চাঁপা কান্না । পর্ব-৪


চাঁপা কান্না
পর্ব-৪
লেখকঃ সাজু

"থানায় এসে বসে আছে। তার সামনে কালো মোটা একটা মানুষ বসা। বড় বড় সাদা চোখ দিয়ে আফনানকে একবার দেখে নিলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পাশ থেকে আফনানের বন্ধু সাগর পুলিশ অফিসার আফনানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
.
— বন্ধু এই সেই ট্রাক ড্রাইভার হায়দার! যে আয়শাকে ট্রাক চাপা দিতে চেয়েছিল।
আফনান চেয়ার থেকে উঠে হায়দারের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসলো। খুব করুণ ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
— কেন ভাই? কেন আপনি এমন কাজটা করলেন? কী দোষ ছিল মেয়েটার?
পুুলিশ অফিসার সাগর আফনানের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
— এই জানোয়ার টা এত সহজে কিছু বলবে না। তুমি ভেঙে পড়ো না বন্ধু। তুমি হসপিটাল চলে যাও, তোমার এখন আয়শার পাশেপাশে থাকা উচিৎ। আর এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি।
আফনান সাগরের কথা অনুযায়ী সেখান থেকে চলে এলো। চারপাশে শতশত মানুষ যার যার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। সবাই আপন গতিতে চলছে। তাদের মাঝে আফনান আনমনে রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। অনেক নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। প্রতিটা মানুষ মানুষের বাহ্যিক রূপটাই দেখে। কিন্তু মনের ভিতর বিশাল দুঃখ কষ্টের পাহাড়াটা কতটা ভর দিয়ে চেপে আছে, সেটা কেউ দেখে না। এমনকি অনুভব ও করতে পারে না।
এই কয়দিন অনেকটা চাপের মধ্যে ছিল আফনান। নাওয়া খাওয়া ঘুম কিছুই নেই। হেটে হেটে হসপিটালের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাথাটা ঝিম ধরে আসে। দ্রুত পাশের একটা চায়ের দোকানে বেঞ্চ এর উপর বসে যায়। পানি নিয়ে মাথার তালুতে দেয়। দুইটা বিস্কুট আর একটা রং চা খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর আবার রওনা দেয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
.
হসপিটাল পৌছাবার আগে আয়শার ছোট ভাই আসিফ বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। বললো আয়শার জ্ঞান ফিরেছে। সে আফনানের সাথে একটু কথা বলতে চায়। আয়শার জ্ঞান ফিরেছে শুনে ভীষণ খুশি হলো। দৌড়ে একটা খালি রিকশায় উঠে বসলো। রিকশাচালক কে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত হসপিটাল নিয়ে যাবার জন্য। আয়শার সাথে কথা বলার জন্য দেরি সহ্য হচ্ছে না। তার মনে হলো, সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নতুন করে ফিরে পেয়েছে।
রিকশাচালক কে বারবার তাড়া করছে। রিকশাচালক বিরক্ত হয়ে আফনানকে একটা ঝাড়ি মারলো। আফনান কিছু মনে করলো না। বরং রিকশাচালক এর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।
হাসপিটাল একরকম দৌড়ে মনে হলো প্রবেশ করলো। আয়শার পাশে যেয়ে বসলো। মাথায় হাত রাখতেই আয়শা চোখ মেলে তাকালো। আফনানের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে একটা হাসি দিলো। আফনান ও একটা হাসি দিয়ে, আয়শার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
.
— এখন কেমন লাগছে তোমার?
আয়শা উপর নিচ করে মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে বললো,
— ভালো।
আফনান আয়শার হাতের উপর হাত রাখলো। আয়শা খুব শক্ত করে ধরে রইলো। দুই তিন মিনিট পর বললো,
— তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
আফনান আয়শার আরও সামনে এগিয়ে বসে বললো,
— এখন কিছু বলতে হবে না। তুমি রেস্ট করো। সময় আছে পরে বলবার।
— কথাটা তোমাকে বলা খুব জরুরী। আমি এখনই বলতে চাই।
— কিন্তু তুমি তো এখনও অনেক অসুস্থ। পরে বলিও।
আয়শা আফনানের শার্ট টেনে ধরে নিজের মুখের কাছে মাথা এনে ফিসফিস করে বললো,
— আমি অসুস্থ তাই কথাটা এখনই বলতে চাই।
আফনান আর কিছু না ভেবে বললো,
— আচ্ছা বলো?
— আমার মাথাটা ধরে একটু তোমার হাতের উপর নিবা?
আফনান আয়শার মাথা উঁচু করে হাতের উপর নিলো। দুজনের চোখ নাক একদম সামনাসামনি খুব কাছে। আয়শা আফনানের চোখের দিক তাকিয়ে বললো,
— আফনান, আমার আগে একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল! কথাটা আমি তোমাকে আরও আগে বলতাম, কিন্তু বলিনি। কারণ তোমাকে হারিয়ে ফেলবার ভয় হচ্ছিল ভীষণ। যেদিন এক্সিডেন্ট করি সেদিন ই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও আফনান।
আফনান কথাটা শোনার পরে চোখের কোণে পানি জমে গেলো। একহাতে আয়শার মাথা রাখা, আর অন্য হাত দিয়ে চোখের কোণের পানি মোছার চেষ্টা করলো। আর এটা আয়শার চোখ এড়ালো না।
আয়শার দু চোখের পানি বেয়ে পড়ছে নীরবে। হঠাৎ নিজের হাতটা নিয়ে আফনানের গালে ছুঁয়ে দিলো। আর খুব ধীরে ধীরে বললো,
— ভালোবাসি। বড্ড ভালোবাসি তোমাকে আফনান।
কথাটা বলেই ডানপাশে মাথাটা ঝুকে পড়ে গেলো। আফনানের আর বুুঝতে বাকি রইলো না যে, তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। আফনান আয়শার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে খুব শক্ত করে চেপে নিলো। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। পাখিদের গুনগুন করে গান গাওয়া ও বোধহয় বন্ধ হয়ে গেলো। নিমিষেই যেন সময়টা থমকে দাড়িয়ে গেলো। আফনানের মুখে কোনো কথা নেই। দু চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝড়ছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁকা দিয়ে টপ টপ করে সেই পানি আয়শার মাথার পাহাড়ি কালো কেশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
.
পুলিশ অফিসার সাগরের কাছে ট্রাক ড্রাইভার হায়দার সত্য টা স্বীকার করেছে। বলেছে, জাহিদ তাকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে। এবং এই কাজের বিনিময়ে তাকে ত্রিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। জাহিদের বাসার ঠিকানা নিয়ে সেখানে যায়। এবং তার বাবা-মা, ইশিতাকে সবকিছু জানানো হয়। জাহিদের বাবা-মা বিশ্বাস করতে পারছে না, তাদের সন্তান এমন কাজ করেছে। কিন্তু ইশিতা কিছুটা বুঝে নিয়েছে জাহিদ কেন আয়শাকে মারলো। শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে এতদিন কিছু জিজ্ঞেস করেনি এবং জানায়নি। জাহিদ আয়শাকে মেরে ফেলছে এটা জানার পর আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সরাসরি তাদেরকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
.
— আমি এতদিন কিছু বলিনি আপনাদের। সবসময় সবকিছু চুপ করে সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু আজ আর চুপ করে থাকবো না! আপনাদের ছেলের আগে বিয়ে হয়েছিল এটা আমাকে কেন বলেননি? কেন এভাবে ঠকালেন আমাকে??
ইশিতার এমন কথা শুনে তারা সম্পূর্ণ বাক রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তারা এই কথার আগা মাথা কিছু বুঝলেন না। কারণ তারা তো জানে না, জাহিদ তাদের না জানিয়ে অনেক আগে বিয়ে করেছিল। ইশিতা বেশ রাগান্বিত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— কী হলো বলুন? কেন এভাবে আমাকে ঠকালেন?
— মা, আমরা তোমার কথা কিছু বুঝলাম না। আমরা তো জাহিদকে আগে বিয়ে করাইনি।
— তাহলে আয়শা এতদিন আমাকে যা বলেছে সব মিথ্যা? আর আয়শাকে আপনার ছেলে মা্রিয়েছে এটাও মিথ্যা?
— দেখো আমরা এই বিষয়ে কিছু জানি। আগে জাহিদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি। যতই যা হোক, জাহিদ কখনও আমার কাছে মিথ্যে বলবে না।
ইশিতা জিসানকে কোলে নিতে নিতে বললো,
— আপনাদের যা মন চায় তাই করেন। আমি এতদিন অনেক সহ্য করেছি আর না। আমি আপনদের খুনি সন্তান এর সংসার আর করতে পারবো না। ভালো থাকবেন।
এটা বলেই ইশিতা জিসানকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। সকল আশা ভরসা স্বপ্ন মাটি চাপা দিয়ে দিলো। বাকি জীবনটা জিসানকে নিয়েই পাড় করে দিবে।
.
আফনান তার ভালোবাসার মানুষ আয়শাকে হারিয়ে আজ ছন্নছাড়া। যাকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে ভেবেছিল আজ সেই মানুষটাই তাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। শূন্যতার মাঝে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছে। এই জগতে তো পেলো না, অন্য জগতে তাকে আপন করে পাবে সেই আশায় এখনও বেঁচে আছে। এখন প্রতিদিন আফনান তার প্রিয় জায়গায় এসে পুরাতন স্মৃতির সাথে লুকোচুরি করে। নদীর পাড় বিশাল কাশবন কে তার সঙ্গী করে নিয়েছে। এখানেই এসে দেখা করার কথা ছিল আয়শার। কিন্তু নিয়তি তাদের এক হতে দিলো না।
.
দেখতে দেখতে ছয়টা বছর চলে গেলো। ইশিতা নিজের পায়ে দাড়িয়েছে। এখন আর অন্যের ভরসায় তাকে চলতে হয় না। একলা চলা শিখে গেছে। জিসানকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা লোক তাদের সামনে এসে দাড়ালো। সাদা একটা শার্ট পড়া। দেখতে পরিষ্কার হলেও কিছু কিছু জায়গায় ছিদ্র হয়ে আছে। কাঁচা পাঁকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লোকটাকে চিনতে তেমন একটা কষ্ট হলো না। কারণ এই লোকটার সাথেই তো ছয় বছর আগে সংসার করেছিল। জাহিদ ইশিতার সামনে দাড়িয়ে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। ইশিতার ও চোখের কোণে পানি জমেছে। কিন্তু সেটা আড়াল করার চেষ্টা করছে।
ছয়টা বছর জেলখানায় ছিল জাহিদ। তখন একটা বারও তার জন্য মন কাঁদেনি। কিন্তু এত বছর পর আজ তাকে সামনে দেখে বড্ড মায়া লাগছে। জিসানের হাত ছেড়ে দিলো। জাহিদ জিসানকে কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। আর গালে কপালে চুমো দিতে লাগলো। সে আজ তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ইশিতাও হয়তো তাকে ক্ষমা করে দিবে। কিন্তু মনের ভিতর যে গাঢ় দাগ কেটে আছে, সেটা হয়তো কোনোদিন মোছা সম্ভব হবে না। জাহিদ জিসানকে কোলে নিয়ে সামনের দিকে হেটে যাচ্ছে। আর ইশিতা পিছন পিছন হাটছে এবং শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে তিনটা জীবনের নতুন ভালোবাসা!!
.
সমাপ্ত।।


(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ