনের লেইগা কোন ভাত নাই।
.
টুনি- মার কথা শুনে বাবার রাগে যেনো রক্ত টগবগ করতে লাগলো।বাবা রাগে মার চুলের মুঠি ধরে।
.
মফিজ- কি কইলি তুই। তোর এতো বড় সাহস। আমারে ভাত দিবি না তোরে বান্দি রাখছি কেন। এতো বড় সাহস তোর। তোরে আজকে মাইরাই ফালামু।
.
টুনি- বলেই বাবা মাকে মারতে লাগে। মা চিৎকার করতে থাকে।
.
দাদি- এই মফিজ কি করোছ কি মাইয়া ডা মইরা যাইবো তো ছাড় কইলাম ছাড়।
.
টুনি- বাবা মাকে ছুড়ে ফেলে চলে গেলো। তারপর দুদিন বাবা বাড়ি ফিরে নি৷ দুদিন পর বাবা বাড়ি ফিরলো। কিন্তু বাড়িতে আর শান্তি ফিরলো না। অশান্তি যেনো প্রতি বেলায় লেগেই আছে। মার প্রতি বাবার অত্যাচার গুলো বাড়তেই থাকলো। প্রায় প্রতিদিনই বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলতো। মাকে মারতো। এর মাঝেই আমার দাদিটা মরে যায়। মা সারাদিন কান্না করত। আমাকে দেখার মতো কেউ থাকল না৷ আমার মা টা দুঃখের অতল সাগরে ভাসতে থাকল। আমি জানি না কেন এমন হচ্ছে। কেন আমার বাবাটা এমন বদলে গেলো। মার কোলে শুয়ে ছিলাম জিজ্ঞেস করলাম।
.
টুনি- মা ও মা
.
টুনির মা- কি মা
.
টুনি- বাজানের কি হইছে মা??? বাজান কেন আমগো আগের মতো ভালোবাসে না। কও না মা কেন ভালোবাসে না বাজান??? কি হইছে বাজানের??
.
মার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছু বললেন না।
.
প্রতিনিয়তই বাবা টাকার জন্য মার গায়ে হাত তুলে। পরের দিন বাবা সাথে একজনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সে কে জানি না৷ আমি আড়ালেই ছিলাম৷ বাবাকে দেখলে দৌড়ে যাই না। বাবা আগের মতো আদর করে কোলে নেয় না। বাবাকে দেখলে ভয় লাগে। সেদিন কি হতে চলেছে তা আমার জানার বাহিরে ছিলো। ঐ দিনই যে আমাদের জীবনটা এভাবে পাল্টে যাবে ভাবতেই পারি নি। আমি বাইরে থেকে মার চিৎকার আর আর্তনাদ শুনতে পেলাম।
.
টুনির মা- কি কন আপনে??? আপনের মাথা ঠিক আছে নি????
.
মফিজ- চুপ একদম চুপ। যা কই তা হুন। নাইলে মাইরা ফালামু তোরে।
.
টুনির মা- আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে এই কথা কইয়েন না। আল্লাহর গজব পরবো।
.
মফিজ- বেশি কথা কইলে তোর টুনিরেও বেইচা ফালামু।
.
টুনি- পরে বুঝতে পারলাম। বাবা জুয়ার নেশায় সব টাকা পয়সা শেষ করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত আমার মা টাকে ঐ লোকটার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। মা চিৎকার করে বলতে লাগলো।
.
টুনির মা- যা টুনি পালায় যা মা। ঐ অমানুষটা তোরেই বেইচা ফালাইবো যা মা ভাইগ্গা যাআআ। ওরা তোরে বাঁচে দিবো না মা পালায় যায়। আপনের দোহাই লাগে আমার টুনিরে ছাইড়া দেন। ওরে ছাইরা দেন।
.
টুনি- বাবা আমার দিকেই আসছিলো। আমি মার কথা শুনে দৌড়াতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। অনেক দূরে চলে এসেছি সামনে বিশাল নদী আর পথ নেই। একবার পিছনে তাকিয়ে বললাম "মা মা গো..."
.
মা গো বলতেই টুনির চোখ মুখ বেয়ে পরা পানি গুলোর স্রোতটা যেনো আরো বেড়ে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখছি আমার অনু কাঁদছে। টুনি আবার বলতে শুরু করল।
.
টুনি- মা গো বলেই আমি সামনের বিশাল লঞ্চটায় উঠে পরলাম। কোথা যাচ্ছি কিছুই জানি না। শুধু জানি মা বলেছে পালায় যা টুনি তাই আমি পালাচ্ছি৷ মা আমাকে বাঁচার জন্য পালাইতে বলেছিলো তাই আমি পালাচ্ছি। ধূ ধূ পানি চারিদিকে হুইছেল দিয়ে লঞ্চ চলছে আপন গতিতে৷ একটা সময় এসে থামলো। একে একে সবাই নামছে কিন্তু আমি কোথায় যাবো??? কার কাছে যাবো??? আমি এতো মানুষের ভিড়ে আমার মাকে খুজতে লাগলাম। " মা মাগো তুমি কই মা?? ও মা তুমি কই?? মাগো" হাজার মানুষে ভিড়ের ঠেলায় আমি আগাতে লাগলাম সামনে। সেই সকাল থেকে হেটেই যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু হাটছি। দিন শেষ হয়ে রাত হলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে গেলো চারিদিক। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। এক অন্ধকার গলি ধরে হাটছি৷ তখনি পিছন থেকে কেউ বলল।
.
- কিরে যাবি নাকি???? দাম কত তোর??? এক রাতের কত নিবি???
.
টুনি- আমি একবার পিছনে ঘুরে দেখে সামনে দৌড়াতে লাগলাম ঐ লোকটাও আমার পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো।
.
- কিরে দৌড়াচ্ছিস কেনো??? কত নিবি বল না।
.
অন্ধের মতো দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। তখনি একটা গাড়ির সামনে গিয়ে পরলাম। আল্লাহ হয়ত আমার ভাগ্যে মৃত্যুর চাইতেও ভালো কিছু লিখে রেখেছিলো। গাড়ি থেকে একজন ফেরেশতা নেমে এলেন।
.
হ্যাঁ, সে আমার জন্য ফেরেশতা। আমি তার পিছনে গিয়ে বললাম। আমারে বাঁচান। সে বলল-
.
-পিছনে দাড়া আমি দেখছি।
.
সেদিনের সেই ফেরেশতাটা আর কেউ নয় আমার স্যার আমার আরেকটা বাবা। যে সেই রাতে শুধু আমার সম্মানই বাঁচান নি আমাকে দিয়েছেন নতুন একটা জীবন।
.
.
.
চলবে.......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ