চাঁপা কান্না। পর্ব-১

চাঁপা কান্না

পর্ব-১

“তুমি আর একটা বিয়ে করে নেও। এবং আমার সন্তান জিসানকে মা’র কাছে রেখে যাও!”
কথাটা শুনে ইশিতা চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় বসে পড়লো। মন চাচ্ছে চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু করতে পারছে না, কারণ পাশের রুমে শ্বশুর-শ্বাশুরি আছেন। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্যদিক ফিরে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। ফোনের দিক তাকিয়ে দেখলো এখনও কল কাটেনি। আবার কানে নিলো। বেশ ভাঙা ভাঙা গলায় জাহিদকে বললো,
.
— তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?
জাহিদ একটু কর্কশ কণ্ঠেই বললো,
— এখানে ভাবার কিছু নেই। ভাবার সময় অনেক আগে পাড় হয়ে গেছে।
ইশিতা এবার আর চেপে রাখতে পারলো না কান্না। শড়ির আঁচলে মুখ গুজে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। আর এই চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে জাহিদ ভুল করলো না।
— তোমার এই ন্যাকামি আমার মোটেও পছন্দ না।
এটা বলেই ফোনের লাইনটা কেটে দিলো জাহিদ। ইশিতা ফোনটা পাশের টেবিলে রেখে দিলো। বিছানা থেকে নেমে রুমের লাইটটা জ্বালালো। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে ওয়ারড্রব এর কাছে গেলো। উপরের ড্রায় থেকে একটা ছবি বের করে, তাতে হাত বুলাতে লাগলো। ছবিটা ইশিতার বাবা-মা’র। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে রোড এক্সিডেন্ট করে দুজনে মারা যান। রেখে যায় দু’টা মেয়ে। ইশিতা এবং তার বড় বোন তিশাকে। তিশা বিয়ে করে আলাদা সংসার করতো। বাবা-মা মারা যাবার পরে বড় বোন তিশার কাছেই থাকতো ইশিতা। পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্যের ঘাড়ে থেকে সেই আশা ভরসা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ইশিতার দুলাভাই কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। ছেলে প্রবাসী। দুবাই থাকে। কিছুদিন হলো দেশে আসছে, আবার চলে যাবে। চলে যাবার আগে শুভ কাজটা করে যেতে চায়। টাকা পয়সা যোগ্যতা সব দিক থেকে পারফেক্ট থাকায়, বড় বোন তিশা রাজি হয়ে যায়। ইশিতার অজান্তে সবকিছু পাকাপাকি করা হয়। ইশিতা তার আশা ভরসা মাটি চাপা দিয়ে জাহিদের সংসারে চলে যায়। এ ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।

বাবা-মা’র ছবিটা বুকে নিয়ে কান্না করছে। হঠাৎ জিসান ঘুমের ভিতর কেঁদে উঠলো। ছবিটা ড্রায়ে রেখে জিসানের কাছে গেলো। জিসানের বয়স তিন বছর। কিন্তু তার আচরণ দেখলে মনে হয় না যে তার বয়স মাত্র তিন বছর। বড্ড চঞ্চল ছেলেটা। বাবা- মা বলতো, ইশিতা যখন ছোট ছিল, তখন সেও নাকি ভীষণ চঞ্চল ছিল। জিসানকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে। আর ফুুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। জিসান অপলক দৃৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ইশিতা এটা খেয়াল করা মাত্র জিসানকে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। মা এবং নিষ্পাপ বাচ্চা, এদের মনের ভিতর চোখের ভিতর সৃষ্টি কর্তা অজানা এক ক্ষমতা দিয়ে দিছেন। ছোট্ট জিসান তার মায়ের দিকে তাঁকিয়ে কী বুঝলো কে জানে। কান্না থামিয়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে রইলো। পাশের রুমে থেকে শ্বশুর কাঁশতে কাঁশতে ইশিতাকে ডাক দিলো। বললো এখনই একটু পানি গরম করে দিতে। এমন গভীর রাতে প্রায় তাকে পানি গরম করে দিতে হয় ঘুম থেকে উঠে। জিসানকে বিছানায় শোয়াই রেখে হাতে একটা খেলনা দিয়ে, রান্নাঘরে চলে গেলো পানি গরম করে আনতে। জিসান খেলা করতে করতে নিজে নিজে ঘুমিয়ে পড়লো। ইশিতা পানি গরম করে দিলো শ্বশুরকে। তারপর ইশিতা অজু করে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ঘুমাতে চলে গেলো। কিন্তু তার চোখে একটুও ঘুম নেই। যেদিন আয়শা নামের মেয়েটার সাথে তার পরিচয় হয়, সেদিন থেকে তার প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটে। আয়শা জাহিদের প্রথম স্ত্রী!

এক সপ্তাহ আগে জিসানের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে মার্কেটে যায় ইশিতা। কেনাকাটা করে বাসায় আসার জন্য রিকশার জন্য দাড়িয়ে থাকে রাস্তার একপাশে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা মেয়ে এসে ইশিতার ঘাড়ে হাত রাখে। ইশিতা বেশ চমকে ওঠে।
— ভয় পেলেন নাকি?
— না ভয় পাইনি। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
— আমার পরিচয় জানতে চান?
— জ্বী বলুন?
— তার আগে বলুন আপনার স্বামী কেমন আছে?
নিজের স্বামীর কথা অচেনা অজানা একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করছে, এটা শুনে ইশিতার বুকের ভিতর মোঁচড় দিয়ে উঠলো। ভ্রু কু্ঁচকে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি কে? আপনার পরিচয়টা আগে বলুন।
মেয়েটা একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে উত্তর দিলো,
— আমার নাম আয়শা। আমি জাহিদের প্রথম স্ত্রী!!
এমন একটা কথা শোনার জন্য ইশিতা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মুখে শুকনো হাসি এনে বললো,
— আপনি মজা করছেন আমার সাথে?
আয়শা মুখটা ভারি করে বললো,
— আপনি কি আমার বেয়াইন হন, যে মজা করবো? আপনি বরং জাহিদের কাছ থেকে শুনে নিবেন। আর আপনার ফোন নাম্বার আমার কাছে। মাঝেমধ্যে আপনাকে বিরক্ত করবো।
এটা বলে আয়শা চলে গেলো। ইশিতা বাক রুদ্ধ হয়ে পিছন থেকে তাঁকিয়ে রইলো। এখান থেকে পা নাড়ানোর শক্তিটুকু সে হারিয়ে ফেলেছে। বিশাল আকাশটা যেন তার বুকে চেপে আছে। জাহিদের সাথে বিয়ে হলো আজ চার বছর। অথচ এত বড় একটা সত্য গোপন ছিল এতদিন! কী করবে কী হবে ভেবে পাচ্ছে না। জাহিদের কাছ থেকে না শোনা পর্যন্ত সে স্থির হতে পারছে না। বাসায় এসেই হাতের ব্যাগ গুলো বিছানায় ছুড়ে ফেললো। পার্স ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে জাহিদকে ফোন করলো।
.
কাঁদো কাঁদো সুরে জিজ্ঞাস করলো,
— আয়শা কে??
— কোন আয়শা? কার কথা বলছো?
— আয়শাকে চিনতে পারোনি?
— পরিচয় না দিলে চিনবো কিভাবে?
— তোমার প্রথম স্ত্রী!
— তোমার কথা আমি ক্লিয়ার বুঝতে পারছি না। আমি এখন কাজে ব্যস্ত, পরে কথা হবে।

কলটা কেটে দিলো জাহিদ। ইশিতার কাছ থেকে হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন আশা করেনি। তাই এড়িয়ে গেলো জাহিদ।
ফোনটা রেখে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো ইশিতা। চোখের গাঢ় কাজল চোখের পানিতে লেপটে গিয়েছে। কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের রুম থেকে শ্বাশুড়ি ডাক দিলেন। ভীষণ কষ্টে কান্না চেপে রেখে শ্বাশুড়ির রুমে চলে এলো। শ্বাশুড়ি কে কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। অথচ তার উচিৎ ছিল এত বড় গোপন সত্যটা প্রকাশ করার। ইদানীং জাহিদ কে ফোনে পাওয়া যায় না। দিনে শতবার কল করে, অথচ জাহিদের সাথে যোগাযোগ নেই। ইশিতা বুঝে নিয়েছে, তাকে ভীষণ ভাবে ঠকানো হয়েছে। অন্তত একটা বার এত বড় গোপন সত্যটা তার কাছে আরও আগে বলা উচিৎ ছিল। তাহলে আজ হয়তো এত কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো না। আয়শা ও প্রায় মাঝেমাঝে ইশিতার নাম্বার এ মেসেজ করে। “কেমন আছেন?, কী করেন?, বাবু কেমন আছে?, আপনার স্বামী কেমন আছে?” এমন বিভিন্ন প্রশ্ন করে মেসেজ দিয়ে। কাটা ঘায়ে নুণ এর ছিটার মতো। ইশিতা কখনও রিপ্লে করে না আয়শাকে। বিরক্ত হয়ে ব্লক করে রেখেছে।
একদিন বিকেলবেলা জাহিদ কে মেসেজ দিয়ে বলে,
“আমি বড় আপার বাড়ি চলে যাচ্ছি। বাবা-মা একা রইলো, ফোন করে তাদের খোঁজ খবর নিও।”
মেসেজটা লেখার পাঁচ মিনিট পরেই জাহিদ কল করলো।
.
— এখন আপা বাড়ি কেন যাবে? বাবা-মা অসুস্থ তুমি জানো না?
খুব রাগি কণ্ঠে ইশিতা বললো,
— আমার কিছু করার নেই। তুমি তোমার পথ দেখো আর আমি আমার পথ খুঁজে নিবো।
— তুমি কী বলতে চাও?
— আমি ঠিকই বলছি। তুমি আয়শাকে ফিরিয়ে আনো এবং তার সাথেই সংসার করো।

জাহিদ কিছু বলার আগেই ইশিতা ফোন রেখে দিলো। পরে জাহিদ অনেক বার কল করেছে কিন্তু ইশিতা রিসিভ করেনি।
আসলে কোনো মেয়ে চায় না তার স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যেতে। ইশিতার ও এমন কোনো মনমানসিকা নেই। তবুও রাগের বশে চলে যাবার কথা বলেছে।
কিন্তু আজ রাতে জাহিদ কল করে নিজে থেকে বললো, “তুমি আর একটা বিয়ে করে নেও। এবং আমার সন্তান জিসানকে মা’র কাছে রেখে যাও!”
.
দূর থেকে ফজরের আজান কানে ভেসে আসছে। সারারাত একটুও ঘুমায়নি ইশিতা। শরীরটা ও ভীষণ খারাপ। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইছে না। তবুও আল্লাহর হুকুম আদায় করার জন্য নরম বিছানা ত্যাগ করে উঠলো। নামাজ কলাম পড়ে সকালের নাস্তা তৈরি করলো। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির বয়স হয়েছে তাদের সম্পূর্ণ দেখাশোনা তাকেই করতে হয়। তাদের রুমে নাস্তা দিয়ে নিজের রুমে আসলো। তার খেতে একটুও মন চাচ্ছে না। জিসানকে খাইয়ে দিচ্ছে আর তার তালে তালে নিজেও দুই এক টুকরো রুটি ছিড়ে মুখে নিচ্ছে। কিন্তু গলা দিয়ে নিচে নামছে না। হঠাৎ তার ফনে একটা মেসেজ আসলো। হাত থেকে খাবার রেখে দিল পাশে। মোবাইল টা হাতে নিয়ে মেসেজ টা অপেন করলো। মেসেজ টা পড়ার পরে ইশিতা পাথড়ে মতো হয়ে গেলো। তার মনে হচ্ছে এখনই সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে,,,
(চলবে)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ