চাঁপা কান্না
পর্ব-২
লেখকঃ সাজু
“আমি তোমার স্বামী’র সংসার তোমাকে করতে দিবো না!”
মেসেজটা পড়ার পরে ইশিতার মাথায় কিছু কাজ করছে না। আয়শার আগের নাম্বার ব্লক করা। এটাও হয়তো তার নতুন নাম্বার। তাছাড়া এমন কথা আয়শা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বলবে না। আসলে আয়শা কী চায় তার কাছে? জাহিদের সংসারে ফিরে আসতে চাইছে না তো?
জীবনে এমন কি পাপ করেছিল যার জন্য আজ এমন পরিণতি। বাবা-মা আজ বেঁচে নেই। তারা থাকলে হয়তো তাদের কাছে মন খুলে কষ্ট দুঃখের কথা গুলো বলতো। সমাধান করতে না পারলেও শান্তনা মূলক দু’টা কথা তো বলতে পারতো। বড় বোন তিশাকে যে বলবে তাও পারছে না। তাদের সংসারে এমনিতেই ঝামেলা, তার ওপর নতুন কোনো ঝামেলা তৈরি করতে চায় না। সত্যি নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর।
পাশ থেকে মোবাইল টা হাতে নিয়ে মেসেজ এর নাম্বার টা বের করলো। কল করতে যেও করলো না। কী মনে করে রেখে দিল। পাশ থেকে জিসান তার মায়ের আঁচল টেনে ধরলো। খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
.
— আম্মু তুমি কাঁদো কেন?
ইশিতা কী জবাব দিবে এখন! কী বলা উচিৎ তার! এতটুকু বাচ্চাকে বলবে, তোমার আরও একটা মা ছিল! নাহ্, এর কোনো উত্তর জানা নেই তার।
কিছুক্ষণ সন্তানের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখে একটা একটা শুকনো হাসি এনে বললো,
— আমি কান্না করি না বাবা। চোখে হয়তো ময়লা গিয়েছে। তুমি নাস্তা খাও।
.
আয়শা আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়েছে। সে একটা ছোট খাটো চাকরি করে। আজ অফিস ছুটি। সেই সুযোগে আফনানের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। আফনান আর আয়শা একই অফিসে কাজ করে। আয়শা বেশ সুন্দরী। আর এই সুন্দরীর সৌন্দর্য আফনানের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। কখন নিজের অজান্তে আয়শাকে মনে জায়গা দিয়েছে নিজেও জানে না। প্রতিদিন তারা নিজেদের কথা একজন অপর জনের সাথে ভাগা ভাগি করে নেয়। প্রতিদিন আয়শাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় যায়। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে আয়শা ও আফনান কে নিজের মনে জায়গা করে দেয়। কিন্তু আয়শা কখনও আফনানকে বলেনি তার আগে বিয়ে হয়েছিল। আজ বলবে। আর তাই তো আজ সেই প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে। আফনানের মনের মতো করেই সাজ গোজ করেছে আজ। এই সত্যটা শোনার পরে আফনান হয়তো তার জীবন থেকে সরে যেতে চাইবে, তবুও আজ আয়শা চুপ করে থাকবে না।
.
আফনান আজ তার পছন্দের একটা জায়গায় বসে আছে। সামনে ছোট্ট একটা নদী আর পিছনে বেশ বড় একটা কাশবন। তার যখন মন খারাপ থাকে, তখন মন ভালো করার জন্য এই জায়গা বেছে নেয়। আয়শাকে নিয়ে এর আগেও একদিন এখানে এসেছিল। কিন্তু সময় করে দুজন পাশাপাশি বসা হয়ে ওঠেনি। সেদিন পারেনি মন খুলে কিছু কথা বলতে। উপভোগ করতে পারেনি কিছু রোমান্টিক মুহূর্ত। তাই আজ অধির আগ্রহ নিয়ে বসে আছে, আর তার প্রিয় মানুষ টা আসার অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ কিছু সময় বসে থাকার পরেও আয়শা এখনও আসছে না। কবুতর এর মতো মাথা ঘুরিয়ে এদিক সেদিক দেখছে, কিন্তু আয়শার ছায়া ও দেখতে পারছে না। অনেক বার কল মেসেজ করেছে কিন্তু কোনো সারা পায়নি। দেখতে দেখতে দুই ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো। শত অভিমান নিয়ে চলে যাবার জন্য উঠে দাড়ালো। হঠাৎ মোবাইল টা বেজে উঠলো। হয়তো আয়শা ফোন দিয়েছে তাই অজানা একটা শান্তি বয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, যখন দেখলো অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। কল টা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। একজন লোক খুব দ্রুত বলতে লাগলো,
.
— আপনার এই নাম্বার টা একটা মেয়ের মোবাইল থেকে পেলাম। তার ডায়াল কলেই আপনার নাম্বার টা ছিল। মেয়েটা রোড এক্সিডেন্ট করেছে! আপনি দ্রুত হাসপাতাল চলে আসুন।
আফনানের বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না যে, আয়শা রোড এক্সিডেন্ট করেছে। হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে দ্রুতগতিতে সেখানে চলে গেলো। যাবার সময় আয়শার বাসায় কল করে দুর্ঘটনার কথাটা জানিয়ে দিলো। আয়শাকে যারা হাসপাল নিয়ে আসছে তারা বললো, খুব মারাক্তক ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে। যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের কাছ থেকে জানা গেলো যে, যে ট্রাক টা আয়শাকে ধাক্কা মেরেছে দেখে মনে হলো, ট্রাক ড্রাইভার ইচ্ছে করে এটা করেছে। আফনান বুঝতে পারছে না এটা কি এক্সিডেন্ট নাকি পরিকল্পিত কোনো কিছু। তার জানা মতে আয়শার তেমন কোনো শত্রু নেই যে, এমন কিছু তার সঙ্গে করবে। একজন নার্স এসে বললো প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। আফনান চেষ্টা করলো রক্ত দেবার জন্য, কিন্তু তার গ্রুপের সাথে মিললো না। যারা আয়শাকে হসপিটাল নিয়ে আসছে তাদের ভিতর থেকে একজনের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো। আফনান একটু নিশ্চিন্ত হলো। আয়শার বাবা-মা ছোট ভাই তারা ও চলে আসছে। সবাইকে সামলানো গেলেও আয়শার মা’কে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। তার কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। মাঝে একবার অজ্ঞান ও হয়ে গিয়েছিল। তার এমন অবস্থা দেখে আয়শার ছোট ভাই আসিফের সঙ্গে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এখানে শুধু আফনান এবং আয়শার বাবা রইলেন। আয়শার বাবা শুধু পায়চারি করছেন আর কিছুক্ষণ পরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। আফনান এর কোনো ভাষা জানা নেই তাকে শান্তনা মূলক কিছু বলার। সে ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে। এখনও আয়শা অপারেশন থিয়েটার এ আছে!
.
ইশিতা শত প্রশ্ন বুকের মাঝে চেপে রেখে বারান্দায় বসে আছে। আর জিসান তার পাশে বসে আপন মনে খেলা করছে। ইশিতার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। ইদানীং তার কোনোকিছুর প্রতি কোনো আগ্রহ খেয়াল নেই। এমনকি কোনো কাজ করলেও সাথে সাথে ভুলে যাচ্ছে। জিসানকে একবার গোসল করিয়ে আনার কিছুক্ষণ পর আবার গোসল করাতে নিয়ে যায়। শ্বশুড় এর ডাকে খেয়াল হয় যে, এর আগেও একবার গোসল করানো হয়েছে। এতটা মন ভোলা রোগ জন্মে গিয়েছে তার ভিতর। ঠিক মতো নাওয়া খাওয়া ঘুম কিছু নেই। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। আকাশে অনেক কালো মেঘ জমেছে। বাহিরের উজ্জল আলো কালো মেঘের আঁড়ালে লুকোচুরি করছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। আগে আকাশে কালো মেঘ জমলে ইশিতার মন ভালো লাগতো, কারণ বৃষ্টি হবে এটা ভেবে। কিন্তু আজ তার মন ভালো করতে পারলো না কালো মেঘ। বরং আরও খারাপ হয়ে গেলো। তার বারবার মন চাচ্ছে আগের সেই সোনালী দিন গুলোয় ফিরে যেতে। কিন্তু মানুষের অতীত কখনও তার জীবনে ফিরে আসে না। অতীত অতীত-ই রয়ে যায়। হঠাৎ কেউ একজন ইশিতার ঘাড়ে হাত রাখলো। চমকে উঠলো ইশিতা। পিছনে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো তার শ্বাশুড়ি দাড়িয়ে আছে।
.
— কিছু বলবেন মা?
— সেই কখন থেকে তোমার শ্বশুর বউ’মা বউ’মা বলে ডাকছে। অথচ তোমার কোনো খেয়ালই নেই। কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি তুমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছো!
ইশিতা একটু থতমত হয়ে বললো,
— তেমন কিছু না মা। শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না।
— তোমার শ্বশুর ডাকছে। আমাদের রুমে আসো।
ইশিতা জিসানকে কোলে নিয়ে এক পা দু পা করে তাদের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
.
(চলবে)

 
 
 
 
 
0 মন্তব্যসমূহ
গল্প গুলো কেমন লাগলো, আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।