পতিতা
পর্ব-১৯+২০
মা- রেনু দেখ তোর বাবা কেমন করছে। কিছু কর রেনু কিছু কর।
.
আমি যেনো বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ছিলাম। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এই মাঝ রাতে কি করবো?? কোথায় যাবো??? কার সাহায্য চাইবো?? মা চিৎকার করেই যাচ্ছে। অনুটা দৌড়ে সানোয়ারা আন্টিদের ফ্ল্যাটে চোলে যায়। এতো রাতে বেল দেয়ায় তামিমের বাবা ইকবাল আঙ্কেল গেট খুললেন।
.
ইকবাল- কি হয়েছে অনু মা তুমি এতো রাতে।
.
কান্নার জন্য অনু কথাও বলতে পারছিলো না।
.
অনু- আঙ্কেল বা..বাবা
.
ইকবাল আঙ্কেল- কি হয়েছে চলো তো দেখি৷
.
ততোক্ষণে আঙ্কেল চিৎকার চেচাঁমেচির শব্দ পেয়ে যায় তাই বুঝতে পারে কিছু হয়েছে। এসে দেখেন বাবার অবস্থা খারাপ। জ্ঞান নেই৷ নিথর হয়ে পরে আছে।
.
ইকবাল আঙ্কেল- ভাবি এখনি হসপিটালে নিতে হবে।
.
আমাদের কোন গাড়ি ছিলো না। সেভাবে কখনো গাড়ির প্রয়োজন পরে নি৷ বাবা বলতেন সবার যদি গাড়ি থাকে তাহলে অসহায় মানুষগুলো যারা রিকশা চালিয়ে নিজেদের অন্ন উপার্যন করে তারা কিভাবে বাঁচবে। তবু বাড়িটা করেই একে বারে গাড়ি কিনবে এমনটাই বাবার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু মানুষের জন্য আল্লাহ কখন যে কি রেখেছেন তা আল্লাহই ভালো জানেন। তাই ইকবাল আঙ্কেল নিজের গাড়িতে করেই বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যান। ডঃ রহমান বাবার বন্ধু৷ তারা একসাথে স্কুল কলেজে পড়া লেখা করেছেন। তারপর আঙ্কেল মেডিকেলে ভর্তি হয়ে গেলেন আর বাবা সরকারি থেকে পড়া শেষ করলেন। বাবা ছোট বেলা থেকেই ব্যবসায়িক মাইন্ডেড ছিলেন। ব্যবসা ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতেন বাবা৷ তাই আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন পড়াটা শেষ করেই নিজের ব্যবসা করবেন। আর তেমনটাই করেছিলেন। এই সব কিছুই বাবার থেকে শুনা। বলতে গেলে আমাদের পারিবারিক ডঃ রহমান আঙ্কেল। আর বাবার তো কিছুদিন পর পর আঙ্কেলকে না দেখলে ভালোই লাগতো না। আঙ্কেলেরও একি অবস্থা ছিলো। আঙ্কেল হসপিটালে ছিলেন না। গাড়িতে উঠতেই মনে হয় আঙ্কেলকে একটা কল দেয়া দরকার। ভাগ্যিস কলটা দিয়েছিলাম। আমার ফোন পেেয় আঙ্কেল বাসায় ছিলেন উনিও হসিপটালে চলে আসেন।
.
ডঃ রহমান- ভাবি একদম চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি। আল্লাহকে ডাকেন।
.
বাবাকে আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হয়। আঙ্কেল অনেক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন। আঙ্কেলর মুখটাও মলিন হয়ে গেছে।
.
মা- ভাই সে ঠিক আছে তো???
.
আঙ্কেল কিছু বলতে পারছেন না। আমাদের তিন বোনকে দেখছেন বার বার। তাই আমি আবার প্রশ্ন করি।
.
রেনু- আঙ্কেল বলেন না বাবা ঠিক আছে তো???
.
ডঃ রহমান- তোমার বাবার স্টোক করেছে।
.
রেনু- কিহহহ
.
ডঃ রহমান- আর ওর বাম পাশটা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
.
অনু- মাআআআআআ..
.
অনুর চিৎকারে পিছনে তাকিয়ে দেখি বাবার কথা শুনে মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বাবা স্টোক করেছেন প্রথম বার। আমার দুনিয়াটাই যেনো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমার সুখি পরিবারটা একজন আপন মানুষের বৈঈমানির জন্য আজ কেমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে৷
.
মার জ্ঞান ফিরার পর থেকে মার কান্না যেনো আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো। এখন কে দেখবে আমাদের। আপন বলতে তো কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজন যারা আছে আমরা না খেয়ে থাকলেও তারা যে সেভাবে জিজ্ঞেসও করবে না তা আমরা ভালোভাবেই জানি। অনেকের জন্যই আমার বাবা অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু তাদের বিপদ কেটে গেলে তারা আর আমাদের খবর রাখতেন না। সে সব কিছু আমাদের জানা।
.
ডঃ আঙ্কেলের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম বাবা নাকি কয়দিন আগে গিয়েছিলো তার নাকি কেমন অসুস্থ অনুভব হয়। আঙ্কেল কিছু টেস্ট করতে বলেছিলেন কিন্তু বাবা করান নি। এমন কি আমাদেরকেও কিছু বলে নি৷ বাসায় এমন অবস্থা চলছিলো তাই নিজের দিকে খেয়াল রাখে নি আমার বাবা টা। শুধু আমাদের কথাই ভেবেছেন। আগেই বলেছিলাম আমার বাবাটা চাপা স্বভাবের কখনো নিজের হাজার কষ্ট হলেও হাসি মুখে থাকতেন কখনো কাউকে বলতে না। এমনকি বুঝতেও দিতেন না। আর আমরাও বুঝতে পারি নি৷
.
মা বাবার স্টোকের কথা শুনার পর থেকে নিজেকেই দোষারোপ করে যাচ্ছেন। মা বাবার এতো কাছে থেকেও কেনো বুঝতে পারেন নি। কেনো বাবার কষ্ট হচ্ছিলো তাও বুঝে নি মা। মাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না।
.
প্রাইভেট হসপিটাল। বাবার ট্রিটমেন্ট এর এতো খরচ কিভাবে কি হবে। মা পরের দিন সকালে গিয়েই ব্যাংকে রাখা টাকা গুলো তুলে আনলেন। তখন ঐ টাকা ছাড়া আমাদের কাছে অন্যকোন উপায়ও ছিলো না। তিন দিন ছিলাম বাবাকে নিয়ে হসপিটালে। অনেক টাকা বিল এসেছিলো। এখনো সব আমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই আমি৷ অনু যখন ক্লাস ৭ এ পড়ে একদিন স্কুলেই হুট করে ওর পেইন উঠে স্কুল থেকে ফোন দিলে বাবা ডঃ রহমান আঙ্কেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ বাবাও চলে যায়। আমাদেরকেও খবর দেয় মাকে নিয়ে আমিও পৌছে যাই৷ হসপিটালে গিয়ে জানতে পারি৷ এ্যাপিন্ডিসাইড এর ব্যাথা তখনি অপারেশন করাতে হবে। অপারেশন পরপরই আমরা অনুকে বাসায় নিয়ে আসি। হাসপিটালে রাখার প্রয়োজন হয় নি৷ মাত্র কয়টা ঘন্টায় অনেক গুলো টাকা খরচ হয়েছিলো। অথচ আমার বাবা টাকা নিয়ে কোন চিন্তাই করে নি তখন। আর আমার সেই বাবার ট্রিটমেন্ট এর টাকা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয়েছে। তবু ভাগ্য ভালো বাবা মার নামে টাকাটা রেখেছিলেন যেনো কোন বিপদ বা প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারি৷ ঐ টাকা দিয়ে হসিপটালের বিল বাবার ঔষধ সব কিছুই হয়ে গিয়েছিলো এমনকি মার হাতে আরো কিছু টাকা ছিলো। তৃতীয় দিন মা বাবার পাশেই বসে ছিলেন আমি মাকে ইশারায় বাহিরে ডাকলাম।
.
মা- কিরে কিছু বলবি???
.
রেনু- মা আমরা ঐ বাসায় আর ফিরে যাবো না।
.
মা- তাহলে কোথায় যাবো??
.
রেনু- এমনি তেও দু দিন পর আমাদের ঐ বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে৷ বাবার এই অবস্থায় বাবাকে এতো টানাটানি করাটা বাবার জন্য ঠিক হবে না মা। শারীরিক অবস্থাটা তাও আমরা দেখতে পাই কিন্তু বাবার মানসিক অবস্থার কথা ভেবেছো একবার৷ বাবার মানসিক কষ্ট গুলোর জন্যই বাবার আজ এই অবস্থা মা। আমরা বুঝতেও পারি নি। আমি আর বাবাকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না মা। আর আঙ্কেলও বলে দিয়েছেন বাবা যেনো কোন প্রকার চিন্তা না করেন।
.
মা- দেখ তাহলে তুই যা ভালো মনে করিস তাই কর।
.
রেনু- আর শুনো কোন বড় বাসা নিবো না। যত কমের মাঝে নেয়া যায়।
.
মা- তাহলে আমাদের এতো জিনিস-পত্র এগুলোর কি হবে???
.
রেনু- এতো কিছু দিয়ে কি করব মা??? যা যা একান্তই প্রয়োজন ঐ সব জিনিস রেখে বাকি সব বিক্রি করে দিবো। এতো কিছুর প্রয়োজন নেই।
.
মা- বিক্রি করে দিবি???
.
রেনু- কি করবো মা বলো। ঐ জিনিস গুলো রাখার জন্য তো এতো বড় বাসা নেয়া সম্ভব না মা। এতো ভাড়া কিভাবে দিবো???
.
মা- ঠিক আছে তাহলে যা ভালো মনে করিস কর।
.
আমি জানতাম আমার কথা শুনে মার কষ্ট হচ্ছিলো। বাবা মার তিলে তিলে গড়া ছিলো সব কিছু। আমাদের বাসাটা, আমাদের সংসার টা বাবা মায়ের জন্য শুধু বাসা বা সংসার ছিলো না। তাদের জন্য তাদের সুখের রাজ্য ছিলো। যা তারা একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন। আর সেই রাজ্যটাই নিমিষে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো আর চাইলেও তারা কিছুই করতে পারছিলেন না।
.
মা, অনু আর তনুকে হসপিটালে রেখে আমি বেরিয়ে পরলাম। আজকের দিনের মাঝেই বাসা খুজতে হবে। সেই সকাল থেকে খালি পেটে হেটেই যাচ্ছি৷ বাসাগুলোর এতো ভাড়া আগে জানতাম না। আমাদের তো কখনো ভাড়া দেয়া লাগে নি তাই জানতাম না। দুই বেড রুমের বাসা গুলোর ভাড়া ১৮ হাজার টার উপরে পড়ে যায়। আর ঐ সময় প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকা গুণা অনেক কষ্ট সাধ্য হয়ে যাবে আমাদের জন্য। কোন ভাবেই কোন বাসা মিলাতে পারছিলাম না। তখন মনে পরলো আমার বন্ধ সাকিবের কথা। ও একাই থাকে দু দিন পর পরই বাসা পাল্টায়। ওর কাছে ধারণা আছে কোথায় বাসা ভাড়া কম হতে পারে। আমি কলের পর কল দিয়েই যাচ্ছি ছেলেটা কল রিসিভ করছে না।
.
সাকিব- হ্যালো
.
রেনু- এখনো তোর সকাল হয় নি???
.
সাকিব- কি করবো বল সারারাত জেগে পড়েছি তাই সকালে চোখ খুলতে পারি নি৷ তুই হঠ্যাৎ কি মনে করে।
.
রেনু- তোর হেল্প লাগবে একটু বের হতে পারবি???
.
সাকিব- কিছু কি হয়েছে???
.
রেনু- তুই আয় আমি বলছি।
.
সাকিব আর কথা না বাড়িয়ে সাথে সাথে আমার কথা মতো চলে আসে। দুজন একটা টং দোকানে বসলাম। সাকিব দু কাপ চা নিলো। ও আমাকে দেখার সাথে সাথে বুঝে গেছে কিছু একটা হয়েছে। তমার পরে যদি আমার কোন ভালো বন্ধ থাকে তাহলে সেটা সাকিব। কলেজ থেকেই আমরা একসাথে পড়ছি।
.
সাকিব- কি হয়েছে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো???
.
রেনু- বাবা স্টোক করেছেন হসপিটালে আছেন।
.
আমার কথা শুনে গরম চা লেগে সাকিবের জিহ্বা পুড়ে গেলো।
.
সাকিব- কি বলছিস??
.
রেনু- হ্যাঁ, আমাদের ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আমাকে আজকের মধ্যেই বাসা নিতে হবে। কাল বাবাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিবে। তাই আজকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে।
.
সাকিব- দাড়া থাম তুই। কি বলছিস কিছুই মাথায় ডুকছে না আমার। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কি সব আবোল-তাবোল বলছিস।
.
আমি সাকিবকে সব খুলে বললাম। শুরু থেকে কি হয়েছে কিভাবে হয়েছে। সাকিব তো আমার কথা শুনে পারছে না এখনি চলে যায় আমার চাচাকে খুন করতে। আমার বন্ধ-বান্ধবী গুলোর জন্য আমি ওদের কলিজা ছিলাম। আর আমার বাবা মাকেও অনেক ভালোবাসতো। ছেলেদের সাথে বন্ধুত্বে আমার বাবার কখনোই কোন নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। উল্টো বাবাও ওদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। বাবা মা জানতেন সাকিব এখানে একাই থাকে। তাই কলেজে থাকতে আমাদের ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার সময় মা খুব আফসোস করলেন বললেন পরীক্ষার সময় টা ছেলে-মেয়েদের ভালো যত্ন নিতে হয়। আর ছেলেটা একা। মার আফসোস দেখে বাবা সাকিবকে ফোন করে বলছিলেন পরীক্ষার কয় মাস ও আমাদের সাথেই থাকবে ব্যগ-পত্র গুছিয়ে চলে আসতে বললেন। সাকিবে প্রথমে আপত্তি করলেও জানতো বাবা যেহুত বলে দিয়েছে সে আর কারো কথা শুনবে না। তাই বাধ্য হয়েই সাকিবকে আমাদের বাসায় উঠতে হলো। পরীক্ষায় সময় মা আমার যতোটা যত্ন করেছিলেন ঠিক ততোটাই সাকিবেরও যত্ন করেছিলো। ওকে বুঝতেই দেয় নি যে ও ওর কোন বন্ধুর বাসায় আছে। সেজন্য সাকিবও অন্য সবার থেকে একটু না অনেকটা বেশি ভালোবাসে আমার বাবা মাকে।
.
সাকিবে বুঝিয়ে বললাম এখন রাগ বা গরম হয়ে লাভ নেই। আমি এদিকটা সামলাতে হবে আর সেজন্য এই মূহুর্তে আমার বাসা নেয়াটা বেশি জরুরী। তারপর আমি আর সাকিব মিলে হন্য হয়ে বাসা খুজার অভিযানে নেমে পরলাম। মোহাম্মদপুর এর ওলিতে গলিতে বাসা খুজতে লাগলাম।
.
সাকিব- দোস্ত এদিকে বাসা ভাড়া বেশি হবে এর চাইতে এক কাজ করি চল। বাশবাড়ী চলে যাই ঐ দিকে বাসা ভাড়া কম হবে।
.
রেনু- ঠিক আছে চল।
.
তবে সেখানেও একি অবস্থা সামান্য কিছু এদিক সেদিক হয় তেমন আহামরি কম ভাড়া নয়। অগত্যা বাসা না পেয়ে অন্য দিকে যাওয়ার কথা ভেবে সামনে হাটা দিতেই সামনে আরেকটা টুলেট দেখতে পেলাম। টুলেট টা দেখে সাকিব আমার দিকে তাকালো৷ আমি বাড়িটার দিকে তাকালাম।
.
রেনু- সেই একি হবে দোস্ত এই বাসা দেখা না দেখা একি।
.
সাকিব- তাও দোস্ত এটাই শেষ। এটা না হলে এই এলাকায় আর কোন বাসা দেখবো না। এরপর নামায় চলে যাবো৷ সেখানে বাসা ভাড়া কম পাবো সিওর থাক। তবে এটা দেখি প্লিজ।
.
রেনু- ঠিক আছে বলছিস যেহুত আর এতো গুলো বাসা দেখেছি এই একটা দেখলে কিই বা হবে।
.
আমরা উপরে উঠে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম পাঁচ তলার পরে ছাদে দুটো রুম আছে ঐ রুম দুটোই ভাড়া দিবে। কথাটা শুনে সাকিব আমার দিকে তাকালো।
.
রেনু- একবার দেখি চল।
.
অর্ধেক জায়গা নিয়ে করা মোটামোটি আকারের দুটো রুম সাথে সামনেই ছোট্ট করে ড্রইং রুমরে মতো ঠিক ড্রইং রুম বলা যায় না শুধু অল্প একটু বাড়তি জায়গা যোগ করা। তবে সমস্যা হলো কিচেন ও বাথরুম একটাও সাথে নয়। বাসায় ডুকার দরজার বাম পাশেই কিচেন আর কিচেনের পিছন দিকেই ছোট্ট একটা স্টোরের মতো আছে। ছাদের অন্য পাশে কোনায় বাথরুম। সব কিছু দেখে সাকিব আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না। আমিই ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম এসেছি যখন সব জানতে দোষ কোথায়। ভাড়াটা খুবি কম ৮ হাজার টাকা মাত্র। ঐ সময় ৮ হাজার টাকাও আমার জন্য কম ছিলো না তবে অন্য সবের তুলনায় অনেক কমই ছিলো। এতো কমে পাবো ভাবতেও পারি নি। আমি দুই ঘন্টা সময় নিলাম একটু ভেবে দেখার জন্য। দুই ঘন্টার মাঝেই জানিয়ে দিবো। সাকিবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
.
সাকিব- সময় নেয়ার কি দরকার ছিলো। এই বাসায় কিভাবে থাকবি??? চল নামার দিকে যাই।
.
রেনু- ঐ দিকে গেলে দূর হয়ে যাবে রে। এখান থেকে অনুর কলেজ তনুর স্কুল সবই মোটামোটি কাছে হয়। আর নামায় গেলে অনেক বেশি দূর হয়ে যাবে।
.
সাকিব- তুই কি এই বাসায় উঠবি???
.
আমি সাকিবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
সাকিব- তোর কি মাথা ঠিক আছে?? পাঁচ তলার উপরে সবার জন্য অনেক কষ্ট হয়ে যাবে৷ আর লিফটও নেই।
.
রেনু- আমাদের আগের ফ্ল্যাটটাও নেই সাকিব। প্রথমে কষ্ট হলেও সবাই ঠিক ম্যানেজ করে নিবে। সবারই প্রথম প্রথম সব কিছুতে কষ্ট হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যায়। সবাই নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমরাও মানিয়ে নিবো।
.
সাকিব- তুই সিওর এই বাসাটাই নিবি।
.
রেনু- এর চাইতে কম পাবো না সাকিব। এমনো পাবো না। ভেবে দেখ অন্য সব বাসার এক মাসের ভাড়া দিয়ে আমি এখানে দুই মাসের ভাড়া দিতে পারবো। আর শুধু ভাড়া দিলেই তো হবে না। পাঁচটা মানুষ তো আর না খেয়ে দিন কাটাবে না। বেঁচে থাকার জন্য মাথার উপর ছাদের পাশাপাশি পেটের জন্য খাবারও প্রয়োজন। সেই সাথে অনু তনুর পড়ালেখাও আছে। বাসার ভাড়ায় যদি সব টাকা চলে যায় তাহলে বাকি সব সামলাবো কিভাবে।
.
আমার জীবনের বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে সাকিব আর কিছুই বলতে পারেনি। আমি সাকিবকে নিয়ে আবার গেলাম।
.
দু মাসের ভাড়া এ্যাডভান্স করা লাগবে। অনেক রিকুয়েস্ট করলাম এক মাসের ভাড়া এ্যাডভান্স করার জন্য তাও কাজ হলো না দু মাসের ভাড়াই আগে দিতে হবে। আর উঠে চলতি মাসের ভাড়া দেয়া লাগবে। অর্থাৎ একসাথে ২৪ হাজার টাকা দেয়া লাগবে। তাও ভালো অন্য কোথাও হলে তো অনেক টাকা দেয়া লাগতো। রুম দুটো খালিই ছিলো তাই বললাম আমি সেদিনই উঠতে চাই প্রথমে উনারা আপত্তি করলেন। পরে আমি বাবার কথা বলায় উনারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর আপত্তি করলেন না। আমি সাথে সাথেই তিন মাসের ভাড়া দিয়ে দিলাম। দুই মাসের এ্যাডভান্স আর চলতি মাসের ভাড়াসহ। আর বললাম আমি সেদিন রাতেই জিনিস-পত্র নিয়ে আসবো কারণ পরের দিনই বাবাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিবে৷ তখন বাবাকে দেখবো না জিনিস-পত্র আনবো। উনারা আমাকে বাড়ির মেইন গেটের একটা চাবি দিয়ে দিলেন।
.
আমি সাকিবকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের জন্য বেরিয়ে পরলাম। সাকিবের বাইক ছিলো তাই আর কষ্ট করে হাটা লাগলো না। এমনিতেও সারাদিনে কম হাটিনি। পথে মাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি বাসা নেয়া হয়ে গেছে৷ ফ্ল্যাটে যাচ্ছি সব জিনিস-পত্র আনতে। রাতেই আমি সব গুছিয়ে ফেলবো।
.
আমাদের ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলতেই আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ঐ যে ড্রইং রুমের বড় চেয়ার টায় আমার বাবা বসে আছে। বাবার আলাদা একটা চেয়ার ছিলো। আমরা তিন বোন বলতাম রাজার চেয়ার আর সেই চেয়ারের রাজাটা ছিলো আমার বাবা। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বাবা পায়ের উপর পা তুলে বসে হাসছেন।
.
.
.
চলবে......
#পতিতা
পর্ব-২০
.
.
.
আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বাবা পায়ের উপর পা তুলে বসে হাসছেন।
.
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। বাবার চেয়ারটা ধরে কেঁদেই দিলাম।
.
সাকিব- তুই যদি ভেংগে পরিস বাকি সবাইকে কে সামলাবে বল।
.
রেনু- হুমম
.
আমি উঠে দাড়িয়ে চোখের পানি মুছে বাবা মার রুমে ডুকলাম। আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছিলো। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে আমি কাজ শুরু করলাম। একদম প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নিলাম না। আমাদের তিন বোনের ছোট্ট বেলার কিছু চিহ্ন যা মা ফেলতে চাইতেন না কখনো সেগুলো নিয়ে নিলাম মার জন্য। কিচেনের পিছনের স্টোর টায় রাখা যাবে৷ দুইদিন সময় থাকায় বাকি জিনিস ফ্ল্যাটেই রেখেদিলাম পরের দিন গিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করব৷ রাতের মাঝেই সব কিছুই গুছিয়ে সাকিব আমাকে হসপিটালে দিয়ে বাবাকে দেখে বাসায় চলে গেলো। পরেরদিন সকালেই বাবােক রিলিজ করে দেয়। হসপিটাল থেকে বাবাকে নতুন বাসায় নিয়ে যাই। বাবা কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি আমাকে। মা আগের দিনই তাকে বলে দিয়ে ছিলেন। বাকি সব ফার্নিচার বিক্রি করে মোটামোটি ভালো কিছু টাকা হাতে এসেছিলো। আমি মাকে বলে এক বছরের ভাড়া এক সাথে দিয়ে দিলাম। যেনো ভাড়া নিয়ে কোন সমস্যা না হয়৷ এক বেলা না খেেয় হয়ত থাকতে পারবো৷ কিন্তু মাথার উপর ছাদ না থাকলে কোথায় গিয়ে থাকবো। তার কিছুদিন পরেই আমার ফাইনাল পরীক্ষা। ভাগ্য ভালো ছিলো যে আমার ভার্সিটির সব টাকাই আগে থেকে পরিশোধ করা ছিলো। শুধু অল্প কিছু টাকা দেয়া লাগবে। টিউশনি তো ছিলোই তা দিয়েই হয়ে গিয়েছিলো। ভাবছিলাম পরীক্ষা শেষ করেই আরো কয়টা টিউশনি খুজে নিবো কোন চাকরী না পাওয়া অবদি টিউশনি করে হলেও কিছুটা হাল ধরা যাবে। ভালো মতো পরীক্ষাও দিয়ে দিলাম। পরীক্ষার সময় সাকিব আমার অনেক উপকার করেছিলো। প্রতিদিন নিজের সাথে নিয়ে যেতো আবার দিয়েও যেতো। দিন রাত পড়ে পরীক্ষা দিলাম যেনো রেজাল্টটা অনেক ভালো হয়৷ কারণ আমার যে অনেক ভালো একটা চাকরী লাগবে৷ মানুষের যখন বিপদ আসে তখন হয়ত চারিদিক থেকেই বিপদ আসে। আমার একসাথে দুইটা টিউশনিই চলে গেলো। আমি যেনো অথই সাগরে পরে গেলাম। এর মাঝে এ বাসায় তিন মাস হয়েও গিয়েছে উঠেছি। মার কাছে যা টাকা ছিলো তাও দিন দিন শেষ এর দিকে। দুই মাস পরই অনুর কলেজের ২য় বর্ষে ভর্তি৷ ভালো কলেজে পড়তে ভালো টাকাও খরচ করা লাগে। কোথায় পাবো আমি এতো টাকা একসাথে। ভেবে ছিলাম টিউশনির টাকা গুলো রেখে দিবো অনুর ভর্তির জন্য কিন্তু তা আর হলো না। আমি আবার হন্য হয়ে টিউশনি খোজা শুরু করলাম। এবারের যুদ্ধটা আরো কঠিন এবার শুধু টিউশনি না সাথে একটা চাকরীও যোগাড় করা লাগবে। অনেক ইন্টার ভিউ দিলাম অনেক। কোথাও থেকে পজেটিভ কোন খবর পাচ্ছিলাম না। আমার রেজাল্ট দেখে সবাই বলে ভালো কিন্তু জানাবে বলে আর কেউ জানচ্ছিলো না। কোন ভাবেই কোন চাকরী হচ্ছিলো না। একদিন একটা কোম্পানির রিসিপশনের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। বেতন ভালোই দিবে ১৫ হাজার টাকা সাথে পিক আর লাঞ্চও দিবে। তাই মনে মনে দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেনো চাকরীটা আমার হয়ে যায়। ইন্টারভিউ রুমে ডুকতেই যে লোকটা বসা ছিলো সে কেমনভাবে যেনো দেখছিলো আমাকে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আমার একদম ভালো লাগেনি। তাও আমি কিছু বলি নি। ইন্টারভিউ ভালোই দিলাম। সব প্রশ্নেরই ভালো উত্তর দিয়েছি।
.
-আপনার তো কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
.
কথাটা শুনে আমার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।
.
- না না আপনি মন খারাপ করবে না। আপনি পারবেন জানি৷ আর রেজাল্ট তো আমার হাতে৷ আমি ওকে করে দিলেই হবে। আর আমার আপনাকে যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। আপনি অনেক স্মার্ট। You are Perfect.
.
তার কথা গুলো আমার গায়ে পরা গায়ে পরা লাগছিলো। ইন্টারভিউতে কেই এভাবে কথা বলে জানতাম না।
.
- বাকিটা আপনার হাতে আপনি যদি চাকরী করতে চান তাহলে।
.
রেনু- স্যার আমার এই চাকরীটা খুব প্রয়োজন। আমি ঠিক সব শিখে নিবো। আর আমার বেষ্ট পারফোমেন্সটাই দেয়ার চেষ্টা করব।
.
ভেবেছিলাম লোকটা হয়ত ভালো হবে। আমার কথাটা বুঝবে।
.
- তাহলে তো হয়েই গেলো। আপনি আমার দিকটা দেখেন আমি আপনার দিকটা দেখছি।
.
তার কথায় আমি বেশ অবাক হই।
.
রেনু- আপনার দিক বলতে???
.
- See life is all about give and take. so আপনি আমাকে দেন আমি আপনাকে দিবো।
.
- আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
.
লোকটা কথা বলতে বলতে উঠে এসে আমার সামনে টেবিলে বসলেন। খুব বাজে ভাবে আমার কাধে হাত রাখলেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না লোকটা কি বুঝাতে চাইছেন বা কি চাইছেন আমার কাছে।
.
রেনু- আপনি চাকরীর বিনিময়ে আমার ইজ্জত চাইছেন???
.
- এভাবে বলছো কেনো??? আমি তো তোমার রেইপ করব না। আমরা একসাথে ইনজয় করব বেবি। আর বিনিয়মে তোমার যতো টাকা লাগে আমি তোমাকে দিবো। তখন তোমার ১৫ হাজার টাকার জন্য চাকরী করা লাগবে না। প্রতিরাতের জন্য তুমি ১৫ হাজার টাকা পাবে।
.
আমি লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। ধাক্কায় খেয়ে বদমাইশ লোকটা গিয়ে নিচে পরে যায়। কিছু পরার শব্দে পেয়ে অনেকেই ভিতরে চলে আসে। আমি উঠে গিয়ে লোকটার সামনে দাড়াই।
.
রেনু- তোদের মতো বেজন্মাদের জন্যই মেয়েরা আজো ঘরের বাইরে সুরক্ষিত নয়। আমি মান-সম্মানের সাথে চাকরী করে হালাল উপার্জন করতে এসেছিলাম নিজেকে বিক্রি করতে নয়।
.
রাগে আর কষ্টে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না। ঐ অমানুষটার মুখে থুথু দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
.
রাস্তায় বেরিয়েই কেঁদে দিয়েছিলাম মেয়ে বলে একজন মানুষ নামের অমানুষ আমার মান-সম্মানে হাত দিতে চাইছিলো। আমি কি কিছুই করতে পারবো না আমার পরিবারের জন্য। আল্লাহ কবে আমাদের মুখের দিকে তাকাবেন। কবে আমাদের দুঃখ গুলোকে একটু কমিয়ে দিবে। আমি অনেক কিছু চাই না শুধু আমার পরিবারকে নিয়ে দুবেলা ঠিক মতো খেয়ে পরে ভালো থাকতে চাই আর কিছু না। কান্না করেই আমার চোখ মুখ ফুলে গেছে। অনেকটা পথ হেটে এসেছি। শরীর আর সঙ্গ দিতে পারছিলো না৷ তাও আমি নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। হুট করেই পথে আমার তুবা আপুর সাথে দেখা হয়। সে আমাকে দেখে একপ্রকার দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। আমি তুবা আপুকে পেয়ে আবার কেঁদে দিলাম৷ আমার কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পেরে আপু আমাকে নিজের সাথে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমাকে শান্ত করে খাওয়া দাওয়া করান তারপর আপু আর আমি চা নিয়ে বসি। সেদিন সকালে ঘটে যাও সব কথা আপুকে বললাম। আপু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
.
তুবা- দুনিয়াটা হারামিরে রেনু। তুই পারবি না এদের সাথে। পথে পথে এমন সব জানোয়ার দিয়ে ভরা। ওরা মেয়ে দেখলেই খাবলে খেতে চায়।
.
রেনু- আমার একটা চাকরী খুব দরকার আপু তোমার তো এতো মানুষের সাথে পরিচয় দেখো না আপু কিছু একটা করতে পারো কি না।
.
তুবা- তারা আমার কাছে নিজের প্রয়োজনে আসে রে। প্রয়োজন মিটিয়ে চলে যায়। আমার কথা শুনতে আসে না।
.
আপুর জন্য শুরু থেকেই আমার অনেক কষ্ট হতো। তুবা আপু আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের পাশের বিল্ডিং এ থাকতো। তার সাথে প্রায় আমার ছাদেই দেখা হতো। তাকে প্রায় সময় আমি নানারকম ছেলের সাথে দেখতাম প্রথম প্রথম ভাবতাম তারা হয়ত আপুর বন্ধু কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল তারা আপুর বন্ধু নয়। এক দিন কৌতুহলের বশেই আপুকে জিজ্ঞেস করে ফেলি তখন আপু বলেছিলো। ছোট বেলায় চাচা-চাচীর কাছে মানুষ হয়েছিলো। আপুর বাবা-মা অনেক ছোট থাকতেই মারা যায়। অনেক কষ্টে নিজের পড়া লেখা চালিয়েছেন। মাস্টার্সটাও কমপ্লিট করেছিলেন। কিন্তু কোথাও চাকরী পাননি৷ অবশেষে একটা চাকরী পেয়েও জান কিন্তু জয়েনের কিছুদিন পরেই তুবা আপু আমার মতোই বাজে একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়৷ তবে আমি নিজের সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে পারলেও তুবা আপু পারে নি নিজের সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে সেদিন। তুবা আপুকে সেদিন নিজের সম্মান হারাতে হয়েছিলো মানুষ রূপি কোন অমানুষের হাতে। ঐ ঘটনার পর আপু আর চাকরী করে নি কোথাও। আপু বলেছিলো চারি দিকে সব শিয়াল-শকুন এদেরকে না দিলে এরা জোর করে খাবে। তারপর আপু নিজেই ঐ লাইনে চলে যায়। যখন প্রয়োজন হয় যায় না হয় তো যায় না। আপুর কাধে তো কোন দায়িত্ব ছিলো না। তার জীবন শুধু নিজেকে নিয়েই। আপুর জীবনের কষ্টগুলোর কথা শুনার পর থেকেই তার প্রতি আমার মায়াটা যেনো অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। আমি কখনো তাকে খারাপ ভাবে দেখি নি। সে কি করে সেটা আমার জন্য মূখ্য নয় আমার জন্য সে আমার তুবা আপু। তবে এটাও জানি যেই আপুর আসল সত্যটা শুনবে সেই আপুকে ঘৃণা করবে। জানি না কেনো আমি আপুকে ঘৃণা করতে পারতাম না।
.
আমি সারা বিকেল আপুর সাথে কাটিয়ে উঠে পরলাম বাসায় যাওয়ার জন্য।
.
রেনু- আপু আজ যাই৷ বেশি দেড়ি হয়ে গেলে আবার মা চিন্তা করবে।
.
তুবা- সাবধানে যাস।
.
আপু আমার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে দিলেন। আমি নিষেধ করাতে আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
.
তুবা- রেনু শুন
.
রেনু- হ্যাঁ আপু বলো।
.
তুবা- আশেপাশে যাকেই দেখবি কখনো ভরসা করবি না৷ সব গুলো পশু। একটাও মানুষ না। মানুষ রূপে জানোয়ার সব৷ কখনো জোর করে কাউকে নিতে দিস না।
.
আমি বাসায় চলে এলাম। মাকে কিছুই বলি নি। তুবা আপু ছাড়া কাউকেই বলি নি।
.
কোন ভাবে একটা চাকরী যোগাড় করতে পারছিলাম না৷ ঐ দিকে অনুর ভর্তির সময় ঘনিয়ে আসছিলো৷ আমার মাথা কোন ভাবেই কাজ করছিলো না। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে আমার ল্যাপটপ টা বিক্রি করে দিয়ে অনুকে ভর্তি করালাম। কিন্তু আমার বিপদের তো সেখানেই শেষ না। মার হাতে যা ছিলো সব শেষ৷ তখন কোন ব্যবস্থা করতে না পারলে কয়দিন পর থেকে ঘরে আর চুলা জ্বলবে না। বাবার ঔষধ। অনু তনুর পড়ার খরচ। সারারাত ছাদে পায়চারি করলাম কোনো দিক দেখতে পাচ্ছি না আমি। যেখানেই যাই কেউ আমাকে চাকরী দিতে চায় না উল্টো আমার সম্মান কেড়ে নিতে চায়। আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না। কারো সাথে কথা বলা দরকার। এতো রাতে তমাকে ফোন দেয়া ঠিক হবে না। তমা ওর হাজবেন্ডের সাথে থাকে। তাই তুবা আপুকেই ফোন দিলাম।
.
তুবা- কিরে এতো রাতে তুই??
.
রেনু- আপু রে একটা চাকরী যে আমার খুব দরকার।
.
তুবা- আমি দেখছি কি করা যায়।
.
মাঝে আরো দিন দশেক চলে গেলো কোন লাভ হলো না। আমি আবার একি পরিস্থিতির শিকার হলাম। ভাগ্যে কি আছে জানি না ২য় বারো আমি মান-সম্মান নিয়েই ফিরে এলাম। তবে এবার আর কাঁদি নি৷ শুধু ভেবেছি৷ আমার হয়ত আর মাস্টার্সটা করা হবে না। আর অনার্সের সার্টিফিকেট কেউ হয়ত চাকরীও দিবে না আর যদি কেউ দেয় তাহলে তা দিবে আমার এই শরীরটার জন্য আমার যোগ্যতার জন্য নয়। আমি বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই চুপচাপ কেউ আমাকে কিছু বলছে না। মাকে জিজ্ঞেস করতে সে মুখ চেপে কাঁন্না করছেন। অনুও কিছু বলছে না। শেষে তনুটার মুখ থেকে বের করলাম। ঘরে কিছু নেই তাই সকাল থেকে সবাই না খেয়ে আছে। কথাটা শুনে আমার যেনো কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিলো। আমার ব্যাগে সামান্য কিছু টাকা ছিলো আমি দৌড়ে গিয়ে গলির মোড়ের দোকান থেকে ১ কেজি চাল আর ৪ টা ডিম কিনে নিয়ে এলাম। আমার অনু তনুকে রান্না করে খাওয়ালাম। বাবা মাকে খাওয়ালাম। সবাইকে ঘুম পারিয়ে আমি ছাদে চলে গেলাম। আমার ভেতরটা হাহাকার করছে। আল্লাহ আমাকে এমন দিনের সম্মুখীন করবেন কখনো ভাবতেও পারি নি৷ না পারছি মরে যেতে না পারছি বেঁচে থাকতে। আমি তুবা আপুকে ফোন দিলাম।
.
রেনু- আপু আমি কাজ করব।
.
তুবা- কোনো চাকরী হলো???
.
রেনু- চাকরী হবে না আপু। কেউ দিবে না চাকরী।
.
তুবা- তাহলে কি করবি???
.
রেনু- কেউ জোর করে নিলে তো আর তার বিনিময়ে কিছু পাবো না এর চাইতে আমারটা আমি নিজেই কাজে লাগাই।
.
তুবা- তোর কি মাথা ঠিক আছে??? কি বলছিস তুই এসব??? এটা কোন জীবন নয়। এটা নরক। মৃত্যুর পরেও এর শাস্তি ভোগ করা লাগবে।
.
রেনু- আমি সেটার জন্যও প্রস্তুত আপু। আমার কিছু করার নেই৷ কোন পথ খোলা নেই আমার কাছে। আজ ঘরে চুলা জ্বলে নি। আমার অনু তনু না খেয়ে দিন পার করেছে। আমার অসুস্থ বাবার মুখে ভাত ঝুটে নি সারাদিন। ওদের যদি না খাইয়েই রাখতে হয় তাহলে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি আপু বলো।
.
তুবা- এতো কষ্ট করেছিস আরেকটু দেখ বোন। এভাবে নিজেকে নরকে ঠেলে দিবি??
.
রেনু- অনেক দেখেছি আপু আর সম্ভব না। নিজেকে নরকে ঠেলে দিয়ে যদি মানুষ গুলোকে ভালো রাখতে পারি তাহলে আমার আর কিছুই চাই না।
.
তুবা- তুই তাও ভাব আরো।
.
রেনু- আমার ভাবা শেষ আপু। তুমি ব্যবস্থা করো।
.
তুবা আপুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ফোনটা রেখে দিলাম। আপু দুবার কলও দিলো আমি ধরলাম না। জানতাম আপু আমাকে বুঝাবে তবে এই বুঝ দিয়ে আমার সংসারের চুলা জ্বলবে না। আমার অসুস্থ বাবার ঔষধ আসবে না। আমাদের বোনদের লেখাপড়া হবে না। সারারাত আমি ঘুমাই নি৷ পরের দিন আবার আপুকে ফোন দিলাম।
.
রেনু- কোন ব্যবস্থা হয়েছে???
.
তুবা- তুই সত্যি সত্যি নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস।
.
রেনু- হ্যাঁ।
.
আপু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন আমি শুনতে পেলাম।
.
তুবা- আমি তোকে কিছুক্ষণ পরে ফোন দিচ্ছি।
.
ফোন রাখার ঘন্টা খানেক পরই আপু আমাকে আবার কল দেয়।
.
রেনু- হ্যাঁ বলো।
.
তুবা- আমি তোকে একটা ঠিকানা এসএমএস করে দিচ্ছি ৮ টা নাগাদ সেখানে চলে যাবি৷ একজন আসবে গাড়ি নিয়ে ডিটেইলস লিখে দিচ্ছি। তোকে নিয়ে যাবে সাথে সকালে আবার পৌঁছে দিয়ে যাবে।
.
রেনু- ঠিক আছে।
.
তুবা- তার নাম ...
.
রেনু- নাম জানা লাগবে না আপু। অন্ধকার অন্ধকারই। অন্ধকারের কোন নাম হয় না। কোন ব্যাখ্যা হয় না।
.
তুবা- ঠিক আছে।
.
রেনু- রাখছি।
.
তুবা- শুন
.
রেনু- বলো
.
তুবা- শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যদি তোর মনে হয় তুই এই কাজ করবি না। তাহলে কিছু করা লাগবে না। আমাকে শুধু একটা ফোন দিলেই হবে আমি সব সামলে নিবো। একবার এই পথে হাটলে তুই ছাড়তে চাইলেও এই অন্ধকার জগৎ তোকে ছাড়বে না।
.
রেনু- হুম....
.
মাকে গিয়ে বললা আমার চাকরী হয়ে গেছে। মা শুনে যে কি খুশি৷ কিন্তু আমি জানি আমি জীবনে প্রথম আমার মাকে মিথ্যে বলছি।
.
মা- কিসের চাকরী???
.
রেনু- মনে আছে গত মাসে একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির কল সেন্টারের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ওরা জানাবে বলে আর জানায় নি৷ ওরাই ফোন দিয়ে বলল আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। আমি চাকরীটা পেয়ে গেছি মা।
.
মা- কিন্তু তুই না বললি রাতের শিফট।
.
রেনু- হ্যাঁ, মা তবে আমি একা নই। আরো অনেক মেয়েরাই রাতে কাজ করে।
.
মা- কিন্তু....
.
রেনু- আর কোন কিন্তু বলো না মা অনেক কষ্টে চাকরীটা পেয়েছি। ২০ হাজার টাকা সেলারি দিবে। সাথে টার্গেটের উপর বোনাস হ্যনতেন অনেক কিছু আছে। এর চাইতে ভালো চাকরী এখন আর পাবো না মা।
.
মা আমার কাপালে একটা চুমু দিয়ে দিলেন।
.
তারপর রাতে আপনি এলেন আমাকে নিতে। বাকিটা আপনার জানা৷ সেখান থেকে শুরু হয় আমার অন্ধকার জগৎ এর অন্ধকার গলিতে পথ চলা।
.
আমি এক নাগাড়ে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু বললে ফেললাম। চোখের পানি নাকের পানি কখন যে এক হয়ে গেছে আমি জানিও না। তার সামনে নিজেকে অনেক তুচ্ছ, নঘন্ন মনে হচ্ছে। তার দৃষ্টি আমাতে স্থির। মনে হয় যেনো সে পলকও ফেলছেন না। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ সে আমার চোখের এক ফোঁটা পানিও মাটিতে পরতে দেন নি৷ সে হাত পেতে রয়েছেন আর আমার চোখের পানি তার হাতে গিয়ে জমছে। সে তার ভেজা হাত দিয়ে আমাকে ধরলেন। তার হাত আমার গালে রেখে তার ঠোঁটের স্পর্শে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন। আমি পিছন ফিরে চলে আসতে চার কদম সামনে যেতেই সে দ্রুত গতিতে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন।
.
অয়ন- আজ থেকে তোমার অন্ধকার জগৎটা কেবল আমার বুকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তোমার অন্ধকার জগৎ এর অন্ধকার সম্পর্কে কেউ জানবে না কখনো।
.
আমি পিছন ঘুড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। নক দিয়ে তার শার্ট খামচে ধরে তার বুক ভিজাতে লাগলাম।
.
.
.
চলবে.......

0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।