গল্পঃ পতিতা। পর্ব-২১+২২


গল্পঃ পতিতা

পর্ব-২১+২২


আমি পিছন ঘুড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। নক দিয়ে তার শার্ট খামচে ধরে তার বুক ভিজাতে লাগলাম।
.
সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলেন নিজের বুকে। যেনো কখনো ছাড়বেন না। হারাতেও দিবেন না।
.
আমার দিন স্বাভাবিক হতে থাকে। বাসায় সময় দেয়া আর রাতে তার কাছে আসা। প্রতিদিনই সে আমাকে নিয়ে যায় আবার দিয়ে যায়। বাবা ইদানিং আবার খুব চিন্তা করেন। কিন্তু কাউকে কিছু বলেন না। আমি জানি আমােক নিয়েই বাবার এতো চিন্তা। পড়ােলেখার খুব শখ ছিলো আমার সেটা তো শেষ করতে পারলাম না। এখন বোনদের দিয়েই শখ পুরণ করব।
.
রেনু কি কখনো বুঝবে না আমি কতটা চাই মেয়েটাকে। কেনো এতো পাগল হয়ে যাই আমি ওর জন্য। কি আছে ওর মাঝে??? শুধু কি রাতে ওকে কাছে পাওয়ার জন্যই??? না তা তো হতে পারে না। ওকে আমার জীবনের প্রতি রাতে চাই৷ প্রতিদিনে চাই। প্রতি মুহূর্তে চাই। ও কি বুঝবে না অয়ন ওকে চায়। এভাবে অয়নের মনে মনে রেনুর ভাবনা খেলা করে বেড়ায় সারাদিন। কিন্তু কোন ভাবেই তা অয়ন নিজে প্রকাশ করতে পারছে না।
.
ইদানিং আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। সারাদিন অস্থির লাগে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়ায়ও করতে পারছি না। মাথা ভার হয়ে থাকে।
.
মা- কিরে এখনো শুয়ে আছিস???
.
রেনু- এইতো মা উঠছি।
.
উঠে দাড়াতেই মাথাটা চক্কোর দিয়ে উঠল। আমি পড়ে যেতে নিয়ে মাকে ধরে বসে পরলাম।
.
মা- কিরে কি হলো??
.
রেনু- না কিছু না। হুট করে উঠেছি তো তাই হয়ত মাথাটা একটু ঘুড়ে উঠল।
.
মা- এতো চিন্তা কেনো করিস। নিজের তো একটু খেয়ালও রাখিস না। মাথা তো ঘুড়াবেই৷ খাবারটাও ঠিক মতো খাস না। তুই বস আমি আসছি।
.
আমি নিজের খেয়াল না রাখলেও আমার আশেপাশের মানুষগুলো তো ঠিকি খেয়াল রাখছে। বাসায় মা অনু তনু ঐদিকে টুুনি সাথে ঐ মানুষটাও তো আছে। আমি নিজের যত্ন না করলেও এই মানুষগুলো ঠিকি আমার যত্ন করছে। তাহলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে দেখে উঠে পরলাম। সারাদিন কোন কাজ করি নি তাও এতো ক্লান্ত কেনো লাগে বুঝি না। গাড়ি করেই আসলাম। তাও মনে হয় কত খাটনি করেছি যে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সে এখনো আসে নি। অফিসে নাকি অনেক কাজ। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে শুয়ে পরলাম। শুয়ে পরতেই যেনো আমার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এলো।
.
কারো স্পর্শে আমার চোখ খুলে গেলো। তাকিয়ে দেখি টুনি। আমার কপালে হাত দিয়ে দেখছে আমার জ্বর এসেছে কি না??
.
টুনি- আপনি তো অসময় ঘুমান না তাহলে আজ কি হলো???
.
রেনু- ক্লান্ত লাগছিলো খুব তাই চোখ লেগে গিয়েছিলো।
.
টুনি- তা তো হবেই। নিজের তো আর খেয়াল রাখেন না।
.
রেনু- আমি না রাখলে কি হয়েছে তুমি তো রাখো।
.
টুনি- হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। এখন উঠে পরুন খেতে হবে। নিচে যাওয়া লাগবে না। আমি খাবার উপরেই নিয়ে আসছি।
.
রেনু- আমার না খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।
.
টুনি- কি বললেন???
.
খাবো না বলতেই টুনি হুংকার দিয়ে উঠে। অগত্যা বাধ্য হয়েই খেতে বসতে হলো। এক লোকমা খাবার মুখে দিতেই আমার যেনো ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসছিলো। আমি কিছুতেই গিলতে না পেরে দৌড়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম।
.
টুনি- আপনি ঠিক আছেন তো???
.
রেনু- হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।
.
টুনি- আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।
.
রেনু- না না তার প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই দেখিয়ে নিবো।
.
টুনি- আপনি যে দেখাবেন না তা আমি ভালো করেই জানি।
.
রেনু- না সত্যি দেখাবো।
.
টুনি- সত্যি তো???
.
রেনু- হ্যাঁ সত্যি। এখন তোমার স্যারকে কিছু বলো না প্লিজ।
.
টুনি- ঠিক আছে।
.
আমি বলায় টুনি অয়নকে কিছু বলেনি। আমার নিজেরও ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম ডাক্তার দেখিয়েই নেই। আমি অসুস্থ হয়ে গেলে বাকিদেরকে কে দেখবে। তাই পরের দিনই ঠিক করি একবার আঙ্কেল কে দিয়ে আসি। ফোন দিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে গিয়েও নিলাম না। বাসায় কেউ জানতে পারলে আবার বাবা মা শুধু শুধু চিন্তা করবেন।
.
দুপুরের পরপরই বেরিয়ে গেলাম হসপিটালে যাওয়ার জন্য। পথেই তুবা আপুর ফোন আসে।
.
তুবা- কেমন আছিস??
.
রেনু- আমি তো ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো???
.
তুবা- কেমন ভালো আছিস তা তো আমি ভালোই জানি। তুই কোথায় গাড়ির শব্দ পাচ্ছি।
.
রেনু- একটু হসপিটালে যাচ্ছি।
.
তুবা- আবার হসপিটাল কেনো??? আবার কি...
.
রেনু- না না বাবা ঠিক আছেন। আমি যাচ্ছি আমার জন্য।
.
তুবা- তোর কি হয়েছে???
.
রেনু- তেমন কিছু না। কয়দিন যাবত শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
.
তুবা- কি হয়েছে শুনি।
.
রেনু- আরে তেমন কিছুই না। তুমি চিন্তা করো না।
.
তুবা- যেমনই হোক আমাকে বল।
.
বাধ্য হয়ে তুবা আপনাকে সব বললাম।
.
তুবা- তুই কোথায় আছিস এখন???
.
রেনু- বললামই তো পথে আছি হসপিটাল যাচ্ছি। আঙ্কেলকে দেখিয়ে আসি একবার।
.
তুবা- কোথাও যাওয়া লাগবে না। আমি তোকে একটা ঠিকানা এসএমএস করছি সোজা সেখানে চলে আয়।
.
রেনু- কিন্তু কেনো???
.
তুবা- এতো প্রশ্ন না করে যা বলছি তাই কর। এখনি চলে আয়।
.
আপু হঠ্যাৎ এমন কেনো করল বুঝলাম না। তার দেয়া ঠিকানা মতোই চেলে গেলাম। পৌছে দেখি একটা ক্লিনিক। আমাকে দেখে আপু ভেতর থেকে দৌড়ে আসে।
.
রেনু- তু....
.
তুবা- তোর কি পিরিয়ত হয়েছিলো এই মাসে????
.
রেনু- আমার???
.
তুবা- হয়েছে???
.
রেনু- গত মাসের শুরুতে হয়েছিলো। তারপর এই মাসে তো এখনো....
.
তুবা- তুই আয় আমার সাথে।
.
আপু আমাকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। সে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখেন। আমার নামে সিরিয়াল দেয়া থেকে শুরু করে সবি করে ফেলেছে। ক্লিনিকটা আপুর বাসার পাশেই ছিলো তাই সে আগে এসে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।
.
ভেতরে যেতেই ডাক্তার আমার চেকআপ শুরু করলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্লাড আর ইউরিন সেম্পল দিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজকেই রিপোর্ট দিয়ে দিবে। ৩০ মিনিট এর মতো সময় লাগবে।
.
আপুকে অনেক চিন্তিত লাগছে দেখতে। আপুর চিন্তা করা দেখে আমার নিজেরই ভয় লাগছে। আপু নিজেও কিছু বলছে না৷ আর আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। একজন ডেকে উঠল।
.
- মিসেস রেনু।
.
তুবা- চল রিপোর্ট চলে এসেছে।
.
রেনু- মিসেস বলল যে??
.
তুবা- আমি দিয়েছি৷
.
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হচ্ছে কি। আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম।
.
ডঃ- আপনি পেশেন্টের কি হোন???
.
তুবা- বোন।
.
ডঃ- ভালো হয়েছে একা আসতে দেন নি। এসময় সাথে কেউ না কেউ থাকা ভালো। তবে সব চাইতে ভালো হয় হাজবেন্ড পাশে থাকলে।
.
তুবা- ওর হাজবেন্ডই আমাকে বলল ওকে নিয়ে আসতে। সে ব্যস্ত সময় পাচ্ছে না তাই৷
.
আমি ডঃ আর আপুর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের হাজবেন্ড। কার হাজবেন্ড। কিসের সময়।
.
তুবা- তাহলে ডঃ রিপোর্ট কি পজেটিভ এসেছে।
.
ডঃ জ্বি। আপনার বোন প্রেগন্যান্ট। সে মা হতে চলেছেন।
.
আমি প্রেগন্যান্ট। আপুই ডাক্তারের সাথে কথা বলেন। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে তার বাসায় চলে আসে। আমি প্রেগন্যান্ট এই কথা শুনার পর থেকে একটা কোথাও বলি নি। এখন বুঝতে পারছি আপু কেনো এমন করছিলো। সে আমার কথা শুনেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো। আর আমি তো আন্দাজ করা দূরের কথা ভাবিও নি এমন কিছু হতে পারে। আমার মাথায় ব্যাপারটা ছিলোই না। আমার ভেতরে আরেকটা জান আছে অথচ আমি বুঝতেই পারি নি। অয়ন চৌধুরীর সত্ত্বা আমার ভিতরে। অয়ন চৌধুরীর সন্তান। না আমাদের সন্তান।
.
তুবা- কবে করবি????
.
আপুর কথায় আমি চিন্তা জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসি।
.
রেনু- কিছু বললা??
.
তুবা- কবে করবি???
.
রেনু- কি???
.
তুবা- এবোর্শন
.
রেনু- এবোর্শন????
.
তুবা- হ্যাঁ, বাচ্চাটা ফেলে দিতে হবে।
.
রেনু- ফেলে দিবো??
.
তুবা- তা নয় তো কি??? তুই কি বাচ্চা রাখতে চাস নাকি???
.
রেনু- বাচ্চা...
.
তুবা- শুন এরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের কাছে আসে। সংসার বা বাচ্চা জন্ম দিতে নয়। বাচ্চার কথা শুনলে সে নিজেই সরে যাবে তোর কাছ থেকে। আর নয়ত নিজেই বলবে মেরে ফেলতে।
.
আমি আপুর কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। চুপ করে শুধু শুনেই গেলাম।
.
তুবা- আমি সব ব্যবস্থা করছি। দেড়ি না করাই ভালো। তুই দুই তিন দিনের জন্য আমার বাসায় চলে আয়।
.
রেনু- আমাকে দু দিন সময় দাও আপু।
.
তুবা- সময় দিয়ে কি করবি???
.
রেনু- প্লিজ আপু।
.
তুবা- ঠিক আছে। তুই নিজেকে মানষিকভাবে প্রস্তুত কর আগে৷ তবে বেশি সময় নিস না।
.
আমি বাসায় চলে এলাম। আজ বের হতে ইচ্ছে করছে না একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তাই ফোন করে বলে দিলাম আমাকে নিতে আসতে না।
.
সবাই ঘুমিয়ে পরতেই আমি ছাদে চলে গেলাম। নিজের অজান্তেই আমার হাত আমার পেটে চলে যায়। এখানে একটা ছোট্ট সত্ত্বা আছে। আমার চোখ বেয়ে পানি পরতে শুরু করল। আমি কিভাবে মারবো ওকে। আমার সন্তানকে আমি কিভাবে মারবো??? ওর তো কোন দোষ নেই৷ তাহলে কেনো ও দেখবে না এই দুনিয়ার আলো। অয়ন চৌধুরী কি সত্যি ওকে নিজের নাম দিবে না??? দূর করে দিবে আমাদের কে????
.
.
.
চলবে.....

#পতিতা
পর্ব-২২

.
.
.
অয়ন চৌধুরী কি সত্যি ওকে নিজের নাম দিবে না??? দূর করে দিবে আমাদের কে????
.
অয়ন সেই থেকে বারান্দায় বসে আছে৷ একদম ভালো লাগছে না। একদিন রেনুকে দেখেনি বলে নিজেকে অস্থির লাগছে। মেয়েটাকে ইদানিং চোখে হারায় অয়ন। হারাবেই বা না কেনো। অয়নের ছন্ন ছাড়া জীবনটাকে যে নতুন করে বাঁচার মানে দিয়েছে মেয়েটা৷ রেনু যদি রাজি না হয় তাহলে জোর করে হলেও রেনুকে নিজের কাছে রেখে দিবে অয়ন। রেনু যখন ঘুমের মাঝে বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি হয়ে অয়নের বুকে ডুকে যায় অয়ন পরম যত্ন করে রেনুকে বুকে আগলে নেয়। কতরাত এমন হয়েছে৷ রেনু বলতেও পারবে না অয়ন না ঘুমিয়ে রেনুকে বুকে নিয়ে রেনুর নিষ্পাপ চেহারাটা দেখে কাটিয়ে দিয়েছে৷ এতো ভালোলাগা কাজ করে মেয়েটার মাঝে যে প্রথম প্রথম নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাইলেও এখন আর অয়ন চায় না রেনুর থেকে দূরে থাকতে। এখন নিজের সবটা জুড়ে কেবল রেনুকে চায় অয়ন। প্রথম রাতে যখন অয়ন রেনুকে নিজের করে নেয়। নিজের ভুলের জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলো ভেবে অয়নের অনেক অপরাধবোধ কাজ করে। তাই তো অয়ন চায় নি রেনু এভাবে নিজেকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিক। আর সেজন্যই বার বার রেনুকে আটকেছে। আর রেনুকে বাঁচাতে গিয়ে কখন যে নিজেই রেনুর মায়ায় জড়িয়ে গেছে তা অয়ন নিজেও জানে না৷ প্রথমে খুব চিন্তা হতো অয়ন রেনুকে সুখে রাখতে পারবে তো কিন্তু এখন অয়ন আর তা ভাবে না। এখন অয়নের রেনুকে চাই ই চাই৷ অয়ন জানে রেনু অয়নের কাছেই ভালো থাকবে। একদিন রেনুকে না পেয়ে, না দেখে নিজেকে নিঃস্ব লাগছে অয়নের।
.
.
আবার নিজেকে অথই সাগরে অনুভব করছি৷ অয়ন কি আমার অন্ধকার পৃথিবীটাকে আলোকিত করবে না?? কি করবো আমি এখন??? অয়ন তো এমন নয়। যে মানুষটা আমার মতো একটা মেয়েকে চোখে হারায় সে কি নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে না?? নিজের পরিচয় দিবে না??? আমি মা হয়ে কিভাবে মেনে নিবো আমার সন্তানের মৃত্যু। আর আমার নিজের মা। আমার যে বাবা মা যাদের জন্য আমার এতো কিছু তাদের সামনে গিয়ে কিভাবে দাড়াবো আমি?? কি জবাব দিবো আমি সবাইকে?? সমাজের মানুষের কথার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাবো??? অয়ন যদি অস্বীকার করে আমাকে আমার সন্তানকে। তাহলে সমাজে কিভাবে দাড়াবো আমি ওকে নিয়ে। আমি নিজে মা হতে গিয়ে আমার বাবা মাকে কিভাবে দুঃখে ঠেলে দেই। বাবা দু দু বার স্টক করেছে৷ এই কথা শুনলে যদি বাবা আবার নাহ... যে বাবাকে বাঁচাতে আমি অন্ধকার জগৎ এ নেমেছি সেই বাবাকে আমি নিজের হাতে কিভাবে শেষ করে দেই। আমার বাবাটা এসব শুনলে মরেই যাবে। তাহলে কি মেরে ফেলবো আমি ছোট্ট জানটাকে। আমার মাথা ঘুড়াতে থাকে। আমি কোন কুল কিনাড়া পাচ্ছি না।
.
আগের থেকে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছি। কথা বলতে মন চাইছে না আমার। কিছুই ভালো লাগছে না। গতকাল যাই নি আজ না গেলে অয়ন সন্দেহ করতে পারে। আর যদি বাসায় এসে উঠে তখন। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও রেডি হয়ে বসে আছি৷
.
মা- তোর কি বেশি খারাপ লাগছে??
.
রেনু- না তো মা কেনো???
.
মা- মুখ চোখ কেমন ফুলে গেছে। ভালো না লাগলে দুদিন ছুটি নিয়ে নে।
.
রেনু- না প্রয়োজন নেই মা। আমি বের হলাম না হলে আবার দেরি হয়ে যাবে।
.
মা- সাবধানে যাস।
.
মা দরজায় দাড়িয়ে রইলেন আমি বেরিয়ে গেলাম। মার মন তো তাই হয়ত জানান দিয়ে দিয়েছে যে তার মেয়ের কিছু হয়েছে। প্রতিটা মেয়ের জীবনে মা হতে পারাটা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক বড় একটা খুশির সময়। কিন্তু আমি না পারছি খুশি হতে আর না পারছি কাউকে বলতে। কিভাবে বলবো। আমার সন্তানকে তো কেউ আর দশটা সন্তানের নজরে দেখবে না। ওকে কিভাবে বাঁচাবো আমি। এখন সব অয়নের হাতে। সেই পারবে আমার সন্তানকে এই সমাজে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে৷ সে অয়ন চৌধুরীর সন্তান।
.
আজ অয়ন আসে নি আমাকে নিতে। মনে মনে হাজার কথা ভাবছি কি করবো৷ অয়নকে কিভাবে বলবো। অয়ন কি বলবে। মেনে নিবে নাকি ছুড়ে ফেলে দিবে। আজ বাড়িতে ডুকতেই টুনিকে দেখতে পেলাম না। হয়ত কোন কাজে ব্যস্ত। আমি উপরে উঠে গেলাম।
.
অয়ন- না খালামণি আমি আগেই না করেছি৷ আর কতবার একি কথা বলবে। এ্যাংগেইজমেন্ট হয়েছে তাই বলে যে এখনি বিয়ে করতে হবে তা তো নয়। আর বিয়ের এতো তাড়া থাকলে তখন এ্যাংগেইজমেন্ট না করিয়ে বিয়েই করিয়ে দিতে তাহলে তো এতো নাটক হতো না। না প্লিজ খালামণি তুমি এখন আমাকে বিয়ের কথা বলো না। আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। আমার কিছু দায়িত্ব আছে সেগুলো শেষ না করে আমি কিছুই করব না। আর এসব বলতে আমাকে কল দিও না। রাখছি।
.
কল টা কেটেই অয়ন ফোনটা ছুড়ে মারে।
.
আমি পিছনেই দাড়িয়ে ছিলাম অয়ন দেখে নি আমাকে। অয়নের বলা কথা গুলো শুনে যেনো আমি জমে পাথর হয়ে গিয়েছি। তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। টুনিও তো কথাটা কখনো আমাকে বলে নি। তাহলে কি তুবা আপু ঠিকি বলেছে। তাহলে কি অয়নও বাকি দশ জনের মতোই নিজের প্রয়োজন মিটাতে আমাকে আকড়ে আছে??
.
ফোনটা ছুড়ে মেরেই অয়ন পিছনে ঘুড়তেই আমরা মুখো-মুখি হই। সে কোনো কথা না বলে আমাকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। আমি ব্যগটা পাশে রেখে বিছানায় গিয়ে বসে নিজেকে পিছনে এলিয়ে দিলাম। শুয়ে দুপাশে দু হাত ছড়িয়ে দিলাম। আমার চোখ দুটো দিয়ে শুধু পানি পরছে। তুবা আপুর বলা একটা কথা মনে পরে গেলো। আপু বলেছিলো একবার এই অন্ধকার জগৎ এ পা রাখলে পরে আমি ছাড়তে চাইলেই এই অন্ধকার জগৎ আমাকে ছাড়বে না। আমি একটু একটু করে এই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি।
.
.
অয়ন রাগে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তখন মা অসুস্থ থাকায় মায়ের জন্য বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হতে হয়েছিলো অয়নকে। না হলে সোহার ঐ প্রতারণার পর আর কারো সাথে নিজেকে জড়াবে না ভেবেছিলো অয়ন। অয়নের খালামণির ভাসুরের মেয়ের সাথেই বিয়ে ঠিক হয় অয়নের। তখন অয়নের মা অসুস্থ হওয়ায় কেবল এ্যাংগেইজমেন্টটাই হয়। কিন্তু এখন তারা চাচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাক। অয়ন যদি জানতো অয়নের জীবনে কোন রেনু আসবে তাহলে কখনোই অয়ন ঐ বিয়ে টার জন্য রাজি হতো না। তবু যাই হোক রেনু ছাড়া অন্য কাউকে অয়ন নিজের জীবনে জায়গা দিবে না। তাই আর দেরি করা যাবে না৷ দায়িত্বগুলো সম্পাদন করেই অয়ন রেনুকে নিজের করে নিবে বলেই অয়ন গাড়ি ঘুড়ায় রেনুর কাছে যাবে বলে।
.
বাসায় ফিরে এসেই দেখে রেনু ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। অয়ন পারে না চোখ ফেরাতে আর চায়ও না চোখ ফেরাতে তাই অপলক তাকিয়ে আছে এই মায়াবতীর পাণে। রেনু ঘুমের মাঝে গুটিশুটি হয়ে কিছু খুজতে থাকে। অয়ন বুঝে যায় রেনু অয়নের বুকটা খুজছে তাই অয়ন আর অপেক্ষা না করে রেনুকে যত্ন করে নিজের বুকে নিয়ে নেয়। এভাবেই সারাটা জীবন অয়ন রেনুকে বুকে আগলে রাখতে চায়। অনেক বেশি ভালোবাসতে চায়। রেনুকে নিয়ে নিজের সুন্দর জীবন শুরু করতে চায়। ছোট ছোট হাত পা আসবে যে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াবে আর অয়নকে বাবাই বাবাই বলে পাগল করে ফেলবে। সেটা অয়নের অংশ রেনুর গর্ভে আসবে। সব সুখ দিতে চায় অয়ন রেনুকে। এসব ভাবতেই অয়নের কি পরিমান খুশি লাগছে আর যখন সত্যি রেনু অয়নের বউ হবে ওর সন্তানের মা হবে অয়ন তো খুশিতে পাগলই হয়ে যাবে৷ আর তর সইছে না অয়নের। অয়ন আবার সুন্দর করে বাঁচতে চায় রেনুকে আকড়ে ধরে।
.
যে সুখের জন্য অয়ন দিন গুণছে সে সুখ যে অয়নের ধরা দিয়েছে তা সে জানতেই পারে নি এখনো।
.
সকালে।
.
বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। অয়ন ঘুম থেকে উঠে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমার ঘাড়ে নিজের নাক ঘষলো।মাতাল করা অনুভূতি। আমি যেনো কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। এই সুখগুলো বিধাতা কেনো আজীবনের জন্য আমার কপালে লিখে দেয় নি। কেনো???
.
অয়ন- একটা কথা বলি???
.
রেনু- বলেন।
.
অয়ন- আমি তোমাকে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে চাই।
.
আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
অয়ন- আমি জানি তুমি তোমার পরিবারের জন্য সব কিছু করছো আর সেটা যদি তোমার হয়ে আমি করে দেই। দায়িত্বটা যদি আমি পালন করি।
.
তার মানে ফোনে সে এই দায়িত্বের কথাই বলছিলেন। তাহলে কি সে আমার থেকে মুক্তি চায় সেজন্য এসব করতে চাইছেন। আমার কাছে কি তার প্রয়োজন শেষ। মনে মনে ভাবতে লাগলাম।
.
অয়ন- তোমার সময় লাগলে তুমি সময় নাও। ভেবে আমাকে জানাও। তুমি যেভাবে চাও আমি সব সেভাবেই করব।
.
উনার কথা শেষ করে সে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিলেন। আমি বাসায় চলে এলাম।
.
তার বলা কথাগুলোই বার বার আমার মাথায় খেলছে। সে আমার হয়ে সব করতে চায়। কিন্তু কেনো??? সেটা কি শুধু মাত্র আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য নাকি সে নিজে আমার থেকে মুক্তি চাই নাকি আমার প্রতি করুনা করছেন?? বাচ্চাটার কথা তাকে বলেই বা কি হবে। হয়ত বলবে এবোর্শন করিয়ে নিতে। কিন্তু আমি তা পারবো না। সে তো আরেক জনের বাগদত্তা। তার সুন্দর জীবনে আমার কোন জায়গা নেই। আমার অন্ধকার জীবনের কোন ছায়া আমি তার জীবনে পরতে দেই কিভাবে। একদিকে পরিবার অন্য দিকে আমার সন্তান। কাকে বাদ দিবো আমি???
.
.
অয়ন আজ অনেকদিন পর শপিং করতে গেছে। নিজের জন্য নয় রেনুর জন্য একটা বেনারসি কিনবে। লাল টুকটুকে বেনারসি। যেটা পরে রেনু অয়নের জন্য বউ সাজবে।
.
আমাকে সব সমস্যার সমাধান যলদি করতে হবে। অনেক গুলো জীবন গুছিয়ে দিতে হবে। আর সময় খুব কম।
.
আমি সেই তখন থেকে তাকে দেখছি। সে কাজ করছে আর আমি দেখছি। কেউ কোন কথা বলছি না।
.
অয়ন- কিছু বলবে??
.
আমি চুপ করে রইলাম।
.
সে উঠে এসে আমার পাশে বসলেন। আমি তাও তাকে দেখছি।
.
অয়ন- কোনো কিছু কি তোমাকে বিরক্ত করছে। কিছু বলতে চাও??
.
আমি মাথা ঝাকিয়ে না করলাম। মনে মনে বললাম এ কথা আপনাকে বলে আর কোন লাভ হবে না। আর আমি নিজের জন্য আপনার জীবনে কোন বাধা সৃষ্টি করতে চাই না।
.
অয়ন- কি হলো। বলো কি ভাবছো।
.
রেনু- কিছু না।
.
অয়ন- আমি কিছু বলেছিলাম সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছো????
.
আমি তারদিকে চোখ তুলে তাকালাম।
.
অয়ন- ভেবেছো??
.
রেনু- কি করতে চান আপনি???
.
অয়ন- যা তোমার প্রয়োজন। তুমি তোমার পরিবারের জন্য যা চাও তাই করব।
.
রেনু- পারবেন আপনি??
.
অয়ন- একবার বলেই দেখো না।
.
রেনু- আমি আমার পরিবারের জন্য একটা সুন্দর ঠিকানা চাই৷ যেখানে তারা নিশ্চিন্তে থাকবে। আমার বাবার ঔষধের জন্য যেনো আমার মাকে চিন্তা না করতে হয়। আমার বোনদের লেখাপড়ার জন্য যেনো কোন ল্যাপটপ বিক্রি না করা লাগে। পারবেন???
.
অয়ন আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন৷
.
অয়ন- তুমি ঘুমিয়ে পরো। আমি তোমার স্বপ্নের নগরী তৈরি করে আসছি।
.
বলেই সে চলে যায়।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সে বসে আছে। মিটমিট করে হাসছে। আমি উঠে যেতেই আমাকে একটা বক্স এগিয়ে দিলেন।
.
রেনু- এটা কি??
.
অয়ন- খুলে দেখো।
.
বক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে কিছু পেপার আর চাবি বেরিয়ে এলো। আমি তার দিকে তাকালাম।
.
অয়ন- পড়ে দেখো।
.
আমি পেপার গুলো পড়তে শুরু করলাম। অয়ন আমার নামে ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই ফ্ল্যাটের পেপার আর চাবি৷
.
অয়ন- চাইলে আজই উঠতে পারো। আর তোমার এ্যাকাউন্টটা চেক করে নিয়ো আজ একবার।
.
আমি কিছুই বলতে পারছি না। মানুষটা রাতারাতি আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্ত করে দিলো।
.
মাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে ফ্ল্যাটটাতে উঠলাম। আমার নামে ফ্ল্যাট বলা যাবে না তাই কোম্পানির ফ্ল্যাট বললাম।
.
আজ সকাল থেকে তুবা আপু বার বার ফোন দিচ্ছে আমি কল রিসিভ করছি না৷ এভাবে কতোক্ষণ কল রিসিভ না করে থাকবো তাই বাধ্য হয়েই রিসিভ করলাম।
.
রেনু- হ্যালো আপু।
.
তুবা- তুই কি রে??? দু দিনের কথা বলে কোন খবরই নেই। আর কতো দেরি করবি??? আমার কথা শুন কালই এবোর্শনটা করিয়ে ফেল।
.
.
.
চলবে....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ